চিত্রদীপ জ্বেলে রেখো ময়ূখ পিদিম; রাত্রি-কথায় বেঁধে নেবো ভোরের খোঁপা।
শাহরিক মুগ্ধতা, ক্লান্তি, হঠাৎ ফুঁড়ে ওঠা বিষণ্ণতা এবং তিরতির করে রক্তের মাঝে বয়ে চলা আতংক নিয়ে পাপিয়া অবশেষে জেগে থাকে। হাত দুটো ভাঁজ করে ওর বুকের ওপর রাখা। একটু পর পর ওর পুরো শরীরটাই নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মৃত্যুভয় কেমন হয় ? কেমন হতে পারে? এমন? এতো ভয়াবহ! ভাষাহীন, অশ্রুহীন, শীতল? পাপিয়ার এ প্রশ্নের কোনো উত্তর কেউ দেয় না।
ও নিজেও জানে কেউ উত্তর দিতে আসবেও না। ওর ঘরের জানালা-দরজা সব বন্ধ করা তবুও এ রকম হু হু করা শীতল বাতাস কোত্থেকে আসছে ও ভেবে পায় না। ধীরে ধীরে সে শীতল বাতাস ওর পুরো শরীরটা গ্রাস করে নিচ্ছে। পায়ের আঙুলগুলো ইতিমধ্যেই কেমন অসাড় হয়ে গেছে। ও কী নাড়িয়ে দেখবে আঙুলগুলো নিজে নিজে? পায়ের আঙুল শেষ হলে সেই শীতলতা পায়ের পাতা, হাঁটু, ঊরু এভাবে আস্তে আস্তে নিশ্চয়ই আরও উপরে উঠে আসবে! এরপর ওর হৃদপিণ্ড, গলা, চেহারা, নাক, কান সবই একটা সময় বরফখণ্ডে পরিনত হবে।
আচ্ছা স সময় ওর মস্তিষ্ক কী তখনো একাকী বাতিঘরের মতো মাস্তুল উঁচিয়ে জেগে থাকতে পারবে? মৃত্যুভয়কে ছাপিয়ে এখন ও সেই অস্তিত্বের টিকে থাকা নিয়ে আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, আরো ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আরো অক্ষম অস্থিরতায় ফুঁসে উঠলেও নিজ জায়গা থেকে ও নড়তে পারে না ইঞ্চিপরিমান। ওর থরে থরে সাজানো প্রিয়, অপ্রিয়, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় স্মৃতির ধারক মস্তিষ্ককে চোখের সামনে অনুভূতিহীন বরফখণ্ডে পরিণত হতে দেখলেও ওর কিছুই করার থাকবে না ভেবে ওর ভেতরে যন্ত্রণা হতে থাকে।
কিন্তু আজ ওর এতো শীত লাগছে কেন! একটা কাঁথা, নিদেনপক্ষে গায়ে দেবার জন্য একটা চাদরও যদি হতো! পঙ্গু মানুষদের যন্ত্রণা, অসহায়ত্ব আজ নিজে সুস্থ-সবল হয়েও ওকে মর্মে মর্মে অনুভব করাচ্ছে, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াতে না পেরে। শীতল সেই বোধটা ওর পায়ের আঙুল থেকে এবার হাঁটুতে এসেছে, জায়গাটা কেমন অসাড় হয়ে গেছে।
তার মানে আস্তে আস্তে এই বোধটা ওর পুরো শরীরকেই গ্রাস করবে বেশ ভালো বোঝা যাচ্ছে। যদিও পাপিয়ে ভয়ে ওর চোখ বন্ধ করে রেখেছে কিন্তু ওর শরীরে কেমন ভেজা ভেজে ভাবও ও সাথে সাথে টের পাচ্ছে। চটচটে, কিছুটা আঠালো ভাব সেখানে। শরীরের গ্রন্থি নিঃসৃত রস কী চুইয়ে চুইয়ে পড়া শুরু করলো তবে? আচ্ছা ও কী ওর হাতটাও নাড়াতে পারবে না? কাকে ও প্রশ্ন ও করে ও জানে না। তবুও ভেতরে ভেতরে তীব্র এক ইচ্ছে পোষণ করে হাতটা নাড়াবার জন্য।
