সমাজ যত সভ্য হয়, নারীবিরোধী প্রথা যা আছে, বিদেয় করা হয়। প্রথাগুলো বিলুপ্ত হতে থাকে। সভ্যতার শর্তই এই, নারীরা মানুষ হিসেবে সমানাধিকার পাবে। নারীর বিরুদ্ধে যত বৈষম্য আছে, সবকিছুর চিরকালীন বিদেয় হবে। হতেই হবে।
এ ছাড়া কোনও সমাজই সুস্থ সমাজ বলে চিহ্নিত হতে পারে না।
পতিতাবৃত্তির মেয়েদের জীবিকার জন্য অন্য ব্যবস্থা না হলে হয়তো পতিতাবৃত্তি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে না। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, পতিতাবৃত্তির সমস্ত মেয়ের জীবিকার ব্যবস্থা যতদিন না করা হবে, ততদিন এই বৃত্তিটি থাকা উচিত। ক্রীতদাসপ্রথা যখন বিলুপ্ত করা হয়, তখন সেই অমানবিক প্রথাটি বিলুপ্ত করার জন্যই বিলুপ্ত করা হয়। সব ক্রীতদাসের কাজের ব্যবস্থা করে তারপর সেই প্রথা বিলুপ্ত করা হয়নি।
আগে তো বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাক মানুষ। সতীদাহপ্রথা যখন বিলুপ্ত করা হয়, বিধবা মেয়েদের কে নেবে, কোথায় যাবে, তাদের খাওয়াবে পরাবে কে, তার ব্যবস্থা করে তারপর বিলুপ্ত করা হয়নি।
জগতে নারীবিরোধী প্রথার শেষ নেই। নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য যদি নারী পুরুষ উভয়ের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য চর্চা ছড়িয়ে যেতে বাধ্য। অনার কিলিং বলে একটা ঘৃণ্য পুরুষতান্ত্রিক প্রথা সমাজে বিরাজ করছে।
প্রথাটি নির্ভেজাল হত্যাকাণ্ড। যদি মনে করা হয় মেয়েরা পরিবারে অসম্মান বয়ে আনছে, তবে সেই মেয়েদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যায় বিশ্বাস করা হয় যে বংশের সম্মান বা হৃতগৌরব ফিরে পাওয়া যায়। যে যে কারণে বংশ ভাবে যে বংশ যায়, তা হলো ১. মেয়েরা যদি আত্দীয়দের ঠিক করা পাত্রকে বিয়ে করতে রাজি না হয়, ২. মেয়েরা যদি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, ৩. ধর্ষিতা হয়, ৪. মেয়েরা যদি স্বামীকে, এমনকি অত্যাচারী স্বামীকেও তালাক দিতে চায়, ৫. মেয়েরা যদি ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন গোত্রের বাইরে কাউকে বিয়ে করে, ৬. মেয়েরা যদি সামাজিকভাবে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। ...সাধারণত এইসব কারণে মেয়েদের হত্যা করা হয়।
হত্যা করে মেয়ের স্বামী, বাবা, ছেলে বা ভাই।
অনার কিলিং কোনও একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তবে দেখা যায় মুসলিম দেশগুলোতে এর চর্চাটা বেশি। কিছু কিছু রাষ্ট্র অনার কিলিংকে এক ধরনের সমর্থনও করে। জর্ডানে কোনও মেয়ে যদি পরিবারের লোকেরা তাকে মেরে ফেলবে এই আতঙ্ক নিয়ে পুলিশের কাছে সাহায্য চাইতে যায়, পুলিশ সেই মেয়েকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জেলখানায় পুরে রাখবে।
সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে এক মেয়ে আবেদন করেছিল, তাকে যে জেলে পুরে রাখা হল তো হলই, যদিও কোনও অপরাধই মেয়েটি করেনি, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জেলখানা থেকে বের হওয়ার তার কোনও স্বাধীনতা রইল না। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, মেয়েদের যদি জেলখানা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, সেই পরিবারের লোকদের হাতেই তাদের তুলে দেওয়া হয়, যারা তাদের খুন করার জন্য বদ্ধপরিকর। এই মেয়েদের যখন হত্যা করা হয়, তাদের এমনভাবে কবর দেওয়া হয় যেন কার কবর তার চিহ্ন না থাকে।
