আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
শরতের দীপ্র সূর্যের সোনালী আলোয় ঢাকার রাস্তাগুলো চমৎকার ভেসে গেলেও, তা গাদাগাদি ভিড়ে বাসের জানালার পাশের আঁটসাঁট একটি সিটে কোনরকমে হাতপা পেঁচিয়ে বসে থাকা শফিকের মনে কোনও প্রকার প্রফুল্লতার জন্ম দিতে পারল না। বেলা তখন সাড়ে বারটা। ঘামে তার শার্টের পিছন দিকটা ভিজে গিয়ে পিঠের সাথে জব-জব ভাষায় কথা বলছে। শফিকের মাথার চুল গুলো কিছুক্ষণ আগেও জানালার বাতাসে উড়ো-উড়ি করছিল; কিন্তু এখন ঘামে-ধুলোয় জট পাকিয়ে গিয়ে ঝড় জুঝে দালানের কোণে এসে আশ্রয় নেওয়া ভীত পাখির মত চুপ করে বসে মৃদু কাঁপছে। শফিক পড়াশুনা শেষ করেছে এক বছর হল।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্তি পাওয়া হাজারো বিবিএ-এমবিএ’দের সেও একজন। বর্তমানে সে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে “মার্কেটিং এক্সেকিউটিভ” হিসেবে, শফিকের ভাষায়, কামলা দিচ্ছে। তার কাজ হল প্রতিদিন সকালে অফিসে পৌঁছে তার বসকে চোখের দেখা দিয়ে পূর্ব নির্ধারিত কিংবা অনির্ধারিত সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে কাস্টোমারদের অফিসের দিকে রওয়ানা হয়ে যাওয়া; সকালের কড়া রৌদ্রে উত্তপ্ত বাসে-ট্রেনে-সিএনজিতে চড়ে হলেও শার্ট এবং মুখ উভয়ই অমলিন ও শুষ্ক রেখে নিজেকে একজন সপ্রতিভ সেলস ম্যান হিসেবে ক্রেতাদের সম্মুখে উপস্থাপন করা। তার কাঁধের ব্যাগটিতে তার প্রতিষ্ঠানটির প্রচারপত্র-ফ্লায়ার যথেষ্ট পরিমাণে মজুদ থাকে। সেটা সমেত মুখে চমৎকার একটি হাসি ঝুলিয়ে তার লক্ষ্যবস্তু ভদ্রলোক কিংবা ভদ্রমহিলাকে নিজের ভিজিটিং কার্ডটি এগিয়ে দিয়ে তার চাকরি-দাতা প্রতিষ্ঠানটির গুণগান করে সে।
আর তারপর অন্তত আধ ঘণ্টা এক নাগাড়ে সেই ভদ্রলোক কিংবা ভদ্রমহিলার অক্লান্ত (এবং বেশীরভাগ সময় অপ্রাসঙ্গিক) বকবক শুনে পরবর্তী সাক্ষাতের জন্য রওয়ানা হয়। এভাবে সারাটি দিন জুড়ে চাকরি-দাতা প্রতিষ্ঠানটির গুণ কীর্তন ও তার জন্য সমর্থন কামনা করে ক্লান্ত, সিক্ত শরীরে পুনরায় অফিসে ফিরে বসকে সারাদিনের কামলা দেওয়ার বৃত্তান্ত দিয়ে তবেই সেইদিনের মত ছুটি। যদিও অফিসের ছুটি নিয়েই আবারও তাকে বন্দি হতে হয় রাস্তার জ্যামে। তির তির করে সন্ধ্যা রাতের অর্ধেকটা ভীর-ব্যস্ততার বেদিতে বিসর্জন দিয়ে যখন সে ঘরে পৌঁছায়, তখন গোসল সেরে খেয়েদেয়ে একটু খানেক আয়েশের সময়টাও তার মেলে না। টেলিভিশনটা ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে, সকালে ঘুম থেকে জাগার আগ পর্যন্ত ওভাবেই দূরদর্শন যন্ত্রটি সারারাত ঘুমন্ত শফিককে বিনোদন-মূলক অনুষ্ঠান দেখানোর চেষ্টা করে।
আজ শফিক একটু তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে যাচ্ছে। তার শরীর ভাল না। ঠাণ্ডা লেগেছে। তাই ছুটি নিয়েছে। বাসের ভেতরটায় গাদাগাদি ভিড়।
