সব কিছুতেই স্বচ্ছতা চাই। আইডিয়াটা পুরোপুরিই ফেবু ফ্রেন্ড জাহাজী পোলা এর থেকে নেয়া। উনি লিখেছিলেন ভয়াবহ মাদক গাজা নিয়ে। আর আমি চেষ্টা করেছি ফেন্সিডিল নিয়ে লিখতে। আমি প্রায় এক বছর একটি বিদেশী দাতা সংস্থার মাদক নিয়ন্ত্রন প্রকল্পের একটি গবেষনামুলক কাজে ছিলাম।
ঐ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই এটা লেখা।
বিঃ দ্রঃ- মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এখানে তা নিয়ে আলোচনা করলাম না, আমার এই লেখায় লিখব মাদক কি এবং সেই মাদকাসক্তকে চিনার উপায় যাতে আপনি বুঝতে পারেন আপনার পরিবার কিংবা বন্ধু বান্ধবের মাঝে কেউ কি সেই ভয়াবহ পথে পা দিয়েছেন কিনা।
মাদকের নাম : ফেনসিডিল(phensidyl)।
ভুমিকাঃ "হাজার টাকার নেশা তোমার সাথে বেঈমানি করতে পারে কিন্তু ১০ টাকার গাঁজা কখনো বেঈমানি করবে না"- ডায়লগটা গাঁজা খোরেদের।
ডায়লগটা থেকে বুঝাই যাচ্ছে গাঁজা অনেক হাইভোল্টেজ নেশা। আর এই গাজার নেশাটাকে মিনিমাম ১৫০ গুন বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আধা বোতল ফেনসিডিল ই যথেষ্ট।
ফেনসিডিলকে সাধারনত ছাত্রনেতা, পাতিনেতা, লোকাল মাস্তানদের নেশা বলা হয়। সাধারনত অন্যান্য মাদক থেকে এর দুষ্প্রাপ্যতা এবং বেশী দামের কারনে এটাকে পলিটিক্যাল নেশা বলা হয়। কিন্তু ভয়াবহ সত্য হল রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে সমাজের উঁচুতলার অনেক ভদ্রলোকও এটা ইউজ করে।
তবে এটায় বেশির ভাগ আসক্ত হল ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে, বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের উদীয়মান তরুন নেতা, লোকাল ছাত্র নেতারা। ইদানীং মেয়েদের মধ্যেও এর আসক্তি চোখে পড়ার মত।
ফেন্সিডিল কি?: এটা এক ধরনের ঔষুধ। কাশির ঔষুধ। এতে থাকে codeine phosphate, pseudoephedrine এবং chlorpheniramine maleate ।
সাধারনত ইন্ডিয়া, নেপাল এবং বাংলাদেশের লোকদের মাঝে এর আসক্তি দেখা যায়। তবে এর মাঝে বাংলাদেশের লোকদের মাঝেই এর আসক্তি খুব বেশী। তবে অন্যান্য দেশের মধ্যে একমাত্র সাউথ আফ্রিকাতেই উল্লেখযোগ্যভাবে এর আসক্তি দেখা যায়।
ফেনসিডিল সাধারনত ইন্ডিয়াতে তৈরি হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করা হয়েছিলো এই ঔষুধ তৈরীর কারখানা বন্ধ করার জন্য।
কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি তা বোঝা যাচ্ছে ভালোভাবেই। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৪মিলিয়ন মানুষ ফেনসিডিল আসক্ত এবং তা ক্রমেই বেড়ে চলছে।
ছদ্মনামঃ ফেন্সি/ডাইল/ফান্টা/ফান্টু/ইঞ্চি/টাকা(১০০০টাকা মানে একটা ফেনসিডিল)/মধু/বাঘের দুধ/লাইন/মবিল/মাল ইত্যাদি। মাদকাসক্তরা নিজেদের মধ্যে ফেন্সি নিয়ে আলাপ করার সময় কিংবা কেনার সময় এই ছদ্ম নাম ব্যবহার করে যাতে সাধারন মানুষ কি নিয়ে আলাপ হচ্ছে তা বুঝতে না পারেন।
