বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...
ভারতের দিল্লী বিধানসভায় শেষ পর্যন্ত নবাগত আম আদমি পার্টি রাজ্য সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। আর মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন আম আদমি পার্টি (আপ)-র নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গত ৪ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি ২৮ টি আসনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে দিল্লীতে আত্মপ্রকাশ করেছিল। ৩১ টি আসনে বিজয়ী হয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ছিল শীর্ষে। আর মাত্র ৮ টি আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস হয়েছিল তৃতীয়।
৭০ আসনের দিল্লী বিধানসভায় বাকী তিনটি আসনে জিতেছিল জনতা দল (ইউনাইটেড) ১টি, শিরোমনি আকালি দল ১টি ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ১টি।
দিল্লীতে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা নবগঠিত আম আদমি পার্টি কিভাবে ভারতের রাজধানীতে এমন একটি অবিশ্বাস্য চমক সৃষ্টি করলো, তা আলোচনার আগে চলুন দেখে আসি কিভাবে আম আদমি পার্টির উত্থান ঘটলো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অনশন প্রতিবাদ করে গোটা ভারতে একটি নতুন চমক তৈরি করেন আন্না হাজারে। জন লোকপাল আন্দোলন গোটা ভারতীয় রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রনে একটি নতুন ধারার অহিংস আন্দোলন। যার নের্তৃত্ব দেন অন্না হজারে।
কে এই অন্না হজারে?
অন্না হজারে (জন্ম: ১৫ জানুয়ারি, ১৯৪০) হলেন একজন ভারতীয় সমাজ সংস্কারক। তাঁর প্রকৃত নাম কিসান বাবুরাও হজারে। তিনি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আহমেদনগর জেলার রালেগন সিদ্ধি গ্রামের উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য গোটা ভারতেই বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় রালেগন সিদ্ধি গ্রামটি একটি আদর্শ গ্রামে পরিণত হয়। এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে।
২০১১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে সরকারি কার্যালয়ে দুর্নীতি রোধে জন লোকপাল বিল আইনরূপে কার্যকর করার দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য অন্না হজারে আমরণ অনশনে বসেন।
২০১১ সালে অন্না হজারে ভারতীয় সংসদে একটি অধিক শক্তিশালী দুর্নীতি-বিরোধী লোকপাল বিল পাস করানোর জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ও কর্ণাটকের লোকায়ুক্ত এন সন্তোষ হেগড়ে, সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ এবং ইন্ডিয়া অ্যাগেইনস্ট কোরাপশন আন্দোলনের অন্যান্য সদস্যরা মিলে একটি বিকল্প বিলের খসড়া প্রস্তুত করেন। এই বিলটির নাম দেওয়া হয় জন লোকপাল বিল। পুরানা লোকপাল বিলের থেকে এই বিলে লোকপালদের অধিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়।
২০১১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে অন্না হজারে দিল্লির যন্তর মন্তরে আমরণ অনশন শুরু করেন। তাঁর দাবি হল সরকার ও নাগরিক সমাজের যৌথ প্রতিনিধিত্বে একটি যৌথ কমিটি গঠন করে অধিক ক্ষমতাশালী ও অধিকতর স্বাধীন লোকপাল ও লোকায়ুক্ত নিয়োগের জন্য নতুন বিলের খসড়া প্রস্তুত করতে হবে। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর দাবি খারিজ করে দেন। পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমগুলির মাধ্যমে অন্না হজারের আন্দোলনের কথা গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাঁকে সমর্থন জানাতে শুরু করেন। তখন ১৫০ জন ব্যক্তি তাঁর সঙ্গে অনশনে যোগ দেন।
ওই সময় অন্না হজারে বলেছিলেন, কোনো রাজনীতিবিদকে তিনি আন্দোলনে অংশ নিতে দেবেন না। তখন মেধা পাটেকর, অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও প্রাক্তন আইপিএস অফিসার কিরণ বেদি, অন্না হজারের অনশন ও দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসেন। টুইটার ও ফেসবুকের মতো ইন্টারনেট সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমেও তখন অনেকে তাঁকে সমর্থন জানান। সেই সঙ্গে ধর্মগুরু স্বামী রামদেব, স্বামী অগ্নিবেশ ও প্রাক্তন ক্রিকেটার কপিল দেব, শেখর কাপুর, সিদ্ধার্থ নারায়ণ, অনুপম খের, মধুর ভাণ্ডারকর, প্রীতিশ নন্দী, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, প্রকাশ রাজ, আমির খান প্রমুখ বলিউড ব্যক্তিত্বরাও টুইটারের মাধ্যমে তাঁকে সমর্থন জানান। আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে শরদ পাওয়ার মন্ত্রিগোষ্ঠীর দুর্নীতি পর্যালোচনা প্যানেল থেকে পদত্যাগ করেন।
