মাদানী প্রেমিক ফুলবাড়িয়ার হুযূর (রাহ.)
হাফেজ মাওলানা ইয়াহইয়া জাহাঙ্গীর
শায়খুল ইসলাম সায়্যেদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ.-এর আশেক আলহাজ্ব হযরত মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান ফুলবাড়িয়ার হুজুর (রাহ.) ০২-০৫-১৮৮৯ঈ. বি.বাড়ীয়া জেলার ফুলবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলহাজ্ব মুনাওয়ার আলী (রাহ.)। মাতার নাম উম্মে জামীল (রাহ.)।
পিতা আলহাজ্ব মুনাওয়ার আলী (রাহ.) একজন বড় আল্লাহওয়ালা ও আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন। একজন মজযূব প্রকৃতির বুযুর্গ হিসেবে তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল।
ইবাদতের প্রতি ছিল তাঁর আসক্তি। হৃদয়ে ছিল গভীর আল্লাহ-প্রেম। সেই আসক্তি ও প্রেমের তাড়নায় তিনি দীর্ঘ ছয় মাস পায়ে হেঁটে মক্কা মুকাররমা গমন করেন এবং পবিত্র হজ্ব আদায়ের পর দীর্ঘ ছয় মাস পায়ে হেঁটে দেশে ফিরে আসেন। আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে থাকা তাঁর বিশেষ পছন্দ ছিল। জীবনের সিংহভাগ সময় তাদের সাহচর্যেই কাটিয়েছেন।
মাওলানা কারামত আলী ছাহেব (রাহ.)-এর পুত্র হাফেজ মাওলানা আহমদ ছাহেব (রাহ.)-এর সাথে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। যিনি ঢাকা চকবাজার জামে মসজিদ সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শেব চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। আলহাজ্ব মুনাওয়ার আলী (রাহ.) সর্বক্ষণ পাগড়ি পড়ে থাকতেন এবং তাঁর মুখে সর্বক্ষণ আল্লাহ তা’আলার যিকির জারি থাকত।
হযরত মাওলানা (রাহ.)-এর ‘মা’ও একজন পরহেযগার ও আল্লাহ তা’আলার খাস বান্দী ছিলেন। তিনি একজন দরদী মুআল্লিমাও ছিলেন।
গ্রামের মেয়েদেরকে গভীর মমতার সাথে কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিতেন। দ্বীনি শিক্ষার গুরুত্ব ও মর্যাদা তিনি তীব্রভাবে অনুভব করতেন, যে কারণে তিনি উলামায়ে কেরামের বড় কদর করতেন এবং নিজ সন্তানরাও যাতে আলেম হতে পারে সেই আকাঙ্ক্ষা অন্তরে লালন করতেন। সেই আকাঙ্ক্ষারই ফল যে, আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছায় তাঁর চার ছেলেই দ্বীনী শিক্ষা লাভ করেছিলেন। বড় ছেলে মাওলানা সিরাজুল ইসলাম (সেকান্দর মৌলভী) ও ছোট ছেলে মাওলানা সিদ্দীকুর রহমানকে তো উচ্চতর দ্বীনী শিক্ষা দানের জন্য দারুল-উলূম দেওবন্দ পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন এবং সেজন্য জমি বিক্রি করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। এটি তাঁর ইলমে দ্বীনের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আল্লাহ তা’আলার উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুলের পরিচায়ক।
প্রাথমিক শিক্ষা
পূর্বেই বলা হয়েছে, মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান ছাহেবের মুহতারামা আম্মাজান একজন পরহেযগার ও বিদুষী মহিলা ছিলেন। কাজেই মায়ের কাছেই তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। পবিত্র কুরআন মাজীদের শিক্ষা তিনি মায়ের নিকটই গ্রহণ করেন। তারপর শহীদবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ায় ভর্তি হন। এর প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাঁর বড় ভাই মাওলানা সিরাজুল ইসলাম রাহ.-এর কাছেই তিনি ইলমে দ্বীনের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।
