আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভবন আছে পার্কিং নেই

পার্কিংয়ের স্পেস না রেখে ভবন নির্মাণ চলছেই। পার্কিংবিহীন এসব ভবন রাজধানীতে নানা দুর্ভোগের সৃষ্টি করছে। যানজটের ধকল থেকে শুরু করে চলছে গাড়ি চুরির মহোৎসব। বিল্ডিং কোড অমান্য করে প্রকাশ্যে চোখের সামনেই একের পর এক ভবন গড়ে উঠছে নগরজুড়ে। রাজউক, সিটি করপোরেশন কেউ বাধা দিচ্ছে না এতে।

হাইরাইজ ভবনগুলোর আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের পুরোটা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা। অথচ আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের বেশির ভাগ স্থান ব্যবহৃত হচ্ছে 'গুদামঘর' হিসেবে। পার্ক করার জায়গা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে বাইরের দোকানপাটের মালামাল রাখার জন্য।

পার্কিং স্পেসবিহীন ভবনবেষ্টিত এলাকা কতটা দুর্ভোগের সৃষ্টি করতে পারে, এর চরম দৃষ্টান্ত রাজধানীর মতিঝিল-দিলকুশা। দুঃসহ যানজটে অবরুদ্ধ মতিঝিল।

শত শত গাড়ির এলোপাতাড়ি পার্কিং। রাস্তা, গলির ৫০ ভাগ বেদখল। চলছে পার্কিংয়ের যথেচ্ছ অপব্যবহার। রিকশাগুলোর তাণ্ডব তো আছেই। দিন নয় মাস নয়, বছরের পর বছর ধরে অভিন্ন অবস্থা বিরাজ করলেও রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলকে বিশৃঙ্খলামুক্ত করা যাচ্ছে না।

ক্রমেই পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত মতিঝিলে অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। 'ব্যাংকপাড়া' বলে আলাদা পরিচিতি আছে মতিঝিলের। এ ছাড়া সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এখানে। পুরো মতিঝিল এলাকা সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, দু-চারটি বাদে আর কোনো অফিস বা প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব পার্কিং জোন নেই।

নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের নিচে পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান থাকার কথা। গ্রাউন্ড ফ্লোর বা আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোর কেবল গাড়ি রাখার জন্যই নির্মাণ করার বিধান রয়েছে। হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণের অনুমতি দিয়ে থাকে রাজউক। তাদের অনুমোদিত প্ল্যান নিয়েই বিল্ডিং নির্মিত হয়। অথচ থাকে না কেবল পার্কিং প্লেস।

মোটা অঙ্কের উৎকোচ পেয়ে নীরব হয়ে যান তদারককারী কর্মকর্তারা। সবকিছু দেখেও তারা না দেখার ভান করে থাকেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শত শত গাড়ি নির্ধারিত পার্কিং জোনের অভাবে রাখা হয় মূল সড়ক জুড়ে। মতিঝিল, দিলকুশা, বিসিআইসি রোড, বিমান অফিস চত্বর, শাপলা চত্বরের চারপাশ, মধুমিতা সিনেমা হল রোড, জীবন বীমার চারদিক, বঙ্গভবন-সংলগ্ন উত্তর পাশের রাস্তায় চার-পাঁচ সারি করে গাড়ি পার্ক করা হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সেগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে এসব রাস্তায়।

প্রাইভেট সেক্টরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাড়ি রাখা হয় এমনকি রাত ৯টা-১০টা পর্যন্ত। অবৈধ পার্কিং আর এলোপাতাড়ি যানবাহন থামিয়ে রাখার কারণে প্রশস্ত সড়কগুলোতে একটা ভ্যান চলাচলও দুষ্কর হয়ে পড়ে। অথচ বাস, মিনিবাস, পাজেরো সবই ঢোকানো হচ্ছে ওই রাস্তাটুকুতে। ফলে সৃষ্টি হয় গোলমেলে অবস্থা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসহনীয় যানজটের কবলে পড়ে থাকতে হয় সাধারণ মানুষকে।

মতিঝিল এলাকায় বেসামাল অবস্থা থাকে প্রতিটি ব্যাংক চত্বরে। কারও কোনো পার্কিং জোন নেই। অথচ ৫০-৬০টি করে গাড়ি থাকে প্রতিটি ব্যাংক-সংলগ্ন সড়ক জুড়ে। বৃহস্পতিবার বেলা ১টা ১৫ মিনিটে জটিল পরিস্থিতি দেখা যায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সামনে, পূর্বাণী হোটেলের পেছন দিকে। ব্যাংকটির সামনের ফুটপাত এবং সড়কের ১৫ ফুট চওড়া ও ৭০-৮০ ফুট দীর্ঘ এলাকা পিতলের স্ট্যান্ড দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

এক স্ট্যান্ডের সঙ্গে আরেক স্ট্যান্ড রয়েছে দর্শনীয় শিকলে বাঁধা। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যাংক কর্মচারী জানান, এ জায়গাটুকু আমাদের ব্যাংকের নিজস্ব গাড়ি রাখার জায়গা। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের গাড়ি এখানে যাতে পার্ক না করতে পারে এ জন্যই 'শিকলবাহী স্ট্যান্ড' ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মূল রাস্তার ২০ ফুট জায়গা দখল করে পার্ক করা আছে ঢাকা মেট্রো গ-১১-৩৪৯২ নম্বরের প্রাইভেট কারটি। ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তার গাড়ি এটি।