বেচা কেনার স্পট এবং বেচা কেনার ধরন এবং দামঃ বর্তমানে ফেনসিডিল একটু দামী নেশা।
সাধারনত একটু রিমোট এরিয়াতে এর বেচাকেনা হয় এবং এক জায়গায় ৫-৬দিনের বেশী থাকেনা। বেশিরভাগ সময়ই মোটর সাইকেল না থাকলে এটা সংগ্রহ করা কস্টকর। মাঝে মাঝে যারা বিক্রি করে তারাও মোটর সাইকেল ব্যবহার করে ক্রেতার কাছে দিয়ে আসে। সাধারনত লোকাল লিডারদের ছত্রছায়ায় এর বেচা কেনা চলে। ঐ লিডাররাই লোকাল আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে যোগাযোগ চালায়।
আর দামের ক্ষেত্রে বলা যায়, আজ থেকে ৬-৭বছর আগেও এক বোতল বিক্রি হতো ৮০-১০০টাকায়। বর্তমানে এলাকাভেদে এর দামের তারতম্য দেখা যায়। সাধারনত বর্ডার এরিয়াতে ২০০-২৫০ টাকায়, বর্ডারের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৩০০-৩৫০ টাকায়, এবং অন্যান্য এলাকায় ৭০০-৮০০টাকায় বিক্রি করতে দেখা যায়। দামের ক্ষেত্রে ক্রেতা বিক্রেতা দুইজনই একক সংখ্যা ব্যবহার করে। মানে ৭ টাকা/৮টাকা।
এবং এর কেনাবেচা অত্যন্ত তরিত গতিতে সম্পন্ন হয়।
কিভাবে সেবন করা হয়ঃ দিন কে দিন ফেনসিডিল আসক্তি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারন হলো এর সেবনের সুবিধার জন্য। অন্য যে কোন ধরনের মাদক সেবনের জন্য নুন্যতম একটু সময় এবং জায়গা দরকার। কিন্তু ফেনসিডিল এর জন্য সময় এবং জায়গা কোনটারই দরকার নেই। অনেকে মোটর সাইকেলের পেছনে বসেও খেয়ে থাকে।
সাধারনত দাম একটু বেশী হওয়ার কারনে দুইজন শেয়ার করে এক বোতল খায়। আর এক বোতলে থাকে ১০০মিলি।
যদি গ্রুপ করে খাওয়া হয় অর্থাৎ ৪-৫জন খায় তখন সাধারনত এক জায়গায় বসে গ্লাসে ঢেলে পানি মিশিয়ে খায়।
ফেনসিডিল কখন এবং কেনোঃ সাধারনত ছুটির দিনের আগে, বিশেষ উতসবের দিনে খাওয়া হয়। আবার অনেকে লং জার্নির শুরুতে এটা খেয়ে থাকে।
তবে যারা কয়দিন কন্টিনিউ করে তাদের জন্য উতসব লাগেনা। প্রতিদিনি তারা কোন না কোন উতসব বের করে ফেলে।
সাধারনত কৌতুহল থেকেই অনেকেই ফেনসিডিল খেয়ে থাকেন। তবে অনেক সময় ডিপ্রেশান, ছ্যাকা খাওয়া মানুষ সহজেই এতে জড়িয়ে পড়েন।
ফেনসিডিল সেবনকারীর সিম্পটমসঃ বেশীরভাগ ফেন্সিখোর স্পটে (যেখানে বেচা কেনা হয়) যেয়েই খেয়ে আসে।
সাধারনত আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পরার ভয়েই এটা নিয়ে চলাফেরা করেনা।
যারা সাধারনত রেগুলার ফেন্সিখোর তারা বিকেল ৩-৪ টার মধ্যেই খেয়ে ফেলে। তাহলে এর একশনটা ৩-৪ ঘন্টা থাকে। অবশ্য যদি ডুপ্লি ফেন্সি পরে তাহলে ভাবের একশন হওয়ার বদলে পেটে সমস্যা দেখা দেয়।
ফেন্সি খাওয়ার মিনিমাম আধা ঘন্টা পর কড়ড়া চিনি দিয়ে দুধ চা খায়।
যারা ফেন্সিখোর তাদের সাধারনত র চা খেতে দেখা যায়না। সবসময়ই কড়ড়া চিনি দিয়ে দুধ চা খায়। আর প্রচুর পরিমানে সিগারেট খেতে থাকে। এবং অনেকসময় তা অবিশ্বাস্য হারে বেড়ে যায়। ফেন্সিখোররা সাধারনত একটু বেশীই চুপচাপ থাকে।