অন্তত হাতড়ে হাতড়ে নিজের অপরিচিত লাগতে থাকা দেহটাকে পরিচিত গণ্ডির মাঝে যাতে আনতে পারে, সে জন্য হলেও ওর হাত নাড়াবার শক্তিটা ফিরে পাওয়া দরকার।
কেন যেন ওর মনে হতে থাকে ওর সাড়া শরীর জুড়ে অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। ছেঁড়া-ফাটা, দোমড়ানো কোনো মানচিত্র ওর শরীরে এসে ভর করেনি তো? হাঁটু পর্যন্ত যে অসাড়তা তৈরি হয়েছে, সেটা শরীরের ঊর্ধ্বাংশে ছড়াতে, হাতের কব্জি পর্যন্ত আসতে তো এখনো অনেকটা সময় বাকি আছে বোধ হয়। এ কেমন শাস্তি সৃষ্টিকর্তার ! – এ অভিযোগটা মনে এসেও পাপিয়া গিলে ফেলে, যদি ওর চিন্তাভাবনা করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে কিংবা পাছে সময়ের আগেই হাতদুটোও বরফাচ্ছন্ন হয়ে যায়! নাহ্ হাতের আঙুল একটু একটু নাড়ানো যাচ্ছে। এ বোধ যেন পাপিয়ার কাছে নতুন শিশুর হাঁটতে শেখা, হাতে কিছু ধরতে ধরতে পারার মতোই আনন্দদায়ক।
যদিও ঘরটায় অপর্যাপ্ত আলো থাকায় ও দেখতে পাচ্ছে না নিজের হাত,আঙুল, নিজের শরীরটাকে পর্যন্ত। ওর চামড়া কুঁচকে যায়নি তো কিংবা অ্যানিমিয়ায় ভোগা রোগীদের মতো ফ্যাকাশে হয়ে ওঠেনি তো! এ চিন্তা মনে এতেই পাপিয়া ধীরে ধীরে ওর গায়ে হাত বুলায়। আধো আলো-ছায়াতেই অনুভব করার চেষ্টা করে আচমকা ওর শরীরে কী এমন পরিবর্তন এলো, কেন এলো! এলোমেলো ঘূর্ণি বাতাসের মাঝে ও পথহারা ঝরা পাতার মতো দিশেহারা বোধ করতে থাকে। ও কী শরীরের এখানে ওখানে ওর কেন এ রকম গর্ত গর্ত হয়ে গিয়েছে! পাপিয়া ভয়ে কেমন গুঙিয়ে ওঠে। হঠাৎ ওর শরীরের সে গর্তে একটা আঙুল ঢুকে কেমন পিচ্ছিল পিচ্ছিল অনুভব হচ্ছে।
রক্ত পড়ছে না তো গা বেয়ে? তাহলে শরীরের এই ফুটোগুলো দিয়েই এতক্ষণ বাতাস ঢুকছিলো আর ওর এতো শীত শীত লাগছিলো?
আলো এবং অন্ধকারের মাঝে পাপিয়া ভাস্কর্যের মতো কেমন একাকী, নিঃসঙ্গ অনুভব করতে থাকে। ওর মনে হতে থাকে পুরো পৃথিবীতে ঐ একমাত্র যার সাথেই শুধু খারাপ ঘটনা গুলো ঘটে যাচ্ছে অবিরত। ওর হু হু করে কান্না পায় একাকী জারুল-শিমুল বনে পথ হারিয়ে যাওয়া কোনো কিশোরীর মতো। কিন্তু ওর চোখের পানিও যেন হারিয়ে গেছে আজ! গা কেঁপে কেঁপে উঠছে কিন্তু চোখে কোনো পানি নেই ওর। বিশাল মুক্তোর মতো টলটলে ঝুলে থাকা ওর অশ্রুর এ কী বিভীষিকাময় পরিণতি! চোখের ভেতরে, গভীরে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ও দেখবে নাকি কোনো অশ্রু আদৌ ওর চোখের কোটরে লুকিয়ে আছে কিনা? এ যেন পাপিয়ার জন্য কোনো অজাগতিক এক বোধ, স্তব্দ হয়ে একি সময়ে ভিন্ন ভিন্ন নাম না জানা অনুভূতির সাথে লুটোপুটি খাওয়া, দিশেহারা হতে হতে জ্ঞান হারাবার পূর্ব মুহূর্ত!
