আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদায় অভিনয়ের যুবরাজ

শীতের রাতে গতকাল বৃষ্টি ছিল। একি বৃষ্টি, নাকি আকাশের কান্না! তিন দিনের উৎকণ্ঠা। অতঃপর গতকাল রাত ৮টা বেজে ১৮ মিনিট। নিভে গেল একটি প্রাণ। তিনি খালেদ খান।

অভিনয়ের যুবরাজ খালেদ খান। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। তাই খালেদ খানের সঙ্গে 'মৃত্যু' শব্দটি বেমানান। তিনি বিদায় নিয়েছেন। রেখে গেছেন নিজের কীর্তি-কর্ম।

বিটিভির স্বর্ণযুগ। সন্ধ্যার পরেই যে যুগে ফাঁকা হয়ে যেত রাস্তা। সবার চোখ স্থির থাকত টিভি পর্দায়। তখন একটি নাটক প্রচার হতো- 'রূপনগর'। নাটকের নায়ক শামীম, ভিলেন হেলাল।

দর্শক চিরকাল নায়কের পক্ষেই বাজি ধরতেন। কিন্তু এ নাটকে চিরকালের হিসাব উল্টে গিয়েছিল। দর্শক বাজি ধরেছিলেন ভিলেন হেলালের পক্ষে। কারণ হেলাল চরিত্রের অভিনেতা খালেদ খান নিজের অভিনয় সুধা দর্শককে পান করিয়ে সব করতালি নিজের পকেটে জমা করেছিলেন। তাইতো মানুষ এখনো তার সেই সংলাপ, 'ছি.. ছি.. ছি.., তুমি এত খারাপ!' শুনে বলে দিতে পারে সব।

খালেদ খান ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। তার দাদিই আদর করে নাম রেখেছিলেন যুবরাজ। সত্যিই তিনি যুবরাজ। অভিনয়ের যুবরাজ। টাঙ্গাইলের ছেলে খালেদ খান ঢাকা কলেজে পড়ার সময় কবিতা আবৃত্তি, বিতর্ক এমন কি গান গেয়ে জিতেছিলেন অনেক আসর।

তাই কলেজে পড়ার সময় থেকেই তার জীবনটা হয়ে ওঠে সংস্কৃতিময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনাকালীন অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির রশীদ হায়দারের কাছ থেকে টিভি নাটকে কাজ করার অফার পান। রশীদ হায়দারের কাছ থেকে টিভি নাটকে অফার পেয়ে একদিন বিটিভিতে গিয়ে হাজির হলেন। ভীষণ সেজেগুঁজে খালেদ খান সেদিন বিটিভিতে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু বিটিভির তালিকাভুক্ত না হওয়ায় তিনি সেখানে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন না।

এরপর আবারও একদিন রশীদ হায়দার খালেদ খানকে মঞ্চে অভিনয় করবে কি না জানতে চাইলেন। এবার খালেদ খান একটু পিছু হটবার চেষ্টা করলে রশীদ হায়দার যেহেতু নিজেই নাগরিকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন ছিলেন তাই এবার খালেদ খান বেশ আশ্বস্ত হয়েই বেইলি রোডে আতাউর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সেদিন মঞ্চস্থ 'দেওয়ান গাজীর কিস্সা' নাটক দেখে খালেদ খানকে ছোটবেলার সেই মুগ্ধতার রোগে পেয়ে বসে। খালেদ খান ভাবতে লাগলেন, 'মাত্র কয়েকজন লোক মঞ্চটাকে কীভাবে মাতিয়ে রেখেছেন। তাকেও এমন হতে হবে'।

এমন ভাবনাই যেন পেয়ে বসে তাকে। পরের দিনই রিহার্সেলে অংশগ্রহণ করলেন খালেদ খান। দেখা হলো আতাউর রহমানের সঙ্গে। তিনিও সেদিন বলেছিলেন, 'তোমাকে দিয়ে আর যাই হোক, নাটক করা হবে না। ' খালেদ খান সেদিন কেঁদেই ফেলেছিলেন।

কিন্তু তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। রশীদ হায়দারের উৎসাহে তিনি শুরু করলেন। শুরুতে অভিনয় করলেন 'শাহজাহান' নাটকে। এরপর তো মঞ্চে শুরু হলো খালেদ খানের ইতিহাস। একে একে অভিনয় করলেন আর মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে রেখেছিলেন দর্শকদের দেওয়ান গাজীর কিস্সা, নূরুল দীনের সারা জীবন, গ্যালিলিও, রক্তকরবী, দর্পণ নাটকে অভিনয় করে।

মঞ্চে যতদিন খালেদ খান ছিলেন ততদিন যেন মঞ্চও মেতেছিল। একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লেও নির্দেশনা থেকে তিনি দূরে সরে যাননি। মনের ভেতর শক্তি নিয়ে তিনি মঞ্চে নির্দেশনা দিতেন। তার সর্বশেষ নির্দেশিত মঞ্চনাটক হচ্ছে সুবচনের 'রূপবতী'। তার নির্দেশিত আলোচিত মঞ্চনাটকগুলো হচ্ছে- মুক্তধারা, পুতুল খেলা, কালসন্ধ্যায়, মাস্টার বিল্ডার, ক্ষুধিত পাষাণ ইত্যাদি।

খালেদ খান অভিনীত প্রথম টিভি নাটক ছিল 'সিঁড়িঘর'। তার অভিনীত আলোচিত টিভি নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে সকাল সন্ধ্যা, এইসব দিনরাত্রি, মোহর আলী, সময় অসময়, কোন কাননের ফুল, রূপনগর, লোহার চুড়ি ইত্যাদি। 'রূপনগর' নাটকে তার মুখের 'ছি..ছি..ছি..তুমি এত খারাপ..' সংলাপটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অবশ্য এ জন্য তিনি এ নাটকের রচয়িতা ইমদাদুল হক মিলনকেই সবসময় কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসছেন। মঞ্চে 'রক্তকরবী' নাটকের বিষু পাগলা চরিত্রটিতে অভিনয়ে করে সবচেয়ে বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

খালেদ খান বিশেষ সম্মাননার মধ্যে অর্জন করেছিলেন মোহাম্মদ জাকারিয়া পদক, নূরুন্নাহার স্মৃতি পদক, সিজেএফবি অ্যাওয়ার্ড, ইমপ্রেস অন্যদিন অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি। জীবনের শেষ সময়ে এসে শারীরিক কিছুটা সমস্যার কারণে অভিনয়ের যুবরাজের আর অভিনয়ে ফেরা হয়ে ওঠেনি।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.