আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আল-কায়েদা আবার শিরোনামে

লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু।


কথিত সন্ত্রাসী উসামা বিন লাদেনকে একটি নাটকের মাধ্যমে হত্যা করার পেছনে আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল, তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও আমরা আম জনতার ধারণা ছিল, আল-কায়েদার যবনিকাপাত ঘটেছে। সম্প্রতি সে ধারণায় চিড় ধরতে শুরু করেছে। কারণ, এত দিন আল-কায়েদার সরব বিচরণ শুধু আফগানিস্তানেই ছিল।

কখনো-সখনো বিভিন্ন প্রদেশ দখল করে একদিকে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের কসরত যেমন তারা করত, তেমনই ‘তথাকথিত’ শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি হলো বলে তাদের আবেগটাও প্রশমিত হত। এদের নানা উৎপাত আফ্রিকাতেও কালে-ভদ্রে খুব অভদ্রভাবেই উপচে উঠার চেষ্টা করে। মিডিয়া তখন নানাভাবে এই সব সংবাদকে যে কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, মিডিয়া এই সব ধর্মান্ধদের কাছ থেকে মুক্তি চায়। তবে মিডিয়া চাইলেও খুব শি¹ির বোধ হয়, এ থেকে মুক্তি মিলবে না।



বিতর্কিত ফিল্ম ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম্স’ প্রদর্শন ও প্রকাশের হুজুগে উত্তপ্ত লিবিয়ায় মার্কিন কনসাল আক্রমণের যে ঘটনা ঘটে, তাতে আমেরিকার প্রচারণা, এটা নির্ঘাত আল-কায়েদার কাজ! অর্থৎ প্রমাণের চেষ্টা যে, সাধারণ মানুষজন তা করতে পারে না। তা তারা যতই ক্ষুব্ধ হোক। সাধারণ জনতার সে ক্ষমতা নেই। তবে আল-কায়েদা গোষ্ঠীর ক্ষমতা আছে। ভয়ঙ্কর আল-কায়েদার ব্যাপারে এরা তাই আগে থেকেই সোচ্চার এবং এজন্যই দীর্ঘমেয়াদি সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধ।

এভাবেই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পক্ষে যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা।

বলেছি, আফ্রিকার নানা দেশেও কখনো নিজ নামে, কখনো ভিন্ন নামে আল-কায়েদা সক্রিয় বলে মিডিয়া প্রচার করে থাকে। তাদের প্রকাশিত শক্তিমত্তাকে জনতার সংঘটিত শক্তির নামে প্রকাশ করায় বেশ বিপদ আছে। এতে তাবেদার শাসকগোষ্ঠীর থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু আল-কায়েদার নামে প্রচরণায় কোনো ঝুঁকি নেই; বরং সুবিধা বেশি।

এ-তো এক চিরস্থায়ী বায়বীয় শত্রু, যার কোনো অবয়ব নেই, সুকীর্তি নেই, কখনো হবেও না। এভাবে প্রচার করলে মার্কিনিসহ পশ্চিমা কোনো মিডিয়ার সামনেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না। শত্রু নিধনে এ-এক সহজ পথ।

মুসলিম বিশ্বের শাসকরাও নিজেদের অপরাধকে আড়াল করার জন্য জনতার ক্ষোভ প্রকাশকে আল-কায়েদার, ক্ষেত্রবিশেষে জঙ্গিদের কর্মকাণ্ড বলে প্রচার করে থাকে। এতে দেশের অভ্যন্তরে ক্ষোভ প্রশমিত না হয়ে বাড়লেও ক্ষতি নেই।

আন্তর্জাতিক মহলে বিরোধী পক্ষকে দমন করার এ-এক মোক্ষম হাতিয়ার। মিডিয়া তা সহজে হজম করে নেয়। এই ধরুন, শরিয়া-তন্ত্র খোদ সৌদি আরবে সাধারণ জনতার ক্ষোভ প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। সংগঠিত কোনো জনতা যখনই এক সাথে হওয়ার আয়োজন করে, তখনই আল-কায়েদা বা জঙ্গি-জমায়েত বলে একে চ্ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয়।

এতদিন এ-তো ছিল নিজের অপরাধ আড়াল করার অন্যতম অস্ত্র।

এখন আবার এই আল-কায়েদাকে নিয়ে চমৎকার এক জেহাদি খেলা শুরু হয়েছে। এ খেলার সূচনা অনেক আগে আমেরিকার হাতেই হয়েছিল, তা সবারই জানা। সাম্প্রতিক এক খবরে প্রকাশ, ফাল্লুজা এখন আল-কায়েদার দখলে! হতে পারে, বরং এটাই স্বাভাবিক। কারণ, শিয়া শাসিত ইরান আর ইরাক যদি সাধারণ কোনো মোর্চা গঠন করে সুন্নি-বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়, তাহলে তথাকথিত খাদেমুল হারামাইন শরিফাইনের গদি নির্ঘাত উল্টে যাবে। মার্কিন সরকার এখন যা শুরু করেছে, তাতে সৌদ পরিবারের রাজত্বে গজব নেমে আসতে পারে যে কোনো সময়।

