লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই
দেখামাত্রই মেয়েটির প্রেমে পড়ে যাই আমি। মেয়েটির সমস্ত শরীর জুড়ে টের পাই একটি ভাবের অস্তিত্ব, শরীরের শুধুমাত্র দুটো জায়গা দিয়ে ভাবটি বের হয়ে আসতে চায়; তার সমস্ত মুখমন্ডল দিয়ে আর দুটি হাতের পাঁচ-পাঁচ দশটি আঙ্গুল দিয়ে। কিন্তু ভাবগুলো তার মসৃণ ত্বক ভেদ করে বের হয়ে আসতে পারেনা। ভাবের উত্তেজনায় তার মুখমন্ডল ও হাতের আঙ্গুলগুলোকে ফোলা-ফোলা দেখায়। ফোলা-ফোলা আঙ্গুলগুলোকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসে, অনেক কষ্টে দুরন্ত ইচ্ছাটাকে চেপে রাখি।
কিন্তু আমার চোখদুটোকে শুধু অবারিত হতে দেই, তার মুখমন্ডল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে; ঠোট দুটো স্পর্শ করতে গিয়ে টের পাই একটি অদম্য বন্দী হাসি, আমি কারাগারের দরজা খুঁজতে থাকি, হাসিটিকে মুক্ত করবো বলে, কিন্তু শত অলিগলি ঘুরেও দরজা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হই। তাই তার ঠোটের রেখা ছেড়ে বেরিয়ে; গন্ডদেশে, কপালে, থুতনিতে বিচরণ শুরু করি। সেখানে অনুভব করি চৈত্র মাসের কাঠ ফাটানো রোদ –কোমলতার ভেতরে অস্বাভাবিক উষ্ণতা। প্রচন্ড তাপে হাসফাস করতে করতে একটু শীতলতার আশায় ওর চোখের মধ্যে নেমে পড়ি। বরফগলানো জলে চোখটি কানায় কানায় ভরা, কুচি কুচি বরফ জলের উপর ভাসছে।
আমার মনের উষ্ণ লাল তরল প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে যেতে থাকে, থর-থর করে কাঁপতে থাকি আমি। কি করবো ভেবে না পেয়ে, সমস্ত শারীরিক, মানসিক শক্তিকে কোনমতে একত্র করে, এক দৌড়ে মুখমন্ডলের প্রান্তর ছেড়ে বেরিয়ে আসি।
তার পর কেটে গেছে পাঁচ-পাঁচটি বছর; এই পাঁচ বছরে আমার মনের ঘোলা জলে প্রেমের কত অসংখ্য বুদ-বুদ উঠেছে, আবার মিলিয়েও গেছে। আমি তাকে খুঁজিনি, আর সে হয়তো আমাকে মনেও রাখেনি। আমিও তাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু এই পাঁচ বছর, আমি তার গন্ডদেশ, কপাল, থুতনির ভীষণ উষ্ণতা, চোখের শীতলতা ও ঠোটের বন্দী হাসি হৃদয়ে করেছি অনুভব।
গভীর রাত্রি, চারদিকে সুনসান নীরবতা। শব্দরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কেউ মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে আড়মোড়া ভাঙ্গছে আর কেউ বা হাই তুলছে; এই যাঃ আমার মাথার ভেতরের অগোছালো চিন্তা-সুতা আরো বেশী করে প্যাঁচ খাচ্ছে; যতই জট খোলার চেষ্টা করছি ততই জড়িয়ে যাচ্ছে। তখন ভাবনার জগত ছেড়ে আমি টালমাটাল পায়ে হেটে প্রবেশ করি ভিন্ন এক দ্বিমাত্রিক জগতে। সেখানেই দেখা হয়ে যায় দেবীর সাথে; যেখানে তাকে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায় না; শুধুমাত্র দেখা যায় তার নিশ্চল কিছু ছবি আর শোনা যায় কালো কালো সুতায় জড়ানো কিছু কথা।
