অদ্ভূত বিষয়গুলোতে বিস্ময়াভূত হওয়া একটি চমকপ্রদ ব্যাপার!! প-এ পায়েল, প-এ পায়েল
চতুর্থ পর্ব এখানে। না পড়লে এই পর্বে কিছুই বুঝবেন না। তখন কিন্তু লেখক দায়ী নন
৬।
আজ আতাউর সাহেবের মন ভীষন নরম হয়ে আছে। এই রাতেও চুপচাপ তিনি বসে আছেন পুকুর পাড়ে।
পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। পুকুরটা তিনি নিয়মিত পরিস্কার করান । অব্যবহার্য এই পুকুরের প্রতি তাঁর যত্নের সীমা নেই। একদম মাঝখানে দুটো শাপলা ফুটেছে। আতাউর স্বচ্ছ পুকুরটার দিকে নিমগ্ন।
বাড়িটার একপাশের প্রতিচ্ছবি পড়ছে পুকুর পানে। ঐ একপাশে পায়েলের ঘর। আতাউর সাহেব পানির ভিতরেই খেয়াল করলেন তাঁর মেয়ে নিজের ঘরে কিসব টুকটাক কাজ করছে। মেয়েটার প্রতি আতাউর সাহেব তীব্র মায়া অনুভব করেন। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগে তাঁর।
এতটুকু একটা মেয়েকে তিনি এতটা কষ্ট কি করে দিলেন তাই ভাবছেন। পায়েল হয়তো ঠিক বোঝে না। যে কারণে ওর কষ্টটা কম। কিন্তু আতাউর তো বোঝে, নিজের বিবেকের কাছে তিনি ছোট হয়ে রয়েছেন সবসময়।
আতাউর সাহেব দেখেন মেয়ে তাঁর জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে।
ঠিক কোথায় তাকিয়ে আছে পায়েল তা বোঝা যাচ্ছে না। ভাবেন, মেয়ে বুঝি তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। তাঁর বাবা একা একা কেন এই পুকুর পাড়ে বসে আছে তাই হয়তো ভাবছে ও। বাবার মনে কি কোন দুঃখ নাকি কোন অসহ্য কষ্ট লুকিয়ে আছে, তাই কি ভাবছে মেয়ে? আতাউর সাহেবের চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি ঝরে পড়ে। হঠাৎ পুকুরের পানিতে তিনি দেখেন কে যেন পায়েলকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে।
বুকটা ধ্বক করে উঠে আতাউরের। তড়িৎ গতিতে মুখ ফেরান তিনি। দেখেন রসুমিয়া এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর পাশে। রসুমিয়া প্রায় এরকম নিরবে এসে দাঁড়ায়। ভাইসাবের মন মেজাজ বোঝার চেষ্টা করে।
সুবিধার মনে হলে কথা বলে না হলে আস্তে কেটে পড়ে। কিন্তু আজকে আতাউর সাহেবের এরকম চমকে মুখ ফেরানো দেখে নিজেও ভয় পেয়ে যায় রসুমিয়া। উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আতাউর। রসুমিয়া বলল, ভাইসাব কি হইছে আপনার? শরীর ভাল তো? কেমন যেন দেখায়!
আতাউর সাহেব আবার আগের মত পানিতে তাকায়। পানিতে রসুকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
বললেন, না শরীর খারাপ না। তবে মনটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে রে রসুমিয়া।
রসুমিয়া চুপ করে থাকে। আতাউরের মাঝে মাঝে এমন কষ্ট হয় তা রসুমিয়া দেখে এসেছে বরাবর। লোকটা নিজেই রাগের মাথায় একটা কাজ করে, আর সারাবছর বসে বসে সেটার জন্য হা-হুতাশ করে।
আতাউর সাহেবের সব ভাল। শুধু এই দিকটাই ওর ভাল লাগে না। রসুমিয়া বলে,
বাদ দেন তো ভাইসাব। এসব নিয়ে ভাইবা আর লাভ আছে? আমি মনে করি ঐটা আপনার ভুল ছিল না। আপনার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম।
ঘরের বউয়ের বেহায়াপনা কে সহ্য করবে?
