আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খার্তুম শহরে নীল নদের আশেপাশে - সুদান

কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্‌ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ



সুদান দেখার আগ্রহ হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। নাইরোবিতে দুপুর বেলা শহর দেখতে বের হয়েছি।

একটা সুভেনিরের দোকানে নানা দেশের পতাকা সাজানো আছে দেখলাম। আমার বেশ শখ ছিল এই পতাকার জন্য। যেসব দেশে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে সেসব দেশের পতাকা কেনার সময় কুয়েতের পতাকা মনে করে ভুলে একটা পতাকা কিনে ফেললাম। পরে দেখি এটা সুদানের পতাকা আর এই দেশে আমি আগে কখনও যাইনি। তখন মনে মনে দেশটা দেখার ইচ্ছে করছিল।

এই ইচ্ছেটা পূরণের জন্যই যেন এবার সাউথ সুদানে আসা হল। তবে এই ক’বছরে সুদান দুই ভাগ হয়ে নতুন একটা স্বাধীন দেশ সাউথ সুদানের অভ্যুদয় হয়েছে। নতুন দেশের নতুন পতাকা। সাউথ সুদানে আসার পর মনে মনে ঠিক করে রেখেছি এখান থেকে একটা সুযোগ কাজে লাগিয়ে সুদান ঘুরে আসব।

১৯৫৬ সালের পহেলা জানুয়ারী ব্রিটেন ও মিসরের কাছ থেকে সুদান স্বাধীনতা লাভ করে।

আয়তনে দেশটা বাংলাদেশের থেকে প্রায় সাতগুণ বড়। এখানকার মুদ্রার নাম সুদানি পাউন্ড। এক ডলারে প্রায় আট পাউন্ড পাওয়া যায়। সুদান উত্তর আফ্রিকার একটা দেশ, এর উত্তরে মিসর, পূর্বে লোহিত সাগর, ইথিওপিয়া এবং ইরিত্রিয়া, দক্ষিণে সাউথ সুদান ও দক্ষিণ পশ্চিমে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, পশ্চিমে চাঁদ ও উত্তর পশ্চিমে লিবিয়া। নীল নদ দেশটাকে পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করেছে।

সুদান একসময় আফ্রিকার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র ছিল। সাউথ সুদানের স্বাধীনতার পর এখন এটা আলজেরিয়া ও কঙ্গোর পর আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র।
সুদানে আসতে এখন ভিসা লাগে, মাঝে মাঝে ভিসা পাওয়া যায়, কখনো ইচ্ছে হলে এমনিতেই দিয়ে দেয়, মাঝে মাঝে ভিসা পাওয়া যায় না। যাক ভিসার জন্য কাগজপত্র জমা দিলাম, ভিসা পেলাম তবে এই ভিসাতে কাজ হবে না, এক মাসের সিঙ্গেল এন্ট্রি, আবার এম্বেসিতে মাল্টিপল আর তিন মাসের ভিসার জন্য গেলাম, ভাগ্য ভাল এবার পেয়ে গেলাম। কোন ভাবে একবার না বলে দিলে আর হ্যাঁ হয় না।

যাত্রার প্রথম পর্ব শেষ হল, এরপর টিকেট। জুবা থেকে রওয়ানা হলাম ঢাকার পথে, প্রথমে জুবা থেকে এন্টেবি- খার্তুম- সারজাহ- ঢাকা। বেশ লম্বা সফর।

জুবা থেকে বিকেল তিনটা তিরিশ মিনিটে আমাদের বিমান উড়াল দিল, ফ্লাইট টাইম এক ঘণ্টা, সাড়ে চারটার সময় আমরা এন্টেবিতে ল্যান্ড করলাম। এক রাত এখানে থাকতে হবে।

সন্ধ্যার দিকে এন্টেবির কিটোরো বাজারে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করলাম। এখানে দাম রিজনেবল, ফলের দাম একটু কম, এখানকার কলা খেতে বেশ মজা এবং দামও অনেক কম।

পরদিন দুপুরে যাত্রা শুরু হল এন্টেবি বিমানবন্দর থেকে। গন্তব্য সুদানের রাজধানী খার্তুম। ফ্লাইট টাইম দুই ঘণ্টা তিরিশ মিনিট।

খার্তুমের সময় একটা তিরিশ মিনিটে বিমান খার্তুম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ল্যান্ড করল। এরাইভালে আসার পর এন্ট্রি ফর্ম ফিলাপ করে লাইনে দাঁড়ালাম। সবাই চুপচাপ, যে যার কাজ করছে, ভিসা চেক করে পাসপোর্টে সিল মেরে দিল। এখানে সব মালপত্র স্ক্যানারের ভিতর দিয়ে চেক করে নেয়। পরবর্তী আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা বাইরে চলে আসলাম।