দেবীর সাথে অন্তরঙ্গতায়, ত্রিমাত্রিক জগত ছেড়ে পুরোপুরিভাবে নিজেকে দ্বিমাত্রিক জগতে সমর্পণ করি।
শুরু হয় আমাদের কণ্ঠস্বরবিহীন, কালো সুতায় জড়ানো আলাপচারিতা। বিভিন্ন ভাবের আদান-প্রদান করতে করতে একসময় তার সামনে জানু পেতে বসে ভেজা কণ্ঠে বলি ফেলি, তোমাকে আমি ভালবাসি দেবী। সে আমার শুষ্ক কঠিন কাঁপা-কাঁপা হাত দুটি ধরে টেনে তুলে, পরম স্নেহে বসায় তার পাশে, তার হৃদয়ের ঝর্ণা ধারার মৃদু শব্দ আমি শুনতে পাই, আর তার বন্দী হাসিটি মুক্তি পেয়ে চতুর্দিক এক উজ্জ্বল আভায় ভরিয়ে দেয়। খরগোশের গর্তের মত গালে টোল ফেলে জিজ্ঞেস করে, কবে থেকে আমাকে তুমি ভালবাসো প্রিয়তম? প্রিয়তম শব্দটি আমার বুকে কালীর মত নৃত্য শুরু করে; দেহের সমস্ত কোষ উলট-পালট হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। আমি ভেঙ্গে চুড়ে যেতে থাকি নিজের ভেতরে, সম্পূর্ণভাবে ধংশ হয়ে যাওয়ার পর; ধংশস্তুপের ভেতর থেকে নতুন করে জন্ম লাভ করি।
নতুন জন্মের আমেজে রাঙ্গা হয়ে বলিঃ যেদিন তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম পাঁচটি বছর আগে ত্রিমাত্রিক জগতে এক মধ্যাহ্নে।
আমি কেটে যাওয়া পাঁচটি বছর কে অনুভব করতে থাকি চারঘণ্টার চরম অস্তিত্বময়তায়। তারপর দেবীর কণ্ঠস্বরের জগতের ঠিকানা চেয়ে নিয়ে; এক দৌড়ে তার কণ্ঠস্বরের জগতের দরজার কাছে পৌঁছে দ্রুত কড়া নাড়তে শুরু করি। ও দরজা খুলে দেয়, ওর কণ্ঠস্বর শুনি; পাঁচবছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা আমার রক্তকনিকা গুলো ধীরে ধীরে জেগে উঠে। আমি বেশীক্ষণ ওর কণ্ঠস্বরের জগতে অবস্থান করতে পারি না, উত্তেজনায় ভীষণরকমে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
আর সাধারনত দেবী রাত্রিতে এতক্ষণ জেগে থাকেনা; ওর নিশ্চয় ঘুম পাচ্ছে। দেবীকে ঘুমুতে যেতে বলে ফিরে আসি নিজের ডেরায়।
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, ঘরের জানালা দিয়ে সূর্য প্রবেশ করে একচিলতে রোদ হয়ে। আমি বিষণ্ণ মাছরাঙ্গা হয়ে জেগে থাকি-পাশেই মাছভর্তি পুকুর থাকলে যেমন মাছরাঙ্গা ঘুমুতে পারেনা। বাহিরে যাই, সিগারেট আনি, ধোঁয়া উড়াই আর জেগে থাকি।
দ্বি-মাত্রিক জগতে আমার যাতায়াত ঘন হতে শুরু করে। ওই জগতের প্রতি আমার নেশা অদ্ভুত রকমভাবে বেড়ে যায়। আর এই জগৎটাও আজকাল বড়ই জনাকীর্ণ হয়ে উঠেছে ,দিন-রাত সবসময় মানুষের পদধ্বনিতে মুখর হয়ে থাকে। এখানে তারা রাজনীতি করে, সাহিত্য চর্চা করে, খোশ আলাপে মশগুল হয়, প্রেম করে এবং অনেকে নিছক অস্তিত্ব জাহির করে। এই জগতে ঢুকেই আমি আনাচে-কানাচে গলিপথে, কঠিন পাথরের দেয়ালের ওপাশে দেবীকে খুঁজে বেড়াই।
