ভারতীয় চামচা মুক্ত ব্লগ
১৯৪৭ সালে ইংরেজ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তিলাভের প্রাক্কালে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা ভারত, যা নাকি বিভিন্ন জাতি ধর্ম ও সভ্যতা সম্পর্কে আরো সমৃদ্ধ হয়েছিল। স্বভাবতই তার একটি বৃহৎ জাতিসত্তায় পরিণত হওয়ার উচ্চাভিলাষ থাকবেই। পরিহাসের বিষয় যে তেমনটি হয়নি যদিও স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই ভারতের স্বাধীনতার অগ্রদূত নেতৃত্ব সচেতনভাবেই দেশের শ্রেষ্ঠদের জন্য লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে রেখেছিল। ভারতের আত্মবিশ্বাসী নেতারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিল। নিশ্চিত ছিল সে সম্বন্ধে ভারতের যোগ্যতার কথাও এবং এও ভাবতেন যে পরাধীনতার গ্লানির জন্যই এত দীর্ঘকাল তা সম্ভব হয়নি।
আফটারঅল, ভারত একটি বিশাল দেশ যা প্রায় একটি মহাদেশসদৃশ। এই বিশাল দেশে ১০০ কোটির অধিক মানুষ বাস করে। ভারত মহাসাগর যা নাকি ঐতিহ্যগতভাবে পূর্ব-পশ্চিমের সংযোগ রক্ষা করে এবং তার ওপর রয়েছে ভারতের প্রায় পূর্ণ কর্তৃত্ব।
দেশটির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায় ইউরেশিয়ান ভূখণ্ডের সাথে ভারতের নৈকট্যের জন্য। তা ছাড়া দেশটিতে রয়েছে গণতান্ত্রিক জীবনপদ্ধতি যা নাকি অনেক দিক দিয়ে আধুনিকতা এবং সভ্যতার সূচক।
ভারত যে একটি বৃহৎ শক্তি হওয়ার ক্ষমতা রাখে স্বাধীনতা-উত্তর ও প্রাকস্বাধীনতার সময়ে ভারতের নেতৃত্বে থাকা অন্যতম দূরদর্শী জওয়াহেরলাল নেহরু সারা বিশ্বে একজন পরিচিত নেতা। সাতচল্লিশের অব্যবহিত পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মতো একজন যতœবান ও সাবধানী নেতাই একটি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর গোড়াপত্তন করেন যার উৎসমূল থেকে শক্তি অর্জিত হয়। তবে ভারতের বৃহৎশক্তি পদমর্যাদার প্রতিফলন অনেক আগেই ঘটেছিল। তখন থেকেই ভারতীয় নেতৃত্ব জোরালো উচ্চারণে একটি বৃহৎ পরিমণ্ডলে ভারতের অবস্থানকে শুধু বিশ্বের শক্তিপুঞ্জের যেমন পশ্চিম ইউরোপ, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি প্রতিস্থাপিত করতে চাইত। ইংরেজরা বৃহৎ ভারতকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ভারতের এলিটিস্ট নেতারা বিশ্বে ভারতের অবস্থানকে ঘিরে এক প্রকার আবিষ্টতায় ভুগতে থাকল।
কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে ভারত ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ভুলে থাকতে পারল না যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতায় চীনও তো একটি প্রবল প্রতিযোগী হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘রণকান্ত’ এবং বিপুল ক্ষয়ক্ষতির বোঝা নিয়ে যখন অবশেষে ভারতের মতো উপনিবেশগুলোকে স্বাধীনতা দিতে যুক্তরাজ্য বাধ্য হলো তখন বাইপোলার (Bipolar) বিশ্বের শুরুতেই দল ভারীর উদ্দেশ্যে শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরগুলো ভারতের মতো একটি দেশকে তাদের দলভুক্ত করতে মেতে উঠল। আজকের গণচীনের তখন জন্মই হয়নি। মাও-জে-ডং তখনো চিয়াং কাই শেকের জাতীয়তাবাদীদের সাথে জীবনপণ লড়ছে। প্রায় সে সময়েই চীনের সাথে ভারতের হিমালয় যুদ্ধ হয় ১৯৬২ সালে।
বলা বাহুল্য হিমালয় যুদ্ধে ভারতের অপমানকর পরাজয় ঘটে। এর দুই বছর পর চীন তার প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। চীন পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর কতককটা ভগ্নহৃদয়ে মারা যান লালবাহাদুর শাস্ত্রী। পেছনে লণ্ডভণ্ড অবস্থায় পড়ে থাকে বৃহৎ শক্তি হওয়ার লক্ষ্যে তার বিশ্ব দর্শন। হিমালয় যুদ্ধে পরাজয় এবং পারমাণবিক বোমা অর্জনে চীনের পশ্চাতে পড়ে যাওয়ায় ভারতে মনস্তাত্ত্বিক পরাজয় ঘটে।