তারপর মাছিহাতার প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মুসলিহুদ্দীন (রাহ.)-এর সাথে চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদরাসায় গমন করেন এবং সেখানে জালালাইন জামাত পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এসময় তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে মাওলানা মুসলিহুদ্দীন (রাহ.) তাঁকে বাড়িতে মায়ের কাছে পৌঁছে দেন। অতপর তাঁর মহিয়সী মা জমি বিক্রি করে সেই অর্থ দ্বারা তাঁকে বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপিঠ দারুল উলূম দেওবন্দে পাঠান। তিনি একটানা পাঁচ বছর সেখানে অবস্থান করেন এবং শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী (রাহ.)-এর অত্যন্ত প্রিয়পাত্রে পরিণত হন।
দারুল উলূমের ছাত্রাবস্থায় সর্বদা মাদানী মনজিলেই তার খাওয়া দাওয়া হত। দারুল উলূম থেকে প্রাপ্ত ভাতা তাঁর সহপাঠী বন্ধু ঢাকা ফরিদাবাদ মাদরাসার সাবেক মুহতামিম হযরত মাওলানা বজলুর রহমান সাহেব (রহ.) কে হাদিয়া করে দিয়েছিলেন।
বৃটিশবিরোধী আযাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ
আদর্শ ছাত্র তাঁর আদর্শ উসতাযের চিন্তা-চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সে অনুযায়ী হযরত মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান (রাহ.)-এর উপর তাঁর মহান উস্তায হযরত মাদানী (রাহ.)- এর আখলাক-চরিত্র ও চিন্তা-চেতনার যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। সময়টা ছিল বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের।
সারা ভারতবর্ষ তখন সে আন্দোলনে উদ্দীপিত। হযরত মাদানী (রাহ.) ছিলেন তার এক অগ্রসেনানী। তাঁর বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও ভক্ত তাঁর সৈনিকরূপে সে আন্দোলনে তৎপর ছিল। মাওলানা সিদ্দীকুর রহমানও বিপুল উদ্যমে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর কর্মতৎপরতায় খুশি হয়ে হযরত মাদানী (রাহ.) তাঁকে সাতশত কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকের প্রধান করেছিলেন।
এভাবে পূর্ণ পাঁচ বছর তিনি মহান
উস্তাযের নিকট শিক্ষাগ্রহণ ও তাঁর নির্দেশ মোতাবেক দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিবেদিত থাকেন।
শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানী (রাহ.) ছাড়া দারুল উলূম দেওবন্দে তাঁর আরও উল্লেখযোগ্য উস্তায ছিলেন শায়খুল আদব হযরত মাওলানা ই‘যায আলী (রাহ.)।
কর্মজীবন
দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি যখন দেশে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন হযরত মাদানী (রাহ.) তাকে বি.বাড়িয়াস্থ জামিয়া ইউনুসিয়ায় ইলমে দ্বীনের খিদমতে আত্মনিয়োগ করার নির্দেশ দেন। হুকুম ছিল- মাদরাসা থেকে তুমি কোন ওজিফা (বেতন-ভাতা) গ্রহণ করবে না। তিনি খুশী মনে তা মেনে নেন।
শুধু এতটুকু আরয করেছিলেন যে, হযরত আমার তো যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা জমি নেই। হযরত মাদানী এক কথায় মনের সব দুর্বলতা ঘুচিয়ে দেন। তিনি বললেন, ‘তোমার জন্য কি আল্লাহ যথেষ্ট নন?’ পরম প্রিয় উস্তাযের দুআ মিশ্রিত ও স্বস্তিদায়ক এ বাক্য শোনামাত্র তাঁর মনের সব দুর্বলতা দূর হয়ে গেল। ঠিকই তো আল্লাহ যার সঙ্গে আছেন তার আর প্রয়োজন কিসে? ইলমে দ্বীনের খেদমতে যে নিজেকে উৎসর্গ করবে সে তো আল্লাহরই সেবক। আর আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা অনুযায়ী, যে আল্লাহর সাহায্য করবে আল্লাহ অবশ্যই তাঁর সাহায্য করবেন।
