কালাম সাহেবের বাড়ির সামনে এক জুতা হাতে নিয়ে এক অবলা পুরুষের মতো দাড়িয়ে আছি। স্যান্ডেল বা চটি নয় কারন জুতা গুলো ছিড়ে ছিড়ে স্যান্ডেল হয়ে গেছে। স্যান্ডেল গুলো ছিড়ে ছিড়ে চটি হয়ে যায়। আর চটি গুলো ছিড়ে একদিন মানিব্যাগ হয়ে যায়। আর মানিকব্যাগ গুলো হয় সুখ জমানোর ভালো বলা চলে উত্তম পাত্র।
জুতার সোল থেকে বানানো মানিব্যাগ। সুখ চুইয়ে পড়ার উপায় নেই। খালি মানিব্যাগে থাকে না দেখা সুখ। সুখ কোনদিন দেখা যায়? যায় না। তাই মানিব্যাগের অদৃশ্য সুখ আছে বলে ধরে নেই।
সুতরাং আমার হাতে একটা জুতা থেকে রুপান্তরিত হওয়া স্যান্ডেল আছে।
কালাম সাহেবের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে প্রত্যেকবার ভাবতে হয় কয়েকবার। বাড়ির সামনে কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকার পর দেখলাম পিছন থেকে কিদ্দিস মিয়া দুই হাতে দুটি বাজারের ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে আসছে। আমার সামনে এসে হাপাচ্ছে। কিদ্দিস মিয়া বুকের উপর হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, " হাহ হাহ হাহ।
কচম বাই। আপনে আইসেন। মেলাদিন পর। হাহ হা হাহ। আপনে জানেন নাহ, হাহহ হাহ হাহ।
আপনেরে কতোদিন খুজছি। গুলিস্তানের মোড়ে গিয়া পোস্টার নিয়া দাঁড়ায় ছিলাম মেলা দিন। আপনার সংবাদ পাই নাই। হাহ হাহ হহহহ। " আমি কিদ্দিস মিয়ার কাধেঁ হাত দিয়ে তাকে শান্ত করলাম।
" কিদ্দিস ভাই শান্ত হন। ধীরে ধীরে বলেন কি সমস্যা? আমাকে এতো খোজাঁর কারন কি? "
" আরেহ ভাই বইলেন না। সেডা হিস্টুরি। এখন চলেন চলেন ভেতরে যাইবেন চলেন "
কালাম সাহেব বাড়ির ছ'তলায় থাকেন। বাড়ি ওয়ালারা সাধারনত ছ'তলায় থাকে না।
যারা থাকে তারা পাগলা মানুষ। পাগলাটে বাড়ি ওয়ালা। নয়তো লোভী। দো'তলা বেশিতে ভাড়া দেয়ার জন্য নিজে ছ'তলায় থাকে। তবে কালাম সাহেব তেমন পাগলা বা লোভী নন।
তিনি মন থেকে কবি। কিছু মানুষ উপরে কবি-দেহে কবি। তাদের দেখলেই চেনা যায়। দূর থেকে দেখলেই চিৎকার দিয়ে বলতে হয়, " ওইযে ভাবি কবি আসে। কবি কবি ভাব শুধু কবিতার অভাব।
ব্যাপার না চেহায় তো কবিতা ভাসে। সেটা দিয়েই চলবে। "। আর কিছু মানুষ থাকে মন থেকে কবি। তাদের দেখলে চেনা যায় না, বোঝা যায় না।
কেউ যদি কোনদিন জেনেও যায় তারা কবি তবে মুখে একটা বিশাল ভেংচি কেটে বলে, " ধুর মিয়া আপনে কবি? ঠাট্টা করেন? মুখ দেইখা মনে হয় চোর। মেলা চুরি করার অভিজ্ঞতা আসে আপনের। যাই হোক কবি যখন হইয়াই গেসেন কি আর করবেন। এখন চুল-বাল বড় করেন। দাড়ি রাখবেন রবীন্দ্রনাথের অর্ধেক।
ছিড়া সেন্ডেল পড়বেন। আধোয়া পাঞ্জাবী পড়বেন। আর দামী সিগারেট খাইবেন না। বিড়ি খাইবেন। দামী সিগারেট খাইবেন কেউ গিফট করলে।
