আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প প্রচেষ্টা-২৪

নির্বিকার-নির্বোধ

আমার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে সঞ্জয় খুব কামেল ছেলে। পড়াশোনাতে নিম্ন-মাঝারী সঞ্জয়কে কর্মজীবনে সফল ব্যবসায়ী বলা যায়। এই বলাটা তার আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে বলা হল, তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বিচার করে নয়। সঞ্জয় কীভাবে কীভাবে যেন টাকা বানাতে পারে। ঠিক কীভাবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না।

তবে ওর যে যথেষ্ট টাকা আছে, এবং সেটা উত্তরোত্তর বাড়ছে সেটা বোঝা যায়। আবার সঞ্জয় কোন অবৈধ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত একথা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। সঞ্জয় রাজনীতি করে না, তবে সব দলের রাজনীতিবিদদের সাথে তার সুসম্পর্ক আছে।
সঞ্জয়ের একটা গুণ হচ্ছে সব পর্যায়ের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, তা সে সমবয়স্ক হোক বা বয়সে ছোট/বড় হোক। আমাদের প্রায় সবার ক্ষেত্রে স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব মাধ্যমিক পাশ করার পর বেশিদিন টেকেনি।

কিন্তু সঞ্জয় আমাদের স্কুলজীবনের বন্ধুদের সাথে এখনো যোগাযোগ অটুট রেখেছে। এতগুলো বছরেও এটা সে কীভাবে চালিয়ে যাচ্ছে সেটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। ফলে বন্ধুদের মধ্যে সঞ্জয় বেশ জনপ্রিয়। ইদানিংকালে সে পুরনো বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কিছু দিন পর পর পার্টি দেয়া শুরু করেছে। ফলে সঞ্জয় এখন আমাদের জীবন্ত সোশাল নেটওয়ার্ক।


ভাবতে পারেন এই ফেসবুক-টুইটারের যুগে এমন জীবন্ত সোশাল নেটওয়ার্ক-এর দরকারটা কী? লক্ষ করলে দেখতে পাবেন একটা বড় অংশ মানুষ সোশাল নেটওয়ার্ক-এ সাধারণত কোন সাড়া-শব্দ করেন না। ফলে কোন কিছু শেয়ার করলে সেটা তাদের নজরে পড়লো কিনা বা তাদের সর্বশেষ অবস্থা কী সেটা সোশাল নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে জানার কোন উপায় থাকে না। আমি একজনকে গত পাঁচ বছর ধরে লক্ষ করে দেখেছি যে, সে বছরে একবার ফেসবুকে ঢোকে — সেটা তার জন্মদিনের দুই/তিন দিন পরে। সেদিন সে ঢুকে “আমাকে যারা যারা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ” এই কথাটা ল্যাটিন হরফে লিখে স্ট্যাটাস দেয়। ব্যাস! পরবর্তী এক বছরের জন্য সে নিরব হয়ে যায়।

কয়জন লোকে আর ফোনবুক হাতড়ে হাতড়ে বন্ধুদের কল করে! আর কনফারেন্স কলের ব্যাপারটা অফিসের বাইরেও যে হতে পারে এই ভাবনাই সচরাচর লোকের মাথায় খেলে না।
সঞ্জয় ফোন করে জানালো স্কুলজীবনের বন্ধু মিরাজ দেশে বেড়াতে এসেছে, এবং সে সম্ভাব্য সবার সাথে দেখা করতে চায়। শীতকাল এলেই উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপপ্রবাসীদের অনেকে দেশ থেকে বেড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন; আর গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়া-নিউজীল্যান্ড প্রবাসীরা। তাই শীতকাল ঘনিয়ে এলে আমরা একজন অন্যকে জিজ্ঞেস করি, “এবার কয়টা শীতের পাখী আসছে রে”? মিরাজ দেশ ছেড়েছে উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই। তারপর ওকে আর কখনো দেখিনি।