ভিড়ে, মধ্য দুপুরের দমবন্ধ করা গরমে যাত্রীদের যখন একেবারে হাঁসফাঁস অবস্থা, ঠিক তখন আগুন ঝরাতে থাকা সূর্যটাকে আড়াল করে কোত্থেকে যেন ঘন কালো মেঘ আকাশের দখল নিয়ে তাদের মনে স্বস্তির সঞ্চার করল। শফিকের মত যারা সিটে বসে ছিল, তারা উৎসাহে নড়েচড়ে বসল। যারা বাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে, তারা চারিদিক হঠাৎ এমন অন্ধকার হয়ে আসতে দেখে, নিজেদের আরও আশ্বস্ত করতে যেন, বসে থাকা যাত্রীদের মাথার উপর দিয়ে আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিল। যেন চোখের দেখা না পেলে, প্রশান্তির মেঘের কেটে পড়ার সম্ভাবনা আছে।
শফিকের বাস থেকে নেমে যাবার ঠিক আগে আগে অঝোর ধারায় নেমে এলো বৃষ্টি।
গ্রীষ্মের কয়েকদিনের টানা অত্যাচারে কম ক্ষোভ জমেনি আকাশে!
বাস থেকে নেমে, ঝেড়ে একটা দৌড় দিয়ে রাস্তার পাশের একটা দোকানের ছাউনির নিচে এসে দাঁড়াল শফিক। ততক্ষণে চারিদিকে যেন বৃষ্টির উৎসব বেঁধে গেছে! তপ্ত ধুলোবালিতে ভরা রাস্তাটা প্রবল বর্ষণে ভিজতে ভিজতে বাতাসে চমৎকার সোঁদা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছিল। মেঘদের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে যেন, জলকণা পূর্ণ একটা দারুণ ঠাণ্ডা বাতাসের প্রবাহ বয়ে যেতে লাগল এলোমেলো। চারিদিকে তখনও মানুষ ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষিত কিন্তু এমন আকস্মিক আগমনে। আশেপাশের দালানগুলোর বারান্দায় শিশুরা পাখির মত চিৎকার করতে করতে অকারণ দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত।
বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে যে কজন মা ঘরে ফিরে যেতে পারেননি তখনো, তারা তাদের হঠাৎ বৃষ্টির উচ্ছ্বাসে পাগল হয়ে যাওয়া শিশুটিকে ছাতার নিচে ধরে রাখতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিলেন। কারো কাছে থাক না থাক, মায়েদের কাছে ছাতা আছে ঠিকই! “আহা:, কী চমৎকার একটা দিনেই না সে ছুটি নিয়েছে”- শফিক মনে মনে ভাবে।
খানিক-বাদে বৃষ্টিটা ধরে এলে শফিক তার বাসার দিকে হাঁটা দিল হালকা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। কাছেই বাসা; তাই রিকশা নিতে ইচ্ছে হল না শফিকের। পদক্ষেপে জুতোর সাথে কাঁদা উঠে প্যান্টের পায়ের কাছে পেছন দিকটা ভরে যেতে থাকলেও, সেদিকে খেয়াল করল না সে।
শফিক যখন বাসার একেবারে কাছাকাছি এসে পৌঁছল, তখন ধীর লয়ের টিপটিপ বৃষ্টিটা আবারও চেপে এলো। পুনরায় দৌড়ে গিয়ে একটা দালানের সদর দরজার সামনের কার্নিশের নিচে গিয়ে আশ্রয় নিতে হল শফিককে। বৃষ্টির ধারায় এর প্রাবল্য ঢেউ খেলে যাচ্ছিল; যেন এক ঝাঁক পাখি তাদের দিক পরিবর্তন করছে দেখে তরঙ্গায়িত হচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে ভিজে যাওয়া চুলে হাত বুলিয়ে একটা সিগারেটের অভাব বোধ করে শফিক। অদূরের পান-সিগারেটের দোকানটার দিকে অনিশ্চিত ভঙ্গীতে তাকিয়ে ইতস্তত করে।
এসময় আরেকজন ব্যক্তি দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়ালো তার পাশে। একজন তরুণী। শফিকের বয়সীই হবে! ভাল করে অবশ্য তাকে লক্ষ্য করতে পারল না শফিক। এত কাছ থেকে অপরিচিত একজনের মুখের দিকে দেখা যায়?