এর সমর্থনে ছোট্ট দুটি উদাহরণ টানা যায়। (ক) ইতিমধ্যে মার্কিনসহ আণবিক বোমার শক্তিধর মালিকরা ইরানের সঙ্গে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। (খ) সিরিয়া বিষয়ে লিবিয়ার মতো গুরুতর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না। তাই সবই চলে যাচ্ছে ইরান সমর্থিত বাশার আল-আসাদের পক্ষে। সৌদি সরকারকে তাই এই মুহূর্তে দ্রুত রাশ টেনে ধরতে হচ্ছে।

এই সূত্রেই সৌদি-রাজ নতুন খেলায় মত্ত হয়ে পড়ে।

ইতিপূর্বে সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপে যে সব সুন্নি তথা আল-কায়েদার সদস্য ছিল, তাদেরকে অস্ত্র সংগ্রহ করে খোদ সৌদি সরকার। বোঝা যায়, এই আল-কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় সৌদিই হল এখন বৈশ্বিক মাধ্যম। কিন্তু মার্কিনি সিদ্ধান্তে তাদের হতাশা জাগলে তারা এই আল-কায়েদাকে সিরিয়ার বাইরে ইরাকেও ব্যবহার করতে থাকে। কারণ, সিরিয়া তো একটু দূর ভূগোলের বিষয়।

ঘরের কাছের ইরাককেও যদি ব্যতিব্যস্ত না রাখা যায়, তাহলে তো ইরাকের শিয়ারা সুন্নি সাদ্দামের মতো বেপরোয়া হয়ে হঠকারী যে-কোনো কাজ করে বসতে পারে।

এদিকে আল-কায়েদার অন্ধ সমর্থকরাও এ বিষয়ে বেশ উল্লসিত। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে, বিশেষত আফগানিস্তানে তালেবানদের শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা সৌদি সরকারের সমর্থনবঞ্চিত। এবারে যেন তাদের পালে হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। তারা এতে বেশ উদ্দীপ্ত।

তবে শিয়া-বিরোধিতার নামে যেভাবে আলকায়েদাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে সৌদির কোনো দূরদর্শী ভাবনা কাজ করছে বলে মনে হয় না। এ নিয়ে পাক-আফগান পরিণতির কথা তাদের সামনে থাকলে বা ন্যূনতম বিবেচনায় থাকলে এধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হাজার বার ভাবতে বাধ্য হত।

তাহলে তথাকথিত আল-কায়েদা বা এর সমর্থকদের কী করার আছে? এ পর্যন্ত যতগুলো ঘটনায় আল-কায়েদা জড়িত থাকার অভিযোগ এসেছে, তা কি সত্যি আল-কায়েদার, নাকি অন্য কোনো গোষ্ঠীর অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড, তা নির্ণয় করা হয় নি। এখানে বড় একটি উদাহরণ টানা যায় টুইনটাওয়ার আক্রমণ নিয়ে। এই আক্রমণের পর আমেরিকাবিদ্বেষী সবাই লাফ দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে।

আবার যখন তালেবান বা আল-কায়েদা দমনের হিড়িক চলে, তখন সেই উল্লাসীরাই বলতে থাকে, এটা পূর্ব পরিকল্পিত এবং তা খোদ আমেরিকার কাজ বা ইহুদিদের কাজ! কেউ কেউ তো এ-যে ইহুদিদের কাজ, এনিয়ে এন্তার যুক্তি দিয়ে যাচ্ছে। সেই সব আল-কায়েদাসমর্থকদের মাথায় বোধহয় কাজ করছে না যে, এতে আল-কায়েদার ভার লাঘব হয়ে যাচ্ছে! প্রশ্ন হল, কেন তাহলে এই দ্বৈত ভূমিকা! আবার যে কোনো অঘটনের পর মিডিয়ায় দেখা যায়, আল-কায়েদা ইন্টারনেটে বিবৃতি দিয়ে বা সংবাদমাধ্যমে ফ্যাক্স করে এ বিষয়ে দায় স্বীকার করছে! এটা কি আল-কায়েদার স্বীকৃত ওয়েবসাইট থেকে দেওয়া হচ্ছে, নাকি সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী জাল কোনো আইডি থেকে তা করছে, তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু আল-কায়েদার অপমূর্তিকে শিখণ্ডি হিসাবে দাঁড় করিয়ে সকল অপকর্ম আড়াল করার জন্য শাসক ও সুবিধাবাদী আন্তর্জাতিক চক্রের জন্য এই বিবৃতিই যথেষ্ট। অবাক কাণ্ড হল, পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা একে নিজেদের কৃতিত্ব হিসাবে ভেবে বেশ তৃপ্তি পান। অথচ সত্যিই একাজে আল-কায়েদা জড়িত কি-না, তা তার নিজেরও জানা নেই।

