“সমালোচনার প্রথম শর্ত সততা,আর প্রশংসার দ্বিতীয় শর্ত হল মিথাচার” **************************************************** গঠনমূলক সমালোচকদের প্রতি আমি যতটা আন্তরিক, যুক্তিহীন সমালোচকদের প্রতি ঠিক ততটাই নির্মম।
১
সকাল ১০: ৩০
৩ জানুয়ারি, ২০১৪
স্থানঃ গেণ্ডারিয়া স্টেশন
নুরা পাগলা স্টেশনের প্লাটফরমে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এটা অবশ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত কোন ঘটনা না। প্রতিটি স্টেশনেই বাই ডিফল্ট দুই একটা পাগল থাকে। কয়েক সপ্তাহ গোছল না করায় নুরা পাগলার আধা হাত লম্বা চুলের রং সাদাটে হয়ে গেছে।
তবে কাঁচাপাকা দাড়ি দেখে ধারনা করা যায় তার বয়স পঁয়তাল্লিশের উপরে। নুরা গেণ্ডারিয়া স্টেশনে এসেছে একমাস আগে। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে ট্রেন দুই মিনিটের জন্য গেণ্ডারিয়া স্টেশনে থামে। প্লাটফরম ওই দুই মিনিটের জন্যই জীবন্ত হয়ে ওঠে। বাকী সময়টা প্লাটফরমের মালিক নুরারা।
শীতকালে সকাল এগারোটায় রোদ লোভনীয়। নুরা পাগলা বিড়ি ধরিয়ে সেই রোদ উপভোগ করতে থাকে। অবশ্য দিনের বেলায় তার কোন তাড়া নেই। তার কাজ শুরু হয় সন্ধ্যার পর পর। বর্তমানে সে গাঁজা বেঁচে পেট চালায়।
গাঁজা বানানোতে তার হাত লাজবাব। সিগারেটের তামাক আর গাঁজার মিশ্রণের ফর্মুলাটা সে ভালোই আয়ত্ত করেছে। সে স্টেশনের সাথেই তার পলিথিনের খুপরির মধ্যে বসে তার ফর্মুলা চালায়। তার তেল চিটচিটে কাঁথার গন্ধে কাস্টোমারা সর্বদা নিরাপদ দূরত্বে থাকে। এক দিনের গাঁজা বেচার টাকায় সে দুইদিন চলে।
তবে ইদানিং সে ভালোই বুঝতে পারে যে তার সময় শেষের দিকে...
২
দুপুর ১২: ৪৫
প্লাটফরমের উলটো দিকে একটি পিকআপ ভ্যান এসে থামলো। ভ্যানে আটজন সসস্র পুলিশ। সাথে নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন। তারা নির্বাচনী মালামাল বহন করে কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছে। তবে এই মুহুরতেই তারা প্লাটফরম পার হয়ে যেতে পারছেনা।
কারন প্লাটফরমে ট্রেন দাড়িয়ে আছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ট্রেন ক্রসিং হবে তারপর এই ট্রেন ছাড়বে। ট্রেন এসেছে বলে স্টেশনের সবাই ব্যস্ত। নির্বাচন কমিশনের লোক ভিতসন্ত্রস্ত হয়ে যক্ষের ধনের মত মালামাল নিয়ে ভ্যানে বসে আছে। পুলিশ অবশ্য ভ্যান থেকে নেমে চারপাশ ঘিরে রেখেছে।
ইন্সপেক্টর কাশেম রোদ পোহাতে থাকা লম্বা সাদা চুলোর দিকে এগিয়ে গেল,
-"কিরে ব্যবসা কেমন?" লাঠি দিয়ে গালে খোঁচা।
নুরা প্রথমে হচকিয়ে গেল। ইন্সপেক্টরের নেমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। পরে নিরলিপ্ত ভাবেই জবাব দিলো,
-“সার ভালা”
-"শালা হারামখোর! কয় ভালা। কোনদিন লটকাইয়া দেই তার হিসাব নাই।
"
-"হ সার! বেশি দিন বাহি নাই। সব কিছুই পরায় শেষের দিকে। "
..ট্রেন ছেড়ে গেলে 'নির্বাচন কমিশন' আঁকা সাদা প্লাস্টিকের ব্যালট বাক্স আর অন্যান্য জিনিষ গুলো নিয়ে নির্বাচন কমিশনের লোকেরা স্টেশন পার হলো। এখনও চারপাশে গার্ড দেয়া স্বসস্র পুলিশ। জিনিষ গুলো পৌঁছে দিতে হবে কয়েকটি কেন্দ্রে।
প্রথমে গেণ্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, পরে একে একে খোকন সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়, সমাজ কল্যাণ মহিলা সমিতি, খোকন ক্লাব, পুরান বাজার ক্লাব, আদর্শ একাডেমী হাই স্কুল...
