আওয়ামী লীগের গেল আমলের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক এখন কার্যত একঘরে। সাতক্ষীরা থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রীর পদ লাভ করেন রুহুল। কিন্তু ক্ষমতার পাঁচ বছরে তার জামায়াতপ্রীতি, রাজনৈতিক অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে সাতক্ষীরা পরিণত হয় জামায়াত-শিবিরের শক্তিশালী ঘাঁটিতে। এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছেন ঠিক, তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তবে এবার আর মন্ত্রীর পদ জোটেনি।
একঘরে হওয়ার পেছনে কারণ একটাই, মহাজোটের বিগত পাঁচ বছর শাসনামলে রুহুল হক ছিলেন একেবারেই জনবিচ্ছিন্ন। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ডে ভূমিকা ছিল না মহাজোট সরকারের একসময়ের প্রভাবশালী এই মন্ত্রীর। আর ক্ষমতার এই সময়ে নানাভাবে মালিক হয়েছেন অঢেল সম্পদের। অথচ ওই সময় হাতে গোনা কয়েকজন দুধের মাছি ছাড়া কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি। আর তার কাছের যে কজন বিত্তশালী হয়েছেন তার ক্ষমতার সময়, তারাও এখন আর কাছে ভেড়েন না।
অন্যদিকে পিএস, এপিএস থেকে শুরু করে রুহুল হকের স্বজন-পরিজন সবাই মূলত বিএনপি-জামায়াতের লোক ছিলেন। তারা সাবেক এই মন্ত্রীকে সব সময় দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। আর রুহুলও সে সময় এড়িয়ে চলতেন ত্যাগী থেকে নিয়ে তৃণমূলকে। এদিকে মন্ত্রী থাকাকালে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ায় ডা. রুহুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জামায়াত-শিবির সহিংসতা চালিয়ে দেশ থেকে সাতক্ষীরা জেলাকে যে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল, তা মূলত ডা. রুহুল হকের কারণেই হয়েছিল বলে মনে করেন এখানকার সুশীল সমাজ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা।
তার কারণে জেলা আওয়ামী লীগে কোন্দলও ছিল প্রকট। কৌশলে দলীয় নেতা-কর্মীদের দূরে সরিয়ে রেখে নিজের বোন, স্ত্রী, ভাগ্নে, ভাগি্নজামাই, পিএস, এপিএসসহ স্বজনদের প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের স্বাস্থ্য বিভাগে ঠিকাদারি, টেন্ডারবাজি, অবাধে নিয়োগ-বাণিজ্য চালিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। নিজেও তাদের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কখনোই জেলার দলীয় কার্যক্রম, হরতালবিরোধী মিছিল-সমাবেশে তাকে দেখা যেত না।
সদ্য সমাপ্ত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও রুহুল হককে জেলা আওয়ামী লীগের পাশে পাওয়া যায়নি। গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সাতক্ষীরা এক রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়। সে সময়ে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের হামলায় একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শিশুসহ আওয়ামী লীগের ২১ জন নেতা-কর্মী নৃশংসভাবে খুন হন। ওই সময় নিহতদের পরিবারের পাশে পাওয়া যায়নি ডা. রুহুল হককে। এমনকি মোবাইল ফোনেও খোঁজখবর নেননি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
গত বছর ২৯ নভেম্বর হেলিকপ্টারে দশম সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় আসেন। এখানে তিনি এক সপ্তাহ সার্কিট হাউসে অবস্থান করেন। কিন্তু তার কাছে কোনো নেতা-কর্মী যাননি। তিনি সার্কিট হাউসে একাকী সময় কাটাতে বাধ্য হন। এমনকি পা রাখার সাহস পাননি নিজ নির্বাচনী এলাকা দেবহাটা, আশাশুনি ও কালিগঞ্জের মাটিতে।
সাতক্ষীরায় অবস্থানকালে তার নির্বাচনী এলাকা দেবহাটার সখীপুরে প্রধান সড়কের ওপর মাটি তুলে পাঁচ ফুট উঁচু করে ব্যারিকেড দিয়ে সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রতীকী কবর তৈরি করে জামায়াত-শিবির। সে সময় রুহুল হক মহাজোট সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হয়েও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। ফলে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিতৃষ্ণার পাত্রে পরিণত হন রুহুল হক। এমনকি দলীয় নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করে প্রতীকী কবর সরাতে ব্যর্থ হন। এ ঘটনায় জেলায় হইচই পড়ে যায়।