আবার জানার আগ্রহও নেই।

অন্তত আমাদের দেশে যাদেরকে আল-কায়েদার সমর্থক বলে ভাবা হয়, তাদের অধিকাংশের জ্ঞানের পরিধি, তা ধর্মীয় বা জাগতিক যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন, নিতান্ত সীমিত। ধর্মের সুদূরপ্রসারী, সুগভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়-আশয় এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরা একান্ত অজ্ঞ। ধর্মের বাহ্যিক জ্ঞান-গরিমাকে এরা নিজেদের হাতিয়ার বলে মনে করে। এমন কি তাদের ব্যাখ্যার বাইরে যে আরো ভিন্ন রকম কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে, তা যেমন বুঝতে চায় না, আবার বুঝলেও মানতে চায় না।

জাগতিক ব্যাপারে এদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা না বলাটাই শ্রেয়। কারণ, এরা জাগতিক বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান রাখে না, রাখতে চায় না। সব কিছুকে এরা নিজেদের ক্ষুদ্র বিশ্ববোধের আলোকে পরিমাপ করতে চায়। ধর্মীয় জ্ঞানের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যার উদাহরণ হিসাবে আনা যায় জিহাদবিষয়ক আয়াত ও হাদিসগুলো। এ আয়াত ও হাদিসগুলোর ব্যাখ্যা এরা যেভাবে দেয়, তার বাইরে কিন্তু নানা রকম ব্যাখ্যা আছে, যা এরা মানতে নারাজ।

এমন কি কেউ যদি তাদের কৃতব্যাখ্যায় যৌক্তিক কোনো প্রশ্নও তুলে, তাহলে সুযোগ পেলে তাকে কতল করবে। তা না পারলে নাস্তিক-মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে ভিন্নতর ব্যাখ্যাটাকে নিজের এবং অন্যের দৃষ্টির আড়ালে রেখে দেবে।

এদের জাগতিক ব্যাখ্যার সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বলা যায়, মুসলিমবিশ্বে অমুসলিমদের হস্তক্ষেপবিষয়ে। এরা শুধু একে ধর্মীয় গণ্ডিতেই সীমিত রাখতে চায় এই বলে যে, আল-কুফরু মিলাতুন ওয়াহিদাহ: সকল কুফরি শক্তি পরস্পরে এক ও অভিন্ন। অথচ অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের সাথেও, এমন কি দলের সাথেও কথিত কুফরি শক্তির দস্তুরমত যোগাযোগ রয়েছে।

যেমন সালাফি বা হিজমত মুভমেন্ট। অপরদিকে অমুসলিম শক্তি উত্তর কোরিয়া বা ভেনেজুয়েলার ব্যাপারে আমেরিকা বেশ খড়গহস্ত! এরা এ নিয়ে কথা বলতে পারে না বা বলতে চায় না।

সে যাই হোক, প্রয়োজন পড়লে আমেরিকা নিজেও তথাকথিত এই আল-কায়েদাকে সাহায্য করবে। যেমন করেছে রুশ-আফগান যুদ্ধে। লিবিয়াতেও প্রাথমিকভাবে আল-কায়েদার সাহায্যে গাদ্দাফি-বিরোধী যুদ্ধকে উত্তপ্ত করেছে।

সিরিয়াতেও তা চেষ্টার আওতায় ছিল। সাময়িকভাবে এতে টান পড়েছে মাত্র। তবে, এখন সৌদি এদের নিয়ে কার্যোদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে, অন্তত ইরাক ও সিরিয়ায়। এতে ইরাক-সিরিয়া বা দূরের আমেরিকার কতটুকু লাভ-ক্ষতি হবে, বলা মুশকিল। কিন্তু যারা আল-কায়েদার নামে দোহার টানেন, তারা কি এনিয়ে ভবিষ্যতের নিশ্চিত কোনো গন্তব্য দেখতে পান? নাকি গোর্খা সৈন্যদের মতো অন্যের হাতিয়ার হয়ে নিজের জান দেওয়াটাই তাদের কাছে জিহাদ ও শাহাদত-বরণের একমাত্র উপায়?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।