৩
বিকেল ৩: ৫০
স্থানঃ খোকন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
নুরা দাড়িয়ে আছে বিদ্যালয়ের সামনে। সাদেক হোসেন খোকার নামে এই বিদ্যালয়ের নামকরন। আজ মাঠে খেলতে আসা ছেলেদের পুলিশ ঢুকতে দিচ্ছে না। নুরা প্রতিদিন বিকালে ছেলেদের খেলা দেখতে আসে। স্কুলের দারোয়ানের সাথে নুরার ভালো ভাব।
কারন দারোয়ানকে নুরা ফ্রিতে গাঁজার যোগান দেয়।
নুরা এগিয়ে গিয়ে গেটে দাঁড়ানো হাবিলদার কে বলল,
-“কাশেম সার আমারে দেহা করতে কইছে। ”
-"কি কাম?"
নুরা পকেট থেকে গাঁজার প্যাকেট দেখিয়ে বলল,
-"সারে গাঞ্জা চাইছিল। "
-"যা, কিন্তু দুই মিনিটে কাজ শেষ করবি। "
নুরা পাগলাকে দেখেই ইন্সপেক্টর কাশেমের বিরক্তি দ্বিগুণ হয়ে গেল-
-"তুই আবার কি চাস এখানে।
তরে ভিত্রে কে ঢুকতে দিলো। "
-"সার আমিই ঢুকছি। গাঞ্জার ব্যবসা ছাইরা দিমু ভাবতাছি। শেষ কিছু বেচার বাকি। তাই আপ্নের কস্তরিতে জমা দেবার আইছি।
"
-"এখন গাঞ্জা জমা দেয়ার সময়? তাও আবার এইখানে? ...ভাগ শালা হারামখোর। "
নুরা পাগলা পালিয়ে আসে।
-হাফিজ সাহেব! সি সি ক্যামেরাটা উত্তর দিকে লাগাবেন......
৪
সকাল ৮: ৩০
৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৪
স্থানঃ গেণ্ডারিয়া স্টেশনের প্লাটফরম
আজ নুরা একটু সকালেই ঘুম থেকে উঠে। তার পুরান ব্যবসা শেষ। তার নতুন ব্যবসা এখন ভিক্ষাবৃত্তি।
সেজন্য তার অবশ্য নতুন কিছু করা লাগেনি। আগের সুরুতেই দেদারসে ভিক্ষা করা চলে। শুধু একটা নোংরা প্লাস্টিকের বাটি লাগবে। আজকে স্কুলে প্রচুর লোক সমাগম ঘটবে। কারন আজ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
প্লাটফরমে বসে নুরা বিড়ি খেতে থাকে, তার সাথে একটি প্লাস্টিকের বাটি। সে অপেক্ষা করতে থাকে উপজুক্ত সময়ের।
...যথা সময়ে সে উঠে দাড়ায়। হাঁটতে থাকে স্কুলের দিকে। আশ্চর্য! সে যেন একদিনেই অনেক বুড়িয়ে গেছে।
আজ তার স্কুলের সামনে আসতে অনেক সময় লাগে। স্কুলের সামনে এসে সে হতাশ হয়। ভোটার সংখ্যা হাতেগোনা। সে গেটের সামনেই বসে থাকে। সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
নিরাপত্তা এখন ভালোই। তবে সারাদিন নিশ্চই এমনটি থাকবে না..
