(গল্পে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের কোন ঘটনা বা ব্যক্তির সাথে তার মিল অনিচ্ছাকৃত ও কাকতালীয় মাত্র। )
প্রথমার্ধের লিঙ্ক
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু না হওয়া, বাসায় বেকার বসে থাকার সময়ে একদিন ছোট ভাই এসে খবর দিল,
- দাদা, সুবীরদা’ তোকে দেখা করতে বলেছে।
- কেন?
- সে আমি কী জানি! আমাকে বলেছে তুই যেন আজ-কালের মধ্যে তার সাথে দেখা করিস।
আমি সুবীরদা’র সাথে দেখা করতে তিনি কোন ভণিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন,
- সাগরদাঁড়ি যাবি?
- সেটা আবার কোথায়?
- অশিক্ষিত কোথাকার! যশোরে, মাইকেল মধুসূদনের জন্মস্থান।
- সেখানে গিয়ে কী করবো?
- ওখানে কবির জন্মদিবস উপলক্ষে মধুমেলা হচ্ছে। শ্রুতিকথন ওখানে পর পর তিন দিন অনুষ্ঠান করবে।
- আমি তো শ্রুতিকথনের সদস্য না। আর আমি গান, নাচ, অভিনয়, বাদ্য বাজানো কিছুই পারি না। সেই কবে একবার আপনার কাছে আবৃত্তি শেখার চেষ্টা করেছিলাম।
তাতে শুধু আপনার ধমকই খেয়েছি আর মেয়েদের সামনে অপমানিত হয়েছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি।
- আমি তোকে ওসব কিছু করতে বলছি না। আসলে ওখানে অনুষ্ঠান চলাকালে সাংবাদিকরা থাকবে, সরকারী লোকজনও থাকবে। তুই শ্রুতিকথনের পক্ষ থেকে আমাদের সংগঠন, তার কার্যক্রম আর অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ওদেরকে ব্রিফ করবি।
স্থানীয় পত্রিকাতে আমাদের ওপর যে খবর যাবে সেটার জন্য বিস্তারিত বিবরণ লিখে দিবি। তাছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে জমা দেবার জন্য একটা ভালো রিপোর্ট লেখা লাগবে। তুই সেটা লিখবি।
আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। ভাবলাম কোন জটিলতায় না গিয়ে সোজাসুজি না করে দেয়াই ভালো।
- আমি এসব পারবো বলে মনে হয় না। কোন দিন এসব করিনি।
- তুই কোন দিন মন্ত্রণালয়ের জন্য রিপোর্ট লিখিসনি সেটা ঠিক, তবে আমি জানি তুই এটা পারবি। তোর রিপোর্ট লেখার হাত ভালো।
সুবীরদা’র প্রশংসায় আমার মন গলে না।
- আপনার সাথে গেলে তো পুরো খরচ নিজে থেকে দিতে হবে। আমার হাতে এখন টাকা নেই। জানুয়ারী মাস বলে কোন টিউশনিও নেই। আর যশোরে যাবার জন্য বাসায় টাকা চাইতে পারবো না।
- টাকা আমি তোকে দেবো না ঠিক, তবে সেটা দিতে পারবো না বলে।
এমনিতে গোটা দলের জন্য বেশ খরচ আছে। মেলা কমিটি যে সামান্য টাকা দেবে তাতে সবার বাস ভাড়া হবে কিনা সন্দেহ। তুই কোন জায়গা থেকে ম্যানেজ কর।
- আমি কোথা থেকে ম্যানেজ করবো? আমাকে কে টাকা দেবে!
