(গল্পে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের কোন ঘটনা বা ব্যক্তির সাথে তার মিল অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয় মাত্র। )
শাপমোচন
আমার ইচ্ছে ছিল অফিস থেকে বের হয়ে রিক্শা করে জিইসি মোড় পর্যন্ত যাবো।
তারপর হাতে সময় কতোটা আছে সেটা বুঝে ঠিক করবো মিমি সুপার মার্কেটে যাবো নাকি সানমার ওশেন সিটিতে যাবো। কিছু কেনাকাটা করার দরকার ছিল, তবে সেটা মুখ্য নয়। অফিস থেকে বের হওয়াটা আর মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে সম্ভাব্য কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ভাবার অবকাশের দরকার ছিল। রিক্শায় যেতে যেতে মন টানছিল মিমিতে যাবার জন্য। এক জীবনে বিকেল-সন্ধ্যায় দলবেঁধে মিমি সুপার মার্কেটে খামোখা ঘোরাঘুরি করতে গিয়েছি।
সেই স্মৃতির টানেই মিমির কথা ভাবা। অবশ্য শহরের এই অঞ্চলে আসলে একে ঘিরে অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে। যেমন, বাদশাহ্জাদীর সাথে পলিটেকনিক থেকে রিকশা করে কফি ইন পর্যন্ত যাওয়া বা কলেজ রোড ধরে হেঁটে চট্টেশ্বরী রোড হয়ে চারুকলার সামনের চড়াই-উতরাই পার হয়ে ওয়ার সেমিটেরি পর্যন্ত অথবা আরো হেঁটে শাহ্ গরীবুল্লাহ্র কাছে চঞ্চলদের পুরনো ঠেকে যাবার কথা। আরো মনে পড়ে দু’জনে মিলে মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের উলটো দিকে ঝাল বিতানে খেতে যাবার কথা। একবার তাকে নিয়ে জিলাপির পাহাড়ে গিয়েছিলাম।
সেদিনের স্মৃতিটা আনন্দের নয় — তাই সেটা আর মনে করতে চাই না। অতীতের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলোতে ভ্রমণ সবসময় সুখকর হয় না। প্রায়ই দেখা যায় আগের দেখা ফাঁকা প্রান্তরে কদর্য সব বিল্ডিং উঠেছে। জল টলটল পুকুর হয় আবর্জনা ফেলার জায়গা হয়ে গেছে অথবা ভরাট হয়ে বাড়ি উঠে গেছে। ছিমছাম দোকানের সারি ঘিঞ্জি বাজার হয়ে গেছে।
হাসিখুশি মানুষগুলো রাগী-গম্ভীর হয়ে গেছে অথবা বিরক্তিকর এঁটুলির মতো হয়ে গেছে। আমার রিকশাচালককে মিমিতে যাবার পথের অবস্থা জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন এই সময়টাতে প্রবর্তক মোড়ে বেশ যানজট হয়। তাই মিমিতে যাবার চিন্তা বাদ দিয়ে সানমারে যাই।
এদেশে তথাকথিত আধুনিক শপিং মলগুলোর ভেতরের চেহারা সর্বত্র একই রকমের হয়। দোকানগুলো স্কয়ার ফুটের হিসেবে বেঁধে দেয়া আকার থেকে ফেটে বের হতে হতে সিঁড়ির মুখে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায়।
সেই দোকানে যা বিকোয় তার বেশিরভাগ জিনিস অত্যাবশকীয় তো নয়ই, প্রয়োজনীয়ও নয়। সেসব পণ্যের মূল্যের আগামাথা নেই। এখানকার বিক্রেতারা ক্রেতাদের যে ধারণা দিতে চান তা হচ্ছে — যা কিছু বিদেশী তাই ভালো, যা কিছু বেশি দামী তাই উন্নতমানের। এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কখনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মে মাসের গরমে ডিসেম্বরের কাঁপন ধরায়। আবার কখনো অচল হয়ে গিয়ে জানুয়ারীর শীতে গরমে হাঁস ফাঁস করায়।
এমনসব বাণিজ্যিক ভবন ডিজাইনের সময় এনার্জি এফিশিয়েন্সি প্রাকটিস বিবেচনায় থাকে না। তাই এখানে সূর্যালোক প্রবেশের ব্যবস্থা থাকে না, ফলে দিনরাতের পার্থক্য বোঝা যায় না। কোথাও কোথাও সূর্যালোক ঢোকার জন্য উপরে কাচের গম্বুজ করা হয় বটে; তবে তাতে বাহ্যিক সৌন্দর্যটাই শুধু বাড়ে, যথেষ্ট আলোর ব্যবস্থা হয় না। এমন জায়গায় একবার ভেতরে ঢুকলে আর বোঝা যায় না কোথায় আছি, এখন সময় কত! শুধু ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভাষায় স্থানীয় টানগুলোর পার্থক্য থেকে আঁচ করা যায় – কোন শহরে আছি। কিছু কেনাকাটা করবো অমন ইচ্ছে থাকলেও আসলে কী কিনবো সেটার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম না।