সকাল ১১: ৪৫
স্থানঃ খোকন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
শীত কমার সাথে সাথে ভোটার সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। কয়েকজন সাংবাদিক রিপোর্ট রেডি করছেন। কিছু সাংবাদিক আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর লোকদের সাথে কথা বলছে। তাদের সাক্ষাতকার নেয়ার প্রস্তুতি চলছে।
দূর থেকে একজোড়া বিচক্ষন চোখই কেবল মহেন্দ্রক্ষণটা ধরতে পারলো। দ্রুতই সে স্টেশনে ফিরে আসে। সে খুজতে থাকে! খুজতে থাকে!! তার হাতে জীবনের শেষ বিড়ি। সময় খুবই কম...
অবশেসে উজ্জ্বল লাল প্যান্ট পরা লোকটিকে সে দেখতে পায়। তার কাছে গিয়ে কোনোমতে সে বলে,
-“ভাই আগুন হবে? আগুন? সিগারেট জ্বালাবো।
”
লাল প্যান্ট যেন যম দেখার মত ভয় পেয়ে যায়। তার হাত কাঁপতে থাকে, কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে। কাঁপা কাঁপা হাতে সে কোনমতে লাইটারটা নুরা পাগলাকে দেয়।
নুরা চলে গেলে, লাল প্যান্ট তার মোবাইল ফোন বের করে। সেভ করা একটি নাম্বারে ডায়াল করে শুধু তিনটি শব্দই বলতে পারে “বস! সিগন্যাল গ্রিন।
”
পর পরই সব কিছু নিরব হয়ে যায়।
৫
সন্ধা ৬:০০
স্থানঃ হাসপাতাল
কবির খান এইমাত্র তার ছেলেকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠালেন। যাক দেশের এই অবস্থার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত অপারেশনের টাকা ম্যানেজ করা গেছে। টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে “সারা দেশের ৩১ টি ভোট কেন্দ্রে গ্রেনেড হামলা। নিহত ৪৭৮ জন, আহত ৮০০ জনেরও বেশী।
আহতদের মধ্যে অনেকের একাধিক অঙ্গহানি হয়েছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ”
কবির খান অপারেশন থিয়েটারের সামনে পায়চারি করতে লাগলেন। এখন তার খুবই সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। নাহ! আর সিগারেট খাওয়া যাবে না।
তিন ঘণ্টা পর ডাক্তার এসে জানালো অপারেশন ভালো হয়েছে। তার ছেলে এখন বিপদ মুক্ত। কবির খান নিশ্চিন্ত হয়ে হাসপাতালের নিচে নামলো।
হাসপাতালের নিচটা এখন মানুষে ভরপুর। কারো হাতের কব্জি উড়ে গেছে, কারও মাথা ফেটে গেছে, কারও বা...
বর্তমানে নিপাট ভদ্রলোক কবির খান! হাসপাতালের নিচে ইন্সপেক্টর কাশেমের সাথে একবার শীতল দৃষ্টি বিনিময় হলো শুধু।
******************************************************************
এরপর কাহিনী খুবই সংক্ষেপ এবং সবারই জানা। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলী নেতা সহ সুশীল সমাজ তাদের পূর্বের মুখস্থ করা অংশ গুলো পাঠ করতে লাগলেন। এদিকে রাষ্ট্রও কিছুটা উদারতা দেখালো, আহতদের ২০ হাজার টাকা এবং নিহতদের ২ লক্ষ করে টাকা দেয়ার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে। সাথে সাথে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক!
জাতীয় পতাকাও তিনদিন নষ্টদের কাছে মাথা নুয়িয়ে রাখল! শুধু তিরিশ লক্ষ শহীদ আর বাংলাদেশের মানচিত্র নষ্টদের ধিক্কার জানালো।
(৩ জানুয়ারি, ২০১৪)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।