কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ
বাংলাদেশ থেকে সুদানের খার্তুম চলেছি, সকাল সাতটায় বিমান বন্দরে এসে সব ফর্মালিটিজ শেষ করলাম। বিমান শারজা হয়ে সুদানের রাজধানীতে যাবে।
মাঝখানে বেশ বড় যাত্রা বিরতি আছে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বিমানে উড়ে সারজা সময় দুপুর একটা তিরিশ মিনিটে আরব আমিরাতের এই প্রদেশে পৌঁছে গেলাম। রাত আটটার সময় আমাদের খার্তুমগামী ফ্লাইটের চেকইন হবে। বেশ কয়েক ঘণ্টা অলস অবসর। ডিউটি ফ্রি শপ আছে,তবে এটা বেশ ছোট দুবাই ডিউটি ফ্রি শপের তুলনায়।
যাওয়ার পথে কেনাকাটা করেছি ফেরার পথে আর কিছু কেনার ইচ্ছা নেই।
ট্রানজিট লাউঞ্জ- শারজাহ
কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে লাঞ্চের জন্য বসলাম। ফুড কর্নারে মাগডোনাল্ডস, ভারতীয়, চাইনিজ, আরবি আর ইংলিশ খাবার আছে। কফি ও মিষ্টি, পেস্ট্রি ইত্যাদি শপ ও আছে এখানে। আমরা চাইনিজ খাবারের অর্ডার দিলাম।
পঁচিশ দেরহাম করে জনপ্রতি। ভালই লাগল খেতে। এয়ারপোর্ট বেশ পরিচ্ছন্ন, বসার ভাল ব্যবস্থা আছে, ফ্রেস আপের জন্য ও সুন্দর আয়োজন। সব মিলে সময় খারাপ কাটে না। বেশ বড় এলাকা নিয়ে এয়ারপোর্ট, দূরে শারজাহ শহরের আকাশচুম্বী ঘরবাড়ী দেখা যায়।
বহু দেশের মানুষের আনাগোনাতে বিমান বন্দরের ট্রানজিট টারমিনাল মুখরিত। রাশিয়া ও সেন্ট্রাল এশিয়ার অনেক দেশে এখান থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
বিমান বন্দর থেকে - দুরে সারজা শহর
সন্ধ্যার দিকে ডিনার করে ফেললাম। এই বিমানে খাবার কিনে খেতে হয়। বিমান থেকে না খেয়ে এয়ারপোর্টে খেয়ে নেয়া ভাল, অনেক পছন্দের মজার খাবার এখানে পাওয়া যায়।
রাত দশটা তিরিশ মিনিটে প্লেন খার্তুমের উদ্দেশে উড়াল দিল। ফ্লাইট টাইম চার ঘণ্টা পনের মিনিট। স্থানীয় সময় রাত একটাতে আমরা খার্তুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরন করলাম। সারজা থেকে রাতে উড়ার পর ঝলমলে সারজা শহর দেখা হল, নামার সময় খার্তুমের আলো শারজা’র তুলনায় কিছুই নয়, তবে একেবারে খারাপ না এখানকার আলোকসজ্জা।
আজ খুব দ্রুত ইমিগ্রেশান পার হয়ে গেলাম।
আমাদের গন্তব্যে পৌঁছুতে রাত দুইটা তিরিশ বেজে গেল। খার্তুমের রাস্তার বাতি জ্বলছে তবে শহর নিদ্রা মগ্ন। এসে ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে একটু দেরি করেই উঠলাম। আজকে শহরটা একটু ভালভাবে ঘুরে দেখব।
শুক্রবার আজ, জুম্মার নামাজ আছে। নামাজ পড়তে কাছের একটা মসজিদে গেলাম। মসজিদের তিন দিক খোলা, পাকা চত্তর মাঝে দোতালা মসজিদ। ভেতরে পরিস্কার, এসি আছে, মার্বেল পাথরের টাইলস দিয়ে বানানো পিলার, মেঝেতে পুরো কার্পেট লাগান। ভেতরে একতালা দোতালা মিলে পাঁচ‘শ র মত মুসল্লি বসতে পারে।