এই বিদঘুটে রাত্রিটা পার হয়ে ভোর অবশ্যই আসবে।
পাপিয়া সেটা জানে বলেই অপেক্ষা করে। পুরো কামরা জুড়েই রহস্যময় আলো আঁধারি। তাই ও ঠাহর করতে পারে না জানালাটা ঠিক কোন পাশে। কোন পাশে তাকালে ভোরের আলোর ছিটে ফোঁটা জানালার ফাঁক গলে ওর চোখে পড়বে। এ যেন অনিশ্চিত কিছুর অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকা, অপেক্ষা করা কিংবা ওয়েটিং ফর গডোর মতো কিছু একটা! পাপিয়ার মাঝে অদ্ভুত এক অনুভূতির সন্তরণ বয়ে যাচ্ছে।
ওর কোনো অতীত বা বর্তমান বলে কিছু আছে কিনা মাথায় কিছুই কাজ করছে না। এই ঘর থেকেই যেন ওর জন্ম বা জ্ঞান হবার পর আজকের এই পরিস্থিতি থেকেই ওর জীবন শুরু হয়েছে এবং এটাই বহমান থাকবে আজীবন নাকি কখনো এই পরিস্থির বদল হবে সব কিছু মিলিয়ে আবারও ওর তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এবার ওর সারা শরীরের শীত ভাব কেটে গিয়ে শুধুমাত্র গলার সামনেটায় এবার শীত লাগা শুরু হলো। হু হু করে বাঁধ ভেঙে বানের পানি ঢোকার মতো কলকল করে বরফকুঁচি ওর গলার সামনে দিয়ে চামড়া ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে পাপিয়া ওর হাতটা গলার কাছে এনে শীতবোধ হওয়া জায়গাটায় আঙুল বুলিয়ে দেখার চেষ্টা করে।
এক ইঞ্চি পরিমান জায়গা আড়াআড়ি ভাবে কেউ যেন কেটে দিয়েছে গলার কাছটায় বেশ গভীর করে। দুই পাশে মোটা সুতো দিয়ে সেলাই করা নকশা করে দিলেও কাঁটা জায়গাটা বেশ হা করে খোলা অবস্থায় এখনো। সে জায়গা থেকে কোনো রক্তপাত হচ্ছে না, শুধু একটা ঠাণ্ডার বোধ ছাড়া। ও প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করে কে ও জায়গাটা কেটে দিছে ওর। কিন্তু পরক্ষণেই মৃত্যুভয় এসে ওকে আচ্ছন্ন করে আবার।
শরীরের বরফাচ্ছন্ন ভাব কেটে গিয়ে এবার ওর দুর্বল লাগতে থাকে। মৃত্যুভয় কতটা ভয়াবহ হতে পারে ও শুধু অনুভব করে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। এ অনুভব কাউকে বলে বা লিখে জানাবার মতো নয়। ও মনে করতে পারে না ওর পরিবার ছিল কি না , থাকলেও তারা কোথায়। তবুও কী করে যেন ক্ষীণ স্বরে 'বাবা, বাবা' বলে ডাকতে থাকে।
ও নিজেও বোঝে ওর গলা দিয়ে ঠিক মতো কোনো স্বর বের হচ্ছে না। বের হবে কী করে! গলার কেটে যাওয়া জায়গাটা দিয়ে বাতাসটা কেটে কেটে বের হয়ে যাচ্ছে।
ওর ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর তবুও হয়তো কারো কানে গিয়ে পৌঁছায়। কেউ বা কয়েকজন হবে হয়তো,তারা পাপিয়ার কামরায় ঢুকলো। পায়ের শব্দে বুঝলো ও।
কি রে মা,এভাবে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছিস! আলোটাও তো জ্বালিস নি!
তিনি কী আমার বাবা,পাপিয়া নিজেকেই জিজ্ঞেস করে। কী নরম মধুমাখা কণ্ঠ তার। শুনলেই মনটা অদ্ভুত রকমের ভালোবাসায় ভরে ওঠার কথা। কিন্তু তার বদলে হুড়মুড়িয়ে পাপিয়ার অন্তর্গত আতংকের ঝোলা যেন বাবার সামনে খুলে পড়ে। পাপিয়া বিছানা থেকে উঠে বসতে চাইলেও ওর শরীরে এক ফোঁটা শক্তি ও পায় না।
ও খালি ‘বাবা,বাবা'করে একটু গুঙিয়ে ওঠে। যেন বা কান্নার মতো কোনো স্বর!
কি রে মা, কিছু নিয়ে ভয় পাচ্ছিস ?