তাই অযথা এই দোকান সেই দোকান ঘুরে শেষে কিছু ডার্ক চকোলেটের বার কিনে ভাবি কোথাও বসে কফি খেতে খেতে চিন্তা করা যাক।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
বছরে খুব কম দিন আছে যেদিন আমার কফি খাবার ইচ্ছে জাগে। ভালো কফির সুবাস যতোটা আকর্ষনীয় মনে হয়, ডিসপেনসারের কফির স্বাদ ততটা জঘন্য লাগে। আমি বিশুদ্ধ চা-খোর — ঘন কালো লিকারের অল্প সুবাসওয়ালা সিলেট বা অহম চা, যাতে প্রতি কাপে শুধু দেড় চামচ চিনি দেয়া হয়েছে কিন্তু দুধ-আদা-লেবু-তেজপাতা-দারুচিনি-এলাচ-লবঙ্গ ইত্যাদি দিয়ে তার স্বাদ-গন্ধ নষ্ট করা হয়নি। ঠিকঠাক চা বানাতে পারে এমন লোকের সংখ্যা বোধকরি সারা দুনিয়াতে খুব কম।
এ’কারণে বাইরে চা খাবার ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে হয়। তাছাড়া এদেশে চায়ের দোকানগুলোর অবস্থা বিশেষ সুবিধার হয় না বলে গল্প করা, আড্ডা দেয়া, সময় কাটানোর জন্য কফির দোকানে বসা ছাড়া উপায় থাকে না। অন্যদিকে বেশিরভাগ কফির দোকানে এসপ্রেসো, কাপুচিনো, ল্যাটে, মোকা নামে যেসব ভ্যারাইটি বিক্রি করে সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা দুরূহ ব্যাপার। এইসব ভাবনায় চা বা কফি কোনটাই পান করার ইচ্ছে আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই বসে বসে ভাববার বদলে সানমার থেকে বের হয়ে হাতের বাঁয়ে এগিয়ে চার নাম্বার রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও. আর. নিজাম রোডের জাংশান পার হয়ে হিল ভিউ রোডের গন্তব্যে চলে আসি।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের বানানো বহুতল আবাসিক ভবনগুলোর দিকে তাকালে অনেক সময়ই কোন ভবনটা কার বানানো সেটা তার ডিজাইন বা রঙ দেখে বলে দেয়া যায়। নির্মাতারা এই ব্যাপারটাকে সম্ভবত তাদের ট্রেডমার্ক বলে জাহির করতে চায়। বহিরঙ্গ বা ভেতরের এই একঘেঁয়েমিতে আমি শুধু সৃজনশীলতার ঘাটতি আর চিন্তার দীনতা দেখতে পাই। বহিরঙ্গ যেমনই হোক ভবনগুলোর প্রবেশ পথ ও একতলার ব্যবস্থা নির্মাতা নির্বিশেষে মোটামুটি একই রকম। এই ভবনটাতেও তার ব্যতয় হয় না।
গাড়ি চলাচলের জন্য রাখা একটা প্রশস্ত গেটের পাশে জন চলাচলের জন্য একটা সরু গেট। সেই গেট ঠেলে ঢুকলে কর্তব্যরত প্রহরীর মুখোমুখি হতে হয়। অবধারিত প্রশ্ন করা হয়,
- কত নাম্বারে যাবেন?
- ফ্ল্যাট নাম্বার তো জানি না, সুনন্দা চৌধুরীর বাসায় যাবো।
- ম্যাডাম তো বাসায় নেই।
- আমি আসলে সুনন্দার কাছে আসিনি।
তার সাথে ইদানীং আরেকজন ম্যাডাম যে থাকছেন তার কাছে এসেছি।
- ঐ ম্যাডামও নেই।
- কিন্তু উনার তো এর মধ্যে ফেরার কথা!
- উনি সচরাচর এমন সময়েই ফেরেন। তবে সব দিন কি আর এক রকম হয়? আপনি উনাকে মোবাইলে ফোন করুন।
- সমস্যা হচ্ছে, আমার কাছে উনার মোবাইল নাম্বার নেই।
আমি কি উনার জন্য গেটে অপেক্ষা করতে পারি?
- তাহলে রেজিস্টারে আপনার নাম-ঠিকানা লিখে গেস্টরুমে বসুন। ম্যাডাম আসলে আপনাকে বলবো। আর একটা কথা, গেস্ট রুমে বসে সিগারেট খেতে পারবেন না, অ্যাসোসিয়েশনের মানা আছে।
- ঠিক আছে।
রেজিস্টারে ফ্ল্যাট নাম্বারটা ফাঁকা রেখে ‘যার সাথে দেখা করতে চান’-এর ঘরে রায়নন্দিনীর নাম লিখি।
কতো বছর পর এই নামটা হাতে লিখলাম সেটা মনে করা সম্ভব নয়। নামটা লিখে কয়েক মুহূর্ত সেটা তাকিয়ে দেখি। অতিচেনা, সাধারণ সব বর্ণ আর স্বরচিহ্ন মিলে কী আশ্চর্য একটা জাদুময় শব্দ তৈরি করে ফেললো!
