আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাসাব্লাংকা থেকে নর্থ এন্ড

ক্ল্যাসিক সিনেমা কাসাব্লাংকায় দেখানো ক্যাফেটির নাম সিনেমা পাগল ছাড়া অন্যদের তেমন মনে থাকার কথা নয়, যদিও ওই ক্যাফের ভেতরেই ঘটে সিনেমার পুরো ঘটনা। একটু ক্লু ধরিয়ে দেয়া যায়, সিনেমার শুরুর দিকে এবং মাঝেমধ্যেই ক্যাফের বাইরের নিয়ন সাইন জ্বলতে-নিভতে দেখা গেছে। লেখা- ‘রিকস’ ক্যাফে আমেরিকান’। হ্যা, সিনেমার দেখানো ক্যাফেটির মালিক তার দোকানের নামেই জানান দেন ভদ্রলোকের নাম রিক এবং তিনি আমেরিকান।

ঢাকার ক্যাফের মালিক রিক হাবার্ড নিজেকে দোকানের মালিক মনে করার চেয়ে বরং নিজেকে কফি প্রেমিক মনে করতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।

দোকানের সাইনবোর্ডেও নিজের নামটি ঝোলাননি। ঢাকার কফি প্রেমিকদের কাছে দোকোনের সোজা সাপ্টা পরিচিতি ‘নর্থ এন্ড’।

তবে হ্যা, ক্যাসাব্লাংকা সিনেমার ক্যাফে আর ঢাকার নর্থ এন্ড, দুটি ক্যাফের অবস্থানগত একটি মিল আছে বটে। আমেরিকায় ভ্রমণপিপাসুদের দুটি ক্যাফের দোড়গোড়ায় আসতেই হয়। সিনেমাতে দেখা গেছে যুদ্ধ আক্রান্ত ফ্রান্স থেকে যারা আমেরিকায় নতুন জীবনের খোঁজে যেতে চায় তারা সন্ধ্যায় আসে রিকের ক্যাফেতে, সেখানে মার্কিন ভিসার খোজ পাওয়া যায়।

আর ঢাকার নর্থ এন্ড একেবারে আমেরিকান দূতাবাস লাগোয়া।

বারিধারায় মার্কিন দূতাবাস থেকে বেরিয়ে প্রগতি সরনী ধরে রামপুরার দিকে তিন-চারটি ভবন পরেই দোতালায় সাইনবোর্ড চোখে পড়বে। না, কাসাব্লাংকার মতো ওখানে নিয়ন সাইন জ্বলে-নেভে না। কফি রংয়ের সাদামাটা সাইনবোর্ডে লেখা ‘নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স’।

কফি বিন রোস্টিং হয় এখানে।

অমিল আবারও। সিনেমার রিক চরিত্রে হামফ্রি বোগার্ট যেখানে দাপুটে মালিক, সন্ধ্যায় ক্যাফেতে চুরুট টানেন, ঢাকার রিক একেবারেই তার উল্টো। প্রতি সকালে রীতিমতো গতর খাটেন ক্যাফেতে। যদি নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে থাকে চলে আসুন, প্রতিদিন সকালে দেখতে পাবেন রিক কফি রোস্টিং করছেন।

আরও একটি বিষয়, ঢাকার রিক রীতিমতো তামাক নিষিদ্ধ করে রেখেছেন তার আড্ডায়।

তবে, একেবারে নেশামুক্ত নন রিক। বললেন, “কফি রোস্টিং আমার কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে। এমন নয় যে, এখানে আমি নিজে না করলে রোস্টিং ভালো হবে না। মনির এই ক্যাফের শুরু থেকেই আছে। ওর হাত আমার মতোই ভাল।

তবুও এই কাজটি নিজে করতেই ভালো লাগে। ”

মনির হোসেন নর্থ এন্ডের সবচেয়ে পুরোনো কর্মী। প্রথম যে ৩ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন রিক, তাদের একজন। এখন প্রথম শাখাটির ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন।

খাটাখাটনি করেন রিকের স্ত্রীও।

মার্কিন কফি চেইন স্টারবাকসের কফি মাস্টার সার্টিফায়েড রিকের স্ত্রী ক্রিস হাবার্ডের মুন্সিয়ানা পেস্ট্রি শেফ হিসেবে। পড়ালেখা করেছেন, নরউইচের কিং আর্থার বেকিং এডুকেশন সেন্টারে। (ফের অমিল কিন্তু! সিনেমার রিক তার প্রনয় জীবনে পোড় খাওয়া একাকী, সংসারহীন)।

ফলে, নর্থ এন্ড মানে হচ্ছে রিকের কফি এবং ক্রিসের পেস্ট্রি। পাওয়া যাবে নিজেদের তৈরি চকলেট ব্রাউনি, বিস্কোত্তি, পাম্পকিন ক্রিম চিজ মাফিন বা সিনামন রোল।

কেবল বেকিং নয়, নর্থএন্ডের ইনটেরিয়র প্ল্যানিংও ক্রিসেরই করা। “এই যে কফির জন্য ব্যবহৃত চটের ব্যাগ থেকে পর্দার আইটেম, বা যেখানে বসে কফি খাচ্ছেন সেখানে দৃষ্টিসীমার মধ্যেই দেখতে পাবেন ঠিক যেখাবে কফি রপ্তানী হয় সেই বস্তার ভেতর কফি বিন। রোস্টিং মেশিনও আপনি দৃষ্টিসীমার মধ্যেই পাবেন। ”

