আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খেলার তারা ঝলমলে মেলা

নাটক। সাসপেন্স। উত্তেজনার দোলাচল। মঞ্চে ঘোষিত হলো তাঁর নাম। তিনি ছুটলেন।

মুহূর্তেই থামিয়ে দেওয়া হলো, না তিনি বিজয়ী নন। এমনি মজা করে বলা হয়েছে তাঁর নাম। হতাশ হয়ে বসে পড়লেন নাসির হোসেন। এক রানের জন্য সেঞ্চুরি হাতছাড়া হওয়ার মতো আক্ষেপ! বিমর্ষ। মুখে রক্তিম আভা।


পরের পুরস্কার। আবার ঘোষিত হলো তাঁর নাম। এবার তুমুল করতালি। নাসির যেন কিছুটা দ্বিধান্বিত। কিন্তু না।

কোনো সংশয় নেই। পাঠক বর্ষসেরা হিসেবে বেছে নিয়েছেন নাসিরকেই। নাসির মঞ্চে উঠলেন। হাতে তুলে নিলেন ক্রেস্ট। কী এক অদ্ভুত ক্লাইম্যাক্স আর অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সের খেল! একটা সার্থক নাটকের চিত্রনাট্যে সবকিছুই থাকতে হয়।

হাস্যরস থাকে। দর্শক হেসে লুটোপুটি। করুণ রস থাকে। দর্শকের চোখে বানভাসি স্রোত। সাসপেন্স থাকে।

দর্শকের নখ কামড়ানো উত্তেজনা।
কাল ঢাকার রূপসী বাংলা হোটেলের উইন্টার গার্ডেনে এমনই এক সার্থক নাটকের মঞ্চায়ন হলো। হাসি-কান্নার আবেগের সব স্রোত এসে মিশে গেল একই মোহনায়। যে নাটকের নাম গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার ২০১২।
দৃশ্যপটে না থেকেও যে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র আসলে শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলেন সাকিব আল হাসান।

নিজের প্রিয়তম খেলোয়াড় লিওনেল মেসির রেকর্ড ছুঁতে চেয়েছিলেন। এই কথা নিজ মুখেই বলেছেন গতবার। মেসিকে ‘ছুঁয়ে’ ফেললেন সাকিব। চারবারের মতো বর্ষসেরা হলেন তিনিও। সর্বশেষ পাঁচ বছরে চতুর্থবারের মতো তাঁর হাতে উঠল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারটি।

‘তাঁর হাতে’ লেখাটা বোধ হয় ভুলই হয়ে গেল। সহধর্মিণী সন্দর্শনে মার্কিন মুলুকে গেছেন সাকিব। তাঁর হয়ে কাল মঞ্চে উঠলেন মা শিরিন আক্তার। নিজের রক্ত-অশ্রু-হাড় দিয়ে নাকি মুক্তোর জন্ম দেয় ঝিনুক। রত্নগর্ভা মা।

মা তো। তাই পুত্রসাফল্যে উদ্ভাসিত জননী হয়েও কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। ’
অনুষ্ঠানের সবচেয়ে আবেগময় আখ্যানটি অবশ্য জন্ম নিল আজীবন সম্মাননার পুরস্কারের বেলায়। ষাটের দশকে খ্যাতির তুঙ্গে থাকা সাবেক ফুটবলার জহিরুল হক জীবনসায়াহ্নে এসে পেলেন অন্য রকম এক স্বীকৃতি। তাঁর নাম ঘোষণার আগে পর্দায় দেখানো হচ্ছিল ছোট্ট কিন্তু ভীষণ আবেগময় ভিডিওচিত্র।

সেই আবেগ ছুঁয়ে গেল প্রথম সারিতে তাঁর পাশেই বসা সহধর্মিণী সুরাইয়া হকের। দর্শক আসনের আলো-আঁধারিতেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তাঁর চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠা আবেগের বিন্দু। হল উপচানো দর্শক দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন যখন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা জহিরুল হকও আর আবেগের স্রোতে বাঁধ দিয়ে রাখতে পারেননি। একদম কাছ থেকে আবেগ ছলছল সেই দৃশ্যের সাক্ষী হলেন কাল অনুষ্ঠানে আসা তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, পুত্রবধূ, নাতিরাও।
উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ উঠেছিলেন বর্ষসেরা উদীয়মানের পুরস্কার দিতে গিয়ে।

এর আগে উদীয়মানের পুরস্কার জেতা জিমি, সাকিব, তামিম, এমিলিরা যে আজ সবাই প্রতিষ্ঠিত, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে জানালেন, বিচারকেরা হিরে চিনতে ভুল করেননি। এবারের তেমনই এক ‘হিরে’ হয়ে গেলেন এনামুল হক বিজয়।
বর্ষসেরা নারীর পুরস্কার নিতে গিয়ে লড়াইয়ের এক আখ্যান শোনালেন ভারোত্তোলক মোল্লা সাবিরা সুলতানা—আমাদের মেয়েদের যে সমাজের একটা অংশের রক্তচক্ষু আর ভ্রু কুঁচকানি অগ্রাহ্য করে, শত বাধার দেয়াল ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে হয়, সেই ভীষণ চেনা আটপৌরে গল্পটাই, ‘আমি তো কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। সেখানে জামায়াত-শিবিরের দাপট। তাদের কারণে ঠিকমতো অনুশীলন করতে পারতাম না।

ক্যাম্পাস থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে গিয়ে অনুশীলন করেছি। ’ দ্বিতীয়বারের মতো বর্ষসেরা নারীর পুরস্কার জেতা সাবিরা পেলেন তুমুল করতালি, তাঁর একলব্য-একাগ্রতার জন্য।
বর্ষসেরা দুই রানারআপের একজন হয়েছেন রাসেল মাহমুদ জিমি। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন হকির কিংবদন্তি আবদুস সাদেক। সাদেক নিজে একসময় খেলেছেন জিমির বাবা আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে।