এর মাঝে কখনো দেশে এসেছিল কিনা জানি না।
বিজ্ঞাপনের চমকে ভুলে প্রায় দুই যুগ আগে মিরাজ সাইপ্রাসে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল। দেশে তো বটেই ভারতেও তখন শিক্ষাবাণিজ্য ব্যাপারটা বোধকরি এতোটা জাঁকিয়ে বসেনি। তাই মিরাজ, তন্ময়, মিঠুর মতো আমাদের খানবিশেক বন্ধু সাইপ্রাসে পড়তে গিয়েছিল। সাইপ্রাসে পড়তে যাবার জন্য সেখানকার শিক্ষার মান কেমন সেটা যাচাইয়ের যেমন উপায় ছিল না, তেমন সেটা নিয়ে কারো ভাবনাও ছিল না।

ইউরোপীয় একটা দেশ যেটা পর্যটকদের স্বর্গ, সেটা সবার মাথায় ছিল। অর্থাৎ সাইপ্রাস মানে হোটেল-রেস্তোরাঁ-বারে কাজ করে অঢেল পয়সা কামানো আর ভূমধ্যসাগরীয় সুন্দরীদের সহজ সান্নিধ্য লাভ এমন অবাস্তব কল্পনা মাথায় খেলেছে বেশি। শিক্ষাবণিকেরাও পাবলিক পরীক্ষায় অপেক্ষাকৃত খারাপ ফলাফলকরাদেরকে ঠারে ঠোরে অমন ইঙ্গিতই দিতো। অতটুকু দেশ সাইপ্রাস যে উত্তর-দক্ষিণ দুইভাগে বিভক্ত সেটা আমাদের জানা ছিলো না। কেউ কেউ না জেনে উত্তরের তুর্কী সাইপ্রাসে গিয়ে ব্যাপক ধরা খেয়েছিল।

তবু যারা সাইপ্রাসে গিয়েছিল তাদের সবার আশা ছিল কম্পিউটার সায়েন্স বা হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিগ্রী আর এক কাঁড়ি টাকা নিয়ে তারা দেশে ফিরবে, অথবা ওখানে থানা গাড়বে, অথবা ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে বা উত্তর আমেরিকায় স্থায়ী হবে।
সাইপ্রাসে যাবার পর শিক্ষাবাণিজ্যের চেহারাটা যখন তাদের কাছে স্পষ্ট হলো ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। যাদের যথেষ্ট সামর্থ্য ছিল তাদের কেউ কেউ দেশে ফিরে এসেছিল, আর কেউ কেউ ওখান থেকে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল। মিরাজ অমন সামর্থ্যবানদের দলে পড়ে না। তাই সে সমূদ্র পাড়ি দিয়ে প্রথমে গ্রীস, এবং আরো পরে বহু চেষ্টাচরিত্র করে ইউএসএ-তে পৌঁছাতে পেরেছিল।

মিরাজের পড়াশোনা আর শেষ করা হয়নি, আমেরিকাতে বৈধ হতেও অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল। সেটাও সম্ভব হয়েছে একটা হিস্পানী মেয়ে ওকে ভালোবেসেছিল বলে। এই সব গল্প আমার অন্যদের কাছ থেকে শোনা। মিরাজের মুখোমুখি হয়ে এই ইতিহাসের সত্যতা যাচাইয়ের কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু এতগুলো বছর পর মিরাজ কেমন আছে সেটা দেখতে চাই।


সাইপ্রাসের শিক্ষা বাণিজ্যটা বেশি দিন টেকেনি। ফাঁকা কলসি আর কয়দিন বাজে! তার জায়গাটা দ্রুত দখল করে নিয়েছিল সদ্য লাল থেকে নীল হওয়া রুশ ফেডারেশন, ইউক্রেন, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া বা গণচীনে পড়তে যাবার কথা তখন কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। অবশ্য পূর্ব ইউরোপে যাবার জোয়ারও দ্রুত স্তিমিত হয়ে আসে। মাঝখান থেকে শিক্ষাবণিকেরা কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়।

