আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চরমোনাইর পীর ও অন্যান্য ইসলামি নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে : আপনারা আর কত বিচ্ছিন্ন থাকবেন

মুসাফির। হাঁটছি পৃথিবীর পথে পথে, অনিশ্চিত গন্তব্যে। কাগজের নৌকা দিয়ে সাগর পাড়ি দেবার দুরন্ত প্রয়াস।

আর কত বিচ্ছিন্ন থাকবেন আপনারা? আপনাদের সীমাহীন বিচ্ছিন্নতা, ক্রমাগত বিভক্তি, পারস্পরিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার লোভ, পদের লোভ, অর্থ-সম্মানের লোভ- আমাদেরকে চূড়ান্ত ধ্বংসের কালো গহ্বরে নিক্ষেপ করেছে। তবুও আমাদের বিবেক জাগছে না, অন্তরের পর্দা সরছে না।

বিশ্বজনীন মানবজাতি হিসেবে মুসলমানরা আজ বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন রাষ্ট্রে, বিভিন্ন ধর্মে, ধনী-গরীবে, সাদা-কালোয়; বিশ্বজনীন মুসলিম উম্মাহ হিসেবেও আমরা বিচ্ছিন্ন শিয়া-সুন্নী, আহলে হাদীস-মাযহাবী, আহমদী-দেওবন্দী ইত্যাদিতে। এমনকি আমাদের এই বাংলাদেশে জাতীয় মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতেও আমরা শতধা বিভক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-উপদলে, মত ও পথের আড়ালে। বিশেষ করে বাংলাদেশের ধর্মীয় ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিক দল-সংগঠনগুলোতে বিচ্ছিন্নতা-বিভক্তির অনুশীলন চলে মহাসমারোহে; বর্তমানে তা ছড়িয়ে পড়েছে মহামারি আকারে। একাধারে তা এক হাস্যকর ও ভয়ংকর পরিস্থিতি, যা আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে ছাড়বে। আমরা মনে করি বড় দলের ‘ছোটনেতা’ হওয়ারচেয়ে ছোট দলের ‘বড়নেতা’ বা ‘আমীর’ হওয়া অনেক মর্যাদার, বড় পত্রিকার লেখক হওয়ার চেয়ে ছোট পত্রিকার ‘সম্পাদক’ হওয়া শ্রেয়, বড় মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়ার চেয়ে ছোট মাদ্রাসার ‘মুহতামিম’ হতে পারাটা বিরাট অর্জন ইত্যাদি।

চতুর্দিকে বাড়ছে নেতা, বাড়ছে দল, মাদ্রাসা, মিডিয়া এসব। এই অপমানের শেষ কোথায়? কবে হবে আমাদের মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন? আমরা কি অনুভব করব মুসলিম জাতির সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা, এই অধঃপতন? নাকি ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হতেই থাকব? ‘বিচ্ছিন্নতা’ মানুষের এক সহজাত প্রবৃত্তি। প্রশংসাপ্রিয়তা, খ্যাতি, অজ্ঞতা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি থেকে এর উৎপত্তি। কোরআন-হাদীসে বিচ্ছিন্নতা থেকে বেঁচে থাকার, আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরার, এক ইমামের (নেতার) অনুসরণ করার যথেষ্ঠ তাকিদ এসেছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কাজ ও মতকে সবচেয়ে সঠিক ও শ্রেষ্ঠতর মনে করি।

অপরের সমালোচনায় মুখে খই ফোটে। অথচ কি আশ্চর্য! নিজের মত ও কাজের স্ববিরোধিতা, কপটতা, স্বার্থবাদিতা ও শয়তানী ধরা পড়ে না। এসব নিয়ে আমরা গভীর চিন্তা ও আত্মসমালোচনা করি না, এমনকি অন্যে কি সমালোচনা করল সেটাও গ্রহণ বা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি না। করব কিভাবে, আমাদের তো অনেক কাজ। চিন্তা করার সময় কোথায়? অথচ হাদীস শরীফে এসেছে, সামান্য সময় চিন্তা করা ৭০ বছর নফল এবাদতের চেয়েও উত্তম।