মাসে একবার গঞ্জিকা খাইয়া টাল হইবেন। আবোল তাবোল কবিতা লিখবেন। আর মাসে মাসে একটা কইরা প্রেমিকা পাল্টাইবেন। তইলেন চলবে" । কবির প্রতি মানুষের এই চাহিদা ভাব মূর্তি দেখে সদ্য কবিতা লিখতে যাওয়া নতুন কবি বেশ চিন্তায় পড়ে।
কেউ কেউ থুতনীতে হাত দিয়ে দাড়ি না পেয়ে মূর্ছা যায়। তবে কালাম সাহেব এসব কবি কবি চেহারা নিয়ে ভাবেন না। মন থেকে কবি হয়েছেন তাই নিজের বাড়ির ছ'তলায় থাকেন। ফ্ল্যাটের উত্তর দিকের এক দেয়াল ভেঙ্গে সেখানে কাচেঁর বিশাল জানালা লাগিয়েছেন। তার মতে সকাল সকাল সূর্যকে মন ভরে না দেখলে শক্তি পাওয়া যায় না।
নিজেকে মৃত লাগে। মনে হয় অন্ধকার এক কবরে আছি।
বাসায় ঢুকতেই দেখি কালাম সাহেব জানালার পাশে বসে বই পড়তে ব্যাস্ত। খুব মনযোগ দিয়ে পড়ছেন তিনি। চোখের চশমা নাকের কাছে চলে এসেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই।
আমি তার পাশে গিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে বসলাম। তাকে ডাকলাম, " কালাম সাহেব "। কালাম সাহেব মুখ ঘুরিয়ে এমন ভাবে তাকালেন যেনো আজ আমাকে প্রথম দেখেছেন। এরপর বললেন,
" আরেহ চমক তুমি? "
" সেদিন আপনার মতো একটা লোককে দেখে আপনার কথা মনে পড়লো। শুনেছি হঠাৎ করে কোন ব্যাক্তির কথা মনে পড়লে হতে পারে সে ব্যাক্তি মারা গেছে।
তাই ভাবলাম আপনার ছেলেকে এসে শান্তনা দিয়ে যাই "
" বাহ! কি সুন্দর ভাবে আমাকে আমার মৃত্যু সংবাদ দিচ্ছো "
আমি তখন হাতের বইটার দিকে চোখ দিয়েছি। বেশ চমৎকার বই মনে হচ্ছে সেটাকে। যে দু পৃষ্ঠা কালাম সাহেব খুলে রেখেছেন তাতে দুটো সুন্দর সুন্দর বান্দরের ছবি আটা। আমি কালাম সাহেবর দিকে তাকিয়ে বললাম,
" কি বই পড়ছেন? "
" বান্দর পালনের একশত একটি সহজ উপায় "
" এই বই কেনো পড়ছেন? বান্দর পালবেন? "
" না কারন আছে। কিদ্দিস নিশ্চই বলেছে তোমাকে অনেক খোজাঁ খুজিঁ করেছিলাম? "
" হুম বলেছে।
কেনো খুজছিলেন? বান্দর কিনতে চান? "
" আরেহ না। প্রেমিকা চাই "
" প্রেমিকা? "
" হুম ভাড়াটে প্রেমিকা "
" প্রেমিকা দিয়ে করবেন? "
" আরেহ প্রেমিকা দিয়ে আর কি করে মানুষ? প্রেম করবো। আর প্রেমের কবিতা লিখবো। জানোতো নিঝুমের মা ডাক্তার। সে রাত দিন হাসপাতালে থাকে।
প্রেম করার কোন মানুষ নেই। আর ডাক্তারেরা ভালো প্রেম করতে জানে না। ডাক্তার হওয়ার পর নারীরা হৃদয়হীন হয়ে যায়। হৃদয়হীনা নারী নিয়ে বেশ কবিতা লেখা হয়েছে। এখন একটা প্রেমিকা দরকার।
প্রেম করে কবিতা লেখবো, বলা চলে প্রেমের অভিনয় করবো। বেতন ভালো দেবো "
" তা বুঝলাম। তো এতোদিনে কোন প্রেমিকা পেয়েছেন? "
" না পাইনি। যা পেয়েছি স্কুল কলেজের মেয়ে। আবেগে ভড়পুর কতোগুলো মাংস পিন্ড।
আবেগকেই ওরা প্রেম ভাবে। এসব মেয়েদের জন্য ছেলেরা ভালোবাসার প্রতি তেক্ত হয়ে যাচ্ছে "
" তাহলে এখনো কোন প্রেম করার মতো মেয়ে পাননি? "
" না পাইনি "
" কিন্তু হাতে এই বই কেনো? বান্দর পালনের একশত সহজ উপায়? "