তাদের কেউ কেউ কলম্বাসের মতো নতুন নতুন দেশ খুঁজে বার করতে থাকে আর কেউ কেউ পরের পাঁচ বছরের মধ্যে দেশেই উচ্চ শিক্ষার নামে সার্টিফিকেট বেচার ব্যবসা খুলে ফেলে।
আগেই বলেছি, সঞ্জয় কামেল ছেলে, আর অনেক দিন ধরে নানা রকম পার্টি আয়োজন করে এই ব্যাপারে সে যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। তাই সে পরামর্শ দিলো পার্টি হবে দুই দিন। প্রথম দিনের পার্টিতে শুধু পুরনো বন্ধুরা থাকবে। সেখানে খাবারদাবার কী থাকবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সেখানে প্রচুর কঠিন পাণীয় থাকবে। দ্বিতীয় দিনের পার্টিতে নতুন-পুরনো সব বন্ধু থাকবে — বউবাচ্চাসমেত। সেখানে প্রচুর খাবারদাবার থাকবে, তবে কঠিন পাণীয় থাকবে না। বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের জন্য এক জন ম্যাজিশিয়ান থাকবেন, আর সবাই যেন ‘বোর ফিল’ না করেন এজন্য চটুল বাংলা-হিন্দী গান গাইতে পারেন এমন একজন গায়িকাকেও রাখা হবে। তিনি দরজা-জানালাওয়ালা টাইট জামাকাপড় পরে নেচে নেচে গান গাইবেন আর সবাইকে তার সাথে নাচতে ডাকবেন।

বলাই বাহুল্য, উভয় পার্টির যাবতীয় খরচ সঞ্জয়ের। দ্বিতীয় পার্টিটার ব্যাপারে আমার আগ্রহ কম। কারণ, এমন পার্টিতে কারো সাথে কথা বলার বা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেবার উপায় থাকে না। শেষ পর্যন্ত ভরপেট ‘রিচ’ খাবারদাবার আর মাথাধরানো গান শুনে ফিরতে হয়। তবে প্রথম পার্টিটার ব্যাপারে আমার আশা ছিল — পুরনো বন্ধুদের সাথে অনেক দিন পর একটা ভালো আড্ডা হবে হয়তো।


প্রথম পার্টির দিনে সঞ্জয়ের বাসায় পৌঁছে দেখি আমাদের সুবিধার্থে সঞ্জয় তার বউবাচ্চাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। একে একে সবাই আসতে থাকে। আমি মিরাজকে দেখি। দেখে অবাক হইনা। বয়সের কারণে আর বেশ কয়েক বছর উত্তর আমেরিকাতে থাকলে যতটুকু পরিবর্তন হয় মিরাজের শরীর-স্বাস্থ্য-চেহারায় অতটুকু পরিবর্তনই হয়েছে।

এবং আরো বহু বারের মতো দুঃখের সাথে লক্ষ করি একটা বড় অংশ প্রবাসীর মতো মিরাজের ভাবনার বাংলাদেশ আর তার মানুষজন এখনো দুই যুগ আগে বসবাস করে। মিরাজ আমাদের ব্যস্ততা নিয়ে তার ক্ষোভ ও অভিমান প্রকাশ করে। সে বুঝতে চায় না আমরা কেউ আর হাইস্কুলে পড়ুয়া বালক নই, চল্লিশোর্ধ্ব-সংসারী-কর্মজীবি মানুষ। সে আশা করে, সাধারণ কর্মদিবসেও আমরা কেউ না কেউ তাকে সময় দেবো, সে আমাদের কারো অফিসে বসে আড্ডা দেবে, ডাক দিলেই দশ-বারো জন এক জায়গায় জড়ো হয়ে যাবে। সে এমনতর আবদার করে যা সে নিজে কোনদিন আমেরিকাতে আমাদের কারো জন্য করতে পারবে না।