গেস্টরুমটা অপরিসর, আধো আলো, গুমোট, মাথার ওপর একটা আটচল্লিশ ইঞ্চির ফ্যান বেদম ঘুরছে — বোধকরি রেগুলেট করার উপায় নেই। এর একমাত্র জানালাটা ভেতরের দিকে, তাই বাইরে থেকে কেউ আসলে দেখা যায়। একতলায় ন্যাড়া কলামের সারি।
সেখানে ভূমিকম্পরোধক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কলামের ফাঁকে ফাঁকে গাড়ি রাখার জায়গা। মাথার ওপরের বীমে অ্যাপার্টমেন্টের নাম্বার দেয়া আছে ১-এ, ২-সি এভাবে। পার্ক করা গাড়ির মডেল দেখে এখানকার বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক অবস্থার একটা ধারণা নেয়া যায়। এটা ধনীদের আবাস নয়, নিতান্তই মধ্যবিত্তদের বাড়ি।
তাই এখানে টয়োটা আর নিসানের বানানো সেডান আর স্টেশন ওয়াগনের আধিক্য। দুয়েকটা ভারতীয় হ্যাচব্যাকও দেখা যায়। নিসানগুলোর কোন কোনটার উইন্ডশিল্ডে লাগানো স্টিকার থেকে বোঝা যায় এগুলোর ব্যবহারকারীরা সরকারী কর্মকর্তা। ইমেইল করে বা সোশাল নেটওয়ার্কে টোকা দিয়ে অনায়াসে রায়নন্দিনীকে জানানো যেতো – আমি কবে, কখন আসছি। অথবা তার মোবাইল নাম্বার নেয়া যেতো।
আমি সেসব কিছু করার চেষ্টা করিনি। আমি ভাবি, এই ভালো — কোন খবর না দিয়ে হুট করে হাজির হওয়া। আরো ভাবি, রায়নন্দিনী আমাকে দেখলে কি চমকে উঠবে?
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
আমার সময়জ্ঞান থাকে না, তাই কতক্ষণ কেটে যায় বলতে পারবো না। মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করার পর থেকে যারা আর হাতঘড়ি পরেন না আমি তাদের দলে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখতেও ইচ্ছে করে না।
এক সময় দ্বাররক্ষীর গলা শুনি,
- ম্যাডাম, আপনার কাছে গেস্ট এসেছে। গেস্টরুমে আছে।
আমি উঠে দাঁড়াই। রায়নন্দিনী নিঃশব্দে গেস্টরুমে ঢোকে। আমাকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক না হয়ে জিজ্ঞেস করে,
- কখন এসেছো?
- ঠিক বলতে পারবো না।
অনেকক্ষণ হবে।
- এসো।
আমি তাকে অনুসরণ করি। পাশাপাশি দুটো লিফ্ট থাকলেও সাশ্রয়ের জন্য একটা সচল আছে। যেটা সচল সেটাতে ঢুকলে বোঝা যায় এনার প্রাণভোমরা আসি-যাই, আসি-যাই করছে।
খোলার সময় তার দ্বার আংশিক নির্মীলিত থাকে। তার চলায় যে ছন্দ আছে তাতে শরীর কেঁপে ওঠে। তার ভেতরের বাতাসে সূক্ষ্মভাবে হলেও ইথানল আর অ্যামোনিয়ার গন্ধ পাওয়া যায়। তার ভেতরের দেয়ালে শক্ত বা ধাতব কিছু দিয়ে ঘষে নানা চিহ্ন কাটার চেষ্টা করা হয়েছে। মাথার ওপরের অদৃশ্য এগজস্ট ফ্যানটি অচল হওয়ায় বদখত এক অ্যাঙ্গেলবারের সাহায্যে একটা বাড়তি ওয়াল ফ্যান লাগানো হয়েছে।
এই লিফটে উঠলেই বাড়ির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, মালিকদের অ্যাসোসিয়েশন এবং এখানকার অধিবাসীদের কারো কারো সম্পর্কে হালকা ধারণা তৈরি হয়ে যাবে। লিফটে আমরা ছাড়া আর কেউ না থাকায় আমাদের কথোপকথন শুরু হয়।
- তোমার সাথে ব্যাগ কি এই একটাই, নাকি অন্য কোথাও ব্যাগ রেখে এসেছো?
- ব্যাগ শুধু এটাই। তবে থাকার জন্য এমপ্রেস রোডের ঠাঁইয়ে বুকিং দেয়া আছে।
- অন্য কোন কাজে এসেছো বুঝি?
- কাজ একটা ছিল বটে।
তবে সেটা মুখ্য নয়। এখানে আসাটাই মুখ্য।
- মিথ্যুক! এখানে আসাটা মুখ্য হলে আগে জানাতে। আর তাহলে এমপ্রেস রোডের ঠাঁইয়ে বুকিং দিতে না।
- আগে জানাইনি ইচ্ছে করেই।
তোমাকে চমকে দেবার ইচ্ছে ছিল। সে চেষ্টাটা জলে গেছে। আর তুমি থাকো অন্যের সাথে। সেখানে আমার ঠাঁই হবে কিনা সেটার তো ঠিক নেই, তাই ওখানে একটা বুকিং দিয়ে রেখেছি।
- যদি থাকতে না দেই তাহলে কি এমপ্রেস রোডে চলে যাবে?