ভেতরে ভরে গেলে বাহিরে রোদ ও ছায়াতেও অনেকে নামাজ পড়ে। ইমাম সাহেব আলাদা রেলিং এ ঘেরা স্টেজ এর উপর দাঁড়িয়ে একটা লাঠিতে হাত রেখে খুতবা দেন। অনেকক্ষণ ধরে খুতবা চলে। নামাজের আগে ও নামাজের মাঝে দোয়া করেন ইমাম সাহেব। সাদা, কালো, দক্ষিণ এশিয়া প্রায় সব ধরনের মানুষ দেখলাম এই মসজিদে।
অনেককে ইন্দোনেশিয়ার কিংবা চীন দেশের মনে হল। এরা কোন না কোন ভাবে এখন সুদানের নাগরিক।
শহর এলাকা- খার্তুম
নামাজ শেষে লাঞ্চ করে শহরে ঘুরতে বের হলাম। বাহিরে বেশ রোদ, এই রোদে বেশি বেড়ানো যাবে না। আমরা নীল নদের পাড়ের দিকে রওয়ানা হলাম।
পথে একটা বাস স্ট্যান্ড। আমাদের দেশের মতই ভিড়, রাস্তার মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে যাত্রী ডাকছে। পেছনে গাড়ির জ্যাম হয়ে গেছে। সেই পুরাতন গল্প। আমরা মূল রাস্তা থেকে নেমে একটা কাঁচা রাস্তায় চলে এলাম।
নদীর পাড়ে ঝাউ বনের মত এলাকা। এই ঝোপ গাছের ছায়াতে খার্তুমবাসিরা ছুটির দিনে ভিড় করে, এখানে পিকনিক করে, মাছে ধরে, আড্ডা জমায় আর ইচ্ছা থাকলে বোটে করে নিল নদের বুকে বেরিয়ে আসে। গাছগুলো বেশ ছায়া দেয়, গাছের ছায়ায় মানুষজন বসে গল্প করছে, সপরিবারে এসে কেউ বারবিকিউ বানাচ্ছে, পিকনিক করছে কয়েকটা দল। অনেক ফেরিওয়ালা আছে এখানে। অলস সময় শুয়ে বসে কাটাচ্ছে কেউ।
নীল নদের পাড় এখানে পানির লেবেলে, বেশি কাছে গেলে কাঁদা মাটি। সেখানে চেয়ার পেতে মাছ ধরছে অনেকে। বোট অপেক্ষা করছে যাত্রীদেরকে নদীতে ভ্রমনে নিয়ে যাবার জন্য। বোটে গান বাজছে মানুষের আগ্রহ বাড়ানোর জন্য।
দূর থেকে দেখা ব্রিজটি
কিছুক্ষণ এখানে সময় কাটালাম।
খার্তুম শহরটা নীল নদের দুই পাড়ের এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে। দুদিকে পারাপারের জন্য অনেক ব্রিজ আছে নদীর উপরে। প্রত্যেকটা ব্রিজের নক্সা আলাদা, এবং একেকটা একেক রকম। গতবার এপারেই ছিলাম, এবার ব্রিজ পাড় হয়ে অন্য পাড়ে রওয়ানা হলাম। নীল নদের উপর অনেকগুলো ব্রিজ বানিয়ে দুইদিকের সাথে সেতুবন্ধন তৈরি করা হয়েছে।
আমরা একটা ব্রিজ পাড় হওয়ার সময় আরেকটা ব্রিজ দেখলাম, ওপারে গিয়ে কিছুক্ষণ বেরিয়ে অন্য আরেকটা ব্রিজ দিয়ে আবার এপারে চলে এলাম।
নদীর অন্য পাড়ের জনপদ- খার্তুম
নদীর দুপারেই অনেক সুন্দর সুন্দর ভবন ও স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, কিছু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এদেশে ছবি তোলা মানা, তবে চলতে চলতে কিছু ছবি তুললাম। রাস্তাগুলো পরিস্কার, চমৎকার ট্রাফিক ব্যবস্থা, মাঝে মাঝে পুলিশ আছে তবে সবাই নিয়ম মেনে চলছে। নদীর দুদিকের এলাকাই উন্নত।
অনেক মসজিদ দেখলাম, আধুনিক কিছু স্থাপনাও দেখলাম, কিছু নির্মাণ কাজ চলছে। মোটকথা উন্নয়নের ছোঁয়া আছে বুঝা যায়। ঘুরে আনন্দ পেলাম।
রাস্তার পাশেই সুন্দর স্থাপনা
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে একজন পতাকা বিক্রেতাকে দেখলাম। গাড়ি থামিয়ে পাঁচ পাউন্ড দিয়ে সুদানের একটা পতাকা কিনে নিলাম।