শহরের অসহনীয় যানজট বা কাজ সারতে অপ্রত্যাশিত সব বাধার কথা সে বুঝতে চায় না। সে বুঝতে চায় না নিত্যদিনকার কাজগুলো নূন্যতম পর্যায়ে সারতেও আমাদের পনের-ষোল ঘন্টা চলে যায়। আরো অনেকে চলে আসায় মিরাজের সাথে বেশিক্ষণ কথা চলে না। মিরাজ আমাকে ছেড়ে ছোট ছোট ভাগে ভাগ হওয়া নানা গ্রুপে একটু একটু করে সময় দেবার চেষ্টা করে।
একটা গ্লাস হাতে নিয়ে আমি লম্বা হল ঘরটার এক কোনায় চলে যাই।

আমি আগ্রহের সাথে সবাইকে দেখতে থাকি। প্রিয়মুখগুলোকে হাতে ছুঁয়ে দেখার দূরত্বে দেখলে মন ভরে যায়। ঐতো কিঞ্চিত তোত্‌লা মুশতাক তার স্টুপিড জোক বলার চেষ্টা করছে, আর তাকে থামিয়ে দিয়ে মিনহাজ তার অশ্লীল গল্পের ভাণ্ডার খোলার চেষ্টা করছে। আরেক কোনে প্রীতম জনপ্রিয় অভিনেতা আর নেতাদের মিমিক্রি করছে, আর নন্দন আকাশ ফাটিয়ে হেসে উঠছে। আমি ভালো একটা আড্ডার সম্ভাবনায় হাতের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে একটা সোফায় আরাম করে বসি।

কিন্তু শীঘ্রই আমার আশা হতাশায় পরিণত হতে থাকে। আর দশটা পার্টি বা অন্য প্রকার অনুষ্ঠানের মতো এখানেও অভিন্ন কিছু খণ্ডদৃশ্য লক্ষ করি।
এক গ্রুপে মোবাইল কানে একজন ‘ব্যস্ত ব্যবসায়ী’ ধরনের আচরণ করছেন,
- আরে ওরে কও কাইল সকালেই য্যান মঙ্গোলিয়ার উলান বাটোর পোর্ট থেইকা আমার তুলাভরা জাহাজটা ছাইড়া দেয়। আর পরশু য্যান বেলারুশের মিনস্ক পোর্ট থেইকা আমার উলভরা জাহাজটা ছাইড়া দেয়।
পাশের জনের দিকে ফিরে,
- বুঝলা, এই বার তুলা আর উল দুইটাই আনতাসি।

গরম-ঠান্ডা দুই রকমের কাপড়ই বানামু। গার্মেন্টসগুলা থেইকা যা অডার পাইসি তাতে আমার টেক্সটাইলে মিশিন ডাবল করন লাগবো। আমি ১০০ কুটি ইনভেস্ট করসি, আরো ২০০ কুটির লেইগা এক্স-ওয়াই ব্যাংকে এপ্লাই করসি। আমার বউয়ের মামাতো বইনের চাচাতো দেওরের শ্বশুরের ফুফাতো ভাইয়ের শালা ঐ ব্যাংকের এমডি। এইবার লোনটা পাইয়াই যামু!
আরেক গ্রুপে গম্ভীর মুখে একজন জ্ঞানী তার পাশের জনকে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন,
- বুঝলে, রাঢ়িখালের আমগাছের নিচে জগদীশ বোস যখন ভাবছিলেন তখন তার মাথায় উপর থেকে একটা পাকা আম পড়ে।

আমটা নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়ে যান। যেহেতু তখন গাছপালা নিয়ে তার ভাবার বিশেষ সময় ছিল না, তাই আম পড়ার বিষয়টা ভাবার জন্য তিনি তার ভাস্তে সত্যেন বোসকে আমটা দিয়ে দেন। সত্যেন বোস আমটা হাতে নিয়ে যা ভাবলেন সেটা তড়িঘড়ি করে লিখে আইনস্টাইনকে পাঠালেন। আইনস্টাইন নিজে রিলেটিভিটি নিয়ে ব্যস্ত থাকার তার ছাত্র রিচার্ড ফাইনম্যানকে বিষয়টার দায়িত্ব দেন। কিন্তু ফাইনম্যান তখন তার ল্যাটিন বান্ধবী নিয়ে কার্নিভ্যাল দেখতে ব্রাজিল চলে গেলে কাজটা পিটার হিগসের হাতে পড়ে।