সুতরাং তিনি আল-হামদুলিল্লাহ বলে দেশে চলে এলেন এবং নির্দেশমত জামিয়া ইউনুসিয়ায় তালীমের খেদমতে আত্মনিয়োগ করলেন। মৃত্যু পর্যন্ত সুদীর্ঘ (প্রায়) পচাত্তর বছর তিনি এই মাদরাসায় শিক্ষকতা করতে থাকেন। প্রথম পঁচিশ বছর তিনি কোনও রকম ওজীফা গ্রহণ করেননি। তারপর একটি দুর্ঘটনা ঘটে যে কারণে তৎকালীন জামিয়ার প্রধান হযরত ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম (রাহ.)-এর নির্দেশে তিনি মাদরাসা থেকে ওজীফা গ্রহণে সম্মত হন।
মোটকথা তিনি এভাবে একটানা পঁচাত্তর বছর একই প্রতিষ্ঠানে ইলমে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত থাকেন।
মানুষের কর্মজীবনে এটা একটা বিরল ঘটনা। এটি তাঁর ইসতিকামাত ও অবিচলতা এবং অসাধারণ আত্মসংযম ও ধৈর্য্যের পরিচয় বহন করে। এ সময়কালে তিনি মৌলিক কিতাবসমূহের পাঠদান করেছেন।
তাঁর তাদরীসী বৈশিষ্ট্য
তিনি নিয়মিত দরস দান করতেন। কঠিন অসুস্থতা ছাড়া কখনও দরসে অনুপস্থিত থাকেননি।
প্রতিদিনের পাঠদানের অংশটুকু ভালোভাবে বুঝে পড়াতেন। গোলমেলে বা অস্পষ্ট দরসদান পসন্দ করতেন না। এ সংক্রান্ত একটি অনুকরণীয় ঘটনা।
১৯৬৬ ঈ.-এর কথা। একদিন জামিয়ার প্রাচীন ভবনের দক্ষিণ পার্শ্বে ফিকহের মৌলিক কিতাব ‘নূরুল ঈযাহ’-এর দরস দিচ্ছেন।
ছাত্রদেরকে একটি মাসআলা মনোযোগ দিয়ে বোঝাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎই তার মাসআলাটির আরবী পাঠের মর্মোদ্ধারে কিছুটা সংশয় দেখা দিল। তৎক্ষণাৎ তিনি দরস থেকে উঠে গেলেন। ছাত্রদেরকে বললেন, তোমরা একটু বস। আমি মৌলভী নূরুল্লাহর কাছ থেকে বুঝে আসি (অর্থাৎ তাঁর প্রিয় ছাত্র স্বনামধন্য মুফতী মাওলানা নূরুল্লাহ ছাহেব রাহ., যিনি তখন ভবনের উত্তর দিকে মিশকাত শরীফের দরস দিচ্ছিলেন। ) কী অসাধারণ বিনয় ও বেখোদী! উস্তায কিতাব বোঝার জন্য ছুটে চলেছেন তাঁরই প্রাক্তন ছাত্রের কাছে!! বর্তমানকালের মুদাররিসীনের জন্য এ ঘটনায় শিক্ষাগ্রহণের অনেক খোরাক আছে।
তো কিতাব নিয়ে তিনি সোজা মুফতী সাহেবের ছারসে হাজির হয়ে গেলেন। মুফতী ছাহেব তো
উস্তাযকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং পরম বিনয়ের সাথে আরয করলেন, হুযূর! কী প্রয়োজন? কষ্ট করে নিজে কেন এলেন? হুকুম করলেই তো নূরুল্লাহ খেদমতে গিয়ে হাজির হয়ে যেত। উস্তায বললেন, মিঁয়া, ওসব কথা রাখ। আমি কিতাবের এই জায়গাটা ভালোভাবে বুঝতে পারছি না। তুমি একটু বুঝিয়ে দাও।
ছাত্ররা বসে আছে। মুফতী ছাহেব নিজ ছাত্রদের সামনে তখন উস্তাযকে যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা উস্তায-ছাত্র সম্পর্কের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তিনি বিনয়ের সাথে বললেন, হযরত! নূরুল্লাহর কাছে কী ইলম আছে? আর সে কী বলবে? বহুদিন আগে ছোটবেলায় যখন এ কিতাব আপনার কাছে পড়েছিলাম, তখন আপনি এ ইবারতের এরকম অর্থ করেছিলেন। সাথে সাথে উস্তাযের সংশয় দূর হয়ে গেল এবং ছাত্রকে ‘জাযাকাল্লাহ্’ বলে নিজ দরসে চলে গেলেন।
ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য
১. ইবাদাত
