আয়েজিয়ান এয়ারলাইন্সের ঘোষনা- আর মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা আমাদের গন্তব্য গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে পৌছাবো… শোনা মাত্রই তন্দ্রাটি কেটে গেলো। জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে আমার চোখ অপার বিস্ময় নিয়ে দেখতে লাগলো আয়েজিয়ান সি। সমুদ্রতো প্রচুর দেখেছি কিন্তু এখানে আমার বিস্ময়ের কারন হচ্ছে আয়েজিয়ান সি মানে ভূ-মধ্য সাগর!
ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে যে ভূ-মধ্য সাগরের কথা পড়তে পড়তে জীবন তামা তামা করে ফেলেছি সেই ভূ-মধ্য সাগর আমার চোখের সামনে! অবারিত শান্ত নীলের মাঝে ছোট ছোট জাহাজ বুক চিরে ছুটে চলেছে একটি সাদা রেখা তুলে দিয়ে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই হঠাত করেই প্লেন নেমে গেলো এথেন্স এয়ারপোর্টে। এথেন্স এয়ারপোর্টটা পাহাড়ের মাঝে।
চারদিকে পাহাড় দেয়াল তুলে দাড়িয়ে।
প্লেন থেকে নেমেই আরেকটি ধাক্কা খেলাম। আবহাওয়া একেবারে বাংলাদেশের মতো! ব্রিটেনে যেখানে শীতে পর্যদস্তু জীবন, সেখানে মাত্র ৩ ঘন্টার দূরত্বেই ইউরোপের একটি দেশে তাপমাত্র ২৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস! মাত্র একদিনের নোটিশে এথেন্সে আসার কারন চ্যানেল এস টেলিভিশনের জন্য অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন এর প্রথম কনভেনশনের নিউজ কাভার করা। সারা ইউরোপের বাংলাদেশীদের এক ছাতার নিচে আনার জন্য এমন একটি উদ্যোগ।
ইমিগ্রেশন শেষ করে যখন বের হলাম দেখি কনভেনশনের একজন ভলান্টিয়ার আমার নাম লেখা প্লে-কার্ড নিয়ে দাড়ানো।
কাছে যেতেই ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো। একটি আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন আয়োজন করতে এদের ঘুম হারাম গত ১৫দিন ধরে। যিনি অভ্যর্থনা জানালেন উনার নাম নূরুল ইসলাম। শরীয়তপুরের ছেলে। গ্রীসে এসেছেন প্রায় ১৬ বছর।
এখানে ২টি সুপার মার্কেটের মালিক (ব্রিটেনে এই ধরনের শপকে বলে কর্নার শপ)। প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশী বসবাস করেন গ্রীসে। গাড়িতে করে হোটেলে যেতে যেতে এসব শুনছিলাম নুরুল ইসলামের কাছে। তুর্কীর বর্ডার ভূ-মধ্য সাগরের ওপারে হওয়ায় মিডলইষ্ট থেকে অবৈধভাবে জাহাজে করে গ্রীসে ঢুকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাগ্যান্বেষী মানুষেরা। কতো প্রান ঝরে যায় এই ভূ-মধ্যসাগরে! তার কোন হিসাব নেই।
যারা ঢুকে তাদেরও নানা বিরম্বনা। গ্রীসে ঢুকে পড়া মানেই ইউরোপে ঢুকে পড়া। এরপর ব্রিটেন ছাড়া সারা ইউরোপ ট্রাভেল করা যায় ভিসা ছাড়াই। তবে চেকিংয়ে পড়লে ধরা পড়তেই হয়। সেক্ষেত্রে আবারো বর্ডারে ছেড়ে দিয়ে আসে পুলিশ।
এইসব আলাপের মাঝেই পৌছে গেলাম হোটেলে। এথেন্সের প্রানকেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট নামের পাচ তারকা হোটেলেই কনভেনশন এবং ইউরোপের ২৬টি দেশের শতাধিক ডেলিগেটসের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চ্যানেল এস এর ইউরোপ প্রতিনিধি নূরূল ওয়াহিদকে সাথে নিয়ে ত্বরিত কনভেনশনের প্রস্তৃতির একটি নিউজ পাঠিয়ে দিলাম লন্ডনে। পরের দুদিন হোটেলেই কেটেছে কনভেনশন এর নিউজ কাভার করতে করতে। ফিরে আসার দিন সেলিম নামের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকের একটি ছেলেকে সাথে নিয়ে গেলাম বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকায়।