হিগস তখন সত্যেন বোসের সাথে মিলে বের করেন যে, আমের আঁটি লম্বা হবার কারণে আমটা অমন ভাবে পড়েছিল। এই রকম লম্বা কণাকেই হিগস বোসন কণা বলে। তাহলে বোঝো অবস্থা। জিনিস ছিল জগদীশ বোসের, আর হয়ে গেলো পিটার হিগসের!
পাশের অ-জ্ঞানী জন কাঁচুমাচু মুখে বলেন,
- আমি তো জানতাম নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল।
- আরে ধুর্‌! ঐসব ব্রিটিশদের বানোয়াট গল্প।

দেশ তো তখন স্বাধীন ছিলো না, তাই জগদীশ বোসের অবদানকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। এখন সেসব চলবে না। আমরা সারা দুনিয়ায় আওয়াজ তুলে জগদীশ বোস আর সত্যেন বোস দুইজনের জন্যই নোবেল প্রাইজ আদায় করে ছাড়বো।
একটা জটলার মধ্যে একজন হঠাৎ হঠাৎ ফোনে ধমকে উঠছেন,
- পিংকির মা! তোমারে না কইলাম ইছা মাছ দারা দিয়া আর পুটি মাছ উশি দিয়া রানতে! আরে এইটা কি কচুর লতি পাইছো যে যা খুশি তা দিয়াই রান্দন যাইবো!
- রিংকি অহনো বাইত ফিরে নাই! কও কী! শিয়ান মাইয়া রাইত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে ঘুইরা বেড়ায় আর তুমি অরে কিসু কও না! অক্ষনেই অরে মুবাইলে ধরো। জিগাও কই গেসে।


- আরে আমি অহনেই আইয়া পড়মু। রাইতে কিছু খামু না। একটা পান বানায়া রাইখো পাতি জর্দা দিয়া।
পার্টি থেকে একটু তফাতে একজন মোবাইলে ফিসফিস করে কার সাথে যেন একটানা আলাপ করে যাচ্ছে। কথা বোঝা যায় না, কিন্তু তার মুখে কখনো ব্রীড়া, কখনো তৃপ্তি, কখনো কপট রাগ, কখনো অভিমানের রঙ খেলা করে যায়।

পার্টির কোন কর্মকাণ্ড তাকে স্পর্শ করে না।
একজন বেশ কিছুক্ষণ জোর গলায় অভিযোগ করলো পার্টিতে বসার অ্যারেঞ্জমেন্ট ঠিক হয়নি। সে তার জিনিসপত্র নিয়ে ঠিকমতো বসতে পারছে না। তার হাতে একটা ল্যাপটপ, একটা ট্যাব, তিনটা স্মার্টফোন। কিছুক্ষণ পর সে তিনটা চেয়ার আর একটা টেবিল মিলিয়ে গুছিয়ে বসে ব্যস্তসমস্ত হয়ে কাজ শুরু করে।

তার কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় ল্যাপটপে ফেসবুক খোলা, ট্যাবে solitaire-জাতীয় কোন একটা কার্ডগেম খোলা, একটা স্মার্টফোনে কারো সাথে চ্যাট চলছে। বাকি দুটো ফোনের একটাতে বোধকরি চার্জ নেই, আর আরেকটা হেডফোন লাগানো — সম্ভবত গান শোনার জন্য।
আরেকজন একটু পর পর ‘অমুক গেলো কই’ বা ‘তমুক আসে নাই’ জাতীয় হাঁক দিয়ে তাদেরকে খোঁজ করছে। যখন অমুক আর তমুককে পাওয়া গেলো তখন সে তাদের সাথে কথা না বলে সমুক আর নমুককে খোঁজ করা শুরু করলো। রাম তার মুখোমুখি বসে থাকলেও রামের মাথা উঁচিয়ে দূরে অন্য গ্রুপে গল্প করা শ্যামকে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে।