আমরা সারাদেশে ওয়াজ করে বেড়াই, অথচ যারা সমাজ-রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার সময় নেই। জনসাধারণের ময়দানে একে-ওকে নাস্তিক-মুরতাদ ঘোষনা করি, ইসলাম ‘প্রতিষ্ঠিত’ করে ফেলি। অথচ শিক্ষিত, চিন্তাশীল ও বুদ্ধিজীবীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে পারি না। তাদের যুক্তি, লেখনী ও থিওরির ভদ্রজনোচিত পাল্টা দিতে পারি না। হজরত মোহাম্মদ (সাঃ) কি সারাদেশ বা বিশ্ব সফর করেছিলেন? তিনি কি শুধুই জনসাধারণের ময়দানে দাওয়াত পেশ করেছিলেন? তাঁর সময়ে কি বাঘা বাঘা কাফের মুশরেকরা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেননি? আমি মনে করি আমাদের এতসব ইসলামের ‘খেদমত’, মসজিদে মসজিদে ‘জিকির’, জেলায় জেলায় ‘সমাবেশ’ এখন একটু কমিয়ে দিয়ে পারস্পরিক মতবিনিময় ও আলোচনায় গুরুত্ব দেয়া দরকার, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত দূর করা উচিত।

পাশাপাশি আমাদের কেন্দ্রীয় ইসলামী নেতৃবৃন্দ জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বগণের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি আলোচনায় বসা দরকার। কারণ অনেকেই আমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আর মাঠ-পর্যায়ের কাজগুলো ভক্ত-মুরিদগণের মাধ্যমেই চলতে পারে। জনসাধারণের ময়দানে ‘খেদমতে’র নামে এগুলোতে ‘আমীরের’ চরকির মতো ঘুরা না বিচক্ষণতার পরিচয়, না রাজনৈতিক কৌশল, আর না ‘হেকমত’। এই ‘ইসলাম’ সম্পর্কে জনমনে ও যুবসমাজের মধ্যে প্রচণ্ডরকম ভীতি কাজ করে।

এর কারণ নিশ্চয় আলেমগণের পক্ষ থেকে ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝতে ও উপস্থাপন করতে না পারা। আর আমরা যারা ‘ইসলাম’ ‘ইসলাম’ ও ‘খেলাফত’ ‘খেলাফত’ করছি, আমাদের নিজেদের মধ্যে সর্বপ্রথম এর প্রয়োগ করতে হবে। দেশ ও বিশ্ব-মানবতার সামনে ইসলামের শান্তি-শৃঙ্খলার ‘ক্ষুদ্র মডেল’ উপস্থাপন করতে হবে। মানুষ এক অনন্য সৃষ্টি। বিপরীতধর্মী শক্তির আধার।

একাধারে সর্বাপেক্ষা দুর্বল ও সর্বাপেক্ষা সবল। অনন্ত সম্ভাবনাময়, যদি বিচ্ছিন্ন না হয়ে ‘জমাতবন্দী’ থাকে। এ সূত্রে আমরা আমাদের হাতের দশটি আঙ্গুলের দিকে নজর করতে পারি। কিভাবে প্রতিটি আঙ্গুল সমন্বিত ও স্বতন্ত্র। পাঁচটি আঙ্গুল ভালগুলো গ্রহণ করে এবং পাঁচটি আঙ্গুল খারাপগুলো বর্জন করে।

একজন মানুষের মাথা যেমন প্রয়োজন, সর্বনিম্ন অঙ্গ পা-ও তেমনি প্রয়োজন। অন্যান্য সৃষ্টিতে ও মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ঐক্যবদ্ধতার প্রচুর নিদর্শন আছে। এগুলো যেন আমরা খোঁজ করি। আমি নির্দলীয়ভাবে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আলেমগণের প্রতি আহ্বান করতে চাই, আপনারা ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে, বিশেষ কোনো দল ও গোষ্ঠীর নাম না নিয়ে একমাত্র কোরআন ও সুন্নার ভিত্তিতে আমাদের জন্য নতুন একটি ধর্মীয় প্লাটটফরম তৈরী করুন। আমাদের আল্লাহ্ এক, ধর্ম এক, কুরআন এক, হাদীস এক, নবী এক।

কিন্তু আমরা কেন এত বিচ্ছিন্ন, হাজারো ভাগে বিভক্ত?


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।