আমার গলা, বাবা আমার গলা! পাপিয়া শুয়ে শুয়ে ওর গলার সামনের গভীর কাঁটা জায়গাটায় হাত এনে ওর বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেখো, এখানে কে যেন কেটে দিয়েছে।
কে কেটেছে, কই দেখি। ওর বাবা পাপিয়ে কে বিছানা থেকে টেনে উঠিয়ে বসায়।
দিন রাত গল্পের বই পড়ে পড়ে তোর এই অবস্থা। এতো বড় হয়ে গেছিস এখনো বই পড়ে তোর ভয় পাওয়ার রোগ গেলো না! হাহাহা!
নির্ভরতার জায়গাটা যদি টলে যায়, মানুষের জীবনীশক্তি হয়তো এমনিতেই কমে আসে। পাপিয়ারও ব্যতিক্রম হলো না। কেন ওর বাবা দেখতে পাচ্ছে না ওর গলার কাছে তৈরি হওয়া ক্ষতটা! পাপিয়া কেন মিথ্যে কথা বলবে! ও শেষ বারের মতো বলে ওঠে , বাবা! আমাকে বাঁচাও। আমার সারা শরীর কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে!
আমার কথা তো বিশ্বাস করবি না।
তোর চাচাকে দেখা, ও তো মিথ্যে বলবে না। দেখ তো আমিন, পাপিয়ার গলায় কী হয়েছে।
এতক্ষণে পাপিয়া খেয়াল করে ওর বাবার পাশে ওর ছোট চাচাও দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু কই ছোট চাচা তো পাপিয়ার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। কেমন একটা অপরাধী দৃষ্টিভঙ্গী তার মাঝে।
ঘুরে ঘুরে ঘরের এ মাথা ও মাথা দেখছে। পাপিয়ার বিছানার পাশের জানালাটা খুলে দিলেন তিনি। কিন্তু ছোট চাচার তাকানোর মাঝে এমন লুকোচুরি ভঙ্গী কেন! পাপিয়া চেষ্টা করে চাচাকে তার দৃষ্টিসীমানা দিয়ে বেঁধে ফেলতে। কিন্তু ওর চাচা বড়ই পিচ্ছিল প্রকৃতির! তবে কী চাচাই ঘুমের ঘোরে ওর গলাটার এই অবস্থা করে দিলো! কিন্তু কেন? এ বাড়ি তো ওর বাবার, চাচাদের তো কোনো ভাগ নেই এখানে। পাপিয়ার বাবা মারা যাবার পর তো এ বাড়ি পাপিয়াদের তিন ভাই বোনের মালিকানায় চলে এসেছে।
তিনি কী তবে পাপিয়াকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে এ ঘরে ঢুকেছিলেন চুপিচুপি? কিন্তু বাবা! তিনি তো মারা গিয়েছেন, তিনি কী করে এখন এ ঘরে এসেছেন? পাপিয়া ওর বাবার দিকে তাকায়। ঐ তো হাসি হাসি মুখে ওর বাবা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন। অশরীরী এক ধরণের ভয়ে পাপিয়া আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ওর ভেতরে কলিজাটা যেন চিপ দিয়ে থাকে। কার কাছে ও যাবে? বাবা মারা যাবার পর যেমন নিঃস্বতার ভারে ওর ভেতরটা আক্রান্ত হয়েছিলো, সবাই থেকেও যেমন কেউ নেই এই বোধ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিলো, এখনো সেই একই অনুভূতি ওর মাঝে বিরাজ করছে।
এ যেন পৃথিবীতে থেকেও কোনো কিছুর মাঝে না থাকা, দেখেও কিছু না দেখা! পাপিয়া নিজের অস্তিত্বহীনতার মনঃযন্ত্রণায় আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে।
চাচা, তুমি কেন আমাকে মেরে ফেলতে চাইছো ! কেন আমার সারা শরীর তুমি ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছো? আমাকে মেরে ফেলো না, আমাকে মেরো না! ও চোখ বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে ওর চাচা বলে ,
না, না আমি কেন মারতে চাইবো! আমি কিছু করি নি তো ! মনে হয় তোর মামারা… তারাই তো তোদের বাড়ি দখল নিতে চাইছে? ভাইজানের মৃত্যুর পর তো তারা …
কী ব্যাপার তার মানে পাপিয়ার ঘরে এখন শুধু ছোট চাচা? একটু আগে না বাবাও ছিলো? ঐ তো বাবা দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে ছোট চাচা কী বাবাকে দেখতে পাচ্ছে না ? সে সব ছাপিয়ে ওর মাঝে কাজ করতে থাকে অন্যভুবনের ভয়। বেঁচে থেকেও মরে যাবার ভয়, যার অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা নেই।