- না, তাহলে একটা রিকশা নিয়ে সোজা দামপাড়াতে চলে যাব।
তারপর যে বাসটা মিলবে তার টিকিট কেটে ফিরে যাব।
- সব চিন্তাভাবনা করেই এসেছো দেখছি। হিসেব না করে ঝাঁপ দেবার সাহস আজো হয়নি।
- অমন সাহস আমার কখনোই ছিল না, সেটা জানো। আর এখন যত দিন যাচ্ছে ততই ভীতু হয়ে যাচ্ছি।
লিফট থেকে বারো তলায় নামতে দেখা গেল এই ফ্লোরে চারটা ফ্ল্যাট। দক্ষিণ-পশ্চিম কোনের ফ্ল্যাটের দরোজা খুললে ভেতরে ঢুকে জুতা খুলি। ফ্ল্যাটে ঢুকতেই ‘এল’ শেপড ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং স্পেস। তার এক প্রান্তে চওড়া-ভারী পর্দা টানানো থাকায় এরচেয়ে বেশি কিছু দেখা যায় না। আমি ড্রইং স্পেসে একটা সোফায় বসি।
রায়নন্দিনী ভেতরে চলে যায়। একটা অচেনা ফ্ল্যাটে রায়নন্দিনীর সাথে আমি একা — এ’কথা ভাবতে আমার নিজের কাছেও অবাক লাগে। পোশাক পালটে, হাতমুখ ধুয়ে রায়নন্দিনী এসে বলে,
- তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি চা করছি।
চা খাবার কোন ইচ্ছে আমার নেই।
তবু কথা বাড়াই না। ওর হয়তো এখন চা খেতে ইচ্ছে করছে। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি ডাইনিং টেবিলে চা আর বেলা বিস্কুট দেয়া হয়েছে। কোন প্রকার বিস্কুটই আমার পছন্দের খাবার নয়। কিন্তু এই অঞ্চলের লোকজন নাকি কোন কিছু না ডুবিয়ে চা খেতে পারেন না।
সেটা বিস্কুট হোক, রুটি হোক আর পরোটা হোক। এমনকি কেকও পর্যন্ত নাকি এরা চায়ে ডুবিয়ে খান। রায়ন্দিনী চায়ে বেলা বিস্কুট ডুবিয়ে কামড় দেওয়াতে বলি,
- বাহ্! এখানকার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছো দেখছি।
- অভ্যাস রপ্ত করিনি। এই সময় খালি পেটে চা খেলে অম্বল হবে।
তুমিও বিস্কুট দিয়ে চা খাও।
- বিস্কুট আমার কাছে জঘন্য লাগে।
- তবুও খাও। রাতে কী খাবে?
- তুমি যা খাও তাই।
- রাতে আমি শুধু সবজী স্যুপ খাই।
ওতে তোমার পোষাবে না।
- শুধু স্যুপে পোষাবে না ঠিক। সাথে একটা স্যান্ডউইচ হলেই চলবে।
ব্যাগ থেকে চকোলেট বের করে রায়নন্দিনীর হাতে দিয়ে বলি,
- তোমার জন্য।
- বাহ্! ডার্ক চকোলেটের কথা ভোলনি দেখি।
- অনেক কিছুই ভুলিনি। আসলে কিছুই ভুলিনি।
চা খাওয়া শেষ হতে রায়নন্দিনী বলে,
- চলো বারান্দায় বসা যাক। এই বাসার বারান্দাটা বড় আর সুন্দর।
- সুনন্দা কখন ফিরবে?
- ওর ফেরার ঠিক নেই।
ওর এখনকার কাজটা রামুতে। তাই সব দিন ফিরতেও পারে না। কেন, সুনন্দা আসলে তোমার থাকা হবে না বলে ভাবছো?