তিনি বড় ইবাদতগোযার ছিলেন।
নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। বি. বাড়িয়া জামে মসজিদে তাহাজ্জুদ আদায়ের পর সেখানে ফজরের নামায পড়তেন। তারপর সকাল ৭/৮টা পর্যন্ত যিক্র আযকার, অজীফা পাঠ ও কুরআনের তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। বেশিরভাগ সময়ই তিনি কুরআন তিলাওয়াতে কাটাতেন। প্রতি রমযান মাসে দিনভর শহরের বিভিন্ন মসজিদের তারাবীর হাফেজগণ মাদরাসা-মসজিদে এসে একের পর এক তাঁকে তারাবীর পারা শোনাতেন।
তিনি ধৈর্য সহকারে প্রত্যেকের পারা শুনতেন।
২. উস্তায-ভক্তি
তাঁর উস্তায-ভক্তি ছিল অসাধারণ। জীবনে যার যার কাছ থেকেই কিছু শিখেছেন তাদের সকলকে প্রাণভরে ভালোবাসতেন ও হৃদয় দিয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। উস্তায-ভক্তির তো বহু ঘটনাই আছে। একদিন তিনি শহরের রাস্তা দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ কে একটা সংবাদ দিল আর তা শোনামাত্র তিনি ফুটপাথে বসে পড়লেন এবং ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দিলেন। তা দেখে বহু মানুষ জড়ো হয়ে গেল। তারা কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমার এক উস্তাযের ইন্তিকাল হয়ে গেছে। লোকেরা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, হুজূর! এ এলাকার প্রায় সকল আলমই তো আপনার ছাত্র, আপনার আবার উস্তায কে? বললেন, জামে মসজিদের ইমাম সাহেব আমার উস্তায। সকলে অবাক! তিনি আবার তার উস্তায হন কী করে? ক্রন্দনরত অবস্থায়ই বললেন, বহুদিন আগে আমি তাকে আয়াতুল-কুরসী শুনিয়ে সংশোধন করেছিলাম।
তাতে আমার উচ্চারণে একটা ভুল ছিল।
চিন্তা করুন উস্তায-ছাত্র সম্পর্ককে তিনি কী সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতেন এবং কী গভীর অনুভূতির সাথে তার মূল্যায়ন করতেন। চরম অবক্ষয়ের এ যুগে তাঁর এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন আছে।
এ ছাড়া তাঁর খাস উস্তায ও মুরুববী শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী (রাহ.)- এর প্রতি তাঁর ভক্তি ভালোবাসা যে কী পরিমাণ ছিল তা আমাদের পক্ষে অনুমান করাও কঠিন। যখনই তাঁর সামনে তাঁর কথা উঠত তখন চোখ ছাপিয়ে যে অশ্রুধারা প্রবাহিত হত সহজে তা আর থামতে চাইত না।
এমনকি অনেক সময় কান্নার ফলে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যেত। দেওবন্দ থেকে দেশে ফেরার সময় হযরত মাদানী (রাহ.) তাঁর প্রিয় ছাত্রকে ইয়াদগার ও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নিজ মাথার টুপিটি হাদিয়া দিয়েছিলেন। তিনি সারা জীবন পরম যত্নের সাথে তা হেফাজত করেছিলেন। মাঝে-মাঝে সেটি বের করে চুমু খেতেন আর তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর ঢল নামত।
ইন্তিকালের দু’বছর আগে নিজ পুত্রকে সেই টুপিটি এই বলে হাদিয়া দেন যে, আমি তোমাকে এমন এক মূল্যবান সম্পদ দিয়ে যাচ্ছি, দুনিয়ার কোনো পিতা তার পুত্রকে এ রকম সম্পদ দিতে পারবে না।
৩. খেদমতে খাল্ক
সকল শ্রেণীর লোকের সাথে তাঁর ছিল মহববত ও ভালোবাসার সম্পর্ক। প্রত্যেকেই বলত, ফুলবাড়িয়া হুযূর আমাকে বেশি মহববত করেন। গরিব ও অসহায় লোকদের প্রতি সমব্যথী থাকতেন। কোনো গরিব লোকের বিপদ-আপদের কথা শুনলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন এবং সাধ্যমত তার সাহায্য সহযোগিতা করতেন। এ ব্যাপারে হিন্দু-মুসলিম কোন ভেদাভেদ ছিল না।