পথের পাশে বেঞ্চিতে কেবল তারই প্রতীক্ষায় বসে থাকি। অনেকের সাথে দেখা হয়, কেউ কেউ “হাই-হ্যালো” বলে অভিবাদন জানায়; আমি প্রত্যুত্তরে শুধু “হাই” বলে নিরস মুখে বসে থাকি । অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে একসময় তার দেখা পেয়ে যাই। দেবী নকশা করা সাদা একটি ফতুয়া গায়ে চাপিয়ে, সূর্যমুখি ফুলের মত উত্তরাকাশের পানে তাকিয়ে আছে। তার ধ্যানে মগ্নতা তাকে দেখেই ভগ্ন হয়।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে দেবীকে অভিবাদন করি; সে আমাকে ইশারায় ডেকে তার পাশে বসতে বলে। আমি মৃদুপায়ে হেঁটে গিয়ে তার পাশে বসি। বন্দী হাসিটিকে সে মুক্ত করে দেয়, সেটি বুনো হাসের মত উড়াল দিয়ে বেরিয়ে আসে। আমি বুনো হাসটিকে ধরে কয়েকটি পালক উঠিয়ে কানের কাছে গুজে রাখি। দেবীর হাতটিকে নিজের দু-হাতের মধ্যে টেনে এনে বলিঃ জানো, আমার কোন ধরনের শৃংখল নেই; আমি কোন ধরনের সামাজিক প্রথা, বন্ধন, নিয়মকে স্বীকার করিনা কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষেরই সম্ভবত কোন না কোন জায়গায় শৃংখলিত হওয়া দরকার, শৃংখলিত হওয়া ছাড়া সে বাঁচতে পারে না।
দেবী, তোমার ভালবাসার শিকলে আমাকে বন্দী কর, একটু শৃংখলিত হওয়া বড় বেশী প্রয়োজন আমার। দেবী আমার কথা শুনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে বলে, আমি শৃংখলিত করতে ভালবাসি, তোমার পায়ে আমি ভালোবাসার সোনালী শিকল পরাবো। আমার হৃদয় উষ্ণ হয়ে উঠতে থাকে, শরীরে রক্ত চলাচল দ্রুত হয়। আমি প্রেম অনুভব করতে থাকি, এক-পাক্ষিক নয় দ্বি-পক্ষিক। হাড়ের ভেতর শ্যাওলা জমে গিয়েছিল সেগুলো ধীরে মুছে যেতে থাকে, আমি ঝরঝরে হয়ে উঠতে থাকি ক্রমাগত ভাবে।
এ প্রেমকে আমি বিশ্বাস করতে চাই, স্পষ্ট করে অনুভব করতে চাই। রহস্যময়তা আমাকে পাকে জড়িয়ে ফেলে, স্পষ্টতা আমাকে মুক্তি দেয়। তার প্রেমে জড়িয়ে আমি আনন্দ পেতে চাই, অনুভব করতে চাই অপার্থিব সুখ। অল্প একটু সুখ, সামান্য আনন্দ, একফোটা উষ্ণতা চাই; চাই বেঁচে থাকার নিতান্ত প্রয়োজনে।
মাঝে মাঝে আমি দেবীর কণ্ঠস্বরের জগতে কড়া নাড়ি, সে আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা করে ভেতরে ডেকে নেয়।
তার আহ্বানে আমি মদিরার গর্জন শুনি। আমার যে কি অনির্বচনীয় অনুভূতি হয়! সমস্ত শরীর, মন, আত্মা, হৃদয় অগ্নিগিরির লাভার মত প্রচন্ড রবে কোলাহল করতে করতে জেগে উঠে –মনে হয় যেন অসম্ভব শক্তিদায়িনী মাতাল করা কোন উগ্র টনিক পান করছি। সে কথা বলতে শুরু করে, আর আমার মনটি ডানা ঝাপটিয়ে চতুর্দিকে পাক খেতে শুরু করে। আমি উন্মাদের মত তার কণ্ঠস্বরকে; হাতে, পায়ে, চোখে-মুখে মাখতে থাকি। কথা বলতে বলতে সে ক্লান্ত হয়ে উঠে, শুনে আমি মুগ্ধ ,সার্থক ও অস্তিত্ববান হই।