বেশ সুন্দর পতাকা, দাম আমাদের দেশের তুলনায় বেশি হলেও কোয়ালিটি বেশ ভাল। সাউথ সুদানে এই পতাকার দাম পড়ে দশ পাউন্ড, দুই ডলারের বেশি। এবার দেশ থেকেও বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এসেছি কয়েকটা।
খার্তুমের রাস্তায়
এবারে নীল নদের পাড় ধরে সমান্তরাল রাস্তা দিয়ে চলছি। রাস্তার পাশে নদীর ধারে চেয়ার পাতা আছে।
দোকানপাট সবগুলো এখন ও খোলেনি, সন্ধ্যার পর এসব জায়গা জমজমাট হয়ে উঠে। আমরা আফ্রা নামে একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কিছু কেনাকাটা করতে আসলাম। বেশ বড় এবং সুন্দর ভাবে সাজান একটা শপিং মল। সামনে বিশাল পারকিং এলাকা, বাগান ও ঘুরে বেড়ানোর জায়গা। মলে ঢুকতেই দেখলাম আজকে এখানে সুন্দর একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে।
নাটক ও সার্কাসের মত, অনেক দর্শক ভিড় করে দেখছে। অনেকে মোবাইলের ক্যামেরাতে ছবি তুলছে। আমরা সিকিউরিটির অনুমতি নিয়ে ছবি তুললাম।
রাস্তার মোড়ে-খার্তুম
বেসমেন্টে সেনা শপিং মল, এখানে সব ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। বিশাল মল।
কিছু চকলেট, বিস্কিট আর ফল কিনলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে এই ফাকে। মল থেকে বের হয়ে নীল নদের পাড়ে একটু হাওয়া খেতে বের হলাম। এখানে আসর জমে উঠছে, তবে আমাদের আজ এখানে বসার ইচ্ছে করছিল না। আরেকটা বড় পাইকারি দোকানে গেলাম।
এখানে সব জিনিসের দাম মলের তুলনায় অনেক কম। আগে জানলে এখান থেকে অনেক কিছুই কেনা যেত। রাতে আর কোথাও যাইনি।
শহর এলাকা- খার্তুম
পরদিন সকাল বেলা একটু দেরি করেই উঠলাম। আজকে আমাদের এন্টেবির ফ্লাইট ধরতে হবে।
দুপুর পর্যন্ত হাতে সময় আছে। খার্তুমে দিনগুলো বেশ ভালই কাটছে। আজকে আশেপাশের এলাকা দেখতে বের হলাম। সূর্যের আলো বেশ তীব্র, আকাশ ঘন নীল, আবহাওয়া এখনো পুরো পুরি তপ্ত হয়নি। কাছেই একটা বড় দোকান আছে।
হেঁটেই রওয়ানা হলাম। এখানে প্রায় সব প্রয়োজনীয় জিনিষ পাওয়া যায়। হাতে এখন ও কিছু সুদানিজ পাউন্ড আছে। সেগুলো দিয়ে টুকটাক কিছু কিনলাম। বেশি নেয়া যাবে না ওজন বেড়ে যাবে।
দুপুরে লাঞ্চ করে বিমান বন্দরের দিকে রওয়ানা হলাম। বিশাল রাজপথ, দুপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে বিমান বন্দর টোল প্লাজার কাছে চলে এলাম, আমাদের গন্তব্য ডি পারচার লাউঞ্জের দিকে। আজ দিনের আলোতে জায়গাটাকে ভালই লাগল। সাদা ক্যানভাস দিয়ে ছাতার মত শেড বানানো আছে। আজ গেইটে কোন সমস্যা হয়নি।
নিয়ম মাফিক চেকইন করে ইমিগ্রেশানে এলাম। পাসপোর্টে সিল মেরে দিল, আমরা ভেতরে চলে এলাম। এবারের মত সুদান ভ্রমনের এখানেই সমাপ্তি। আবার কবে আসা হবে কে বা জানে। “অযথা মায়া বাড়াইয়া কি লাভ, পৃথিবীতে কে কাহার”।
শেষ বারের মত শহরটাকে বিদায় জানালাম, বিদায় খার্তুম, বিদায় সুদান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।