ক্যাবে করে যাচ্ছি আমরা। সেলিমের কাছে শুনলাম অব্যাহত মন্দা অর্থনীতির কারনে একবার প্রায় নিলামে উঠে যাওয়ার দশা হয়েছিলো দেশটির। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহায়তায় এখনো সংকট থেকে বেরুতে পারেনি দেশটি। আর এজন্য সবচেয়ে বেশী কষ্টে আছে ইমিগ্রান্টরা। বৈধ যারা তাদেরই কাজ নেই।
আর অবৈধদেরতো মালিক যাচ্ছে তাই ব্যবহার করে। প্রায় ৫০ হাজার বাংলাদেশীর মধ্যে মাত্র ৮/৯ হাজার বৈধ। বাকিরা অবৈধ অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসব শুনতে শুনতে রাস্তার দুপাশ দেখছিলাম। একেবারে আমাদের ঢাকার ফার্মগেইট, গুলিস্তান, পল্টন মনে পড়ে যায়।
একইভাবে ঘিঞ্জি, রাস্তার উপর দোকান। একসময় চলে আসলাম গেরানিওতে। এখানেই সর্বাধিক সংখ্যক বাংলাদেশী থাকেন। গেরানিও এবং ওমানিয়াতে গিয়ে দেখলাম বাংলাদেশের ষ্টাইলে রেষ্টুরেন্ট। তবে ব্রিটেনের মতো না।
একেবারে বাংলাদেশের বিভিন্ন পাড়ার মোড়ে যে রেষ্টুরেন্ট বা চা ষ্টল থাকে বিষয়টা তেমনই। রয়েছে এখানেই কথা হলো কুমিল্লার ছেলে রতনের সাথে। ৫ বছর ধরে সে একজন অবৈধ অভিবাসী হিসাবে এখানে। কাজ করছে একটি মাংসের দোকানে। আগে যেখানে এই কাজের জন্য ১০০০ ইউরো পেতো সেখানে এখন পায় মাত্র ৫০০ ইউরো।
বেতন বাড়ানোর কথা বললে মালিক বের করে দেয়ার হূমকি দেয়। এই সমস্যা বৈধ লোকেরও। সবারই আয় কমে অর্ধেকে নেমে গেছে। বাংলাদেশের মতো এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছেন ১০/১২ জন। সাংবাদিক শুনে যেনো দু:খকথার ঝাপি খুলে দিলেন সবাই।
গ্রীসে কাজের চেয়ে বড় সমস্যা নিরাপত্তা। গ্রীকরা এখন তাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য দায়ী করছে অভিবাসীদের। আর আস্তে আস্তে দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ছে। অভিবাসীদের জন্য তাদের খারাপ অবস্থা এমনটি ভেবে গ্রীসের ৩য় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ক্রীশ আবগির সমর্থকরা দলবেধে রাস্তায় নেমে বাদামী বা কালো চামড়া লোক দেখলেই হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ে।
এরা নিজেরাই বৈধ কাগজ পত্র আছে কিনা পরীক্ষা করে। গ্রীসের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় এখন বাংলায় একটি লিফলেট দিয়েছে যেখানে স্পষ্টভাবে লেখা অবৈধ অভিবাসীরা যদি নিজের দায়িত্বে ফিরে না যায় তাহলে তাদের পরবর্তী অবস্থার জন্য গ্রীস সরকার দায়ী নয়! এরকম ঘটনার জন্য বাঙ্গালী এলাকা ছেড়ে কেউ বের হোননা। চরম অনিশ্চয়তায় কাটছে তাদের দিনাতিপাত। তাই বৈধ লোকেরাও ভাবছেন দেশে ফেরত যাওয়ার। গ্রীসের অর্থনিতক অবস্থা যে খারাপ তার প্রমান পেলাম ফিরে আসার সময় ট্যাক্সিতে উঠেই।
লোকটা গ্রীক হলেও অল্প বিস্তর ইংলিশ জানে। এয়ারপোর্টে নামার পর দেখলাম ভাড়া এসেছে ২২ ইউরো। কিন্তু লোকটি বললো তাদের এখানে নিয়ম শনিবারে মিটারের ভাড়ার চেয়ে ১৫ ইউরো বেশী দিতে হয়। আমি বুঝলাম অভাবে স্বভাব নষ্ট। কথা না বাড়িয়ে দিয়ে দিলাম।
কারন এইটুকু রাস্তা লন্ডনে আসতে ৬০ পাউন্ড মানে ৭০ ইউরো দিতে হতো। ট্যাক্সি থেকে নেমে যখন এয়ারপোর্টে ঢুকছি তখন উষ্ঞ আবহাওয়া মনে করিয়ে দিলো বাংলাদেশের কথা। আবহাওয়া পরিবেশ সবকিছু বাংলাদেশের মতো হলেও এখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের পরিস্থিতি ঠিক বিপরীত!
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।