কি চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে! চারিদিকে মেঘের ছায়ায়, প্রশান্তির সোঁদা ঘ্রাণে কি অপূর্ব সিক্ত সুন্দর পরিবেশ! ‘আর এর মাঝে এমন জলজ্যান্ত এক তরুণী এসে হাজির হল কোত্থেকে?’ ভাবে শফিক। আবার মনে মনে নিজের মনোভাবের তুচ্ছতাকে উপহাস করে হাসল সে।
বৃষ্টি আরও চেপে আসতে প্রমাদ গুনল তারা দুজনে;
মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী অবস্থা শুরু হল দেখেন তো!”,
শফিক তার দিকে না তাকিয়েই হাসল কিছুটা শব্দ করে; যেন বলল, “ তাই তো দেখছি”।
এই সামান্য যোগাযোগে শফিকের হৃদয় এক দুর্জ্ঞেয় উৎফুল্লতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। পর মুহূর্তে তার নিজের দিকে খেয়াল হল তার। ‘কি পোশাকই না পড়েছে সে আজকে!’ আজ ছুটি নেওয়ার সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল গত রাতেই। তাই সকালে অফিসে যাওয়ার সময় পোশাকআশাকের দিকে মনোযোগ দেয়নি সে মোটেও।
খুব দ্রুত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির অলক্ষ্যে একবার হাত দিয়ে চুলটা ঠিক করে নিতে চেয়ে দেখে ঘামে-ধুলায় আঠালো হয়ে তার চুলগুলো, একচুলও নড়ে না। মেয়েটি আবার তর্জনী উল্টো ভাবে বাঁকা করে নাকে ছুঁইয়ে রেখেছে। তাইতো! বাসে আসার সময় কম তো ঘামে নাই শফিক। না জানে কি দুর্গন্ধই না বেরোচ্ছে তার ঘামে-বৃষ্টিতে ভেজা শার্টটি থেকে। তার না হয় ঠাণ্ডা লেগে নাক আছে ঢিপে।
পাশের ব্যক্তিটির নাক তো আর ঢিপে নেই। বরং বসন্ত দিনের দখিনা জানালাটার মতই অবারিত হওয়ার কথা! ভাবে শফিক।
খানিক-বাদেই আবারও বৃষ্টি ধরে এলো। মেয়েটি বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে যাওয়ার আগেই শফিকের দিকে হাত নাড়ার ভঙ্গি করে রীতিমত দৌড়ে শফিকদের বাসার দালানটির দিকেই চলল। এই সুযোগে স্পষ্ট ভাবে দেখতে পেয়ে মেয়েটিকে শফিক চিনতে পারল, দুঃখের সাথে।
সে তাদের দালানেই থাকে। প্রতিদিন সকালে তার ছয় ফুট লম্বা মডেল সদৃশ প্রেমিক বেশ হালের একটি মোটর সাইকেল সমেত মেয়েটিকে নিয়ে যেতে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে; আবার সন্ধ্যে বেলা পৌঁছে দিয়ে যায়। মেয়েটির চেহারা শফিক কোনোদিন ভাল করে দেখতে পায়নি, যতটা না একটি মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখার সঙ্কোচের কারণে, তারচেয়ে অনেক বেশি মেয়েটির ঝাঁকরা, লাল রঙ করা চুল আর মুখে উগ্র ভাবে মেখে রাখা মেকআপের কারণে। আজ আকাশ ভারী মেঘে ছেয়ে থাকায় চারিদিক অন্ধকার হয়ে ছিল বলে, অদ্ভুত যোগাযোগে খানিক সঙ্কুচিত শফিক খেয়াল করতে পারেনি ঠিক। নইলে এমন আগুন রঙা চুল তার চোখ এড়ানোর কথা নয়।
এ হচ্ছে সেই ধরণের মেয়ে যাদের মুরুব্বীরা উড়নচণ্ডী হিসেবে অভিহিত করেন; ছেলেমেয়েরা যাদের নিয়ে চরিত্রগত বিষয়ে বাজে কথা ফাঁদে (তাদের সবটা হয়ত অসত্যও নয়); মহিলারা ছাদে গল্প করতে গিয়ে তুমুল সমালোচনা করেন আর আত্মীয়স্বজনেরা তরুণ-আধুনিকা আত্মীয়ার অদ্ভুত বেশভূষার কারণে কিছুটা চাপা অহংকারই করে।
শফিকে ভাবে, ‘এই সুবিশাল লোকালয়ে না জানে কত কোমল হৃদয়ের আয়তলোচনা রূপবতী নারী বসবাস করে! আর সাজানো গোছানো শরতের রুক্ষ সূর্যটাকে পরাভূত করা গাঢ় মেঘের তুমুল বৃষ্টির এমন অদ্ভুত সুন্দর দুর্লভ দিনে কিনা তাকে এমন একটি মেয়ের সাথে দেখা করিয়ে দিলে; হে হৃদয়হীন নিয়তি নির্ধারক!’