হৃদয়ের গভীর থেকে খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন রঙের অনুভূতিগুলোকে কাঁপা হাতে তুলে আনি, পাশাপাশি সাজাই, উলট-পালট করি আবার সাজাই, ঘষা মাজা করি, বিভিন্ন ধরনের রস মিশ্রিত করি, মনোহারী অলংকার পরাই, কিছু চিত্রকল্প মনের অজানিতে আপনি ভেসে উঠে, তারপর তাদেরকে কালো অক্ষরের গ্রন্থিতে ঢেলে দেই, ওগুলো পরিনত হয় আমার আরেকটি সত্ত্বায়। দেবীর কণ্ঠস্বরের দরজার নিচ দিয়ে পাচার দেই। প্রায় সাথে সাথেই আমার কণ্ঠস্বরের দরজায় দেবীর কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাই। শুনতে ভাল লাগে, আলস্যে জড়িয়ে যাই; উঠে দরজা খুলতে ইচ্ছে করেনা। কড়া নাড়ার শব্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও আমি শব্দের রেশ শুনতে পাই।
কিছুক্ষন আলস্যে জেগে থাকার পর, উঠে গিয়ে দেবীর কণ্ঠস্বরের দরজায় মৃদু শব্দে কড়া নাড়ি। প্রথম নাড়াতেই দরজা খুলে আমার দিকে রাগী চোখে তাকায়। মুখের রাগান্বিত ভাবটি আরো ঘনীভূত করে বলেঃ আমি যখন কড়া নাড়লাম তখন দরজা খুললে না কেন? তুমি যাও তোমার সাথে আর কথা বলবনা। আমি বলি, -এইবারের মত ক্ষমা করো দেবী, তোমার দরজায় কড়া নাড়তে ভীষণ ভাল লাগে যে; তাই বার বার কড়া নাড়ি। মুখের মধ্যে একটু উষ্ণতা এনে বলেঃ এবারের মত ক্ষমা করা হল, কারন আমাকে নিয়ে লেখা তোমার কবিতাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।
খুব কবিতা লেখা হচ্ছে আজকাল তাই না? দেবীর উষ্ণতায় আমার রক্তের শীতলতা একটু কমে আসে। একটু জিরিয়ে নিয়ে বলিঃ কবিতা! কবিতা লেখার সাধ্য কি আমার আছে দেবী! যদি কবিতা না আসে জন্মের আহ্বান নিয়ে, যখন অনুভূতি গুলো এসে জমা হতে থাকে আমার হৃদয়ের জরায়ুতে, ভাবনার রক্ত চলাচল দ্রুততর হয়; তারপর অনুভূতি গুলো সুন্দর সুন্দর অবয়ব পেতে থাকে, জীবন রসে সিঞ্চিত হয়। ওগুলো আমার ভেতরে নড়াচড়া করতে শুরু করে, ওদের অস্থিরতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, পরিণত হয় একটি আলাদা স্বত্বায় । তীব্র সুখের প্রসব বেদনা শুরু হয়ে যায় আমার ভেতরে। আমি কোনমতে, তাকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করে পুলকিত হই, শিহরণ বোধ করি, ওকে বুকের কাছে নিয়ে আদর করতে চাই, নরম তুলতুলে গালে চুমো খেতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু ও ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বাতাসে হরেক রকমের বিচিত্র শব্দ তুলে তোমার কাছেই চলে আসে। ও যেন আমার নয় কোনকালে ছিলও না, ও বিশ্ব মানব মনের ।