বি.বাড়িয়া পাওয়ার হাউজ রোডের পথে এক জীর্ণ কুটিরে এক হিন্দু বিধবা বাস করত। ফুলবাড়িয়া হুজূর প্রায়ই তার খোঁজ-খবর নিতেন এবং নিজে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি কেমন আছ? দিন কীভাবে চলছে? তারপর তার হাতে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে আসতেন। ঝড়-বৃষ্টি হলে নিজে গিয়ে বা কাউকে পাঠিয়ে তার অবস্থা জানতেন। প্রয়োজনে টাকা দিয়ে তার ঘর মেরামত করে দিতেন।
৪. বিনয়-নম্রতা
তিনি অত্যন্ত নিরহংকার প্রকৃতির লোক ছিলেন।
কখনও কোনও বিষয়ে অহংকার দেখাতেন না বা দর্প করতেন না। একদম সাধারণ লোকের সংগে মিশতেও তাঁর কুণ্ঠাবোধ হত না। কিতাব বোঝার জন্য ছাত্রদের সামনে নিজ প্রাক্তন ছাত্র হযরত মুফতী নূরুল্লাহ ছাহেবের কাছে ছুটে যাওয়ার ঘটনা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটিও তাঁর বিনম্র- স্বভাবের একটি আদর্শ ঘটনা। তাঁর জীবনে বিনয় ও নম্রতার এ রকম হাজারও ঘটনা আছে। তাই বলে শরঈ ব্যাপারে তিনি কখনো আপোষ করতেন না।
দ্বীন-বিরুদ্ধ কোনো কিছু নজরে এলে তিনি সিংহের মতো গর্জে উঠতেন এবং ‘আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকারে’র দায়িত্ব পালনে তৎপর হতেন।
৫. জিহাদী জযবা
যৌবনকালে ছাত্রাবস্থায় হযরত মাদানী (রাহ.)-এর নেতৃত্বে যেভাবে বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি সেভাবেই অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে জেহাদী জযবা লালন করে গেছেন। বয়স যখন একশ বছর, সে সময়কার ঘটনা। ফুলবাড়িয়ার দক্ষিণ গ্রাম গজারিয়াতে কিছু লোকের উদ্যোগে একটি যাত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গ্রামের এক লোককে মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে তার ধানী জমি কেটে প্যান্ডেল তৈরী করা হয় এবং চারদিকে তা প্রচারও করা হয়।
এ
দুঃসংবাদ যখন ফুলবাড়িয়ার হুযূরের কানে পৌঁছল তিনি সংগে সংগে গর্জে উঠলেন এবং ঘোষণা দিলেন, আমার এলাকায় এ রকম ইসলাম-বিরোধী কাজ হতে দেয়া হবে না। প্রয়োজনে রক্ত দেব, শাহাদাত বরণ করব, তবু এই জঘণ্য পাপ কাজ হতে দেব না। সুতরাং প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তিনি লাঠি ভর করে বের হয়ে পড়েন। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী গ্রাম চান্দপুর, জগৎসার, ভাটপাড়া ও গজারিয়ার বিভিন্ন মসজিদে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে একত্র করে যাত্রার ক্ষতি সম্পর্কে বোঝাতে থাকেন। এভাবে এলাকায় যাত্রা-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন।
যে লোকটির জমিতে প্যান্ডেল করা হয়েছিল তার বাড়িতে গিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু টাকার লোভে সে বুঝ গ্রহণ করেনি। ফলে হুযুর মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে আসেন। দু’দিন পর লোকটি মারা যায় এবং এর ফলে এলাকার লোকদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও আতংক সৃষ্টি হয়। অবশেষে হযরতের আন্দোলন সফল হয় এবং যাত্রার উদ্যোক্তারা রাতের অন্ধকারে প্যান্ডেল খুলে ফেলে এবং যাত্রার সরঞ্জামাদি নিয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়।
ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
ব্যক্তিগত আমল