খার্তুম শহরে
তখন বেলা দুইটা বাজে, বিমান বন্দরের বিশাল দরজা পেরিয়ে আসতেই তীব্র সোনালি সূর্যের আলো চোখ ধাধিয়ে দিল। আকাশ তীব্র নীল, বেশ গরম সাথে আলোর বন্যা। ট্যাক্সি আছে, ড্রাইভাররা এসে কোথায় যেতে চাই জানতে চাইল, বেশ ভাল লাগল এদের ব্যাবহার। এক ড্রাইভার তার মোবাইল ফোন দিল কথা বলার জন্য, আমারা টাকা দিতে চাইলাম সে নিল না, বেশ আন্তরিক মনে হল। বিমাম বন্দর থেকে বাইরে এসে আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অফিসে গেলাম।

কাছেই অফিস, হেঁটে চলে আসলাম, রিসিপসানে জানালো পরের দিন আসতে হবে। আজ রাতে আমাদের ফ্লাইট তাদেরকে জানালাম, কাগজপত্র নিয়ে গেল আমাদের কাছ থেকে, কিছুক্ষণ পর সিল মেরে ফেরত দিয়ে দিল।

খার্তুমের রাস্তায়
বিমান বন্দর থেকে বের হতে টোল দিতে হয়, বাহিরে বেশ খোলামেলা। রাস্তাগুলো ওয়ান ওয়ে, তিন তিন করে ছয় লেনের রাস্তা। এর দুপাশ দিয়ে আরও দুই দুই করে চারটা লেন।

সব মিলিয়ে শহরের মূল রাস্তা দশ লেনের। রাস্তা গুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, খোলামেলা। রাস্তার দুপাশে জায়গা রেখে দোকান পাট, ঘরবাড়ী ও অফিস আদালত আছে। ট্রাফিক জ্যাম নেই, এক রাস্তাতে দামি গাড়ির পাশাপাশি খচ্চরে টানা এক্কা গাড়িও চোখে পড়ে। প্রাচুর্য ও অভাব এখানে পাশাপাশি চলছে।

পুরাতন অনেক ঘরবাড়ী ভেঙ্গে নতুন কাঠামো গড়ে উঠছে। চলছে ভাঙা গড়ার সেই নিত্য আয়োজন। এখানে সব গাড়ি বাম হস্তে চালিত, রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ি চলে।

খার্তুম শহরে
আজ রাতেই আমাদের ফ্লাইট, হাতে সময় কম। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমাদের গন্তব্যে চলে এলাম।

একটু ফ্রেশ হয়ে বিকেল বেলা বের হলাম। এই সুযোগে শহরটা দেখব বলে ঠিক করলাম। প্রথমে গেলাম সুক আল আরাবি এলাকাতে। এটা বাজার এলাকা, এখানে টাকা বদলে নিলাম। সুদানে এখন বেশ মূল্যস্ফীতি চলছে, ডলার ব্যাংক থেকে বদলে নিলে চার পাউন্ড আর বাইরে সাড়ে সাত কিংবা আট পাউন্ড করে পাওয়া যায়।

এখানে বিশাল একটা শপিং মল আছে, আল ওয়াফা শপিং মল। সব জিনিসপত্রই এখানে পাওয়া যায়, দামও বেশ সাশ্রয়ী। কিছু চকলেট ও ফল কিনলাম নিজেদের জন্য। এখানে গোল্ড মার্কেট আছে, যেহেতু সোনার কিছু কিনব না এবার তাই এটা দেখতে যাইনি। দুবাই গোল্ড সুকের কাছে এগুলো কিছুই না।


দেখতে দেখতে মাগরেবের আজান দিয়ে দিল। এই শহরে অনেক মসজিদ, চারিদিকেই আজানের শব্দে এলাকা মুখরিত। সন্ধ্যার পর হালাকা ঠাণ্ডা আবহাওয়া, বিকেলে খার্তুমের মানুষেরা সপরিবারে নীল নদের পারে সময় কাটাতে আসে। এখানে নীলের পাড়ে অনেক ফাস্ট ফুডের দোকান, বসার জায়গা এবং পার্ক বানানো হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য রয়েছে খেলার ব্যবস্থা ।

বেশ সুন্দর সময় কাটানোর সুযোগ এখানে গড়ে উঠেছে। নীল নদের পাড় থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে নদীতে ভাসমান রেস্টুরেন্ট আছে, আছে নদীতে ভ্রমনের জন্য সাজানো গুছানো বড় ছোট নানা আকারের ইঞ্জিন বোট ও নৌকা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা চমৎকার।