খানিক বাদে বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেলে বিমর্ষ শফিকও ক্লান্ত পায়ে বাসার দিকে চলল। শফিকের ম্লান হাল দেখতেই যেন, মেঘের আড়াল থেকে চপল সূর্য একবার দ্রুত উঁকিও দিয়ে গেল।
ঢাকায় শফিক বড় ভাইয়ের বাসায় থাকে সেই কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনটি থেকে। শফিকদের বাবামা দুজনেই মারা গেছেন।
বড় ভাইটি পিতৃ-তুল্য; ভাবিটি মাতৃসমা। ছোটখাটো সুন্দর সংসার তাদের। ঘরে শুধু শফিকের ভাই, ভাবি, তাদের চার বছর বয়সী ছেলে। শফিকের কাপড়চোপড় রাখার আলমারির ড্রয়ারটি যতটা অগোছালো, তাদের চারজনের সংসার ততটাই গোছানো।
সেদিন ঘরে ফিরে আহত হৃদয়ে ছটফট করতে করতে টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করে, ফেসবুকে অনবরত স্ক্রল করে অস্থির কাটল শফিকের সময়।
তবে পরের দিন সব ভুলে না গেলেও, ফাটা কপালটার কথা আর মনে করেনি সে। এবং এভাবেই চলতে থাকল শরতের নিস্তরঙ্গ দিনগুলো তার। কঠিন শহুরে জীবনে শরত শেষে সুগন্ধি হেমন্ত ছোঁকছোঁক করা প্রকৃতি প্রেমিকদের কাছে এক আধ বার ধরা দিয়েই শীতের কাছে আত্মসমর্পণ করল। কিন্তু শফিকের জীবন চলতে থাকল একঘেয়ে ব্যস্ত দিনগুলোতে চড়ে। ছোঁকছোঁক করা প্রকৃতি প্রেমিকদের একজন সে নয়।
মাঝে মাঝেই লাল চুলো উড়নচণ্ডী মেয়েটির সাথে লিফটে দেখা হয় তার। দেখা হয় তার ছয়-ফুটি দানবীয় বয়-ফ্রেন্ডের সাথেও। এমনই পোড়া কপাল শফিকের; সেই দিনের পর থেকে মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা যেন বেড়ে গেল! আগে যেখানে এই এলাকা ও বিল্ডিংটিতে পাঁচ বছরেরও অধিক সময়কালের বসবাসে মেয়েটিকে সর্বসাকুল্যে একবার কি দুবার দেখেছিল, সেখানে নিষ্ঠুর ভাগ্য তাকে সেই মহনীয় দিনটির পর থেকে সপ্তাহে অন্তত একবার দেখা করিয়ে দিচ্ছে মেয়েটির সঙ্গে! কখনো লিফটে, কখনো রাস্তায়; কাকতালীয় ভাবে এমনকি এমন স্থানেও দেখা হয়েছে, যেখানে তার সাথে দেখা হবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। উড়নচণ্ডীর ছেঁটে রাখা উঁচু ভ্রূ সম্বলিত চুনের মত ফ্যাকাসে মেকআপে ঢাকা চেহারাটায় ফুটে থাকা দম্ভ সবসময় ছিল একইরকম; স্থির।
এভাবে একটা বছর দ্রুত ঘুরে এলো।
অস্ফুট ঋতুরা নিয়মের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে এসে পুনরায় নিজেদের তুলে দিল প্রভাবশালী গ্রীষ্মের রুদ্র হাতে। এরই মধ্যে বহুদিনের প্রতীক্ষিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে প্রবল অস্থিরতা দেখা দিল। সামাজিক যোগাযোগের অনলাইন মাধ্যম-গুলোয়, পথে ঘাটে, টঙ্গের দোকানে, সেলুনে, অফিসে, ঘরে, বাজারে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা শুরু হল। একদিন কাদের মোল্লা নামক এক যুদ্ধাপরাধীর যাবত-জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করল আদালত। আর সেই নমনীয় রায় শুনতেই হতবাক হয়ে দেশবাসী, শাহবাগে যূথবদ্ধ হতে হতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল।