জন লোকপাল বিল আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করতে অন্না হজারের নের্তৃত্ব তখন একটি টিম অন্না গঠিত হয়। এক পর্যায়ে টিম অন্না'র অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে অন্না হজারের একটি বিষয়ে মত পার্থক্য তৈরি হয়। অন্না হজারের বক্তব্য হল, রাজনীতিতে অংশ না নিয়ে এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। আর অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন যে, রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেই দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠন করতে ভূমিকা রাখতে হবে। সেই মত পার্থক্যের সূত্র ধরেই ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নের্তৃত্বে আম আদমি পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লীতে যাত্রা শুরু করে।
কে এই অরবিন্দ কেজরিওয়াল?
১৯৬৮ সালের ১৬ আগস্ট ভারতের হরিয়ানায় অরবিন্দ কেজরিওয়াল জন্মগ্রহন করেন। খরগপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে তিনি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক পাশ করেন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি টাটা স্টিল ফার্মে চাকরি করেন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেবার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর কিছুদিনের জন্য তিনি কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশনে কাটান।
ওই সময় তিনি মাদার তেরেসা'র সান্নিধ্য লাভ করেন এবং মাদার তেরেসার দর্শনে দারুণভাবে উদ্ভুদ্ধ হন।
১৯৯৫ সালে তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করেন। তারপর তিনি একজন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরি শুরু করেন। ২০০০ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য দুই বছরের জন্য চাকরি থেকে ছুটি নেন। ২০০৩ সালে তিনি আবার উচ্চ শিক্ষা শেষে চাকরিতে যোগদান করেন।
২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দিল্লী'র ইনকাম ট্যাক্সের যুগ্ম কমিশনার পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিয়ে করেন সুনীতা দেবীকে। যিনি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের একজন ব্যাচমেট ও ভারতের ইনকাম ট্যাক্স বিভাগে কর্মরত। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন ভ্যাজিটারিয়ান।
জন লোকপাল বিলের তিনি একজন অন্যতম ড্রাফটম্যান। এছাড়া গ্রাসরুট লেভেলে রাইট টু ইনফরমেশান আন্দোলনের তিনি একজন অন্যতম রূপকার। অন্না হজারের সঙ্গে মত পার্থক্যের কারণে আম আদমি পার্টি গঠনের মাধ্যমে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। ৪ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত দিল্লী বিধানসভার নির্বাচনে তার নের্তৃত্ব আম আদমি পার্টি ২৮ টি আসনে জয়লাভ করে দিল্লী বিধানসভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
৮ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে দিল্লী বিধানসভার ফলাফল ঘোষিত হয়।
তখন থেকেই অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তার নবগঠিত আম আদমি পার্টি দিল্লী'র আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। ৮ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের একটি সংক্ষিপ্ত টাইম লাইন এরকম:
৮ ডিসেম্বর: দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসনে আম আদমি পার্টি (আপ) বিজয়ী।
৯ ডিসেম্বর: আম আদমি পার্টি (আপ) সিদ্ধান্ত নেয় যে, দিল্লী'র জনতা তাদের বিরোধী আসনে বসার রায় দিয়েছে। তাই সরকার গঠন করার দাবি তারা করবে না।
১০ ডিসেম্বর: দিল্লী বিধানসভায় সরকার গঠন করার জন্য কংগ্রেস আম আদমি পার্টিকে সমর্থণ করার ইঙ্গিত দেয়।
তখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল পাল্টা বলেছিলেন, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে বরং একক বৃহত্তম দল হিসেবে বিজেপি সরকার গঠন করুক।
১১ ডিসেম্বর: কংগ্রেস বা বিজেপির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করার পরিবর্তে নতুন করে ভোটে যেতে আপত্তি নেই আম আদমি পার্টি'র।
১২ ডিসেম্বর: একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে বিজেপি'র হর্ষ বর্ধনকে ডেকে পাঠালেন দিল্লির লেফ্টেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং। জবাবে বিজেপি জানিয়ে দেয় যে, জোড়াতালি দিয়ে তারা সরকার গঠনে আগ্রহী নয়। তারপর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল আম আদমি পার্টি (আপ)-কে ডেকে পাঠালে তারা ১৪ ডিসেম্বর লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরের সঙ্গে দেখা করবে বলে জানিয়ে দেয়।
১৪ ডিসেম্বর: লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরের কাছে আম আদমি পার্টি (আপ) সিদ্ধান্ত নিতে ১০ দিন সময় চায়। একই সঙ্গে লোকপাল বিল, রাজধানীতে জল ও বিদ্যুৎ সঙ্কট-সহ ১৮ দফা দাবি নিয়ে কংগ্রেস ও বিজেপির অবস্থান কি তা সুস্পষ্টভাবে জানতে চায় আম আদমি পার্টি। সেই অবস্থান জনগণকে জানানোর পর জনমত নিয়ে ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানায় আম আদমি পার্টি।
১৫ ডিসেম্বর: ত্রিশঙ্কু দিল্লিতে জট খোলার কোনও আশা না দেখে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দেকে রিপোর্ট দিলেন লেফ্টেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং। সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সুপারিশও করেন নাজিব জং।
১৭ ডিসেম্বর: এসএমএস, ওয়েবসাইট ও জনসভার মাধ্যমে দিল্লির জনতার মতামত নেওয়ার ঘোষণা দেয় আম আদমি পার্টি। কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনে তাঁদের কী মত, জানতে ২৫ লক্ষ ভোটারকে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে সভা করে দিল্লিবাসীর মত জানতে চায় আম আদমি পার্টি।
২০ ডিসেম্বর: কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় যে, কেজরিওয়াল মানুষের সমস্যা সমাধানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা এখন পূরণ করুন। আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আম আদমি পার্টি জবাবে জানায়, গনভোটের রায় পাওয়া না গেলেও আম আদমি পার্টি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়েই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
২১ ডিসেম্বর: অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন যে, দিল্লিতে সরকার গঠন করে কংগ্রেস বা বিজেপি'র চেয়ে আম আদমি পার্টি বেশি ভাল কাজ করে দেখাবে।
২২ ডিসেম্বর: আম আদমি পার্টি জানায় যে, আগামিকাল দলের রাজনীতি বিষয়ক কমিটি দিল্লিবাসীর রায় সমীক্ষা করে দেখে চূড়াম্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
২৩ ডিসেম্বর: আম আদমি পার্টি (আপ) ঘোষণা দেয় যে, দিল্লিতে আম আদমি পার্টি সরকার গঠন করবে।
ইতোমধ্যে ২৮ জন বিধানসভার বিজয়ী আম আদমি পার্টি'র সাংসদ অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে তাদের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন করেছেন। নাজিম জং-এর সঙ্গে দেখা করে অরবিন্দ কেজরিওয়াল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লেফ্টেন্যান্ট গভর্নরকে চিঠি লিখে সরকার গঠনের কথা জানানো হয়েছে।
লেফ্টেন্যান্ট গভর্নর ওই চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে নির্দেশ এলেই শপথ গ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হবে। আর প্রাথমিক আলোচনায় ঠিক হয়েছে যে, শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান হবে রামলীলা ময়দানেই। অর্থ্যাৎ দিল্লী রাজ্যসভায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন আম আদমি পার্টি'র নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গো অ্যাহেড ইয়াংম্যান।
নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতি পালনই হোক আপনার একমাত্র কর্মসূচি। জয়তু অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।