- দ্যাখ আমি তোকে এমন করে বলতাম না। কোন পত্রিকাতেই যদি এক্সক্লুসিভ খবর না যায় তাহলে দলের ছেলেমেয়েদের মন খারাপ হয়।
ভবিষ্যতেও রেফারেন্স দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ে রিপোর্টটা গেলে আগামী জুলাইতে কিছু সরকারী বরাদ্দ পাওয়া যেতে পারে। টাকাপয়সা তো খুব বেশি কিছু লাগবে না। আসা-যাওয়ার ভাড়া আর নাশ্তা খাবার খরচ। মেলা কমিটি দুপুর আর রাতে খাওয়াবে।
তারা থাকার ব্যবস্থাও করেছে। তুই না করিস না।
- আচ্ছা যাতায়তের টাকা নাহয় জোগার করলাম। এই মাঘ মাসের শীতে বাসে করে যশোরে যাওয়া, আর সেখানে থাকার উপযুক্ত গরম কাপড় আমার নেই। এখন জ্যাকেট-সোয়েটার কিনতে গেলে আরো টাকা লাগবে।
- তুই আমার অনুরোধে যাবি না তো! কিন্তু আমি জানি শেষ পর্যন্ত তুই যাবিই। তুই যেটা জানিস্ না সেটা হচ্ছে, আমাদের সাথে তারক রায়ের ছোট বোন দীপাও যাচ্ছে।
এরপর আমার আর না করার কোন উপায় থাকে না। কোথা থেকে কী করে টাকা জোগার করেছিলাম, কার কাছ থেকে হুডওয়ালা জ্যাকেট ধার করেছিলাম সেসব আর মনে নেই। গান-বাজনা-নাচ-আবৃত্তি-অভিনয় কোন কিছু না জেনেও আমি শ্রুতিকথনের আমন্ত্রিত দলের সদস্য হয়ে মধুমেলায় অংশ নিতে সাগরদাঁড়ি রওয়ানা হয়ে যাই।
পাঠ্যপুস্তকে ‘কপোতাক্ষ নদ’ আর ‘রসাল আর স্বর্ণলতিকা’ ছাড়া মধুসূদন দত্তের কোন লেখাই আমি পড়িনি। তবে বাংলার শফিক স্যার ক্লাসে মধুসূদনের জীবনি বলেছিলেন সেটা মনে আছে। আর কোন কবি-সাহিত্যিকের জীবনি এতোটা বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। আসলে অমন বিচিত্র আর গ্ল্যামারাস জীবন কারই বা ছিল!
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
যাবার দিন দেখা গেলো বাসে কে কার সাথে বসবে সেটা নিজেদের মধ্যে আগে থেকে ঠিক করা আছে। রায়নন্দিনী বসেছে সাদিয়ার সাথে।
তার সামনের, পেছনের বা পাশের কোন সিটেই বসার সুযোগ পেলাম না। গোটা দলে একমাত্র আমার সাথে বসার কেউ নেই। আমার অবস্থা দেখে সুবীরদা’ নিজের সিটটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, “তুই এখানে বস, আমি সামনের দিকে বসছি”। দেখি পাশের সিটে ওয়াজেদ ভাই বসা। তবলাশিল্পী ওয়াজেদ ভাই স্বল্পভাষী লোক — তাতে একটু স্বস্তিবোধ করি।
মাথা ধরে যায় বলে গাড়িতে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা বা কিছু পড়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাছাড়া কিছু পড়তে পড়তে যাওয়াটা আমার পছন্দও নয়। আমি বাইরের দিকে চোখ রাখি। বাস আমিন বাজার পার হলে হাতের ডানদিকে দিগন্ত জুড়ে রঙের খেলা শুরু হয়ে যায়। প্রান্তর জুড়ে সবুজ রঙের গমক্ষেত, হলুদ রঙের সর্ষেক্ষেত আর লালরঙা লালশাকের ক্ষেত দেখলে শিল্পীর ক্যানভাস বলে মনে হয়।
এসব দেখেই কিনা জানি না ওয়াজেদ ভাইয়ের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। কি জানি এমন অসহ্য সুন্দর মানুষের গভীর দুঃখকে তুলে আনে কিনা! ওয়াজেদ ভাই তার বেদনার কথা বলা শুরু করেন,
- বুঝলি, আমাদের দেশে শিল্পী হলে কেবল কণ্ঠশিল্পীই হওয়া উচিত।
- কেন?
- দ্যাখ, গান শিখতে যেমন লম্বা সময়ের সাধনা লাগে বাজনা শিখতেও অমন লম্বা সময়ের কঠোর সাধনা লাগে। এই ধর্, আমি তবলা শিখছি আজ বিশ বছর হয়। খুব একটা খারাপও বাজাই না।
কিন্তু বিশ বছরেও আমার কোন নাম হলো না। অথচ দেখবি, দু’দিন হয়নি যে গান গাইতে শুরু করেছে তার কী নামডাক! শিল্পী বলে তার কী কদর! কারো গানের সাথে বাজাতে গেলে লোকে যখন আমাকে ‘তবলচী’ বলে ডাকে তখন কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। আমি কি শিল্পী না!
- আপনি অবশ্যই শিল্পী। কণ্ঠ, বাদ্য সব মিলিয়েই তো সঙ্গীত হয়। আর তবলাশিল্পীদের নামডাক হয় না কে বললো? এই যে ওস্তাদ আল্লা রাখ্খা সাহেব আর ওস্তাদ জাকির হুসেন সাহেবের নাম কে না জানে!