সেদিন রাতের বাসে শফিক অফিসের একটা কাজে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল। বাসে তার পাশে বসেছিল একটি ছেলে। তার চেয়ে বয়সে ছোট অনেক। কোন এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনা করে সে। পথে শফিকের সাথে কথা হচ্ছিল ছেলেটির।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে ছেলেটিই তাকে জানালো- আজ নাকি শাহবাগে লোকজন জমায়েত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর লঘু শাস্তি প্রত্যাখ্যান করে, তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করে। তারা নাকি কোনও নির্দিষ্ট দলের নয়; তারা নাকি সাধারণ মানুষ! এই গল্প করতে করতে ছেলেটির তরুণ মুখ অদ্ভুত নিরুদ্বিগ্নতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল।
চট্টগ্রামে অত্যন্ত ব্যস্ত একটি দিন কাটিয়ে রাতেই আবার ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল শফিক। খুব ভোরে বাসায় ফিরে পড়ে পড়ে ঘুমাল সারাটা সকাল। সেদিন আর অফিসে গেল না সে।
বেলা এগারটার দিকে ঘুম থেকে উঠে, দাঁত মেজে, গোসল সেরে নিলো। টেবিলে রাখা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া নাস্তা খেলো চুপচাপ। আয়নার সামনে তার নরম ভেজা চুল গুলো আঁচড়াল যত্ন করে, সময় নিয়ে। ঘরের কাপড় বদলে একটা পাতলা হাফ-হাতা সাদা টি-শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পড়ে নিলো। পায়ে পড়ল তার পুরনো কনভার্স জুতো জোড়া।
তারপর ভাবিটিকে তার বৃত্তান্ত জেনে নেবার কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়ল দরজা লক করার ক্ষুদে বাটনটি টিপে। সাথে নিয়মিত ব্যবহারের কুচকুচে কালো কাঁচের রোদ-চশমা আর ক্যাপটি নিতে ভুলল না।
নিচতলায় নেমে দেখে লাল-চুলো উড়নচণ্ডী সেই মেয়েটি তার ছয় ফুটি প্রেমিকের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে দুজন হাসল। নাকি সে ভুল দেখল? তারা দাঁড়িয়েছিল মূল দরজার কাছে।
তাই ইতস্তত করে, ভুল হতে পারে এই আশঙ্কায় সরাসরি না তাকিয়ে ভদ্রতার একটা মৃদু হাসি ফুটিয়ে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল শফিক।
কাছাকাছি এলে, শফিককে মেয়েটি হেঁসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন শফিক ভাই”?
শফিক কিছুটা চমকে কিন্তু পরোক্ষণেই দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে, মুখে চমৎকার একটা হাসি ফুটিয়ে জবাব দেয়, “জ্বি ভাল। “। আর পাশের ছেলেটির দিকে তাকিয়েও “কি খবর কেমন আছেন” এমন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করে। প্রত্যুত্তরে “এই তো” ভঙ্গিতে মাথা কাত করে ছয়-ফুটি।
“আপনার সাথে প্রায়ই দেখা হয়, কিন্তু কথা হয় না। আপনি এত অন্যমনস্ক থাকেন যে আপনার সাথে যে কথা বলব, সে সাহস হয় না”! বলে মেয়েটি।
দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সুরে, দু-হাত নেড়ে নেড়ে উচ্ছলতায় ঝলমল করতে করতে মেয়েটি কথা বলছিল। তার লাল এলো চুল কথা বলার প্রবল অঙ্গভঙ্গির দমকে আরও এলোমেলো হয়ে উঠছিল। চোখের রেখায় মোটা করে দেওয়া কাজল, তার চোখের তারার উৎফুল্লতায় যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল।
মুখে মেকআপের প্লাস্টার আজ যেন আরও বেশি পুরু,আর তা অদ্ভুত রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছিল তার মুখমণ্ডলে।
“হাঃহাঃহাঃ শব্দ করে হেঁসে “কি যে বলেন” ভঙ্গিতে দু পাশে মাথা নাড়ে শফিক।
"কোথায় চললেন?" জিজ্ঞেস করে মেয়েটি। মুখের হাসিটি নিঃসঙ্কোচ, আন্তরিক।
“শাহবাগের দিকে যাবো একটু।
“
“তাই? আমরাও তো ঐদিকেই যাচ্ছি। আমাদের সাথে চলুন না?”