অসহায়ের মত রসুর দিকে তাকায় আতাউর। রসুর মুখ ভাবাবেগ শূন্য। তারপর আবার পুকুরের দিকে ফিরেন তিনি। বলেন, যে আমার এত বড় সর্বনাশ করছে তাঁকে পেলেও আমি খুন করতাম।
রসু বলে, যা করছেন ভুলে যান ভাইসাব।
জীবনে অনেক কিছুই তো ঘটে। ঐটা আপনার জীবনের একটা দূর্ঘটনা, আর কিছুই না।
ভুলতে চাইলেই কি আর সব ভোলা যায় রসু? আমি যে তাঁকে বড্ড ভাল বাসতাম, সে রাতের ঘটনা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না।
রসু সে রাতের ঘটনা বহুবার শুনেছে। তবু ও জানে আজকেও আতাউর সাহেব ওকে সে রাতের ঘটনা শুনাবে।
হাই তুলে রসু। তারপর মাটিতে বসে পড়ে। আতাউর সাহেব শুরু করেন,
প্রতিদিন আমি যখন কাজ থেকে বাড়ি ফিরি সাথে সাথেই গামছা আর জল নিয়ে তোর ভাবি দাঁড়িয়ে থাকত। কি সুন্দর মুখ। আমি ওর মুখ দেখে ঘর থেকে বের হতাম আর মুখ দেখেই ঘরে ঢুকতাম।
বিয়ের কয়েকবছর তো কাজেই মন লাগত না। একদিন ভালবেসে গড়ে দিয়েছিলাম এক জোড়া পায়েল। সে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াতো, আর তাঁর পায়ের ঝুন ঝুন শব্দ শুনতাম আমি ঘরে বসেই। আমার এত ভালবাসার মূল্য সে এভাবে দিবে আমি ভাবতে পারিনি রে রসু। আমার পায়েল তখনো কতটুকু।
একবছর কি দেড় বছর হবে। রসু সংশোধন করে দেয়,
পায়েল-মার বয়স আড়াই বছর ছিল।
আমি বরাবর-ই ঘরে ফিরি রাত আটটা-ন’টার দিকে। ব্যাবসায় প্রচুর চাপ। তোর ভাবিকে সেদিন ভাল ভাল রাধতে বলে গিয়েছিলাম।
তাই বাজার করতে তোকে আগেই ছুটি দিয়েছি। পায়েল বাড়ি ছিল না। এসে সাথে করে নিয়ে গেছে ওর মামা। সেদিন ঘরে একটু আগে ভাগেই ফিরলাম। বাড়ি ফিরে পেয়ারাকে কোথাও দেখলাম না।
ভাবলাম রান্না ঘরে হয়তো রান্না করছে। চুপি চুপি রান্না ঘরে গেলাম, ভয় দেখাবো বলে। পেলাম না। তারপর পেয়ারাকে ডাকতে শুরু করলাম। ডাকতে ডাকতে আমাদের ঘরে গেলাম।
ঘরে বাতি নেই। চট করে ঘরে ঢুকে পড়লাম। জানালা দিয়ে লাফ দিল এক লোক। অন্ধকারে বুঝলাম না। পিছন থেকে দেখলাম শুধু।
আর পেয়ারা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার মাথা কাজ করছিলো না কি হচ্ছিল এখানে। পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। বদ্ধ উন্মাদের মত-ই মার ধোর করলাম তোর ভাবিকে। বেশ কিছুক্ষন পর তুই এসে আমাকে থামালি।
রসু রসুরে তুই আরো আগে কেন এলিনারে। তাহলে তোর ভাবি হয়তো বেঁচে যেত। এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল আতাউর। মৃত্যুর আগে বারবার করে সে কেবল পায়েল পায়েল করে পায়েলেরই নাম নিচ্ছিল। মেয়েটাকে আমি মা হারা করলাম।
রসু এগিয়ে এসে শান্ত্বনা দিল। বলল, ভাইসাব। যা হবার হয়ে গেছে। আপনি সেগুলা ভুলে যান। মনে যত করবেন তত বেদনা।
ভুলে যান সব।
চোখের পানি মুছে ভাল ভাবে তাকায় আতাউর সাহেব। রসু একটু সরে যাওয়ায় পায়েলের ঘরের জানালা আবারও দেখা যাচ্ছে। পায়েল এখনো জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। মুখ তুলে মেয়ের দিকে তাকায় আতাউর সাহেব।
মেয়ে তাঁর দিকে নয়, তাকিয়ে আছে মাষ্টারের ঘরের দিকে। দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে তাকায় আতাউর। যা দেখে তাতে তাঁর চোখ বিস্ফোরিত হবার যোগার। আতাউর সাহেবের চোখের ভঙ্গি দেখে রসুও তাকায় ওদিকে। জানালা ধীরে ধীরে আটকে দিচ্ছে কাজল।
আর বড় বড় ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে তাঁদেরই দিকে।
পরদিন পায়েল গাছে পানি দিতে বাগানে এল। কাজলের জানালা বন্ধ। পায়েল পানি দিচ্ছে একদমই কাজলের জানালার কাছের গাছগুলোতে। কাজল তবুও জানালা খুলছে না।
সন্দেহ হল পায়েলের। ঘরে নেই বুঝি! পানি দেওয়া শেষে পায়েল যখন ফিরে যাচ্ছিল ঠিক তখনি জানালা খোলার শব্দ হল। দাঁড়িয়ে পড়ল পায়েল। কাজলের গলা শুনতে পেল ও। কাজল বলল, “আপনার সাথে কথা আছে আমার”।
পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে পায়েলের নজরে এল রসুচাচা বারান্দায় দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। আর দাড়ালো না পায়েল, দ্রুত ঘরে চলে গেল।
দুদিন যাবৎ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না কাজল, জানালায়ও আসছে না। অসুখ করল কিনা কে জানে? পায়েল কাজলের খবর নিতে চাইলেও সেটা সম্ভব নয়, কেননা কুসুম আর রবিকেও সে ক’দিন পড়াচ্ছে না। তারপর একদিন রাতে কাজল মূল বাড়িতে আসে।
রসুমিয়া সাথে আসে ওর। আতাউর সাহেব সবে ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেতে বসেছে। বারান্দা থেকে রসুমিয়ার গলা শোনা গেল, ভাইসাব একটু বাইরে আসবেন? কথা ছিল।
আতাউর সাহেব হাত মুছে বাইরে এলেন। একবার কাজলকে দেখে রসুমিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার রসুমিয়া? খাবারের সময় এত ডাকাডাকি কিসের?