এই দৃশ্যগুলো কমবেশি সর্বত্র আমি দেখতে পাই – এমন আড্ডায়, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে, গুরুগম্ভীর আলোচনা অনুষ্ঠানে, গানের অনুষ্ঠানে, নাটকে এমনকি কুলখানি-চেহলাম-শ্রাদ্ধেও। ভাগ্যিস এখানে কোন স্টেজ নেই। স্টেজ থাকলে তার সামনে সারিবাঁধা লম্বানলওয়ালা ডিজিটাল ক্যামেরাধারীদের পশ্চাতদেশ দেখতে হতো, স্টেজের কিছু আর চোখে পড়তো না।
এসব দেখে আমার রইস হাসানের কথা মনে পড়ে গেলো। রইস হাসানের সাথে পরিচয় কর্মসূত্রে।

কোন দরকার থাকলেও পারতপক্ষে আমি রইস হাসানের অফিসে যাই না। অফিসে তার টেবিলে দুইটা ল্যাপটপ, একটা ট্যাব, তিনটা স্মার্টফোন, দুইটা ল্যান্ডফোন, টেবিলের পাশে একটা বিরাট মনিটরের ডেস্কটপ কম্পিউটার রাখা আছে। তার সবগুলো সচল আছে, সেই সাথে রইস হাসানও। তার মুখ চলছে, হাত চলছে। সবার সাথে কথা বলছে, কিন্তু কোন কথাই শেষ হচ্ছে না, বাক্যগুলো অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে।

এভাবে তার কোন কাজই ঠিকভাবে, যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। তাকে কেউ ফোন করে সহসা পায় না। কারণ, তার ফোন হয় ব্যস্ত থাকে নয়তো সে ফোন ধরার সময় পায় না। তাই আমি প্রয়োজন হলে তাকে ‘মিস্‌ কল’ দেই। কিছুক্ষণ পরে সে কলব্যাক করে।

সেই কলও যে একটানা চলে তা নয়। এক ফোন কানে লাগিয়ে দ্বিতীয়টা লাউডস্পীকারে দিয়ে তার কথা চলতে থাকে। সুতরাং কোন কথা কাকে বললো সেটা অনেক সময় বোঝা মুশকিল হয়ে যায়। আপনার যদি রইস হাসানের সাথে জরুরী আলাপ থাকে তাহলে তৃতীয় কাউকে অনুরোধ করুন, তিনি যেন রইস হাসানকে তার বাসায় বা অফিসে আমন্ত্রণ জানান। কারণ, রইস হাসান যখন আমন্ত্রণকারীর বাসায় বা অফিসে যাবে তখন ঐ ব্যক্তি তার কাছে সবচে’ অমনোযোগের জন।

তখন আপনি নিশ্চিন্তে রইস হাসানের সাথে দরকারী কথাগুলো সেরে নিতে পারবেন।
তলস্তয়ের ‘তিনটি প্রশ্ন’ আমরা সবাই জানি কিন্তু ‘বর্তমান কাল’ আর ‘সামনে উপস্থিত ব্যক্তি’কে যথাযথ গুরুত্ব দেবার কথা ভাবি না। এসব ভাবনা ভেবে মন খারাপ করার চাইতে আমি বরং মিরাজকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। দেখি মিরাজ যে সার্কেলটাতে গল্প করছে সেখানে সবাই বেশ চার্জে আছে। দেশের মানুষ বাঙ্গালীত্বের চর্চায়, মুসলমানত্বের চর্চায় কতোটা পিছিয়ে পড়ছে সেটা নিয়ে মিরাজ তার হতাশা ব্যক্ত করছে।