খেলার মাঠে সতীর্থের ঘামে ভেজা বুক জড়িয়ে ধরেছেন কতবার। সেই দৃশ্যটা অদ্ভুতভাবে খানিকটা পাল্টে কাল হুট করে হাজির। সাদেক এবার জড়িয়ে ধরে রাজ্জাক-তনয় জিমির কপালে এঁকে দিলেন আশীর্চুম্বন। জিমি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ‘আমি বর্ষসেরা উদীয়মান হয়েছি, এবার হলাম বর্ষসেরা রানারআপ। মানে আমি ঠিক পথেই আছি।

আপনারা দোয়া করবেন, এই পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে সামনে যেন আমি বর্ষসেরাও হতে পারি। ’
রুমানা মালিক মুনমুনের উপস্থাপনায় শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান। এর আগে ‘রেড কার্পেটে’ সাবেক ও বর্তমান তারকাদের পূর্ব প্রতিক্রিয়া জেনেছেন সিজিল মির্জা ও আরিফুল ইসলাম। মূল অনুষ্ঠানে মুনমুন তাঁর সহ-উপস্থাপক খুঁজতে গিয়েও জন্ম দিয়েছেন নাটকের। প্রথমে এই অনুষ্ঠানের একসময়ের নিয়মিত উপস্থাপক উৎপল শুভ্রকে সঙ্গী হিসেবে মঞ্চে ডেকে নিলেও প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক নিজের শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে মুনমুনকে ‘বিপদে’ ফেলে নেমে আসেন।

এরপর মুনমুন পেয়ে যান যোগ্য সঙ্গীকে। মুনমুনের পাশে গিয়ে দাঁড়ান দেশসেরা গোলরক্ষক আমিনুল হক।
দুই উপস্থাপকের খুনসুটি, হাস্যকৌতুকে এগিয়ে গেছে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে বাড়তি রং ছড়িয়েছে গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের থিম সংয়ের ওপর প্রদর্শিত মনোমুগ্ধকর লেজার শো। দল বেঁধে নেচেছেন মডেল ও অভিনয়শিল্পী ইমন ও মীম।

ফুটবল নিয়ে কারিকুরি করে দেখিয়েছেন গত বছর গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখানো, মাথায় বল রেখে ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া আবদুল হালিম। দর্শকদের মজা দিয়েছে পাঠকের ভোটে বর্ষসেরার মনোনয়ন পাওয়া ছয় ক্রীড়া তারকার ওপর বানানো অ্যানিমেশন-ছড়া।
পুরো অনুষ্ঠানে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই কথা, এটি শুধু পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান নয়। যেন সার্থক এক মিলনমেলা। সব খেলার খেলোয়াড়দের এক ছাদের নিচে নিয়ে আবার বিরল এক উপলক্ষ।

মুনমুন ও আমিনুল তো মজার বুলেটিন পাঠের ছলে বলেই দিয়েছেন, একসঙ্গে এত নক্ষত্র আর কখনো দেখা যায়নি বলেই নাকি নাসার বিশেষ দল ছুটে আসছে ঢাকায়!
স্বীকৃতিটাই সবচেয়ে বড়। তবে স্বীকৃতির পাশাপাশি আজীবন সম্মাননা ও বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ দুজন পেয়েছেন দুই লাখ টাকা করে। বাকি সব বিজয়ী ক্রেস্টের পাশাপাশি পেয়েছেন এক লাখ টাকা করে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন, ‘আমার শৈশব-তারুণ্যের হিরোদের দেখতে পাচ্ছি। এঁদের অনতিদূরে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরাও নিশ্চয়ই এই প্রজন্মের হিরো।

আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের যে সুবর্ণ ঐতিহ্য, সেটা ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব এখনকার তরুণদের। ’ এই অনুষ্ঠানের প্রায় এক দশকের ইতিহাসে ১২টি ভিন্ন ভিন্ন খেলার ক্রীড়াবিদেরা এখন পর্যন্ত পুরস্কৃত হয়েছেন। এই তথ্য জানিয়ে মতিউর রহমান বলেন, এখান থেকে এর ব্যাপ্তিটাও বোঝা যায়।
ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্র তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘এই অনুষ্ঠান অব দ্য প্লেয়ার, বাই দ্য প্লেয়ার, ফর দ্য প্লেয়ার। ’
গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘শুধু ক্রিকেট বা ফুটবল নয়, গ্রামীণফোন তার সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বাংলাদেশের তুলনামূলক কম জনপ্রিয় খেলার সঙ্গেও কাজ করছে, করবে।

এমনকি আমাদের স্পেশাল অলিম্পিক দলকেও অব্যাহত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। ’
তবে জুরিবোর্ডের প্রধান জালাল আহমেদ চৌধুরীর কথাটা মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের, ‘শুরু থেকেই এর বিচারকাজে যুক্ত আছি। প্রথম দিকে খেলোয়াড় বাছাই করতে আমাদের যতটা বেগ পেতে হতো, এখন কেন জানি কাজটা সহজ হয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সাফল্য আসছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের ঘরোয়া ক্রীড়াঙ্গনের চর্চা আরও বাড়াতে হবে।

আমরা চাই আমাদের নির্বাচনের কাজটা আরও কঠিন হোক। ’
তাঁর কথায় যেভাবে সাড়া দিয়ে করতালি দিয়েছেন সমাগত ক্রীড়াবিদেরা, বুঝিয়ে দিয়েছেন, আরও আরও ঘাম ঝরাতে তাঁরা প্রস্তুত। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.