তা সত্ত্বেও ইতোমধ্যেই ভারত পরিণত হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে। এ পর্যন্ত শক্তিধর দেশটি তখন তার সাম্রাজ্যবাদী নীতি বহালে কমিউনিস্ট চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত, কিন্তু একটি বিশাল গণতন্ত্রের সখ্য লাভে উদগ্রীব। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, গণতন্ত্রকামী ছোট বড় ও মাঝারি যেকোনো দেশের ডার্লিং বা প্রিয়পাত্র হবেÑ এটাই স্বাভাবিক।
ব্রিটিশ আমলের অখণ্ড ভারত উপমহাদেশ বিভাজিত হলেও মূল ভারতের অবশিষ্টাংশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যথেষ্টই সম্মানিত এ দেশটির রাজনৈতিক বিকাশ ঈর্ষনীয়। এখনো ভারতের তুলনায় উপমহাদেশের অপর অংশ পাকিস্তান বড়জোর একটি সেকেলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক বিপথগামিতার নিদর্শন।
লক্ষ্য করার বিষয়, গণচীন ১৯৪৯ সালে অস্তিত্বে আসার পর ভারত কার্যত দেশটিকে পথ দেখিয়ে আফ্রো-এশিয়া কমিউনিটিতে নিয়ে আসে। ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্যোক্তা ও সাথী হিসেবে চীনের অগ্রগামী বা অগ্রজের ভূমিকায় কাজ করেছে। সে সময়ে চীনের জন্য বিশ্বের বহু মিথস্ক্রিয়ার জানালাই খোলেনি।
এখন প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর পর যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বৃহৎ শক্তি চীনকে একটি প্রবল বৃহৎ শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে তখন ভারত একটি বৃহৎ শক্তি তো দূরের কথা তাদের কাছে শুধুই একটি বিবদমান ভূখণ্ড মনে হয় অথবা ভারত ুদ্রতর পাকিস্তানের একটি শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর বেশি কিছু মনে হয় না। কাশ্মিরকে ঘিরে সেখানে আধিপত্য বিস্তারে দখলদারিত্ব নিশ্চিত করতে ভারত অবশ্যই অধিক শক্তিশালী একটি পক্ষ, কিন্তু কিছুতেই কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আনয়নকারী নয়।
ভারতের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বলয়ের জন্য কেউ তাকে আন্তর্জাতিক শক্তির সম্মান দেয় না। ভারতের যা কিছু আছে তাতে সারা বিশ্ব সামরিক বা অর্থনৈতিকভাবে দেশটাকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেই জানে। সেই আঞ্চলিক শক্তির কেন আবার তার অবাধ্য প্রতিবেশী দেশগুলোকে সামলাতে হয়।
ইতোমধ্যে শক্তির আরেকটি নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে প্যাসিফিকে যেখানে শুধু জাপানই যুদ্ধোত্তরকালে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে শুধু অর্থনৈতিক নয়, প্রয়োজনে রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সন্দেহ নেই যে, প্যাসিফিক এই শক্তির নতুন ভর কেন্দ্র ভারতের বৃহৎ শক্তি হওয়ার উচ্চাভিলাষের সামনে এক নতুন এবং বিশাল চ্যালেঞ্জ।
সমৃদ্ধিশালী এবং উন্নত জার্মানি ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের মতোই ইউরোপে শক্তির স্বতন্ত্র একটি কীলকে (Pivot) পরিণত হয়েছে। এখন তো এটাও অনিশ্চিত যে ভারত এই শক্তি কেন্দ্রগুলোর তুলনায় কোথায় অবস্থিত। এও অনিশ্চিত যে প্রাক-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে এবং স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বের শক্তি বিন্যাসে ভারতের স্থানই বা এখন কোথায়?