নীল নদের পারে গড়ে উঠা বিনোদনের জায়গা
আমদের গাড়ি রাস্তার পাশে পার্ক করে নদীর পাড়ে এলাম। এটা চার লেনের রাস্তা।

স্ট্রীট লাইট আছে রাস্তাগুলোতে। নদীর পাড় আলো ঝলমলে। আরবি ও নানা ভাষার গান বাজছে। নদীর পাড় দিয়ে মাইলের পর মাইল এই ধরনের আয়োজন। অনেক ফাস্ট ফুডের দোকান আছে এখানে, সাথে বসার জায়গা, ছাতার নীচে চেয়ার পাতা রয়েছে, সুন্দর ওয়াকওয়ে আছে , সেখানে মানুষ হাঁটছে, বাচ্চারা দৌড়া দৌড়ই করছে।

ফেরিওয়ালারা আইসক্রিম এবং খেলনা ফেরি করছে। বেশ কিছুক্ষণ নিল নদের পাড়ে হাঁটলাম। সুন্দর আবহাওয়া, হালকা ঠাণ্ডা নির্মল বাতাস, আলো ঝলমলে খার্তুম শহর, নীলের উপর বানানো অনেক আলোকিত ব্রিজ, ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি চলাচল, নদীতে নৌকা ও বোটে ভ্রমনরত মানুষ দেখতে দেখতে অনেক সময় কাটিয়ে দিলাম।
এরপর একটা স্টলের সামনে এসে চিকেন সোয়ার্মার অর্ডার দিলাম। সেলফ সার্ভিস, কিছুক্ষণ পর তৈরি হয়ে গেল।

নিয়ে এসে ছাতার নীচে বসলাম। নদীর দৃশ্য দেখতে দেখতে সময়টা উপভোগ করলাম সুন্দর ভাবে। দোকানী শিক্ষিত যুবক, দুবাইতে ছিল এখন নিজের দেশে এসে ব্যবসা করছে। তার কাছে তার দেশ বিদেশ থেকে প্রিয়। আমাদেরকে বলল, সন্ধ্যাটা সে এখানেই পাড় করে তার বন্ধুদের সাথে, একইসাথে ব্যবসাটাও দেখে।

অর্ডার নেয়ার পর আবার সে খেলতে বসে গেল। এই জায়গাটা ছাড়া তার মতে খার্তুমে আর কোন সময় কাটানোর মত সুবিধা নেই। অনেক সুদানি ও বিদেশী সপরিবারে এখানে এসে রাতের খাবার সেরে ফেলছে। নীচে নদীতে চলছে বোট ট্রিপ, গান বাজছে বোটে, মাঝ নদীতে যাত্রীদের নিয়ে গিয়ে আবার পাড়ে নিয়ে আসে। লম্বা লাইন হয়ে যায় মাঝে মাঝে।



নীল নদের উপর ব্রিজ
অনেক ব্রিজ আছে নিল নদের উপর। ব্রিজগুলো বেশ সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন এগুলো আরও সুন্দর লাগে। এবার এই ব্রিজগুলোতে যাওয়া হয়নি। দেশ থেকে ফিরে এসে বেড়াব আসা করি। এখানে বলে নেয়া ভাল যে, সুদানে ছবি তোলা প্রায় নিষিদ্ধ।

পুলিশ দেখলে নাকি ক্যামেরা নিয়ে নেয় এবং হেনস্তা করে। তাই দেখে শুনে ছবি তুলতে হয়। আমাদের ফ্লাইট মধ্য রাতে, এখানে থাকা যাবে না বেশীক্ষণ। তাই নাস্তা শেষ করে উঠে পড়লাম।
রাতে সময় মত বিমানবন্দরে চলে এলাম।

ভেতরে যাওয়ার গেইট একটু ছোট। তবে ভেতরে বেশ জায়গা আছে। অনেক সুদানি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাতায়াত করে ব্যবসার জন্য, বিশেষ করে আরব আমিরাতে, তাই যাত্রী প্রচুর। বিমান বন্দরের ভেতরতা কেমন যেন অন্ধকার মনে হল। ভেতরে একটা ফাস্ট ফুডের স্টল আর একটা সুভেনিরের দোকান, এছাড়া ডিউটি ফ্রি এলাকাতে আর কিছু নেই।

সব ফরমালিটিজ শেষ করে বোর্ডিঙের জন্য বসলাম। বিমান যাত্রীতে ভরপুর। খার্তুমে কিছু সময় কাটিয়ে সারজা হয়ে ঢাকার পথে উড়াল দিল আমাদের বিমান।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।