তার কথা, আমেরিকাতে তারা ইসলাম আর বাঙ্গালীত্বের চর্চায় যতোটা সজাগ-সক্রিয় আমরা তার এক-আধলাও না। সে দেশে আসার পর এতগুলো দাওয়াত খেয়েছে, এতগুলো পার্টিতে গেছে কিন্তু কোথাও একটা ‘হালাকা’ হতে দেখেনি। এ কেমন নৈতিক অবক্ষয়! মিরাজের বিস্ময় কাটেনা। ধাতস্থ হতে সে হুইস্কির গ্লাসে লম্বা চুমুক দেয়। বাকিরা দেখি মিরাজের কথায় বেশ একমত।


স্বাভাবিক ভাবে আলোচনায় দেশজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা অবরোধ, শাহ্‌বাগ-হেফাজত-বাসে আগুন-যুদ্ধাপরাধের বিচার এইসব গরমাগরম টপিক চলে আসে। লক্ষ করি ছাত্রজীবনে কেউ কেউ মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের সাথে এক-আধটু জড়িত থাকলেও এখন প্রায় সবাই হেফাজতের ১৩-দফার সমর্থক, যুদ্ধাপরাধের বিচার স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ-আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না এমনটাতে বিশ্বাসী। আমাদের কেউ অথবা আমাদের কারো আপনজন বাসে দেয়া আগুনে পোড়েনি, আমাদের কারো গাড়ি ভাঙচুরের মধ্যে পড়েনি। সুতরাং কোথায় কতজন পুড়ে মরলো বা কয়টা গাড়ি ভাঙা পড়লো সেটা নিয়ে আমাদের কারো মাথাব্যথা নেই। বরং বাজারে ডিলাক্স হুইস্কি’র আকাল চলছে বলে কেউ কেউ বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করলো।


সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় পার্টি রুমকে স্বাভাবিক রাখতে কোনায় কোনায় মোমবাতি জ্বালানো আছে। তবু আমার কেমন যেন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। হঠাৎ ঝলকে ঝলকে কাঠকয়লাপোড়া ধোঁয়া আর মাংসপোড়ানো গন্ধে ঘর ভরে ওঠে। আমার মনে হতে থাকে এটা কোন পার্টি রুম না, আগুনলাগা বাস। আমার চারপাশে এরা মুশতাক-মিনহাজ-প্রীতম-নন্দন নয়, বরং মনির হোসেন-আসাদ গাজী-মোস্তাফিজ-মন্টু পালেরা।

আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারি না। একটু বাতাসের জন্য হাঁকুপাঁকু করি।
বিনিপয়সার অঢেল পানীয় আর খাবার আর আমাকে আর ধরে রাখতে পারে না। সঞ্জয়কে খুঁজে বের করে বলি,
- চলি রে দোস্ত।
- সে কি রে! এখনই যাবি কেন।

মকবুল বাবুর্চিকে দিয়ে তোর পছন্দের খাসীর তেহারী রান্না করা হয়েছে। এখন ঝন্টু বাবুর্চিকে দিয়ে চিকেন বারবিকিউ করা হচ্ছে এসব না খেয়েই চলে যাবি! এক্ষুণি খাবার দিতে বলছি।
- না রে, কাল খুব ভোরে ত্রিশাল যেতে হবে। একটা নতুন প্রজেক্টের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
- তাই নাকি! আমিও তো ঐদিকে দেশী মাছের একটা খামার করার কথা ভাবছি।

তা তোদের প্রজেক্টটা কিসের?
- ওসব আলাপ আজকে থাক দোস্ত। আমি চলি। তুই সবাইকে সময় দে।
- ঠিক আছে, শুক্রবারের পার্টিতে ভাবী আর বাচ্চাদের নিয়ে আসতে ভুলিস না। বারবিকিউ ঐদিনও থাকবে।

ঐদিন আর না খেয়ে যাবি না।
- আচ্ছা সে দেখা যবে ‘খন। এখন যাই, বাই।
- ওকে, আল্লাহ হাফেজ।
বাসায় যাবার পথে গাড়ি যখন বাংলা মোটর পার হচ্ছে, দেখি কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ কর্তব্য পালন করছেন।