অনার কিলিং বা অনার ক্রাইম মেয়েদের বিরুদ্ধে নির্যাতন। রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য এই নির্যাতন থেকে মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়া।
অনেক দেশে এমন অপরাধের বিরুদ্ধে সরকার নিষ্ক্রিয় থেকে অথবা এসবকে আভিজাত্যের চর্চা বলে অপরাধকে একরকম মেনেই নেয়। তখন পুলিশের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তদন্ত চালানো।
প্রতি বছর পাঁচ হাজার মেয়েকে এই ক্রাইমের শিকার হতে হয়। পাকিস্তানে খুব হয় এই ক্রাইম। ও-দেশে একে বলে কারো কারি।
কারো কারি নিয়ে সরকারেও কোনও উদ্বেগ নেই। কারণ পাকিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কৃতির এত গভীরে ঢুকে গেছে মেয়েদের সম্পত্তি ও সম্মান মনে করার মানসিকতা, যে সরকারও মেয়েদের পরিবারের কারও দ্বারা নিত্যদিনের খুন হয়ে যাওয়াটাকে একরকম দেখেও না দেখার ভান করে। পাকিস্তানের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অনার ক্রাইম ঘটেছিল ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে। লাহোরের আঠাশ বছর বয়সী সামিয়া বিখ্যাত মানবাধিকার আইনজীবী হিনা জিলানি আর আসমা জাহাঙ্গীরের অফিসে গিয়েছিল অত্যাচারী স্বামীকে তালাক দেওয়ার জন্য। সামিয়া যখন আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছে, তখন সঙ্গে একটা লোক নিয়ে সামিয়ার মা ঢোকে ঘরে, লোকটা কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে সামিয়ার কপালে গুলি করে।
ঢলে পড়া মৃত সামিয়ার গায়ে আবারও গুলি চালিয়ে বেরিয়ে যায় হত্যাকারী। একবারও পেছনে না ফিরে হত্যাকারীর পেছন পেছন বেরিয়ে যায় সামিয়ার মা। সামিয়া তার স্বামীকে তালাক দেবে, এতে সামিয়ার বাবার সম্মান ধুলোয় লুটোবে, তাই সম্মান রক্ষা করতে সামিয়াকে লোক পাঠিয়ে খুন করলো সামিয়ার বাবা। সামিয়ার মাও পরিবারের সম্মান এতটাই রক্ষা করতে চায় যে নিজের কন্যার জন্য এতটুকু করুণাও তার হয়নি। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, এই ঘটনাটি সকলে জানে, সামিয়ার প্রভাবশালী বাবা বা পরিবারের কেউ অস্বীকার করেনি যে তারা হত্যা করেনি সামিয়াকে।
কিন্তু আজ অবধি খুনির শাস্তি হয়নি। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে পাকিস্তানের কোনও রাজনৈতিক দলই এই অনার ক্রাইমের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। বরং সংসদ থেকে দাবি উঠেছে দুজন আইনজীবীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির।
জর্ডানের আইন অনার ক্রাইমকে সমর্থন করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, জর্ডানের দণ্ডবিধির ৩৪০ ধারা বলছে, স্বামী বা রক্ত সম্পর্কের আত্দীয় একটি মেয়েকে অবৈধ সম্পর্ক রক্ষার অপরাধে খুন করলে কোনও শাস্তিই ভোগ করতে হবে না।
জর্ডানে ১৯৯৪ সালে অবিবাহিত অবস্থায় গর্ভবতী হয়েছিল বলে আঠারো বছর বয়সী একটি পঙ্গু মেয়েকে জেল খাটতে হয়েছিল। জেল থেকে ছমাস পর বেরোনোর পর তাকে খুন করেছে তারই সতেরো বছরের ভাই। খুনের পর পরিবারের সবাই খুব স্বস্তিতে আছে, খুব সুখে। খবরটা তারাই চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে, আর কোনও চিন্তা নেই, মেয়েকে খুন করা হয়ে গেছে। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে ১৯ বছরের ভাই হুসেইন সুলেয়মান একটা পিকআপ ভ্যান তিন তিনবার চালিয়ে নিয়েছিল তার অবিবাহিত ছমাসের গর্ভবতী বোনের ওপর।
বোন কাতর অনুনয় করছিল যে সে দোষী নয়। কোনও লাভ হয়নি। কেবল জর্ডান নয়, সিরিয়ার দণ্ডবিধির ৫৪৮ ধারা বলছে, যে পুরুষ তার স্ত্রীকে বা পরিবারের কোনও মহিলাকে বয়সে বড় বা ছোট, অথবা বোনকে যদি ব্যভিচার করতে দেখে, তবে খুন করবে, একজনকে অথবা দুজনকে, এতে কোনও শাস্তি সে পাবে না।