একেকবার মনে হচ্ছে ওর শরীর বলতে কিছু নেই, ওর নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে, ওর চোখের পাপড়ি নেই। কিছুক্ষণ আগেও অন্ধকারে নিজের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ও টের পেয়েছে ওর গায়ের চামড়াও কুঁচকে গেছে, ওর মাথার চুল কী আছে না সবই পড়ে গেছে! ওর মুখের দাঁতগুলো থাকবে তো নাকি সে সবও পড়ে যাবে? ও তো ওর বাবাকে দেখে কাঁদতে চেয়েছিলো কিন্তু তার বদলে গোঙানোর মতো শব্দ বের হয়েছিলো। তার মানে কী তাহলে দাঁতও … এবার ও মা, মা বলে কাঁদতে থাকে। কোনো ব্যথাজনিত কারণে নয়। আতঙ্কে! জগতের সব খারাপ কিছু কী শুধু পাপিয়ার সাথেই হতে হবে? ও প্রাণপণে চাইছে দৌড়ে এই ভূতুড়ে ঘরটা থেকে বের হয়ে যেতে।
কিন্তু কোথাকার এক অদম্য অপশক্তি ওকে বিছানার সাথে আটকে রেখেছে। এমনিতেই পাপিয়ার মাঝে পূর্বাপর কোনো স্মৃতিই কাজ করছে না। বিজলী চমকের মতো আসছে আর যাচ্ছে। স্মৃতিধারণের সমস্ত স্নায়ুকোষই যেন বিকল হয়ে গেছে একমাত্র আতংকের মতো ভয়াল অনুভব ছাড়া।
নির্বিকার পাপিয়ার ঠোঁট কাপে।
শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। হাত বাড়িয়ে হয়তো ও কোনো আঁচল ধরতে চায়। মায়ের আঁচল। কিন্তু হাতের সামনে দিয়েই হুটোপুটি করে ধোঁয়াশা কিছু যেন ফসকে যায় বারে বারে। কলকল নদীর ভরা জোয়ারের মতো হাসির শব্দ যেন দূর থেকে ভেসে আসছে।
পাপিয়া কান খাড়া করে থাকে সেদিকে। একবার কী কেউ মশাল হাতে পাপিয়ার এখানে আসবে। কেউ কী একটু আলো জ্বেলে দিয়ে যাবে! কিছুক্ষণ আগে পাপিয়ার বাবার জ্বালানো আলোটা নিভে গিয়ে ওর ঘরটা এখন কেমন ভৌতিক এক অন্ধকারে ডুবে আছে। সেই কলকল হাসির শব্দটা ক্রমশই ওর ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। হাসির শব্দটা ওর কানে কেমন পরিচিত ঠেকে।
স্মৃতির অটল থেকে সেই মানুষগুলোর পরিচয় ভেসে উঠতে গিয়েও কেমন ডুবে যায়। পাপিয়ার ঘরে দুজন মানুষ এসে ঢোকে। মানুষ দুজনের কেউই পাপিয়ার দিকে মনোযোগী হয় না। একে অপরের শাড়ি, তাদের গলার সোনার দুই ভরি ওজনের চেন নিয়ে খুব কথা বলতে শুরু করে পাপিয়ার বিছানার অদূরে রাখা চেয়ারে বসে। তাদের মাঝের একজন উঠে গিয়ে ঘরের উজ্জ্বল বাতিটা জ্বেলে দেয়।
ও বুভুক্ষের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে যদি বা তারা কেউ ওর দিকে তাকায়, ওর এই অদ্ভুত শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার জন্য যদি একটু হলেও সহানুভূতিশীল হয় ওর প্রতি! অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তাদের সাড়া না পেয়ে পাপিয়া পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে বিছানা থেকে নামে। মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে ঐ দুজন নারীর দিকে আগায় ও। অল্প বয়সী নারীটা পৌঢ়া নারীটির দিকে তাকিয়ে বলে –
ইশ কোথায় নিয়ে এলে মা? দেখো তো কেমন অদ্ভুত বাজে দেখতে একটা জন্তু আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আবার হামাগুড়ি দিয়ে এদিকেই আসছে। চলো এখান থেকে। অল্প বয়সী নারীটি গা শিউরে ওঠা একটা ভাব নিয়ে দুই পা তুলে চেয়ারের উপরে নিয়ে যায়।
ইশ দেখতে কেমন বাজে দেখেছো মা? গলার সামনে কাঁটা কাঁটা, রক্ত , পুঁজ সব কিছু গলা বেয়ে বেয়ে পড়ছে। মুখের ভেতরে দাঁত নেই, মাথার তালুতে জায়গায় জায়গায় চুল নেই! ভীন গ্রহের কেউ নয় তো!