গতকালই এখানে তাঁদের একজন সহকর্মী মোহাম্মদ ফেরদৌস আগুনে পুড়ে মরেছেন। কনস্টেবল ফেরদৌস আর কনস্টেবল ফায়জুল ইসলাম বাসে বসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ড্রাইভার বায়েজীদ চলে আসলেও তখনো আরেকজন কনস্টেবলের আসা বাকি ছিল। ঠিক তক্ষুণি দুই মোটর সাইকেল আরোহী দ্রুত এসে বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়েই পালিয়ে যায়। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন গোটা বাসটিকে গ্রাস করে।

ফায়জুল আর বায়েজীদ বাইরে বের হতে পারলেও আগুনের লেলিহান জিহ্বায় জানালায় আটকে পড়া ফেরদৌস কাবাবপোড়া হয়ে যান। ভাগাড়ে নতুন মৃতদেহ পরার গন্ধে ছুটে আসা গৃধিনীর দলের মতো এক শ্রেণীর পেশাদারেরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। কিন্তু কেউ আগুন নেভাবার চেষ্টা করে না। ফায়ার সার্ভিসে কেউ খবর দিয়েছে কিনা সেটাও জানা যায় না। শুধু পাশের অটো পার্টসের মার্কেটের কর্মচারী এক কিশোর প্রাণপণে দৌড়ে কোথা থেকে এক বালতি করে পানি এনে আগুনে ছুঁড়ে মারতে থাকে।

যাত্রাবাড়ি, শাহবাগ, গাজীপুর চৌরাস্তার মতো সারা দেশে বাসে-ট্রাকে-ভ্যানে-সিএনজিতে-হিউম্যান হলারে পোড়া আর ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হওয়া অগ্নিদগ্ধদের অনেকের মতো নিহতের তালিকায় ফেরদৌস আরেকটি নাম হিসাবে যুক্ত হয়ে যান।
আমি গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে দেই, দম পাবার আশায় লম্বা নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করি তবু নিঃশ্বাস নিতে পারি না। মনে হচ্ছে পেট্রোল বোমা দিয়ে আগুন লাগানো বাসের দাউ দাউ করা আগুনের হলকা আর মাংসপোড়া গন্ধে বাতাস এতোটা ভারি হয়ে আছে যে বাতাসে আর এক ফোঁটা অক্সিজেনও আর অবশিষ্ট নেই।
আমি জানি, আমার এই দমচাপা ভাব বেশিক্ষণ থাকবেনা। বাসায় পৌঁছে গেলে আমি কনস্টেবল ফেরদৌসদের মতো মানুষদের কথা ভুলে যাব।

টেলিভিশনের স্ক্রলে, সর্বশেষ সংবাদে বা পরদিন সকালে সংবাদপত্রের পাতায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরা নতুন নতুন নাম পড়বো। পোড়া বাস-ট্রাক-ভ্যান-টেম্পোর তালিকা নিহতের তালিকার সাথে মিলে একটা পরিসংখ্যান হয়ে যাবে মাত্র। হাজার কোটি টাকার হিসাবে দেয়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের স্তম্ভলেখের উচ্চতা আরেকটু বাড়বে কেবল। আমি মনে করি, আমার কিছুই হবে না। আমি তো আর বাসে-টেম্পোতে-হুম্যান হলারে উঠি না।

সত্যি বলতে কি হরতাল-অবরোধের দিনে আমি বাইরে বেরই হই না। খুব জরুরী কোন কাজ থাকলে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করি। আমি বরং শুক্রবারের পার্টিতে কী পোশাক পরে যাব, বউয়ের শাড়ির রঙের সাথে ম্যাচিং কিছু পরবো কিনা সেটা নিয়ে ভাবি। ঐদিন নিশ্চয়ই ঝন্টু বাবুর্চির বানানো বারবিকিউ চিকেন না খেয়ে আসবো না!

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.