দ্বিমাত্রিক জগতে খুঁজতে খুঁজতে আবার দেবীকে একদিন রাত্রির প্রথম প্রহরে আমি পেয়ে যাই। চোখে চশমা লাগিয়ে, পুরো মুখের আনাচে–কানাচে একটি একটি অদ্ভুত গাম্ভীর্য ছড়িয়ে সে একটি গাছের তলায় বসে আছে। তার চতুর্দিকে গভীর কাজের স্তুপ।
সমস্ত মনোযোগকে একত্র করে সে কাজে মগ্ন হয়ে আছে–আমি ভয়ে ভয়ে ত্রস্ত পায়ে তার নিকটে গিয়ে দাড়াই। সে চশমার ফাঁকে আমার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বসতে বলে। আমি কাজের স্তুপের মধ্যে একটুখানি ফাঁক খুঁজে নিয়ে বসে পড়ি। দেবী আমার চোখে সরাসরি রৌদ্রোজ্জ্বল দৃষ্টি ফেলে মৃদু উচ্চারনে বলে, তোমাকে শুনতে আমার ভালো লাগে, তুমি বলো আমি শুনি। অনেকদিন পর ওকে পেয়ে আমার সবটুকু হৃদয়োচ্ছ্বাস এক দমকে বের হয়ে আসতে চায়।
আমি কোনমতে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করি। হৃদয়ে সামান্য একটা নালী কেটে কথার স্রোতকে আস্তে আস্তে বইয়ে দিতে থাকি। ও মাথা দোলায়, হু -হা করে, কাজের ফাঁকে দু- একটি কথার প্রত্যুত্তর দেয় শুধু মাত্র। আমার সংকোচ বোধ হতে থাকে, বলি তুমি কাজে ব্যাস্ত –আমি তাহলে আজকে যাই। দেবী চোখ না তুলেই বলেঃ না তুমি থাকো, আমি শুনছি তো তোমার কথা।
আমি হৃদয়ের নালী আরেকটু ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি।
সে হঠাৎ করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, বলেঃ -তুমি কিছুক্ষণ বসে অপেক্ষা করো আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। কাজের স্তুপগুলোকে মাথায় উঠিয়ে গজেন্দ্রগমনে হেটে চলে যায় সে। আমি গাছের ছায়ায় বসে অপেক্ষা করতে থাকি। দেবী আর ফিরে আসেনা, আমি অপেক্ষা করতে থাকি।
অপেক্ষা আমার মাথার উপর ভারী পাথর হয়ে চেপে বসে। ধীরে ধীরে মাথায় অপেক্ষার পাথর সমেত ধৈর্যের সুচাগ্র বিন্দুতে পৌছে যাই। পড়ে যেতে যেতে আকড়ে ধরে থাকি । বিন্দু বিন্দু স্বপ্নেরা মাথার ভেতরে জমা হতে থাকে। স্বপ্নের জগতে তাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা আরো বেশী তীব্রতর হয়।
গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে নরম আলস্যে ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি।
দেবীর কন্ঠস্বরের দরজায় কড়া নাড়ছি আমি; একবার, দুইবার, তিনবার, চারবারের বেলায় সে দরজা খুলে দেয়। আমি সেদিন রাত্রে তার আর ফিরে না আসার কারন জানতে চাই। দেবী উৎফুল্ল হয়ে বলেঃ আমি তোমাকে নিয়ে স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম, তাই আর ফিরে আসতে পারিনি; রাগ করোনা প্লীজ। শুনে আমার হৃদয়টা ফুলে উঠে, ভেসে উঠে, ডানা মেলে আরব সাগরের স্বচ্ছ নীল পানিতে সাতার কাটতে থাকে।
বেগ সামলাতে গিয়ে আমি মৌন হয়ে পড়ি।
ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি দরজায় কড়া নাড়তে- নাড়তে। ব্যাথায় আঙ্গুল টনটন, মাথা ঘোরে ঝিম ঝিম; ক্ষ্যাপা আমি কড়া নাড়তেই থাকি। দেবী দরজার নীচ দিয়ে একটি চিরকুট পাচার করে, “গরম দুধে আমার পা পুড়ে গেছে, তুমি আজকে ফিরে যাও আরেকদিন এসো”। অস্তিত্বের আলোড়নকে অনেক কষ্টে বাক্স বন্দী করে পাথুড়ে উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে হোচট খেতে খেতে নিজ কক্ষে ফিরে এসে কবিতায় অবগাহন করে কিছুটা সুস্থ বোধ করি।
দেবী যেন আজকাল মাটির প্রতিমায় পরিণত হয়েছে। দ্বিমাত্রিক জগতে শুধু তার নিশ্চল ছায়া মূর্তিটুকুই দেখা যায়। লাল পেড়ে কাপড় পড়ে অস্ফুট হাসিতে মুখটা সামনের দিকে বাড়িয়ে রয়েছে। কালো লাইনের সজীব গ্রন্থিতে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিশ্চল ছায়ামূর্তি দেখে তার কণ্ঠস্বর শোনার আগ্রহটা আমার তীব্র হয়ে উঠে।
দেবীর কণ্ঠস্বরের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করি, দশবার – বিশবার – ত্রিশবার ---------------ক্লান্তিতে, অস্থিরতায় দরজার পাশে বসে পড়ি। উন্মাদের মত দু-হাত দিয়ে জোরে জোরে মাটি আচড়াতে থাকি–বের হয়ে আসে এলোমেলো কিছু ভাব। সেগুলোকে কালো গ্রন্থিতে পুরে দরজার নিচ দিয়ে পাচার করে দেই। কিছুক্ষণ পর দেবী একটি চিরকুট পাঠায়, “ মন ভালো নেই প্রচন্ড শোক-জ্বর তপ্ত আমি । আমার ঘনিষ্ঠ একজন আমাদেরকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন”।
আমার মনে ভাবনা আসে, মানুষ কি শুধুমাত্র চলে যাওয়ার সময় কাঁদায় ,থাকতে কাঁদাতে পারেনা; আমার যাওয়ার সময়ও কি সবাই কাঁদবে? কিন্তু আমি তো যাওয়ার সময় কাউকে কাঁদাতে চাইনা, কেন কাঁদাবো; কাঁদিয়ে কি কোন লাভ আছে? আমি তো যাওয়ার সময় সবাইকে উল্লাসে ভরাব, ফূর্তিতে মজাবো, আনন্দে নাচাবো । বেঁচে থাকব এমন কালা পাহাড় যে, আমি গেলে যেন সকলের হাড় জুড়োয়, হাফ ছেড়ে বাঁচে, পরম শান্তিতে যেন রাত্রে ঘুমায়।
দেবীর স্বপ্নে, আশায়, নেশায়, কন্ঠস্বরের কামনায় কাটতে থাকে আমার সময়ের পালাক্রম । দ্বিমাত্রিক জগতে কঠিন পাথরের দেয়ালের ও পাশে শুধু মাত্র দেবীর ফিসফিসানি শোনা যায়। দেয়াল ভেদ করে দেবীর কাছে আমি পৌঁছুতে পারিনা।
আমি দেবীর ফিসফিসানি শুনতে পেয়েও তার কাছে না পৌঁছুতে পারার যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যেতে থাকি। আমার হৃদপিন্ডটা কে যেন ধারালো চাকু দিয়ে ফালা ফালা করতে থাকে।
হঠাৎ করে দেয়ালের ওপাশ থেকে দেবীর হাহাকার করা চিৎকার শুনতে পাই। সে কান্না ভেজা কন্ঠে একটি ছেলের মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করতে থাকে বার বার। জিহবার নরম আলোড়নে ছেলেটির পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি জানাতে থাকে সমবেদনা।