- না, আমি সেসব কিছু ভেবে বলিনি। এমনি জানতে চাইলাম।
- সুনন্দা আসলেও অসুবিধা নেই।
এই বাসায় একজন অতিথির স্থান অনায়াসে হবে।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
এই ভবনটা উপর থেকে নিচের দিকে ধাপে ধাপে প্রশস্ত হয়েছে। তাই উপরের দিকের ছয়টা ফ্লোরে খোলা ছাদওয়ালা বারান্দা আছে। বারান্দাটার মাথা খোলা থাকলেও সামনের যে দিকটা খোলা সেদিকে ১০-১২ ফুট উঁচু গ্রিল দেয়া আছে। গ্রিল যতোটা না অনুপ্রবেশকারী ঠেকানোর জন্য, তারচেয়ে বেশি যাতে নিচের তলার খোলা বারান্দাতে উঁকি দেয়া না যায় তার জন্য।
আশেপাশে আর কোন উঁচু ভবন না থাকায় বারান্দাটাতে একই সাথে একটা খোলামেলা ভাব অথচ প্রাইভেসির ব্যবস্থা হয়েছে। বারান্দাটাতে একটা বেশ লম্বা-চওড়া, সাদা রঙকরা কাঠের বীচ চেয়ার পাতা আছে, তাতে ফোমের পুরু গদি পাতা। এমন খোলা বারান্দা কিন্তু তাতে কোন ফুলের বা লতানো গাছ নেই। বুঝলাম এই বাসার অধিবাসীরা হয় উদ্ভিদপ্রেমিক নয় অথবা গাছের নিয়মিত পরিচর্যা করার মতো সময় তাদের নেই। সুনন্দার রুটিন যা জানা গেলো তাতে তার পক্ষে নিয়মিত গাছের পরিচর্যা করা সম্ভব নয়।
তাছাড়া প্রায়ই দীর্ঘ সময়ের জন্য তাকে নাকি শহরের বাইরে বা দেশের বাইরে থাকতে হয়। সুতরাং বারান্দায় বীচ চেয়ারটা ছাড়া কেবল কাপড় শুকানোর জন্য খান দুই ক্লোদস র্যাক আছে। সেই ক্লোদস র্যাকে আবার কোন কাপড় নেই। এ বাড়ির বাসিন্দারা বোধকরি নিয়মিত কাপড় ধোবার সুযোগও পায় না।
চেয়ারে বসে পিঠ ঠেকিয়ে পা লম্বা করে দিতে শরীরে ক্লান্তি ভর করে।
জিজ্ঞেস করি,
- এদেশে কতদিনের জন্য এসেছো?
- কতদিন ঠিক জানি না। তিন মাস হতে পারে, ছয় মাস হতে পারে। তবে তিন মাসের বেশি সময় লাগলে মাঝে আমাকে একবার সশরীরে অফিসে গিয়ে কাজের অগ্রগতি জানাতে হবে।
- কাজটা কী?
- সিনো-টিবেটিয়ান বর্গের কম করে হলেও ২১টা ভাষা এই দেশে প্রচলিত। তার মধ্যে কম করে হলেও ১০টা এই অঞ্চলে প্রচলিত।
তার মধ্য থেকে ৫-৬টা নিয়ে কাজ।
- বাপ্রে! এই দেশে চীনা ভাষার জাতভাই ভাষায় লোকে কথা বলে সেটাই জানতাম না। তা কী সেই কাজ?
- এই ধরো, এসব ভাষাভাষী মানুষ এখন কী পরিমাণ আছেন, তারা কোথায় কোথায় থাকেন, তাদের অবস্থা কী, তাদের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে, তাদের ছেলেমেয়েরা এই ভাষা কতটুকু পারে, ভাষাটাতে ইদানিং অন্য কোন্ কোন্ ভাষার শব্দ ঢুকে যাচ্ছে, এই ভাষার বই আছে কিনা, এই ভাষায় লোকসাহিত্যের নিদর্শন মেলে কিনা, এই ভাষার সামনে চ্যালেঞ্জটা কী এমনসব হাজারোটা বিষয়। তোমার অতসব কচকচানি জানার দরকারটা কী? কাজ মানে কাজ, ব্যাস!
- তা ঠিক! আমি এই লাইনের লোক না। এসব আমার মাথায় ঢুকবে না।
তা সেই কাজের সীমা কি শহরেই সীমাবদ্ধ নাকি শহরের বাইরেও আছে।
- কাজ শহরে না যতটুকু তারচেয়ে বেশি শহরের বাইরে, আশেপাশের জেলাগুলোতে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
- তাহলে তো চিন্তার ব্যাপার। এই অঞ্চলের কিছু কিছু জায়গা হঠাৎই অশান্ত হয়ে ওঠে। মানে মোটামুটি যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়।
খামোখাই কি আর এই অঞ্চলে এতদিন ধরে সেনাছাউনি আছে!