ভারত এক সময়ে পশ্চিমা শক্তি বর্গের সমপর্যায়ে তার অবস্থান খুঁজেছিল। এখন তো দেশটিকে চীনের সমপর্যায়েও ভাবা হয় না। ভারতীয়দের বিরক্তিকে উপেক্ষা করে ভারতকে পাকিস্তানের সমপর্যায়ে দেখা হয়।
চীন স্পষ্টত কমই অগ্রগতি ও সামরিক প্রযুক্তি দৌড়ে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৬৪ সালে চীন সাফল্যের সাথে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটালে, অতপর ভারতের সাথে তার শক্তির দূরত্বের ব্যবধান বৃদ্ধিই পেতে থাকে।
আঙুলগুলো পারমাণবিক বোতামে স্থাপন করে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আশ্চর্য নয় যেকোনো তর্কবিতর্ক ছাড়াই চীন পারমাণবিক গোষ্ঠীর অংশে পরিণত হলো। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার প্রবেশ ছিল লৌকিকতার ব্যাপার।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন দূরপ্রাচ্যে এক চীন নীতি অনুসরণ করেছিলেন। ফলে তাইওয়ানের জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী আসনের একটি চীনের ভাগে পড়ল। দেখা যাচ্ছে যে দুই বা আড়াই দশকের মধ্যে চীন পশ্চিমা বিশ্বের এলিট কাবের একজন bonafide সদস্যে পরিণত হয়েছে।
অথচ একটা সময় ছিল যখন বিখ্যাত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন এই বলে যে ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশের একজন মহান নেতা তার উপস্থিতিতে মার্কিন কংগ্রেসকে ধন্য করেছে। এখন কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ওয়াশিংটন সফর করলে তাকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সুবিধা-অসুবিধার জন্য শুধু অপেক্ষাই করতে হয় নাÑ যদিও সেই সাক্ষাৎকারের সময় মাত্র ৪০ মিনিট- মজার কথা যে, সেই সাক্ষাৎকারের বিবরণী মার্কিন মিডিয়া মাত্র কয়েক লাইন পেলেও পেতে পারে।
কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা হয়তো একটি ব্লিপ (Blip)ও পাবে না। কিন্তু কোনো চীনা প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটনে এলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রীতিমতো হোমওয়ার্ক করেন। তাদের মধ্যকার আলোচনায় থাকে স্ট্র্যাটেজিক ইস্যু। ভারতের বেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে হয় মার্কিনিদের প্রিয় অর্থনৈতিক সংস্কারের হিতোপদেশ। যথার্থভাবে উচ্চাভিলাষী ভারতের এই অবস্থার জন্য ভারত নিজেই অনেকাংশে দায়ী।
ভারত পাকিস্তানের তরফ থেকে বছরের পর বছর এত বেশি নিরাপত্তা সমস্যার কথা উচ্চারণ করেছে, শুধু উপমহাদেশের ইস্যু নিয়ে এত বেশি আবিষ্ট থেকেছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনে হতে পারে ভারতের সব স্বার্থ উপমহাদেশকে ঘিরেই। আসলে তার কোনো আন্তর্জাতিক নীতি নেই। নেই নৈতিক মানদ অন্তত প্রতিবেশীদের সাথে তার আচরণে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের সাথে তার সঙ্ঘাত। এমন একটি দেশ কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সঙ্ঘাত এড়াতে বা চলমান সঙ্ঘাতের নিষ্পত্তি করতে পারে? এগুলোই যদি বৃহৎ শক্তির অন্যতম ভূমিকা হয়ে থাকে ভারত অন্তত এ পর্যন্ত এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি বরং সঙ্ঘাতকে উসকে দিয়ে সমস্যা জিইয়ে রাখাতেই ভারত বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এবং নিরাপত্তা, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
লেখাটি এখান থেকে নেয়া হয়েছে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।