মৃতের প্রতি তার ভালোবাসা জেগে উঠে। মৃতের প্রতি তার ভালোবাসার অনুভূতিগুলোকে ছুড়ে দিতে থাকে। আমি ভয় পেতে শুরু করি, তাহলে দেবী কি শেষমেশ ওই মৃত ছেলেটির প্রেমে পড়ে গেলো! আমার ঈর্ষাগুলো সার বেঁধে ছেলেটির দিকে বুলেটের গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে।
কে এই ছেলেটি, কেন সে মারা গেল; তাকে কি আমি চিনি, কোথাও দেখেছি তাকে? এরকম হাজারটা প্রশ্ন আমার মনে গুঞ্জন শুরু করে। আস্তে আস্তে মনে পড়তে থাকে, অনেক কিছু, দুই–তিন বছর আগে আমিই তো ছিলাম সেই ছেলেটি, আমার ভেতরেই ওর বসবাস ছিল, আমার সত্ত্বারই একটি অংশ ছিলো সে।
তার পর আমিই তো তাকে একাকী নির্জন প্রান্তরে ফেলে চলে এসেছি। প্রাণ ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসেছি পালিয়ে, আর ও একাই লড়ে যাচ্ছিলো অকুতোভয়; সমস্ত অমানবিকতা, অসঙ্গতি, বৈষম্য, প্রেমহীনতা ও নষ্ট সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে। আর এগুলোই তো ওকে মেরে ফেলেছে। যুদ্ধ করতে করতে ও যখন ভীষণ ক্লান্ত, শ্রান্ত, অস্থির, অসম্ভব একাকী তখন প্রেমহীনতাই তো তাকে শেষ আঘাতটা দিয়েছে, এক ধাক্কায় মৃত্যু-কূপে ফেলে দিয়েছে। সকল নষ্টামী, ভন্ডামীকে ও জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল; করতে চেয়েছিল ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো।
সবকিছু জ্বালাতে গিয়ে নিজে কি একটু জ্বলতে চেয়েছিল প্রেমের আগুনে? প্রেমের উষ্ণতায় অবগাহন না করতে পেরেই কি একটু বিশ্রামের আশায় ও কাকড় বেছানো লৌহপথে ঘুমিয়ে পড়েছে!
যে গাছ একটুখানি প্রেম রসের অভাবে শুকিয়ে মরে গিয়েছে তার গোড়ায় প্রেম রস ঢালার আর কি কোন দরকার আছে? ঢালতে তো হবে সে গাছে, যেটি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এখনো মারা যায় নি। আমিই তো সেই গাছ, যেটি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে; মারা যাচ্ছে নিঃসঙ্গতা ও প্রেমহীনতার তীব্র দহনে। আমি কোথায় পাব এতটুকু প্রেম বেঁচে থাকার নিতান্ত প্রয়োজনে। অন্ন-বস্ত্র –বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার পাশাপাশি একটু প্রেমও যে আমার ভীষণ দরকার। দেবী কি আমাকে একটু প্রেম দেবে? তীব্র খা খা করা বৈষম্য রোদে, অমানবিকতার মরুভুমিতে আমি পড়ে রয়েছি, প্রেম পিপাসায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
একটু প্রেম রস না হলে যে, নিজেকে নিতান্তই বাঁচাতে পারবোনা! ওই হতভাগা ছেলেটির মত আমারও যদি কাঁকড় বেছানো লৌহপথে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, তাহলে আমাকেও জীবন থেকে হারিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমার যে বেঁচে থাকতে বড়ই ইচ্ছে হয়।