আবেগের ছোঁয়া পাওয়া যায় রিকের গলায়, “এটা কেবল যে আমরা কীভাবে প্রসেস করি সেই বিষয়ে স্বচ্ছতা তা নয়, এটা কফি তৈরির গোটা প্রক্রিয়া অনুভব করায়”।

রিকের আবেগের ক্যাফেতে কফির তালিকায় কী কী আছে জানতে হলে আসুন চোখ বুলিয়ে নেই নর্থ এন্ডের ওয়েবসাইট নর্থএন্ডকফি ডটকম-এ।

সুমাত্রা মানদেলিং, ডিক্যাফ সুমাত্রা, ব্রাজিল, কোস্টা রিকা, ইথিওপিয়া ওয়াশড সিদামো, অর্গানিক ইথিওপিয়া সিদামো এবং  গুয়াতেমালা ব্লেন্ড। পাশাপাশি চমক আছে বাংলাদেশিদের জন্য। আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের আছে ‘স্পেশাল’ হিল ট্র্যাক্ট ব্লেন্ড। আর রোস্টিংয়ের ধরন অনুসারে আছে এসপ্রেসো রোস্ট আর ফ্রেঞ্চ রোস্ট।

প্রগতি সরনীর প্রথম শাখা ছাড়াও নর্থ এন্ডের ২টি শাখা আছে গুলশানের লেইক শোর হোটেলে আর আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে।

সেইসঙ্গে নর্থ এন্ডের কফি বিন পাওয়া যাবে মূল শাখা আর গুলশানের ইউনিমার্টে।

প্রায় ৪০-৪৫ জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে ক্যাফেতে। তবে মজার বিষয় হল কফিপ্রেমিকদের কয়েকটি ধরন লক্ষ করা গেল দিনের বিভিন্ন সময়ে। সকাল থেকে বিকেল অব্দি সাধারণত বিদেশীরা আসেন এখানে। অনেকেই ল্যাপটপ ব্যাগে নিয়ে চলে আসেন কফি পানের পাশাপাশি কাজ করার জন্য।

ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের সুবিধাটি ব্যবহার করা সম্ভব এখানে। সন্ধ্যার পর ভিড় বাড়ে স্থানীয় ‘ইয়ং প্রফেশনালদের’। আর বিকেলে অনেক সময়েই আসেন ছাত্র-ছাত্রীরা। এদের পাশাপাশি আসেন যারা কফি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারা।

সবাই যে কেবল কফির দোকানে কাজ করার জন্যই প্রশিক্ষণ নেন, এমন নয়।

চাইলে যে কেউ ভর্তি হয়ে যেতে পারেন ৩ দিনের মোট ৯ ঘন্টার কোর্সে। স্রেফ কফির দোকানে কাজ করার জন্যই এই কোর্স-ব্যাপারটি এমন নয়।

“দেখুন, কফি হচ্ছে একটা এক্সপেরিয়েন্স, একটা ভালো সময় কাটানো। ”-বললেন রিক।

মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের বস্টনে ইতালিয়ান অধ্যুষিত এলাকায় বড় হওয়ার কারণে এবং পরে স্টারবাকস-এর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করার জন্য যতোটুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে, সেইটি শেয়ার করছেন তিনি আগ্রহীদের সঙ্গে।

পাশাপাশি ক্রিসের কাছে পেস্ট্রি এবং বেসিক কেক ডেকোরেশনের প্রশিক্ষণ পাওয়া যাবে।

একটু খেয়াল করলে নর্থ এন্ডের একটি সীমাবদ্ধতা চোখে পড়বেই। কফি আর পেস্ট্রি আইটেম। এর বাইরে কোনো ঝাল স্বাদের সুযোগ নেই এখানে।

রিক বললেন, “আমার প্রথম শর্তই ছিল কোয়ালিটি ঠিক রাখা।

ঝাল আইটেম সেটা স্যান্ডউইচ বা ফ্রাই যাই রাখিনা কেন, আমাকে আউটসোর্স করতে হবে। আর বাইরে থেকে খাবার নিতে হলে সেটার মান ঠিক রাখাটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আরও একটি বিষয় হল আমরা এটাকে কেবল একটি পছন্দের কফির দোকান হিসেবেই রাখতে চেয়েছি। ”

দোকানটি যে আপদমস্তক কফির সেটি বোঝা যায় দোকানে ঢোকার আগেই। কফির ঘ্রান টের পাওয়া যাবে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়ই।

কফি প্রেমিকরা হয়তো আরেকটু আবেগ নিয়ে বলবেন, ‘মাতাল করা ঘ্রান’, কফি প্রেমিকদের টেনে নিয়ে আসার পেছনে যার অবদান অনেকটাই।

রিক বললেন, “এসপ্রেসো বা আমেরিকানো যারা পছন্দ করেন, তাদের এখানে আসতেই হবে”।

খানিকটা যেন মিল পাওয়া গেল- কাসাব্লাংকা সিনেমার সঙ্গে নয় বরং ওই সিনেমার প্রথম স্ক্রিপ্টের সঙ্গে। কারণ ওই চিত্রনাট্যের নাম ছিল ‘এভরিবডি কামস টু রিক’স’।

 

ছবি: হাসান বিপুল




সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।