না-ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গতকাল সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে মধ্য কলকাতার বেসরকারি বেলভিউ ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে ২৪ ডিসেম্বর এ হাসপাতালে ভর্তি হন সুচিত্রা সেন। তার পর থেকে এক দিনের জন্যও তার শারীরিক অবস্থার কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটেনি।
কখনো স্থিতিশীল কখনো বা সংকটে। সকালের দিকে একটু ভালো থাকলেও বিকালের পর থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ নিয়ে ডাক্তাররাও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। টানা ২৫ দিনের জীবন-মৃত্যুর লড়াই শেষ হয় শুক্রবার। মৃত্যুকালে রেখে যান কন্যা মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রাইমা ও রিয়া সেনকে।
তারা তিনজনই চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠিত নায়িকা। পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় বালিগঞ্জ প্লেসের (৫২/৪/১ ভেদান্ত) বাড়িতে। সেখানে আত্দীয়রা শেষ শ্রদ্ধা জানান। সেখান থেকে গোলপার্ক-রাসবিহারী অ্যাভিনিউ হয়ে বেলা ১টা ১০ মিনিটে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। সেখানে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রাকন্যা মুনমুন সেন, সুচিত্রার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. সুব্রত মৈত্র, কলকাতার মেয়র শোভন দেব চট্টোপাধ্যায়, কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিত কর পুরকায়স্থসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ ছাড়াও এ দিন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন সুচিত্রার নাতনি রিয়া ও রাইমা সেন, অভিনেতা প্রসেনজিৎ, দেব, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শোহম, জুন মালিয়া, চিত্রপরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। এরপর রাজ্য সরকারের তরফে প্রয়াত সুচিত্রা সেনকে গান স্যালুট দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়। বেলা ২টা নাগাদ চন্দন কাঠের চুলি্লতে পোড়ানো হয় সুচিত্রা সেনের মরদেহ। এর আগে সুচিত্রা সেনের মৃত্যু সংবাদ জানার পর সকালেই হাসপাতালে ছুটে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহানায়িকাকে শ্রদ্ধা জানাতে হাসপাতালে যান কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম, সিপিআইএম নেতা তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, রবীন দেব।
প্রিয় নায়িকার মৃত্যু সংবাদ পেয়েই এ দিন হাসপাতাল চত্বরেও অসংখ্য মানুষ ভিড় করে। অভিনেত্রীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই চলচ্চিত্র জগতে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে শিল্পী, কলাকুশলী, রাজনীতিবিদ প্রত্যেকেই। সুচিত্রা সেনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। সুচিত্রাকন্যা মুনমুন সেনকে পাঠানো এক শোকবার্তায় সুচিত্রাকে লিজেন্ডারি আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, 'দুই যুগের বেশি সময় তিনি বাংলা ছবিকে শাসন করেছিলেন।
তার মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রজগৎ একজন প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীকে হারাল, যে ক্ষতি অপূরণীয়। ' তার অসামান্য অভিনয়ের মধ্য দিয়েই তিনি গুণমুগ্ধদের মাঝে বেঁচে থাকবেন বলে শোকবার্তায় উল্লেখ করেন রাষ্ট্রপতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে বলেন, 'একটা মহীরুহ চলে গেল। আজ বড় দুঃখের দিন। কেউ কারও বিকল্প হয় না।
বিশ্বে এ রকম মানুষ একটাই জন্মায়। আজ দেখে মনে হলো তিনি খুব শান্তিতে চলে গেলেন। ' তার আত্দারও শান্তি কামনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সুচিত্রা সেনের চলে যাওয়াটা একটা সময়ের অবসান বলে বর্ণনা করেন অভিনেত্রী-চলচ্চিত্রকার অপর্ণা সেন। তিনি বলেন, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আমার সে রকমভাবে কথা বলা বা দেখা করার সুযোগ না হলেও তাকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু উনি কোনো দিনই তাতে রাজি ছিলেন না।
পর্দায় সুচিত্রা সেনের উজ্জ্বল উপস্থিতি বরাবরই মুগ্ধ করেছে বলে মত অপর্ণা সেনের। বলিউড অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন শোক জ্ঞাপন করে বলেছেন, 'সুচিত্রা সেন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তার মৃত্যুতে আমি শোকাহত। তার অনন্য অভিনয়ের মধ্য দিয়েই তিনি বাংলা ছবিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। হিন্দি চলচ্চিত্রে তিনি অসামান্য ছাপ রেখেছিলেন। ' অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, সুচিত্রা সেনের মৃত্যু বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার জন্য বড় ক্ষতি যা কোনো দিনই পূরণের নয়।
সুচিত্রা সেনকে নারীশক্তির প্রতীক বলে উল্লেখ করে অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা বলেন, তিনি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রজগতেই নন বিশ্ব চলচ্চিত্র মানচিত্রেও সুবিদিত ছিলেন। আমি তাকে সম্মান করি। তিনি মানুষের মনের মধ্যেই বেঁচে আছেন এবং তার পরিচিত হাসির মধ্যেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে হারানো সুর ছবিতে অভিনয় করা বিশিষ্ট অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় সুচিত্রা সেনকে বাঙালির গর্ব বলে আখ্যায়িত করে বলেন, 'তার ছবি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, কর্মজীবনে উনি খুব দায়িত্বশীল ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মজীবনকে কীভাবে আলাদা করে রাখা যায় তা তার কাছেই শিখেছি।