আমি প্রেম বুভুক্ষু, তাই মিছিল বের করবো প্রেমের দাবীতে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা- চিকিৎসার দাবীতে যদি মিছিল হতে পারে, তাহলে প্রেমের দাবীতে কেন মিছিল হতে পারবে না! প্রেমের জন্য মিছিলে কি আমার পাশে কেউ থাকবে? কেউ থাকুক না থাকুক আমি একাই মিছিল বের করব? কিন্তু একা কি মিছিল হয়, মিছিল করতে তো অনেক লোক লাগে, আমি আমার সবগুলো স্বত্বাকে ডেকে একত্রিত করবো, তাদের সবাইকে নিয়ে মিছিল বের হবে। কিন্তু ত্রিমাত্রিক জগতের রাজপথে আমি কি এই মিছিল বের করতে পারবো? লোকে কি আমাকে পাগল বলবেনা? কিন্তু মিছিল আমি বের করবই , কারন প্রেম আমার ভীষণ রকম দরকার, ওটি না হলে আর চলবেনা; প্রেম আমার চাই-ই চাই।
আমার শরীরের সমস্ত রক্ত আথালি-পাথালি শুরু করে দিয়েছে, হাড়-মাংশ অনবরত শ্লোগান দিচ্ছে। আমি মাথায় লাল ফেটি বেঁধে, অন্ধের মত বেগে ছুটে যাই দ্বিমাত্রিক জগতের দিকে, দেবীর বিশাল একটি ছবি দিয়ে ব্যানার তৈরী করি, ছোট ছোট ছবি দিয়ে অনেকগুলো প্ল্যাকার্ড। শুরু হয়ে যায় মিছিল, একটুখানি প্রেমের জন্য মিছিল। অখন্ড মেঘের মত চরাচর কাপিয়ে মিছিলটি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বিদ্যুৎ বেগে মিছিলের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
মিছিলের সামনে ব্যারিকেড পড়ে, দাঙ্গা পুলিশ লাঠি বাগিয়ে মিছিল লক্ষ্য করে দৌড়ে আসতে থাকে। আমার মধ্যে কোন ধরনের ভয় কাজ করে না। আমি মিছিলটি নিয়ে আরো তীব্র বেগে এগিয়ে যেতে থাকি। যথারীতি মিছিলের খবর দেবীর কানেও পৌঁছে যায়। সে রেগেমেগে অস্থির হয়ে মিছিলের সামনে চলে আসে।
তাকে দেখে আমার হৃদস্পন্দন থেমে যাবার যোগাড় হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ কমে আসে। সে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি অনেক বাড়-বেড়ে গেছো, তোমার সাহসতো কম নয়; আমার ছবি দিয়ে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড বানিয়ে প্রেমের মিছিল বের করেছো! মিছিলটি এখুনি বন্ধ কর। তার হুকুমে আমি রোবটের মত কাজ করতে শুরু করি, সাথে সাথে ব্যানার গুটিয়ে ফেলি, প্ল্যাকার্ড গুলো নামিয়ে ফেলি আর স্লোগানগুলো ক্ষীণতর হতে হতে একসময় স্তব্ধ হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়া স্লোগানগুলো কিন্তু ঠিকই আকাশে, বাতাসে গুঞ্জরিত হতে থাকে-প্রেম চাই, প্রেম চাই ; সোনার শিকলে বন্দী কর, করতে হবে ; ভালবাসার দাবি মেনে নাও, মানতে হবে। দেবী পিছনের দিকে আর না তাকিয়ে সামনের দিকে গটমট করে হেটে চলে যায়।
দেবীর মুখে ঐ সময় প্রেম এবং হাতে সোনালী শিকল না থাকলেও তাকে দেখে আমার অস্তিত্ব কিছুটা সার্থকতা পায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।