আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তৃতীয় লিঙ্গ: আমার অপরাধ বোধ

ইহা কঠোরভাবে একটি রাজনীতি মুক্ত ব্লগ । ।

কাজের চাপে ভালোলাগা একটি খবর শেয়ার করতে ভুলেই গেছি। সেটা হল গত ১৩ই ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার ফেসবুক তৃতীয় লিঙ্গকে সমর্থন দিয়েছে। তারমানে আমরা যাদের হিজড়া বলে জানি তাদেরও এখন থেকে ফেসবুক একাউন্ট থাকবে।

খবরটা দেখে খুবই ভালো লাগলো। কবে যে আমাদের দেশে ওরা একটু ভালো মর্যাদা পাবে !!! ছোট বেলা থেকেই এই প্রশ্ন আমাকে বিদ্ধ করে করে আসছে। মালেক নামে আমার এক বন্ধু ছিলো ছোটবেলায় একই এলাকায় বাড়ি যে ছিলো হিজড়া। তারপরে দীর্ঘ অনেক বছর পর দেখা আমার ভার্সিটির সামনে, যথারীতি শাড়ি পরা, মাথায় অনেক বড় খোপা, ঠোটে লাল লিপিস্টিক আমার বন্ধুদের সামনে আমাকে ছোটবেলার মত জড়িয়ে ধরেছিল। আর শিক্ষিত হীন আমি লজ্জায় সংকুচিত হয়ে ওকে নতুন বন্ধুদের সামনে অবজ্ঞা করেছিলাম ।

এখনও আমার চোখের সামনে সেদিনের জলে ভেজা চোখের মর্মাহত মালেকের মুখটি ভাসে। পড়াশুনা ও চাকরীর সুবাদে এরপর দীর্ঘ কয়েক বছর থাইল্যান্ডে কাটিয়েছি, অনেক বন্ধুদের পেয়েছি যারা তৃতীয় লিঙ্গের। সেখানে আছে ওদের পূর্ন সামাজিক মর্যাদা ও সমান অধিকার-সে ভোটাধিকার থেকে শুরুকরে শিক্ষা ও চাকরীর বাজার সবখানে। তখন মনে হত আমাদের দেশে কেন আমরা পারিনা এদের প্রাপ্য অধিকার দিতে, ওদের জন্ম ত্রুটির দায়ভার কেন সমাজ ওদের ওপর চাপিয়ে দেবে? কেনই বা দিতে হবে? ক্ষতি কি ওদের মর্যাদা দিলে?? আমাদের দেশে ওরা যে কতটা অবহেলিত তা সংক্ষেপে বলি ঃ
১। ওদের স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়না।


২। বাবা মা তাদের বাচ্চাদের সাথে হিজড়া বাচ্চাদের খেলতে দেন না।
৩। তাদের কোন সামাজিক অনুষ্টানে দাওয়াত দেওয়া হয়না। পরিবারও লজ্জায় তাদের আড়াল করে রাখে।


৪। তাদের ভোটাধিকার নেই।
৫। হাস্পাতালে তারা অবহেলার শিকার।
৬।

কাজ চাইলেও কেউ তাদেরকে কাজ দেয় না।
৭। মৃত্যুর পর ওদের জানাজা হয় না।
৮। মুসলিম গোরস্তানে ওদের কবর হয়না বা শ্মশানে ওদের সৎকার হয়না।



তথাকথিত এই সভ্য সমাজের আমরা হিজড়াদেরকে অশুভ কিছু বলে ভয়ংকরভাবেই এড়িয়ে চলি। এই আমরাই ভুলে যাই যে তারা আমাদের মতই একই বাতাস, গ্রহন করে বেঁচে থাকে, ওদেরো রক্তের রঙ আমাদের মতই লাল। সমাজ ও পরিবার থেকে বিতাড়িত এই সম্প্রদায়ের নিত্যসঙ্গী হচ্ছে অভাব। অন্যদের করুণা এবং ভিক্ষাই ওদের জীবিকা। স্বাভাবিক জীবন যেন ওদের কাছে একটি স্বপ্ন।

লেখক রণদীপম বসুর একটি কলামের কিছু অংশ দিয়ে শেষ করি, “আপনার স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ করেই কোন হিজড়ার সাথে দেখা হয়ে গেলে হয়তোবা স্বতঃকৌতুহলি হয়ে ওঠবেন আপনি। এই কৌতুহলের মধ্যে অজান্তেও কোন কৌতুক মেশাবার আগেই একটিবার অন্তত ভেবে দেখবেন কি, এই না-পুরুষ না-স্ত্রী সত্তাটি আপনার আমার মতোই সবক’টি নির্দোষ দৈহিক উপাদান নিয়েই কোন না কোন পারিবারিক আবহে জন্মেছিলো একদিন। মানবিক বোধেও কোন কমতি ছিলো না। কিন্তু প্রকৃতি তাকে দিয়েছে ভয়াবহ বঞ্চনা, যা আপনার আমার যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারতো ! অসহায় পরিবার ত্যাগ করেছে তাকে, অবিবেচক সমাজ করেছে প্রতারণা। নিয়তি করেছে অভিশপ্ত, আর রাষ্ট্র তাকে দেয়নি কোন সম্মান পাবার অধিকার।

কোন অপরাধ না করেও ভাগ্য-বিড়ম্বিত সে কি আপনার আমার একটু সহানুভূতি থেকেও বঞ্চিত হবে ?" আশার কথা যে এখন অনেক এনজিও এদের ওধিকার প্রতিষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে । খুলনার লোসাউক, বরিশালের নাহার ,র‌্যক ও বয়েজ অব বরিশাল, ঢাকার সুস্থজীবন, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, সুস্থ জীবন, বাঁধন হিজড়া সংঘ, লাইট হাউস, দিনের আলো, চট্টগ্রামের নোঙ্গর সমাজ উন্নয়ন সংস্থা ইত্যাদি বেসরকারি সংগঠন। গত বছর নভেম্বরে এইসকল সঙ্গঠনের পক্ষ থেকে হিজড়াদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের জোরালো দাবী উঠেছে। এমনকি ২০১১ সালে নোমান রবিন পরিচালিত "কমন জেন্ডার" নামক একটি বাংলা সিনেমাতে হিজড়াদের করুন জীবন তুলে ধরা হয়েছে। ২০১১ সালের আদমশুমারীতে বেশীরভাগ হিজড়া অন্তরভুক্ত হয়নি।

আমাদের দেশে হিজড়াদের ভোটার হওয়ার নিয়ম না থাকলেও ভারতে কিন্তু লোকসভার সদস্য হয়েছিলেন হিজড়া শবনম মৌসি। আশা করি এইসব সামাজিক আন্দোলনের ফলে একদিন তারা তাদের ন্যাযা অধিকার ফিরে পাবে।

এখনও খুলনায় গেলে দল বেধে চলা হিজড়াদের মাঝে আমি আমার সেই ছোটবেলার সেই মাঠের খেলার সাথী অসচ্ছল পরিবার থেকে আসা চরম হাসিখুসি মালেককে খুজে ফিরি। ওর সেই মর্মাহত মুখটি আমাকে অনুতাপে প্রায়ই দগ্ধ করে। যদি কখনো দেখা পাই তবে ক্ষমা চেয়ে নেবো আর বন্ধুত্বের অধিকারটি অন্তত ফিরিয়ে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ব করবো আমার ভুলের।


ছবি ও কিছু তথ্য সুত্রঃ গুগল
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।