“চলুন। “
কিছুটা ইতস্তত করেই জবাব দেয় শফিক... এছাড়া আর কীইবা জবাব দিতে পারত সে? সেতো সেইদিকেই চলেছে!
কিন্তু বাইরে মোটরসাইকেলটিকে একপাশে হেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মনে পড়ল যে ছেলেমেয়ে দুটো এতে করেই যাবে শাহবাগ। এই ছোট্ট বাইকটিতে সে বসবে কোথায়?
তাই শফিক, ঘুরে তাদের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে খানিক হেঁসে বলে
“আপনারা চলুন, আমি আসছি আপনাদের পিছু পিছু। “
“তিনজন বসা যাবে তো!” সাথে সাথে উত্তর দেয় ছয় ফুটি।
“আমরা বন্ধুরা নিয়মিত এভাবে যাওয়া আসা করি! কোনও সমস্যা নেই। আপনি এই... এখানে বসেন আর আপনার পেছনে ফারহানা বসতে পারবে; ওর অভ্যাস আছে। “
ছেলেটা যেন বিস্মিত- বুঝে পায় না কেন শফিক তাদের সাথে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে!
শফিকের অদ্ভুত লাগল, হাসিও পেল। কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই উঠে পড়ল মোটরসাইকেলে। ফারহানা মেয়েটি বসল তার পেছনে।
মোটরসাইকেলটি চালু হয়ে গর্জন করে উঠলে নিঃসঙ্কোচে শফিকের কাঁধে হাত রাখে সে মৃদু।
শফিক মনে মনে ভাবে, এ কোন ফ্যাসাদে পড়ল সে? এ কেমন অস্বস্তির কথা এ্যা? তাদের দেখতেই বা লাগছে কেমন? সামনে এক ছয়-ফুটি দানব, পেছনে আগুন রঙা চুলের এক রূপবতী উড়নচণ্ডী আর মাঝখানে সে বিজড়িত শফিক!
অচিরেই ছুটে চলল তারা শাহবাগের দিকে। মেয়েটির মিষ্টি ঘ্রাণে ভরা নিঃশ্বাস তার ঘাড়ের কাছে পড়তে থাকল সারাটা পথ। পথে তারা চিৎকার করে কথা বলছিল নিজেদের মধ্যে; শব্দের কারণে। দমকা বাতাসে তাদের দুর্বিনীত চুল মুক্ত পতাকার মত উড়ছিল।
ফারহানা একবার তার কানে কানে বলল, “এক বৃষ্টির দিনে আপনার পাশে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমাদের বাসার কাছে। আপনি বোধহয় সেদিন আমাকে চিনতে পারেননি! পেরেছিলেন?”
শফিক চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ, পেরেছিলাম। “
কিন্তু স্বল্প পরিচিতা প্রতিবেশী আর তার বন্ধুর মাঝখানে এই ইঞ্জিন চালিত দ্বি-চক্র যানের এমন অদ্ভুত আরোহণের বিস্ময় তার কাটছিল না। একেই বোধহয় তারা বলে, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা!
তারা যখন শাহবাগে এসে পৌঁছল, তখন মধ্য দুপুর। চারিদিকে বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্র, সূর্যের তাপেই যেন, তা টগবগ করে ফুটছিল।
চড়া রৌদ্রে বিচ্ছুরিত হয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ ঠিকরে পড়েছিল চারিদিকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।