মরক্কোর দণ্ডবিধির ৪১৮ ধারা বলছে, স্ত্রী ব্যভিচার করলে স্বামী মেরে ফেলবে। এতে দোষ নেই।
হাইতির দণ্ডবিধির ২৬৯ ধারা বলছে, স্বামী তার স্ত্রীকে আর তার প্রেমিককে হাতে নাতে ধরে ফেললে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলতে পারে, ক্ষমা পেয়ে যাবে।
১৯৯১'র আগে ব্রাজিলের আইনে বংশের সম্মান রক্ষার তাগিদে মেয়েদের মেরে ফেলার অধিকার পুরুষের ছিল। আইনটি এখন নেই, কিন্তু এখনও সেই পুরুষদের শাস্তির কোনও ব্যবস্থা হয়নি যারা যে বছর আইন পাল্টানো হল, সে বছরই তাদের ব্যভিচারী বউদের মেরে ফেলেছিল। বছরে ৮০০ পুরুষ তাদের স্ত্রীদের প্রাণে মারতো। ১৯৮০'র আগে কলোম্বিয়ায় অনার ক্রাইম বৈধ ছিল।
তুরস্ক, ইরাকি কুর্দিস্তান, পাকিস্তান- এসব দেশে অনার ক্রাইম আইনত বৈধ না হলেও এর চর্চা অব্যাহত। তুরস্কে যদিও হত্যাকাণ্ডের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তারপরও হত্যাকাণ্ড চলে। কুর্দিস্তানে যদিও ২০০২ সালের পর থেকে অনার কিলিং অবৈধ করা হয়, কিন্তু প্রতিদিন একজন হলেও মেয়ে এ কারণে খুন হয়। পাকিস্তানে এক ২০০৩ সালেই বারোশ একষট্টিটি মেয়েকে খুন হতে হয় বংশের সম্মান রক্ষা করার জন্য। বাইরের এবং ভেতরের চাপে এই অনার ক্রাইমের বিরুদ্ধে একটি বিল পাস করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরোদমে চলছে নারী হত্যা।
মনে করা হয় একটি পরিবারে পুরুষের দায়িত্ব মেয়েদের নিরাপত্তা রক্ষা করা, তাই পুরুষেরা মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করে। যদি মেয়েরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে তা নাকি পুরুষের জন্য অপমানকর। পুরুষেরা মরিয়া হয়ে ওঠে অপমানের প্রতিশোধ নিতে।
ইওরোপেও দেখা দিচ্ছে অনার ক্রাইম। ব্রিটেনে বছরে বারোটা করে ঘটছে ঘটনা।
মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়া থেকে আসা পরিবারেই মূলত দেখা যাচ্ছে এই অপরাধপ্রবণতা। এসব পরিবারের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের মেয়েরা যারা ইস্কুল-কলেজে যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে ইওরোপিও ছেলেদের প্রেম হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই এই প্রেম বা বিয়ে মেনে নিতে পারে না মেয়ের পরিবার। তখন খুব ঠাণ্ডা মাথায় একটি কাজ তারা করে, মেয়েকে খুন করে। ফাদেমা নামের এক কুর্দ মেয়ে বড় হয়েছে সুইডেনে, সুইডিশ এক ছেলের সঙ্গে তার প্রেম, একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছে।
একদিন ফাদেমা তার মার সঙ্গে দেখা করতে এলে, ব্যস, বাবা গুলি করে মেরে ফেললো নিজের মেয়েকে। বললো এটা আমাদের কালচার। মাল্টিকালচারালিজমের পক্ষে যারা কথা বলে, তারা হাঁ। কী করে ভয়াবহ নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক এই সংস্কৃতিকে তারা শ্রদ্ধা করবে! সেই সংস্কৃতিকে মানা যায় না, যে সংস্কৃতি বৈষম্য লালন করে। যে সংস্কৃতি মনুষ্যত্বের অপমান করে, সেই সংস্কৃতি রক্ষা করলে মানবজাতির ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ হবে না।
কী করে এর শেষ হবে? মেয়েদের ওপর নির্যাতন, নিষ্পেষণ, পীড়ন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ এসবের কোনও শেষ নেই, এ কথা আমি মানতে নারাজ। নিশ্চয়ই শেষ এসবের হবে। শেষ হওয়াতে চাই কি আমরা? যদি চাই, শেষ হতে বাধ্য।
-লেখক : নির্বাসিত লেখিকা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।