অনেকটা ঝিম মেরে থাকে। কোলাহল থেকে দূরে যেয়ে একলা বসে থাকে আর সুযোগ পেলেই সিগারেট খায়। ফেন্সি খাওয়ার ৫-৬ঘন্টা পর অনেকে গাজা খেয়ে থাকে। যারা গাঁজা খায় তারা সাধারনত অনেক রাতে ঘুমায়, ঘুমানোর কিছুক্ষন আগ থেকে গাঁজা সেবন করে। বাসার ছাদে বা বারান্দায় গভীর রাতে গাঁজা খেয়ে রুমে ঢুকে সটান শুয়ে পড়ে।
ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে। ফেন্সি ও গাঁজা খেয়ে গান শুনতে ভালবাসে অনেকেই,তবে যারা শুধু গাজা খায় তারা হেডফোন লাগিয়ে হাই ভলিউমে গান শুনে। কিন্তু ফেন্সি খাওয়ার পর গাজা খেলে সবাই সাধারনত খুব লো ভলিউমে গান শুনে। এবং তারা একা বা আরেকজন ফেন্সিখোরের সাথেই চলতে বেশী স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে। তবে একটি ব্যাপার বেশ লক্ষ্যনীয় যে ফেন্সিখোরদের মাঝে খুব বেশী মিল মহব্বত থাকে যদিও তারা ভিন্ন ভিন্ন নীতি আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করে।
তবে যারা প্রথম প্রথম ফেন্সি খায় তারা অনেকসমইয়ই তা সহ্য করতে পারেনা। দেখা যায়, শরীর প্রচন্ড গরম হয়ে যায়। কোন স্থান কাল বিবেচনা না করেই যেকোন জায়গাই সটান করে শুয়ে পরে। সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়।
ফেন্সিখোররা সাধারনত কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না।
সাহস কমে যায়, কথা বার্তা খুব কমে যায়। যেকোন কাজের স্পিড নষ্ট করে দেয়।
ফেন্সি খেলে সাধারনত খুধা অনেক কমে যায়। যারা ফেন্সি খায় তাদের পকেটে বেশীরভাগ সময়ই চকলেট থাকে বিশেষ করে এলপিনেবল চকলেট।
যারা ফেন্সি খায় তারা অনেক মারফতি চিন্তা ভাবনা করে যা সাধারন অবস্থায় সম্ভব না, চিন্তার গভীরতা অনেক বেড়ে যায়।
অনেক বেড়ে যায় বলতে গভীরতা মাঝে মাঝে এতই বেড়ে যায় যে সে নিজেও বুঝতে পারেনা। আর সুস্থ্য অবস্থায় এই চিন্তা ভাবনাগুলো কল্পনাতেও আসেনা।
পরিনতিঃ চিকিতসা বেজ্ঞানের ভাষায় এর ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, রুচি নষ্ট হওয়া, এবডোমিনাল পেইন, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ফেন্সিখোরদের পরিনতি খুব বেশীই ভয়াবহ। আর বেশীরভাগ ফেন্সিখোরদের কেউই এমনকি পরিবারের সদস্যরাও ট্রেস করতে পারেনা।
যারা একেবারেই ফেন্সিখোর তারা একা একা চলাফেরা করে। দিনের বেলায় কাজ না থাকলে বের হয়না। নিজে নিজে খুব বেশী চিন্তা ভাবনা করে। এবং একসময় তা নেগেটিভ পর্যায়ে চলে যায়। সবাইকেই সন্দেহ করতে থাকে।
এবং এটা তার নিজের ভেতরেই রেখে দেয়। কারো সাথে শেয়ার করেনা। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে ফেন্সিখোরদের কনফিডেন্স অনেক বেশী। সবসময়ই ভাবে তারা যা চিন্তা করে তাই সঠিক। আর সবার চিন্তা ভাবনাই ভুল।