রসুমিয়া ইশারায় কাজলকে দেখিয়ে দিল।
আতাউর সাহেব কাজলের দিকে তাকালেন। কাজল মাথানিচু করে রেখেছে। ধিরে ধীরে বলল,
আমি কাল সকালে চলে যাব।
আতাউর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কেন? তোমার কি চাকুরী হয়েছে?
জ্বি না, আমি ঠিক করেছি একেবারে বাড়ি চলে যাব।
আতাউর সাহেব চোখ ছোট করলেন।
বললেন, বাড়ি গিয়ে কি করবে শুনি?
ওখানে একটা স্কুল আছে। জয়েন করব। কোন অসুবিধা হবে না আমার।
খাবার টেবিলে সমস্ত কিছুই শুনছিল পায়েল। কাজলের হঠাৎ করে চলে যাবার সিদ্ধান্তে ভীষণ অবাক হয় ও।
এভাবে না জানিয়ে কেন-ই বা কাজল চলে যাবে, কি হয়েছে ওর? সেদিন কি বলতে চেয়েছিল কাজল! জানতে বড্ড ইচ্ছে হয় পায়েলের। কিন্তু কিছুই করার নেই ওর। হঠাৎ-ই কেমন কষ্টে বুক ভেঙ্গে আসে ওর। খেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু খাবার টেবিল ছেঁড়ে উঠে যেতেও পারছে না, মা আছে সামনে।
চোখে পানি চলে আসে ওর। চোখের পানি লুকাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় কুসুমের কাছে। কুসুম ইচ্ছে করেই গ্লাসের পানি ঢেলে দেয় পায়েলের কোলের ওপর, যেন খাবার টেবিল ছেঁড়ে উঠে যেতে সাহায্য করে ওকে।
রাতে আতাউর সাহেব আর রসুমিয়া বসে আছে বারান্দায়। আতাউর সাহেব গম্ভীর হয়ে বসে আছে।
রসু তাঁর পাশে কাচুমাচু মুখে। আতাউর সাহেব বললেন, এটুকু তোমাকে করতেই হবে রসুমিয়া। আমার জন্য এতটুকু তুমি করতে পারবা না? তোমার কোন আশাটা আমি অপূর্ন রাখছি?
রসুমিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কোন কথা বলছে না। আতাউর সাহেব এ কেমন অনুরোধ করছে তাঁকে? এ কিভাবে সম্ভব? আতাউর সাহেব আবারও বললেন, এত বছর যাবৎ যা সবার অয়াজানা ছিল তা এখন জানাজানি হয়ে গেলে কি হবে তুমি ভেবে দেখেছো একবার? আমার কথা একবারও ভাববে না তুমি? জানাজানি হয়ে গেলে পায়েল মা-র কাছে আমি কি করে মুখ দেখাবো বলতে পারো?
রসু তারপরও চুপ।
আতাউর সাহেব আবারও বললেন, সত্যি সত্যি তো কিছু হবে না রসুমিয়া, তুমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছ। রসুমিয়া একবারও কোন জবাব দিচ্ছে না বলে আতাউর সাহেব উঠে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, কাল সকালেই যেন আমি সব ব্যাবস্থা দেখতে পাই। শেষের কথাটা বেশ কঠিন ছিল আতাউর সাহেবের। শুনে চমকে উঠে রসুও।
চলবে.......[/sb
পর্ব ছয় পড়ুন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।