" ও আচ্ছা। তুমি তো জানোই মেয়েদের মন বিধাতা ও বোঝেন না। তো চিন্তা করে দেখলাম বাদর সম্পর্কে ভালো করে জানতে পারলে মেয়েদের মনের সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞ্যান পাওয়া যায়। বাদরের মন বোঝাও কঠিন।
তারা এক মূহূর্তে মন পরিবর্তন করতে পারে। তাই বান্দর পালনে বিস্তর জ্ঞ্যান থাকলে নারীর সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে কি কি করা প্রয়োজন তা জানা যায়। তা নিয়ে দুই লাইন কবিতা ও ভেবেছি "
" কি কবিতা শোনান দেখি? "
"বিধাতা একদা করিয়াছিলো এক ভুল,
নারীর মনে বসাইয়া দিলো, বান্দরের এক চুল।
নারীই কি চায় জানেনা নারী,
বিধাতা তুমি বরই আনাড়ি "
" বাহ বেশ সুন্দর । তাহলে আপনার কি এখন ভাড়াটে প্রেমিকা চাই না বান্দর চাই? "
" কোনটা হলে ভালো হয় বুঝছি না "
" বান্দর হলেই ভালো হয়।
ধরুন বান্দরের মনের উপর কবিতা বিশ্লেষন লিখে বই বের করবেন। বইয়ের নাম দেবেন নারীর মন বোঝার একশত সহজ উপায়, লেখক কালাম চৌধুরী। বই চলবেও ভালো। নারীর মন বিষয়ে মানুষ নতুনত্ব পাবে "
" তাহলে আমার জন্য একটা বানর জোগাড় করো চমক। খুব বেশী প্রয়োজন "
"যি আচ্ছা ।
আপনি বসুন আমি নিঝুমের সাথে দেখা করে আসি "
নিঝুমের রুমের সামনে দাড়িয়ে শুনলাম সে কম্পিউটারের কি বোর্ডে বেশ ঝড় তুলছে। দরজায় দুটো দিয়ে বললাম, " আপু আসবো? "। ভেতর থেকে কিবোর্ডের যে ঝড় গতির আওয়াজ চলছিলো তা কমে এসেছে। । গম্ভীর গলায় নিঝুম বললো, " ভেতরে আসুন " ।
ভেতরে গিয়ে নিঝুমের পাশের চেয়ারে হাসি মুখে বসলাম। নিঝুম তখন আমার উপর ক্ষেপে আছে। আমার দিকে লাল ঝাল করে তাকায়,
" আপনি আবার আমাকে আপু ডেকেছেন? "
" আসলে নিঝুম তো মেয়েদের নাম তাই আপু চলে আসে সাথে। "
" আসলেও আর আপু ডাকবেন না। কোথাও লেখা আছে নিঝুম মেয়েদের নাম? "
" না আসলে মেয়েলি ধরনের।
তাই ভেবে নেয়া "
" না আপনি আর ভাববেন না। "
" আচ্ছা ঠিকাছে। "
" তো আপনি বাবার মাথায় নতুন কি ভূত ঢুকিয়েছেন? আপনার বুদ্ধিতে সূর্য দেখার জন্য বাবা উত্তরের দেয়াল ভেঙ্গে কাচঁ লাগিয়েছে। আজ কি বুদ্ধি দিয়েছেন? "
" আজ কোন বুদ্ধি দেইনি। সে নিজেই চাইছে বান্দর পালবে "
" বান্দর? "
" হ্যা! নারীর মন বোঝার জন্য বান্দর পালবে।
"
" এখানেও নিশ্চই আপনার হাত আছে? "
" না সে আমাকে অনেকদিন খুজছিলো ভাড়াটে প্রেমিকা খুজেঁ দেয়ার জন্য। আজকে আসার পর বললো নারীর মনের সাথে বান্দরের মনের বেশ মিল। বান্দরের মন বুঝলেই নারীর মন বোঝা যায় "
" দেখবেন কিন্তু। এবার যদি উল্টা পাল্টা কিছু হয় তবে আপনাকে জঙ্গী বলে র্যাবের কাছে ধরিয়ে দেবো। "
" যি আচ্ছা "
" যি আচ্ছা করবেন না।
আপনে এখন যান। আপনার জন্য ব্লগের কমেন্ট করতে দেরী হয়ে যাচ্ছে "
কালাম সাহেবের রুমে ফিরে এসে দেখলাম সে এক নতুন বই ধরেছে, " মন ডাকাতি করার কৌশল "। আমি তার পাশে বসলাম। কালাম সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