- অমন পরিস্থিতি কখনোসখনো যে তৈরি হয় না তা নয়। এদের রাজনৈতিক সমস্যার এক কালে সামরিক সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সুতরাং অমনটা হতেই পারে। তাছাড়া যারা এখনো বিক্ষুদ্ধ, তারা নানা উপদলে ভাগ হয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যে হানাহানি আছে।
তাই একটু জেনে শুনে আগাতে হয়।
- সাবধানের মার নেই। তুমি এই অঞ্চলে কাজ না করে এই দেশের অন্য অঞ্চলে যেখানে সিনো-টিবেটিয়ানে কথা বলার লোক আছে সেখানে কাজ করতে পারতে।
- সেটা হয়ত করা যেত, তবে এই এলাকায় আগে আরো কাজ হওয়ায় এখানে কাজ করাটা সুবিধাজনক। অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
আগের লোকদের তৈরি করা গাইডলাইনগুলোও বেশ কাজে দেয়। এসব থাক। তোমার কথা বলো।
- আমার বলার কিছু নেই। অবস্থা সর্বশেষ যা জানতে, তাই আছে।
বোধকরি বাকি জীবনে তার কিছু অবনতি ছাড়া কোন উন্নতি হবে না।
- এই জীবনে তুমি চোখে দেখতে শিখলে না। হাতের কাছে যে অমূল্য ধন থাকে সেটা চোখে দেখতে পাও না বলে খামোখা হা-হুতাশ করো। ওই যে রবিবুড়ো বলেছিলো না, “আমি যখন ছিলেম অন্ধ, সুখের খেলায় বেলা গেছে, পাইনি তো আনন্দ”।
- না, আমি আসলে অতটা অন্ধ নই।
ঠিক এই মুহূর্তে আমার সামনে যে অমূল্য ধন আছে তাকে দেখতে পাচ্ছি। তাকে দুহাতে আঁজলা করে তুলেও ধরতে পারবো।
- অসভ্যতা করবে না! অমূল্য ধন না, ছাই! সময় কালে এসব মনে ছিল না।
- আমি বুদ্ধিতে খাটো তো তাই সঠিক সময় কোনটা সেটা প্রায়ই বুঝে উঠতে পারি না। তবে কোনটার মূল্য কতটুকু সেটা মোটামুটি বুঝতে পারি।
কিন্তু সেটাই তো সব নয়। আমার সাহসের ঘাটতি আছে।
আলোচনা অস্বস্তিকর দিকে মোড় নিচ্ছে দেখে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করি।
- এই বাসায় কাজকর্ম কে করে? কোন গৃহকর্মী নেই?
- বেশির ভাগ কাজ আমরা দুজনেই করি – যে যখন সময় পায়। কিছু কিছু কাজ করার জন্য একজন গৃহকর্মী আছেন বটে তবে তার আসাটা নিয়মিত নয়।
যেদিন দরকার হয় সেদিন দিনের বেলায় মোবাইলে কল করে জানিয়ে রাখলে সন্ধ্যার পরে এসে কাজ করে দিয়ে যান।
- সুনন্দার সাথে জুটলে কী করে?
- কয়েক বছর আগে সুনন্দা আমাদের শহরে একটা ওয়ার্কশপে গিয়েছিল। দুই সপ্তাহের ওয়ার্কশপ। সেখানেই পরিচয়, হৃদ্যতা। ওয়ার্কশপ শেষে আমার সাথে আরো পাঁচ দিন ছিল।
শহরের বাইরে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল। আমি বললাম, “তুমি যে শহরের মানুষ তার পায়ের কাছে সমুদ্র, বুক জুড়ে পাহাড়, ডানে-বাঁয়ে বের হলেই জঙ্গল। আমি তোমাকে কোথায় বেড়াতে নেবো”? তাই শেষে আমাদের শহরের ভেতরেই দিনমান হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি। এক সকালে টেরিটি বাজার চলে গেছি চীনে ব্রেকফাস্ট করতে, আরেক দুপুরে টিফিন গলিতে চলে গেছি দুপুরের খাবার খেতে। চৌরঙ্গী আর লিন্ডসে স্ট্রীটের ফুটপাথের দোকান থেকে হাবিজাবি জিনিস কিনেছি।
কলেজ স্ট্রীট থেকে খুঁজে খুঁজে পুরনো বই কিনেছি। নন্দনে সিনেমা দেখেছি, জ্ঞান মঞ্চে নাটক দেখেছি, ইন্টারন্যাশনাল মিউজিক ফেস্টে গান শুনেছি। সারা রাত ধরে গল্প করেছি। পরে আরো দুই বার দেখা হয়েছে — একবার ইউনেস্কোর একটা সম্মেলনে তিন দিনের জন্য নিউ ইয়র্কে, আরেকবার কুয়ালালামপুরে এক সপ্তাহের একটা ট্রেনিং প্রোগ্রামে। সামনাসামনি আর দেখা না হলেও ফোন-সোশাল নেটওয়ার্ক-ভিডিও চ্যাটে নিয়মিত কথা হতে থাকে।
এভাবে আমাদের মধ্যে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। কথা ছিল আমাদের একজন আরেক জনের শহরে গেলে তার বাসায় উঠতে হবে। তাই এই শহরে কাজ করার কথা যেদিন ওকে জানালাম সেদিন থেকেই ও আমার জন্য ঘর গুছিয়ে রেখেছে।
- তোমার ভাগ্য ভালো যে সুনন্দার মতো মানুষ পেয়েছো। নয়তো এই শহরে তোমার থাকাটা খুব সহজ ছিল না।
- না, তা নয়। এদেশী কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা আমাদের লাইনে কাজ করে, এখানে তাদের গেস্টহাউস আছে। আমরা চাইলে সেখানে থাকতে পারি। ওরা আবার আমাদের ওখানে গেলে আমাদের গেস্টহাউসে থাকতে পারে। একটা দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার আর কি!
- আমাদের পুরনো শহরে শেষ কবে গেছো?
- এক যুগ পার হয়ে গেছে।
তুমি?