পৌঢ়াটির মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা যায় না। হয়তো সেও পাপিয়াকে দেখে ভয়ে নিজের দু পা চেয়ারের উপর তুলে বসবে। আবার এমন নাও ঘটতে পারে। হয়তো পৌঢ়াটি চিনতে পারবে এটি তারই মেয়ে পাপিয়া।
অকারণ বিশৃঙ্খল চিন্তা এসে এসে ওকে গভীর সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে একবার, আরেকবার কাছে টেনে আনছে। ছায়াচ্ছন্ন ঘোরের কারণেই হয়তো সে নারী দুজনের কেউই পাপিয়ার চোখের শিশির বিন্দু দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পাচ্ছে না ওর নিদ্রাকাতর চোখ, ক্লান্ত শরীরের ধীরগতিতে ক্ষয়ে পড়া। চারিদিকের ভোগ আর সুখের বিচিত্র আয়োজনের গোলকধাঁধায় এতো এতো বিস্ময় ছড়িয়ে আছে যে এর রহস্যময়তায় পাপিয়ার বড্ড ভয় হয়। বিস্ময়ের বিদ্যুৎতরঙ্গ পাপিয়াকে স্থির করে রাখে।
পাপিয়া তাকিয়ে থাকে সে দুজন নারীর দিকে। পাপিয়া এবং তাদের মাঝখানের যে দূরত্ব সে যেন কোটি কোটি মাইল দূরত্বে অবস্থান করা মহাজাগতিক কোনো নক্ষত্রের মতোই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার মতো। তবুও পাপিয়া আকুল হয়ে একবার পৌঢ়া নারীটির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে –
মা, মা গো , আমি মারা যাচ্ছি। আমার শরীরের সমস্ত রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে। এই দেখো গলা টা কেটে গেছে কী বিচ্ছিরি ভাবে! আমাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও না মা!
পৌঢ়াটি নিরুত্তর।
মাথা কাঁত করে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে পাপিয়াকে কয়েকবার দেখে। তার চোখের মণিজোড়ায় শনিগ্রহের অগ্নিমত্ত কোনো বলয়ের অবিরাম ঘূর্ণন চলছে যেন। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্যই। ধীরে ধীরে সে মণিজোড়া শিশির বিন্দুর মতোই অদৃশ্য হয়ে এক বীভৎস রূপ ধারণা করে। খেনো গলায় অল্প বয়সী নারীটির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে –
আয় চলে যাই এখান থেকে।
পাপিয়ার জাগতিক কিংবা অজাগতিক চোখজোড়া ক্রমশই একাকীত্বের ভয়ে বা মৃত্যুভয়ে ঝাপসা হয়ে আসে তাদের প্রস্থানের কথা ভেবে। ও স্থানু হয়ে থাকে। অতঃপর মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে দেখে অন্য এক আলোর আগমন। জলপাই রঙা আলোতে উদ্ভাসিত কেউ একজন সামনে দাঁড়িয়ে, হাত বাড়িয়ে। তার প্রতি কদমে কদমে সুবাসময় অস্থির এক আলোকরেণুর ছড়াছড়ি।
অনেক আগের হারিয়ে যাওয়া কিংবা কাছেই ছিল নিভৃতে এমন একজনের আগমন, হাত বাড়িয়ে দেয়া মুহূর্তেই পাপিয়াকে বিগত ভৌতিক কিছু অনুভব ভুলিয়ে দিতে বলে ওঠে,
ভয় পেয় না বন্ধু! আমি আছি তো! চলো তোমাকে আলোর কাছে নিয়ে যাবো।