এর একপর্যায়ে রুহুল হকের নির্বাচনী এলাকা কালিগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের হাতে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান খোকন এবং কলারোয়া উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা মাহাবুবর রহমান বাবু ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রবিউল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন দলীয় নেতা-কর্মী। তখন ডা. রুহুল সাতক্ষীরায় অবস্থান করলেও নিহতের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো দূরের কথা, তাদের খোঁজ পর্যন্ত নেননি। সে সময় এমনকি জেলা নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে শহরে ১৪ দলের মিছিল-সমাবেশ হলেও সেখানে উপস্থিত হননি তিনি। এ সময় সার্কিট হাউসে অবস্থান করেই জেলা নির্বাচন কমিশনারের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর না নিয়ে তাদের বিপদে ফেলে পুনরায় হেলিকপ্টারে ঢাকার উদ্দেশে সাতক্ষীরা ত্যাগ করেন। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগ রুহুল হকের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
ইতোমধ্যে রুহুল হকের নির্বাচনী এলাকা দেবহাটা ও কালিগঞ্জে জামায়াত-শিবিরের হাতে খুন হন দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু রায়হান, শ্রমিক লীগ নেতা আলমগীর হোসেন ও আওয়ামী লীগ কর্মী আজিজুল, মোসলেম উদ্দিনসহ সাতজন নেতা-কর্মী। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকে দশম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সাতক্ষীরায় প্রভাষক মামুন, আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলাম, মেহেদি হাসান জজ মিয়া, মাহবুবুর রহমান, গিয়াস উদ্দিনসহ খুন হয়েছেন ২১ জন নেতা-কর্মী। এসব পরিবারে মাতম চললেও রুহুল হক তাদের খোঁজ নেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রুহুল হকের আত্মীয়স্বজন, পিএস মশায়েত আলী খোকন ও এপিএস মাসুদসহ সবাই বিএনপি-জামায়াতের লোক। এ কারণে সাতক্ষীরায় স্বাস্থ্য বিভাগে ও পুলিশ কনস্টেবল পদে যত নিয়োগ হয়েছে, এর সিংহভাগ চাকরি হয়েছে জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মীদের।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আশাশুনি উপজেলা থেকে বিপুল ভোটে তাকে এমপি নির্বাচিত করেন। এরপর মন্ত্রী হয়ে তিনি বেমালুম ভুলে যান সেসব নেতা-কর্মীর কথা। মন্ত্রী থাকাকালে তার এপিএস ছিলেন কালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. মোশায়েত আলী খোকন। আর পিএস আবু মাসুদ আপাদমস্তক জামায়াতের লোক। সাবেক এই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর স্বজন-জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সবাই জামায়াত-বিএনপি করেন।
আর এ কারণেই জামায়াত-শিবির সাতক্ষীরায় এতটা সুবিধা করতে পারে। ডা. রুহুল হকের নিষ্ক্রিয়তা ও তার স্বজনদের জামায়াত-শিবিরে সক্রিয়তাই মূলত সাতক্ষীরাকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার পেছনে মূল ভূমিকা রাখে। জামায়াত-শিবিরের কর্মকাণ্ড, তারা কী করছিল, কী করতে চেয়েছিল এসব জানার পরও রুহুল হক চুপ ছিলেন। ফলে দলটি সাতক্ষীরাকে আলাদা স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের মতো মনে করতে থাকে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. রুহুল হক সাতক্ষীরায় মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা।
এসব কারণে কখনো বিতর্ক এড়িয়ে চলতে পারেনি তিনি। তার অনুগত মণি-রায়হান সিন্ডিকেট সাতক্ষীরায় পুলিশ ও চিকিৎসকদের বদলি-বাণিজ্য করেছেন। এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্ত্রী ইলা হক হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। রুহুল হকের কারণে সাতক্ষীরা জেলায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ তিনি মন্ত্রী থাকাকালে জেলা আওয়ামী লীগকে দ্বিখণ্ডিত করে রাখেন।
রুহুল হক তার পছন্দের সুবিধাভোগী মানুষকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ওই সুবিধাভোগীদের কারণে দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা তার পাশে ভিড়তে পারেননি। রুহুল হক খোঁজখবর রাখেননি বঞ্চিতদের। এ কারণে তৃণমূলের সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল দূরত্ব। এসব কারণে সাতক্ষীরায় সৃষ্টি হয়েছে দলে চরম গ্রুপিং।
দলীয় ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে চরমভাবে।
আর এ সুযোগে জামায়াত-শিবির একের পর এক দলীয় নেতা-কর্মী খুন, হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাতে থাকে। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ডা. রুহুল হকের কারণেই সাতক্ষীরা সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরিণত হয় এক আতঙ্কিত জনপদে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।