- আমি বছরে তিন-চার বার যাই। তবে এতো অল্প সময়ের জন্য যাই যে ঘুরে দেখাও হয় না বা কারো সাথে দেখা করাও হয় না।
- জানো, কোথাও কোন গান, নাচ বা আবৃত্তির অনুষ্ঠান দেখতে গেলে আমার কেবল সুবীরদা’র কথা মনে হয়। উনি কি এখনো অমন আছেন? এখনো কি সাংস্কৃতিক দল করে বেড়ান?
- সুবীরদা’র সাথে আমার দেখা হয় না সেটাও এক যুগের বেশি। সুতরাং, তোমার প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই।
সুবীরদা’র কথা আমারও মনে হয়। তবে আমি তো আর্ট-কালচার লাইনের লোক না, ওসবের খবর রাখি না। তাই সুবীরদা’ বা তাঁর সংগঠন শ্রুতিকথন এখনো অনুষ্ঠান করে কিনা জানি না।
- কফি খাবে?
- ভালো কফি না হলে কফি খেয়ে আমার পোষায় না।
- এটা ফলগার্সের একটা ডার্ক রোস্ট ভার্সন।
তোমার পছন্দ হবে।
- ঠিক আছে।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
রায়নন্দিনী কফি বানাতে গেলে সুবীরদা’র কথা ভাবি। একটা সময় ছিল যখন দিনের বড় একটা সময় সুবীরদা’র সাথে কাটতো। সুবীরদা’ ভালো ছাত্র ছিলেন।
মা-বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। তিনিও মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিলেন। কিন্তু দুই বছর যেতে না যেতে তিনি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার পাট শিকেয় তুলে আমাদের শহরে ফিরে আসেন। এসে ঘোষণা দেন — ডাক্তারী পড়ে মানুষের শরীরের রোগের চিকিৎসা করলে সমাজের শরীরের রোগ সারবে না। এর জন্য চাই সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
ব্যাস! শ্রুতিকথন নামে একটা সংগঠন গড়ে সেখানে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের বিনিপয়সায় গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয় শেখাতে লাগলেন। তাদের নিয়ে জাতীয় দিবসগুলো আর মহান ব্যক্তিদের জন্মদিবসে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতে লাগলেন কলেজের মাঠে, শহীদ মিনারে, সড়কদ্বীপে, মুক্তমঞ্চে।
সুবীরদা’দের প্রজন্মটা বোধকরি একটু অস্থির চিত্তের ছিল। তাঁদের সময়ের অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার গড়ার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ঝক্ঝকে ফলাফল করা এক একজন উচ্চতর পড়াশোনা, চাকুরী বা ব্যবসায়ের পথে না গিয়ে ঘরের খেয়ে নানা প্রকার বনের মোষ তাড়াতে লাগলেন।
হানিফ ভাই ঘোষণা দিলেন তিনি আর কলেজে যাবেন না। এখন থেকে বিজ্ঞানের সাধনায় মনোনিবেশ করবেন। বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য সর্বসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে বক্তৃতা করবেন। মিজান ভাই আরেকটু এগিয়ে বললেন, “নিউটন বা আইনস্টাইনের কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল? তাহলে আমাকে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে”? টুলটুল ভাই এক সকালে তাঁর যাবতীয় অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট সুতোয় গেঁথে মালা বানিয়ে একটা রাস্তার কুকুরের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন, “এখন আমি যাবতীয় অপ্রয়োজনীয় ডিগ্রি থেকে মুক্ত। এখন থেকে আমি শুধু কবিতা লিখব”।
বিজনদা’ কোন প্রকার ঘোষণা না দিয়ে কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা নদীর পাড়ে গিটার নিয়ে গান বাঁধতে শুরু করলেন। শহরজুড়ে এমন সর্বনাশা সব ঘটনা দেখে আমাদের বাবা-মায়েরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন আমরা যাতে এসব কুলাঙ্গারদের সাথে না মিশি। তবু কারো কারো সর্বনাশ ঠেকানো যায় না। তবে তারা সংখ্যায় খুব অল্প।
আমরা ভালো ছেলেরা মন দিয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি বাগানোর চেষ্টাতে নামি যাতে চাকুরির বাজারে পিছিয়ে না পড়ি।
আমরা বা আমাদের অভিভাবকেরা না চাইলেও কী করে যেন আমরা বার বার পিছিয়ে পড়তে থাকি। কলেজে পড়ার সময় হঠাৎ এক বন্যায় সারা দেশ তলিয়ে যায়। আমাদের শহরের রাস্তা দিয়ে বড় বড় নৌকা চলতে থাকে। আমরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে কোন দিন বাড়ি বাড়ি থেকে চাল-ডাল-রুটি সংগ্রহ করে ওসমানী স্টেডিয়ামের আর ইসদাইর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেয়া বন্যার্তদের দিয়ে আসি।