পাশেই সারিবদ্ধভাবে ও বেআইনি পন্থায় পার্ক করা আছে দুই ভাইস চেয়ারম্যান, অন্য পদস্থ কর্মকর্তা, ক্যাশ বিভাগের মাইক্রোসহ গ্রাহকদের ২০-২২টি প্রাইভেট কার। সারিতে জায়গা না পাওয়ায় সড়কের মধ্যখানে এলোপাতাড়িভাবে থামানো হয় ঢাকা মেট্রো-ঘ-০২-২৪৮৯ পাজেরোটিসহ আরও ৮-১০টি গাড়ি। তিন-চার হাত সড়ক ফাঁকা থাকলেও উল্টো পাশেই পার্ক করা আছে ৩৪টি বড় বাস-মিনিবাস। দিলকুশার জীবন বীমা ভবনটির সামনে রাস্তাজুড়ে বানানো হয়েছে পার্ক, লাগানো হয়েছে গাছ। এখানেই বিনিয়োগ বোর্ডের গাড়ি রাখার জন্য স্থায়ী পার্কিং স্পেস বানানো হয়েছে ইট-সিমেন্ট দিয়ে।

কারওয়ান বাজার এলাকায় বড় আয়তনের অফিস ভবন- তিতাস, বিএসইসি, ওয়াসা, বিটিএমসি, পল্লী ভবন কোথাও নেই কার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। দু-একটি ভবনে যৎসামান্য পার্কিং স্পেস রাখা আছে। সেগুলো শুধুই পদস্থ কর্মকর্তাদের গাড়ি রাখার জন্য সংরক্ষিত। অন্যান্য কর্মকর্তা ও দর্শনার্থীর গাড়ি পার্ক করা হয় প্রধান রাস্তার ওপর। বনানী ২ নম্বর রোডের শুরু থেকে ওয়্যারলেস গেট পেরিয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে সারিবদ্ধভাবে গাড়ি পার্ক করা।

রাস্তা এতে অর্ধেক হয়ে আছে। এ দৃশ্য কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, গুলশান ২ ও ২ নম্বর সবখানেই। মিরপুর ১ নম্বর, কাজীপাড়া, মিরপুর রোডের ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, গাউছিয়া, নিউমার্কেট কোথাও নেই বৈধ পার্কিং ব্যবস্থা। রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলো এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায়। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ভাড়া নিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে ব্যবসা।

বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে দোকানপাট, ব্যাংক, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, ফাস্টফুডের দোকান। এমনকি বাড়ির গ্যারেজও পরিণত হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু নির্বিকার রয়েছে কর্তৃপক্ষ। সে সুযোগে বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে বাড়িওয়ালারাও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিচ্ছেন বাসাবাড়ি। অথচ ঢাকা সিটি করপোরেশন ও রাজউকের বিধান অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার বাড়ি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।

কিন্তু প্রশাসনের নাকের ডগায়ই মহল্লায় মহল্লায় বাসাবাড়িগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর চলছে অনেকটা নির্বিঘ্নে।

উত্তরা মডেল টাউনের বিভিন্ন সেক্টরে প্রায় দেড় শতাধিক বাসাবাড়িতে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কয়েকটি ব্র্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। ৪ নম্বর সেক্টরে রয়েছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর পিকিউএসের বিলাসবহুল দোকান। এ ছাড়া রয়েছে ওয়েস্টটেক্স, রেক্স, প্রিটেক্স নামে আরও কয়েকটি সুপরিচিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দোকান।

এখানকার একটি বাড়ি ভাড়া করে কার্যক্রম চালাচ্ছে এইচএসবিসি ব্যাংকের শাখাও। রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের শাখা। এই ৪ নম্বর সেক্টরে প্রায় ৪০-৫০টি বাড়িতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে এমন প্রতিষ্ঠান। ৩ নম্বর সেক্টর এক কথায় এখন পরিণত হয়েছে মার্কেটে। এ এলাকার বাসাবাড়ি ভাড়া করে তৈরি হচ্ছে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, কমিউনিটি সেন্টার, রেডিমেট গার্মেন্টসের দোকান, কনফেকশনারি।

এমনকি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসও রয়েছে এ ধরনের আবাসিক এলাকায়। ৩ নম্বর সেক্টরে ৪০-৫০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বেশির ভাগই দোকানপাট। রবীন্দ্র সরণিতে তিনতলা বাড়ি ভাড়া করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ফ্যামিলি নিডস নামে বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এ এলাকায় রয়েছে ইষ্টিকুটুম নামে একটি কমিউনিটি সেন্টার, যা চলছে ভাড়াবাড়িতে।

এ ছাড়া রয়েছে টেঙ্মার্ট, মুনসুন রেইনের মতো ব্র্যান্ড কোম্পানির দোকান। ৩, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর সেক্টরের প্রায় প্রতিটি সড়কের বাসাবাড়িতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে দোকানপাট। অথচ এর কোথাও নেই পার্কিং স্পেস। এসব বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর বহু এলাকাতেই প্ল্যান পাস হয়েছে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে।

সুপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ না হলে ঢাকা আর বসবাসের উপযোগী থাকবে না।

ভবিষ্যতে ঢাকাকে বাঁচাতে হলে কঠোর হাতে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। সুপরিকল্পিত নগর গড়ার জন্য কঠোর আইন আছে। বিল্ডিং কোড ও আবাসিক ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রয়েছে বিধিমালা। এই বিধিমালা ও বিল্ডিং কোড মেনে চলতে হবে। তিনি জানান, ডেভেলপাররা কেউ বিল্ডিং কোড ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা মেনে ভবন নির্মাণ করছেন না।

শতকরা ৯৯ ভাগ ভবনই গড়ে তোলা হয়েছে বেআইনিভাবে। এখান থেকে বের হতে না পারলে আগামী দিনে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এ সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে সরকারের উচিত হবে কঠোরভাবে আইন অনুসরণে বাধ্য করা।

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।