" আচ্ছা নিঝুমের কি খবর? ওর সাথে কথা হয় না বেশ কয়েকদিন। "
" খবর ভালো না।
সে ব্লগ চালায় "
" ব্লগ চালিয়ে কি হয়? "
" রান্না শেখে "
" রান্না শেখে মানে? "
" জ্বী হ্যা। রান্না শেখে। আজ কালকের মেয়েরা রান্না করতে জানে না। তাই আপনার ছেলে তার প্রেমিকার জন্য ব্লগ দিয়ে রান্না করছে। এখন মেয়েরা প্রেম করার আগে ছেলেদের জিজ্ঞেস করে সে রান্না করতে জানে কিনা।
রান্না করতে না জানলে সে ছেলে বাদ "
" কি বলো এসব? আজকের ছেলেদের এই অবস্থা? আমার ছেলে নিঝুম ও এমন করছে? "
" জ্বি হুম "
সাথে সাথে কালাম সাহেব উঠে নিঝুমের রুমের দিকে দৌড়ে গেলেন। আমিও তাদের বাসা থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম । আজকাল পরিবারের খুব মরচে ধরেছে। ভালোবাসার বন্ধনের মাঝে আজ কিছু একটা দাড়িয়েছে। তার নাম দুরত্ব।
কালাম সাহেবের পরিবারেও তেমন দুরত্ব বেড়েছে খুব। কালাম সাহেব নারীর মন বোঝার জন্য বান্দর পালতে চান কিন্তু ছেলের মুখ দেখেন না অনেকদিন। হয়তো ব্লগ দিয়ে রান্না করার ব্যাপারটা তাদের অনেকদিন পর মুখোমুখি করবে।
আমি রাস্তা দিয়ে হেটে আসছি। তখন সন্ধ্যা।
আকাশটা খুব রাগ করেছে। রাত হয়ে চাইছেনা বোধ হয়। তাই আকাশে হলদেটে ভাব। হয়তো আকাশের মনটা বোঝা ও খুব কষ্টের। আকাশ কি দিনের পর রাত হতে চায় নাকি রাতের পর দিন?
গুলশান দুই নম্বরের রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে যেতে অনেক দূর থেকে দেখলাম একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে একা।
আমি কাছে গিয়ে বললাম, " কোন সাহায্য চাই? "। মেয়েটায় মুখটা মায়া মায়া আভা এনে বললো,
" হুম! একটা রিক্সা বা সিএনজি চাই খুব। অনেক সন্ধ্যা হয়ে গেছে "
" আপনি কোথায় যাবেন? "
" বাড্ডা। "
" আমি যাবো মালিবাগ "
" আপনিও সাথে যেতে পারেন। আমি ভাড়া দেবো "
অনেক্ষন ঘুরে মেয়েটার জন্য একটা রিক্সার রাজা ইঞ্জিন রিক্সা নিয়ে আসলাম।
একসাথে রিক্সায় ও উঠলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর মেয়েটা আমার দিকে ফিরে তাকালো। মুখে একটা ভাজ টেনে বললো,, " অর্ধেক ভাড়া দিতে না পারলে এখানে নেমে যান। আপনার জন্য রিক্সা আস্তে চলছে " । কিচ্ছুক্ষন ভেবাচেকা খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এরপর টুপ করে রিক্সা থেকে নেমে পরলাম। মেয়েটা একটু নয় পুরোপুরি অবাক হয়েছে। সে ভাবেনি অর্ধেক ভাড়ার প্রস্তাব পেয়ে আমি রিক্সা থেকে নেমে যাবো। রিক্সাটা যখন চোখের সামনে দিড়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছে তখন তার দিকে তাকিয়ে কালাম সাহেবের কবিতাটা মনে পড়ছে,
"বিধাতা একদা করিয়াছিলো এক ভুল,
নারীর মনে বসাইয়া দিলো, বান্দরের এক চুল।
নারীই কি চায় জানেনা নারী,
বিধাতা তুমি বরই আনাড়ি "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।