এবং একটা সময় মানসিকভাবেই অসুস্থ্য হয়ে যায়। যে কোন কাজের প্রতিই তাদের আগ্রহ কমে যায়। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায় ফেন্সিখোরদের চাকরী চলে যায়,ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়।
ফেন্সিডিলের নেশা ছারার জন্য খুব বেশীই আত্মবিশ্বাসী হওয়া লাগে। তারপরো পারেনা।
একমাত্র উপায় হচ্ছে তাকে ঘরের মাঝে বন্দী করে রাখা। অনেকেই আবার এক নাগাড়ে কয়দিন খেয়ে আবার কিছুদিনের জন্য বাদ দেয়। এর ফলে কিছুক্ষনের জন্য প্রচন্ড খারাপ লাগে। কোনকিছুই ভালো লাগেনা। ঘন্টাখানেক পর আবার সব ঠিক হয়ে যায়।
তখন সে ভাবে ফেন্সির উপর তার কন্ট্রোল আছে। কিন্তু এটাই ভুল ধারনা। ফেন্সি ছাড়ার পর যতদিন যেতে থাকে, ফেন্সি ছাড়ার এফেক্টটাও বেশী প্রকট হতে থাকে। এবং একটা সময় ঘুম আসেনা। দেখা যায় ৭-৮ দিন টানা ঘুমাতে পারছেনা।
তীব্র মাথা ব্যাথা করে, অনেকসময় জ্বর আসে। তখন সে মনে করে এক ফোটা ফেন্সি খেতে পারলেও হতো। তবে ফেন্সিখোরদের পরিনতিই হলো ধ্বংসের অতল গহবরে হারিয়ে যাওয়া। অবশ্য হারিয়ে যাওয়া নয় অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় বেচে থাকা।
তবে দেশকে এই মাদকের হাত থেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে এর চালান রোধ করা।
একবার যে ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে পড়ে তার পক্ষে এটা ছেড়ে দেয়া কখনোই সম্ভব হয়ে উঠেনা।
উপসংহারঃ মাদক নিয়ন্ত্রন প্রকল্পে কাজ করার সময় একজন ফেনসিডিল আসক্ত ব্যাক্তি আমাকে মেইল করেছিলেন। আমি তা তুলে দিলাম “if anyone continue,there is only one way he’s going, and thats down!! Nothing about this drug is good!!! You'll start off experimental... you will find the buzz it delivers is potent and it gives you a major sense of power.... this only lasts for 2 of the 4 hours. the remaining 2 hours is where the codiene kicks in.
Its so difficult to just leave and forget about it...
you are going to rip your own family off by taking small things from there and end up pawning them all.... this all starts a viscious circle...
good luck... stay AWAY!!!! “
কৌতুহল বশত কখনোই ফেনসিডিল খাওয়া শুরু করা উচিত নয়। এই পৃথিবীতে কৌতুহল দেখানোর জন্য অনেক আদর্শ বিষয় আছে। কোন প্রকার মাদক নিয়েই কখনো কৌতুহল দেখানো ঠিক না।
একটা কথা আছে- " সিগারেট হল সকল নেশার মা। " যারা যে নেশাই করুক তাদের মধ্যে কমন জিনিস হল তারা সবাই সিগারেট খায়। যারা সিগারেট খায় না তাদের মাদকাসক্ত হবার সম্ভবনা খুবই কম। তাই সিগারেট থেকে দূরে থাকতে পারলেই নিশ্চিত মাদক থেকে দূরে থাকতে পারবেন।
লেখার সুত্রঃ অভজার্ভেশন এবং মাদকাসক্ত লোকের বাস্তব অভিজ্ঞতা শুনে এবং উইকিপিডিয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।