আগেই বলা হয়েছে, তিনি অত্যন্ত আমলদার ও ইবাদতগোযার লোক ছিলেন। সুন্নত অনুযায়ী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি রাস্তায় চলাচলের সময় বেশি বেশি পড়তেন,
حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ، نِعْمَ الْمَوْلى وَنِعْمَ النَّصِيْرُ
পথে পড়ে থাকা কলা, আম, তরমুজ ইত্যাদির খোসা তুলে ডাস্টবিনে বা দূরে কোথাও ফেলে দিতেন, যাতে পথিক পা পিছলে পড়ে না যায়। ধান কাটার মৌসুমে ধান কাটার পর পরিত্যক্ত ধানের ছড়া চোখে পড়লে তা তুলে নিতেন এবং কোনো বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তা হাঁস-মুরগীর সামনে ফেলে দিতেন আর বলতেন, এতে এ সকল প্রাণীর দুআ পাওয়া যাবে।
কারও পক্ষ থেকে সামান্য একটু উপকার পেলেও তাকে এই বলে দুআ দিতেন-জাযাকাল্লাহু খাইরান ফিদ দারাইন। ‘আল্লাহ তোমাকে উভয় জাহানের উত্তম বিনিময় দান করুন। আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের খোঁজ-খবর নেওয়াও তাঁর নিয়মিত কাজের অংশ ছিল। প্রতিদিন আসরের পর শহরে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়ে তাদের খোঁজ খবর নিতেন। বাড়িতে কখনও ভালো কিছু রান্না হলে প্রতিবেশী ও গ্রামের মুরুববী অথবা অসহায়দের বাড়িতে একটা অংশ পাঠিয়ে দিতেন।
বুযুর্গানে দ্বীনের ইহতিরাম
বুযুর্গানে দ্বীনের ইহতিরাম রক্ষা করা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কখনও তাঁদের সমালোচনা করতেন না এবং তা করা পছন্দও করতেন না। আমার নিজের জীবনের ঘটনা, ১৯৬৬ ঈসাব্দে হযরত মাওলানা আতহার আলী (রাহ.) প্রতিষ্ঠিত কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়ায় পড়াকালে প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন দানা বেধে ওঠে। অধিকাংশ ছাত্র-উস্তায তাতে জড়িয়ে পড়েন। সে আন্দোলনে যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করা হত তা শুনে শুনে আমি একদিন বাড়িতে আববার কাছে তা উল্লেখ করি।
তা শুনে তিনি খুব দুঃখ পান এবং পুত্রকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার্থে উপদেশ দেন যে, বাবা! হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ. হযরত থানভী রাহ.-এর একজন বিশিষ্ট খলীফা। তুমি লোকমুখে তাঁর সম্পর্কে যেসব কথা শুনেছ, আল্লাহ না করুন তা যদি সত্যিও হয়, তবে এক রাতের এক তাহাজ্জুদের পর এক মুনাজাত দিয়েই তিনি নিজ মাবূদকে সন্তুষ্ট করে নিবেন, যা তুমি চৌদ্দ মাসেও পারবে না। কাজেই সাবধান! কখনও বুযুর্গানে দ্বীনের সমালোচনায় কান দেবে না। আববাজানের সেই কথা দিলে এমন আছর ফেলেছে তারপর আর ভুলেও হযরত মাওলানা আতহার আলী রাহ.- এর কোনো সমালোচনা যবান থেকে বের হয়নি। বস্ত্তত আলেম-উলামার সমালোচনা নিজ জীবনের জন্য ধ্বংসাত্নক।
পবিত্র হজ্ব আদায়
কীভাবে তাঁর পবিত্র হজ্ব আদায়ের সৌভাগ্য হল তার সাক্ষী আমি নিজেই। আমার মুহতারাম আববা-আম্মা ও আসাতিযায়ে কিরামের দু’আর বরকতে আল্লাহ তা’আলা আমাকে বহুবার বায়তুল্লাহ শরীফের মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন- আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আববাজান যেহেতু চরম বার্ধক্যে পৌঁছে গিয়েছিলেন, বয়স একশত বছর পার হয়ে গিয়েছে, বড় কমজোর হয়ে পড়েছেন, লাঠির সাহায্যে রুকুর হালতে চলাফেরা করেন, তাই তাঁকে বায়তুল্লাহ শরীফের সফরে নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা কখনও মনে জাগেনি। হাঁ তাঁর পক্ষ থেকে একাধিকবার উমরা আদায়ের তাওফীক হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।