সুচিত্রা সেনকে একজন বিস্ময় বলে উল্লেখ করে তার আত্দার শান্তি কামনা করেন তিনি।
সুচিত্রা সেনকে বাঙালির মস্ত বড় আইকন বলে উল্লেখ করে অভিনেত্রী ললিতা চ্যাটার্জি বলেন, 'হার মানা হার' ছবিতে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল, তার থেকে বয়সে ছোট ছিলাম, সেই ছবির মধ্য দিয়েই আমরা খুব কাছে আসি। অত বড় একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে ছবি করতে গিয়ে আমার খুব ভয় হতো, কিন্তু তার সঙ্গে মেশার পর সে ভুল ভাঙে। তার ছবি দেখার জন্য পাগলের মতো ছুটতাম।
লিলি চক্রবর্তী বলেন, সুচিত্রা বড় মাপের অভিনেত্রী ছিলেন।
কাজ করার সময় সহযোগিতা করতেন। তার সঙ্গে কাজ করতে কোনো সমস্যাই হতো না। তার অভিনীত ছবিগুলো সব সময়ই চিরন্তন থাকবে। বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী সুচিত্রা সেনের আত্দার শান্তি কামনা করে বলেন, আমি একজন অসাধারণ অভিনেত্রীকে হারালাম। বাংলা ও হিন্দি ছবিতে তার অসামান্য অবদানের কথাও স্মরণ করেন মোদী।
১০টা ২০ মিনিটে হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের কাছে সুচিত্রার প্রয়াণ সংবাদ ঘোষণা করেন। সুচিত্রাকন্যা মুনমুন হাত জোড় করে সংবাদমাধ্যমকে প্রণাম জানান। বলেন, 'মায়ের হয়ে আপনাদের প্রণাম'। সুচিত্রার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই যে ভিড় শুরু হয়েছিল হাসপাতালের বাইরে, সে ভিড়ই কার্যত জনসমুদ্রে পরিণত হলো শ্মশানে। রবীন্দ্রসদনে তার ছবি রাখা হয়।
বেলা ২টা থেকে সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করে সাধারণ মানুষ।
আলোর মুখ দেখেনি প্রথম ছবি : ১৯৫২ সালে 'শেষ কোথায়' ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রজগতে পা রেখেছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি সুচিত্রা অভিনীত প্রথম ছবিটি।
সত্যজিৎ ও রাজ কাপুরকে 'না' : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'দেবী চৌধুরানী' উপন্যাস অবলম্বনে ছবি বানাতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। ছবিটিতে সুচিত্রা সেনকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু শিডিউল জটিলতার কারণে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল সুচিত্রাকে। সুচিত্রা সেনকে না পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে আর কখনই 'দেবী চৌধুরানী' ছবিটি তৈরি করেননি সত্যজিৎ রায়। ১৯৭৪ সালে 'দেবী চৌধুরানী' ছবিটি নির্মাণ করেন দীনেন গুপ্তা। ছবিটিতে প্রফুল্লমুখী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। 'মেরে নাম জোকার' খ্যাত হিন্দি চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেতা, প্রযোজক ও নির্মাতা রাজ কাপুরের ছবিতে কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন।
সে সময় আর কে ফিল্মসের ব্যানারের ছবিতে অভিনয়ের জন্য মুখিয়ে থাকতেন প্রায় সব অভিনয়শিল্পী। এ ক্ষেত্রে রাজ কাপুরের মতো নির্মাতার ছবিতে অভিনয় না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরল নজিরই গড়েছিলেন সুচিত্রা।
দাদাসাহেব ফালকে প্রত্যাখ্যান : হিন্দি চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতি বছর সম্মাননা প্রদান করে ভারত সরকার। চলচ্চিত্রের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এ সম্মাননা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব সম্মাননা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি।
সম্মাননা নিতে কলকাতা থেকে দিলি্ল যেতে চাননি বলেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুচিত্রা।
আন্তর্জাতিক পুরস্কার : সুচিত্রা সেনই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম অভিনেত্রী, যিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। 'সাত পাকে বাঁধা' ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব থেকে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান তিনি।
উত্তমকুমারের আগে নিজের নাম : মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে জুটি বেঁধে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় জুটি হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন উত্তম-সুচিত্রা। চলচ্চিত্র প্রযোজকদের সুচিত্রা বলেছিলেন, ছবির পোস্টারে উত্তমকুমারের আগে তার নামটাই যাওয়া উচিত।
বলিউডেও মজবুত আসন : অসাধারণ অভিনয়শৈলী আর সাবলীল অভিনয় উপহার দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে একচেটিয়া সাফল্য পাওয়ার পাশাপাশি বলিউডেও মজবুত আসন গেড়েছিলেন সুচিত্রা সেন। 'দেবদাস', 'অাঁধি' ও 'মমতা'র মতো ছবিতে সুচিত্রার অভিনয়প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন অগণিত দর্শক। শরৎচন্দ্রের 'দেবদাস' উপন্যাস নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। হিন্দি ভাষায় নির্মিত 'দেবদাস' ছবির প্রথম পার্বতী হয়েছিলেন সুচিত্রা। বিমল রায় পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৫ সালে।
ছবিটিতে দিলীপকুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন সুচিত্রা।
স্বাধীন ও দৃঢ়চেতা : ব্যক্তিজীবনে স্বাধীনচেতা সত্তার পরিচয় দিয়েছেন সুচিত্রা সেন। দৃঢ় মনোবলের অধিকারী নারী হিসেবেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি। তার মেয়ে মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রাইমা ও রিয়া সেনও অভিনয়জগতে সাফল্য পেয়েছেন। বাংলা ও হিন্দি ছবিতে পরিচিত নাম মুনমুন, রাইমা ও রিয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।