কোন দিন চাঁনমারীর কাছে ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ মেরামত করি। কোন দিন পঞ্চবটির কাছে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ পাহারা দেই। একবার একটা মেডিক্যাল টিমের সাথে নৌকায় করে শীতলক্ষ্যা নদী পাড় হয়ে সাবদী বাজারে চলে গিয়েছিলাম। ফিরতি পথে শহরে ঢোকার মুখে নৌকা ডুবে যায়। কয়েক দিন আগেই ত্রাণ তৎপরতা চালাতে গিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায় এমন নৌকাডুবিতে জগলুল হোসেন আলো আর লিঙ্কন আকবর নামে আমাদের বয়সী দুইজন মারা গিয়েছিল।
আমাদের নৌকা পুরোপুরি ডুবে যাবার আগেই আশেপাশের আরো নৌকা এসে আমাদের উদ্ধার করে ফেলে। বাসায় ভেজা কাপড়ে ফিরলেও সবাই এটাকে স্বাভাবিক মনে করে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেনা। আমিও নৌকাডুবির কথা চেপে যাই।
বন্যা সরে যাবার পর যতই আমাদের কলেজ ফাইনাল এগিয়ে আসতে থাকে ততই সারা দেশ বিশ্ববেহায়াকে তাড়াতে উঠেপড়ে লাগে। প্রায়ই হরতাল-অবরোধ-বিক্ষোভ ইত্যাদি কর্মসূচী থাকে ফলে ক্লাস হয় না।
একবার তো প্রায় দেড় মাসের জন্য সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া হল। হরতাল থাকলে কেউ স্কুল-কলেজ-অফিসে যায় না। তখন পাড়ার সবাই মূল রাস্তা থেকে দূরে পেছন দিকের একটা ফাঁকা জায়গায় দিনমান ক্রিকেট খেলতে যেত। খেলতো মূলত ছোটরা, বড়রা সবাই মাদুর বিছিয়ে ছাতা খাটিয়ে বসে খেলা দেখতো। তবে আন্দোলন যখন তুঙ্গে ওঠতে লাগলো তখন আর কেউ ক্রিকেট খেলতে যেতো না।
কমবয়সীরা মিটিং-মিছিলে যেত। বড়দের মধ্যে যারা রাজনীতি করতেন তারা মিটিং-মিছিল তো করতেনই তবে তাদেরকে প্রায়ই গ্রেফতার আর অন্যসব জুলুম সইতে হতো। এইসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই আমরা কলেজ ফাইনাল শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে যাই। কিন্তু বিশ্ববেহায়ার আমলে দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকতো বলে আমাদের শিক্ষাজীবন সেশন জটের মতো অশ্রুতপূর্ব এবং ভয়াবহ একটা দানবের কবলে পড়ে যায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও আমাদের ক্লাস আর শুরু হতে পারে না।
আমরা প্রায় দুই বছর ধরে বেকার ঘরে বসে থাকি।
আমাদের সময় কাটতে চায় না। হাতখরচ জোটানোর জন্য টিউশনি করি। মাঝখানে শ্রুতিকথনে গিয়ে একবার আবৃত্তি শেখার ব্যর্থ চেষ্টা করি। আবৃত্তি শিখতে না পারলেও সুবীরদা’র সাথে দিনমান লেগে থেকে শ্রুতিকথনের নানা কাজ করে দেই।
কখনো প্রেসে গিয়ে সীসার টাইপে কম্পোজ করা আমন্ত্রণপত্র, ফোল্ডার, লিফলেট ইত্যাদির প্রুফ দেখি, ডিজাইন ঠিক করি। কখনো নিজেই বিভিন্ন জনের কাছে গিয়ে আমন্ত্রণপত্র বিলি করি। কখনো অনুষ্ঠানের জন্য স্পন্সর বা বিজ্ঞাপনদাতা জোগাড়ের জন্য বিশিষ্টজনদের বাসায় বা অফিসে ধর্ণা দেই। এ’কথা ভাবার কোন কারণ নেই যে আমি আর্ট-কালচারের ব্যাপারে খুব উৎসাহী। তাহলে আমি শ্রুতিকথন নিয়ে অত খাটাখাটুনি করতাম কেন? প্রথমত, আমার এইসব কাজ করতে খারাপ লাগতো না।
বরং আর্ট-কালচার লাইনের কিছু লোককে আমার ভালোই লাগতো। দ্বিতীয়ত, আসলে এটাই মূল কারণ, শ্রুতিকথনের গানের দলের একজনের নাম দীপা রায়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে রায়নন্দিনী যখন গাইতো,
সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,
সংকটের কল্পনাতে হোয়োনা ম্রিয়মান।
আ–আহা-হা-হা-হা
মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধর, নিজেরে কর জয়।
তখন আমি না পারি সংকোচের বিহ্বলতা ঝাড়তে, না পারি সংকটের কল্পনা ছাড়তে।
না পারি ভয়কে জয় করতে, না পারি নিজের মাঝে শক্তি ধরতে। রবিবুড়ার সুরে নিমজ্জিত রায়নন্দিনীর মুখের দিকে তাকালে আমার মনে হতো সে বুঝি আমাকেই বলছে,
মুক্ত করো ভয়, নিজের ‘পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।