১৯৯৫ সনের কথা। পবিত্র হজ্ব আদায়ের পর কিছুদিন হরম শরীফে থাকার সুযোগ হয়। একদিন তাওয়াফকালে একটি আশ্চর্য হৃদয়কাড়া দৃশ্য চোখে পড়ল। দেখি, পাকিস্তানী এক নওজওয়ান তার কবুতর ছানার মত জরাজীর্ণ বৃদ্ধা মাকে চাদর দিয়ে পিঠে বেঁধে নিয়েছেন এবং কাঁধের উপর দিয়ে তার দু’হাত ধরে রেখেছেন। আর অতিরিক্ত সাবধানতাস্বরূপ নিজে কুজোঁ হয়ে আছেন।
মা-পুত্রের এই মর্মস্পর্শী দৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করল। আমি সেই ভাগ্যবান যুবকটির কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার পিঠে ইনি কে? তিনি আনন্দ-বিগলিত কণ্ঠে হাসিমুখে বললেন, আমার সম্মানিত মা?। বললাম, তুমি ভাগ্যবতী মায়ের সৌভাগ্যবান পুত্র। তিনি বললেন, দুআ করবেন যেন আল্লাহ তাআলা কবুল করেন। সেই মুহূর্তে আমার নিজের বাবার কথা মনে পড়ল।
আল্লাহ তাআলার কুদরত ও মেহেরবানীর উপর ঈমান আরও তাজা হয়ে উঠল। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। তাওয়াফ শেষে
দু’রাকাত নামায আদায় করলাম। তারপর দ্রুত মুলতাযামে চলে
গেলাম, যেখানে দু’আ করলে আল্লাহ তা’আলা কবুল করে নেন। আমি মহা করুণাময়ের উপর পূর্ণ আস্থার সাথে কাবা ঘরে হাত রাখলাম এবং হৃদয়-মনের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে বললাম, হে কাবাঘরের মহান মালিক! এই পাকিস্তানী বৃদ্ধাকে যদি তোমার ঘরের মেহমান বানিয়ে ধন্য করতে পার, তবে আমার আববা কেন বঞ্চিত হবেন? তিনি তো ওই বৃদ্ধা অপেক্ষা কিছুটা ভালো, নিজে নিজে হাঁটতে পারেন।
দয়াময়! তুমি তাকেও তোমার ঘরের মেহমান হওয়ার সুযোগ দাও। মনে হয় সেই অশ্রু নিবেদন আল্লাহ তা’আলা মঞ্জুর করেছিলেন। পরের বছরই ১৯৯৬ সনে আববাজানকে নিয়ে বায়তুল্লাহ শরীফে সফর করার সৌভাগ্য লাভ হয়-আলহামদুলিল্লাহ।
বিবাহ
জামিয়া ইউনুসিয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইউনুস সাহেব রাহ.-এর পছন্দমত সরাইল আঁখিতারা গ্রামের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁর সহধর্মিনীর নাম জামীলা খাতুন।
তাঁর সন্তান-সন্তুতি সাতজন। পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা।
উল্লেখযোগ্য ছাত্রগণের নাম
সুদীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তাঁর হাতে অসংখ্য আলেম-উলামা তৈরী হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন শায়খুল হাদীস মাওলানা আজীজুল হক রাহ., মাওলানা আব্দুল হক শায়খে গাজীনগরী রাহ., মাওলানা মুফতী নূরুল্লাহ রাহ., মাওলানা ফয়জুদ্দীন রাহ.(প্রাক্তন মুহাদ্দিস ও মুহতামিম জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা), মাওলানা মুফতী হাবীবুর রহমান, কমলপুর ভৈরব প্রমুখ।
ইন্তিকাল
তিনি ২৭শে জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৪ হি. মোতাবেক ২৭ আগস্ট ২০০৩ ঈ. , ১২ই ভাদ্র ১৪১০ বাংলা রোজ বুধবার ফজরের আযানের পর ইন্তিকাল করেন।
ফুলবাড়িয়া ঈদগাহ ময়দানে জানাযা হয়। তাঁর তৃতীয় সন্তান (লেখক) তাতে ইমামতি করেন। বিপুল সংখ্যক ছাত্র, ভক্ত-অনুরক্ত, উলামা মাশায়েখ ও সাধারণ মানুষ জানাযায় শরীক হন। ফুলবাড়িয়া জামে মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।