নিজের ভাবনা অন্যকে জানাতে ভালো লাগে।
‘যে জন বঙ্গেত জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন-জানি। ’ মধ্যযুগের কবিকে যখন এমন কবিতা লিখতে হয়, তখন আমাদের বুঝতে সমস্যা হয় না, বাংলা ভাষার শত্রু সেই মধ্যযুগেও ছিল, এখনও যেভাবে আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মধ্যযুগের সেই শত্রুরা কারা? যাদের জন্ম নিয়েই কবিকে ঘৃণাভরে প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে। একথার জবাব হিসেবে আমরা ইতিহাসজ্ঞান দিয়ে যা ধারণা করতে পারি: বাংলা ভাষা ছিল প্রাকৃতজনের মুখের ভাষা, এই ভাষার চর্চা আর বিকাশ হয়েছে সমাজের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের মধ্যদিয়ে।
আর তৎসমের অভিজাত শ্রেণি এই ভাষাকে অভিহিত করতো ইতর শ্রেণির ভাষা হিসেবে।
তবে সেই অভিজাত শ্রেণির ভাষা কি ছিল? আমাদের ইতিহাসজ্ঞান বলে, বাঙালি অভিজাত মুসলমানরা নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিল আরবি এবং উর্দু আর হিন্দুরা গ্রহণ করেছিল সংস্কৃতকে। মধ্যযুগের সেই মুসলমান অভিজাত শ্রেণিকেই পাকিস্তানি উপনিবেশ সময়কালে আমরা দেখছি, বাংলা ভাষা নিয়ে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠতে। আরবি হরফে বাংলা, বাংলা ভাষাতে আরবি এবং উর্দু শব্দের সমাবেশ ঘটানোর মতো অপ-তৎপরতার মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বিকাশ স্তব্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা করতে। এই অপচেষ্টা রুখে দিয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্ত আর মেহনতি মানুষ সম্মিলিত সংগ্রামের মধ্যদিয়ে যার পরিণতি মহান একুশ।
এখনতো বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের জন্য একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র আছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয়, এখানে শাসক আর প্রজা সকলে একই ভাষাতে কথা বলে, এখন বাংলা ভাষা নিশ্চিতভাবেই শত্রুমুক্ত! তবে এই সাধারণ দৃষ্টির বাইরেও একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, যেটা সমাজ, রাষ্ট্র আর তার চরিত্রকে বিশ্লেষণ করার জন্য আমাদের প্রয়োজন পড়ে। সেই মানদণ্ড দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়। আমরা যতই বাংলা ভাষাকে শত্রুমুক্ত ভাবি না কেন, আদতে বাংলা ভাষা এখনও শত্রুমুক্ত নয়। আর শত্রুমুক্ত নয় বলেই, সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন এখনও সম্ভব হয়ে উঠে নাই।
অন্যসব কিছু বাদ দিয়ে একটি জাতির সবচেয়ে বড় আস’ার জায়গা যে সর্বোচ্চ আদালত, সেই আদালতের ভাষা এখনও ইংরেজি। এখনও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত বই সংগ্রহ করতে হয় ইংরেজিতে। এবং স্বাধীনতার ৪৩বছর পরও অভিজাত শ্রেণির মানুষের শিক্ষার মাধ্যম হচ্ছে ইংরেজি। ভাবলে হতবাক হতে হয়, একটি দেশে শিক্ষায় এত বিভাজন থাকতে পারে!
হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানের জন্য এনজিও স্কুল কিংবা কওমি মাদ্রাসা। নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তান পড়বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, মধ্যম মধ্যবিত্তের জন্য আছে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা কিন্ডারগার্টেন- আর উচ্চবিত্তের জন্য খাঁটি ইংরেজি মাধ্যম এ-লেভেল ও-লেভেল।
শিক্ষার এই বিভাজনের ভেতর আমরা দুইটা মাধ্যমকে দেখছি যেখানে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে ভিনদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই দুইটা মাধ্যম হলো, মাদ্রাসা এবং ইংরেজি শিক্ষা মাধ্যম যথা ও-লেভেল এ-লেভেল, যেখানে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি এবং আরবি ভাষারই প্রাধান্য দেওয়া হয়। অথচ যেকোন জাতির শিক্ষা ব্যবস’ার কাজ হচ্ছে একই মানসচেতনায় জাতিগঠনে ভূমিকা রাখা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, আরবি কিংবা ইংরেজি জানা কি জাতীয় চেতনার পরিপনি’? সেক্ষেত্রে আমি বলব, অবশ্যই না। বরং কোন ব্যক্তি বহু ভাষা জানা মানেই তার জ্ঞানের বহু শাখা বিস্তৃতি হওয়া, এই বিষয় আমাদের সন্দেহ’র কোন অবকাশ নেই।
তবে অবশ্যই সমস্ত জাতির জন্য শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে এক এবং অন্য ভাষা শিক্ষার ব্যাপারটা নির্ভর করবে শিক্ষার্থীর অভিরুচির ওপর। এখন প্রশ্ন আসতে পারে শিক্ষার অন্যস্তর নিয়ে, যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা প্রকৌশল বিদ্যার মতো বিষয়গুলো যেখানে শিক্ষার উপকরণ বই-পুস্তক মানেই হচ্ছে ইংরেজি, সেক্ষেত্রে কি করা যায়। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলেই আমরা সর্বক্ষেত্রে বাংলা প্রচলনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বিষয়টার উত্তর খুঁজে পাব।
এক্ষেত্রে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল লেখন পদ্ধতি ম্যান্ডারিন ভাষার উদাহরণ টানব। ম্যান্ডারিন ভাষার কোন বর্ণমালা নেই, আছে ৫০ হাজার সাংকেতিক চিহ্ন।
যেমন ধরুন ম্যান্ডারিন ভাষাতে কেউ একজন বনানী লিখতে চায়, তখন তাকে লিখতে হবে: গাছ+গাছ কিন’ সে যদি ঘনজঙ্গল লিখতে চায়, তখন লিখতে হবে: গাছ+গাছ+গাছ। একজন ম্যান্ডারিন ভাষার অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মানেই হচ্ছে তাকে দুই হাজার সাংকেতিক চিহ্ন মুখস’ করতে হয়েছে। এত জটিল প্রক্রিয়ার পরেও আজ চীনা জাতি বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানবিজ্ঞান তার নিজের ভাষাতে আত্মীকরণ করে নিয়েছে। প্রত্যেক ভিনদেশি শব্দের সৃষ্টি করেছে নিজস্ব ভাষার প্রতিশব্দ। যেমন বাংলাদেশ ম্যান্ডারিন ভাষায় মনজিলা।
এই যে বিশ্বের তাবৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নিজের ভাষার ভেতর আত্মীকরণ করতে পারা, এটা কোন ব্যক্তিগত উদ্যোগ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ফল। স্বাভাবিক নিয়মেই আজ আমাদের সামনে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায় স্বাধীনতার পর থেকে ৪৩ বছর ধরে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল তারা ভাষার জন্য কি করেছেন? আমরা আজ কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার চর্চা করছি, এখানেওতো কোন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপার ছিল না। বরং ব্যক্তি উদ্যোগের ফল ভোগ করছি মাত্র।
এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিয়েছিল, প্রযুক্তির মধ্যে দিয়ে ইংরেজি ভাষাকে বাংলা এবং বাংলা ভাষাকে ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরের মতো সফটওয়ার বানানোর কাজে। অর্থ সংকটের কারণে সে উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
আমরা সবসময় বানান সমতার কথা বলি, অথচ এই প্রযুক্তির যুগে বানান সমতা আনার ব্যাপারটা অন্য যে কোন সময় থেকে অনেক সহজ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রকে এমন কোন সফটওয়ার বানানোর উদ্যোগ নিতেতো দেখা যায় না। অথচ এগুলো এমন কোন বিশাল বাজেটের বিষয়ও না।
বড়জোর একজন এমপির এক বছরের আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার সমপরিমাণ অর্থ হতে পারে। তারপরও এই বিষয়গুলো নিয়ে রাষ্ট্রের এত অবহেলার কারণ কি? কারণ একটাই, ওই যে অভিজাত শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা, যারা ভাষা বিভাজনের ভেতর দিয়ে নিজের শ্রেণির বিশেষ সুযোগগুলো নিতে চায়।
অথচ সত্য হচ্ছে, একাধিক ভাষা শিখে কোন ব্যক্তি জ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে ঠিকই কিন’ একটি জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠন করার জন্য মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার কোন বিকল্প নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।