পাপিয়া পরম নির্ভরতায় মুনের হাত ধরে ওর অনিবার্য পতন ঠেকায়। ওরা প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে এ কামরা থেকে ও কামরায় যায়। মুন ওকে প্রতি কামরার জানালা খুলে খুলে দেখায়, আলোর কাছে নিয়ে যায়। বলে –
দেখো, কোথাও আঁধার নেই।
কোনো অশুভ কিছু লুকিয়ে নেই আড়ালে। কেউ তোমাকে মেরে ফেলতে বা নরকে নেয়ার জন্য আসবে না। তুমি স্বাধীন, তুমি মুক্ত।
মুনের কথা পাপিয়ার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ওর দ্বিধান্বিত চেহারা দেখে মুন ওকে ওদের বাড়ির শেষ কামরাটায় নিয়ে যায়।
দৌড়ে দৌড়ে জানালা খোলে, পর্দা সরিয়ে দেয়। একবারও পাপিয়ার মনে হয় না কিংবা মনে করতে চায় না এতো বছর পর ওর বন্ধু কী করে ওর এমন দুঃসময়ে সামনে এসে দাঁড়ালো, কী করে অস্তিত্বের সংকটে ওকে সাহস দিতে এগিয়ে এলো! এ কামরাটা খুব পরিচিত মনে হতে থাকে পাপিয়ার। ও মুনকে বলেও একবার সে কথা।
ওমা তুমি ভুলে গেছো? এ তো তোমার স্বপ্নের ঘর, এ রুমে বসে তুমি পড়তে। যখন আকাশে মেঘ করতো, বৃষ্টি ঝরতো তুমি জানালা খুলে হাত বাড়িয়ে দিতে! ভুলে গেছো? সময় সময় আমিও থাকতাম তোমার সাথে!
পাপিয়া মনে করার চেষ্টা করে।
আসলেই এ কী স্বপ্নের ঘর? ও যে ঘরটায় ছিল কিছুক্ষণ আগেও সেটা তো অনেক উঁচুতে ছিলো, আকাশের কাছাকাছি। কিন্তু এ ঘরটা তো মাটির কাছাকাছি। ঐ যে বাইরে মাঠে হাঁস-মুরগী ছুটোছুটি করছে। রোদের কাঁচা গন্ধ আসছে। নাক ভরে ঘ্রাণ নেয় পাপিয়া।
চোখ বন্ধ করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে ভয়হীন, শঙ্কাহীন একটা সময়। হঠাৎ করেই একটা প্রাইভেট গাড়ি থামার শব্দ আসে পাপিয়ার কানে। চোখ খুলে দেখতে পায় জানালার কাছ ঘেঁষে একটা ধূসর, জায়গায় জায়গায় রঙ চটে সাদা হয়ে গিয়েছে এমন একটা গাড়ি এসে থামে। সেটা দেখে পাপিয়া আর্ত চিৎকার করে ওঠে। সেই চলে যাওয়া ভয়টা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে আবার বেঁধে ফেলে।
ভয়টা যেন ভুল ক্রমে ওর পেটের মাঝে ওঁত পেতে ছিলো, কেমন কিলবিলিয়ে ভেতর থেকে উঠে আসে। পাপিয়া একদল মৃত মানুষের ছায়ার মিছিল দেখতে পায় চক্রাকারে গাড়ির সামনে ঘুরছে। তাদের কাঁধে লাশ বহনকারী খাট, কাফনের সাদা কাপড়। ধীরে ধীরে গাড়ির সামনের গ্লাসটি নিচের দিকে নামতে থাকে। পাপিয়া তীব্র ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
এদিকে মুন ওর গা ধরে ঝাঁকাতে থাকে –
পাপিয়া চোখ খোলো। যা দেখছ সব তোমার কল্পনা। কেউ তোমাকে নিতে আসে নি, জানালার সামনে ধূসর রঙ চটা কোনো গাড়ি এসে থামেনি। সব ভুল! অশুভ শক্তির প্ররোচনা! চোখ খোলো, সামনে তাকাও!!!
ধীরে ধীরে পাপিয়া চোখ খোলে। চোখের পল্লবে এখনো ওর ভেজা পরশ।
দারুন ভাবে অচেনা পৃথিবীটা ওর কাছে চেনা হতে থাকে, পরিচিত পরশে, পরিচিত শব্দে। অতঃপর রাত্রি গড়িয়ে যায় ভোরের মায়াময় হলুদে।
সমাপ্ত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।