- জানিস কেবল ঐ আল্লা রাখ্খা সাহেব আর জাকির হুসেন সাহেবের নাম।
বাংলাদেশের কোন ওস্তাদ তবলাশিল্পীর নাম জানিস্? এমনকি আমাদের শহরে যিনি সবচে’ ভালো তবলাশিল্পী তার নাম বলতে পারবি?
আমি অজ্ঞতা স্বীকার করি।
-তাহলে দ্যাখ, সারা দেশে কতোজন শিল্পী তবলার সাধনা করে জীবন পার করে ফেললেন অথচ তাদের কারো নামই তোরা জানিস না।
কথাটা ভেবে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। আলোচনার মোড় ঘুরাতে বলি,
- আরিচার ফেরিতে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেতে পাওয়া যাবে?
- খাওয়া দাওয়া ছাড়া তোর মাথায় কি কিছু নেই? বাসে ওঠার আগে দেখলাম কলা-বাটারবন খাচ্ছিস, বাসে ওঠার পর দেখলাম বাদাম চিবুচ্ছিস্।
- না, ব্যাপারটা হচ্ছে কী, আমাদের শহরে যা ইলিশ পাওয়া যায় তার সবই তো মেঘনার ইলিশ।
পদ্মার ইলিশ মেলেই বা কোথায়! তাছাড়া পদ্মার বুকে বসে পদ্মার ইলিশ দিয়ে ভাত খাবার মধ্যে বেশ একটা থ্রিলিং ব্যাপার আছে না!
- ফেরিতে ভাত খাস্নে। ওদের রান্নার পানি আর মশলার ঠিকঠিকানা নেই। শেষে ডায়রিয়া বা আমাশা হলে বিপদে পড়ে যাবি।
বাস আরিচা-দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটে আসলে আমরা বাস থেকে নেমে পড়ি। এককালে ফেরিতে ওঠার সময় যাত্রীরা বাসেই বসে থাকতো।
কয়েক বছর আগে মেঘনা ফেরিঘাটে রাজবিথী পরিবহন নামে যাত্রী বোঝাই একটা বাস নদীতে পড়ে অনেক লোক মারা যাবার পর থেকে বাস ফেরিতে ওঠার আগে সবাইকে নামিয়ে দেয়া শুরু হয়েছে। আমরা ফেরির দোতলায় উঠে যাই। এই যাত্রায় একই সাথে বাসভ্রমণ আর লঞ্চভ্রমণ হয়ে যায়। পদ্মার হু হু বাতাসে কমবেশি সবার খিদে পেয়ে যায়। তাছাড়া ফেরি থেকে নামার পর বাস কোথায় থামবে তার নাকি ঠিক নেই।
এই ভয়ে সবাই কমবেশি খেয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। ওয়াজেদ ভাইয়ের হুঁশিয়ারীতে আমি আর ইলিশ মাছ-ভাত খাবার সাহস করে উঠতে পারি না। এক ঝালমুড়িওয়ালা দেখি তাজা ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, টমেটো, শশা কুঁচি করে তার সাথে কাসুন্দি মিলিয়ে এমন ঝালমুড়ি বানাচ্ছে যে তার সুবাসে চারপাশ ম’ ম’ করছে। আমরা হামলে পড়ে ঝালমুড়ি খেলাম। কেউ কেউ সেদ্ধডিম, চা, কলা এসবও খেলো।
এমন সময় হঠাৎ আমাদের দলের সেতু গান ধরে, “ও কী ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা রে ...”। পদ্মার বুকে বসে ভাটিয়ালীর বদলে ওর ভাওয়াইয়া গাওয়ার শখ হলো কেন জানি না। তবে গানটা কেমন যেন পরিবেশের সাথে মানিয়েও গেলো। সেতুর গানে আমাদের আশেপাশের, অন্য সব যাত্রীদের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই আমাদের চারপাশে ভীড় করে দাঁড়ালো।
সেতু এরপর “থাকতে পারঘাটাতে তুমি পারের নাইয়া দীনবন্ধু রে ...” ধরলে লোকজন উদ্বেলিত হয়ে পড়ে। গানে গানে ফেরি একসময় অন্য পাড়ে চলে আসে। আমি ঝালমুড়ি ছাড়া আর কিছু না খেয়েই বাসে উঠে পড়ি। কামারখালীতে মধুমতী নদী পার হবার সময় বাস থেকে নেমে শুধু খিরাই খেয়েছিলাম। এরপর যশোরে লিঙ্কন কাকার বাড়িতে না পৌঁছানো পর্যন্ত আর কোন খাওয়া জোটেনি।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
ঠিক করা ছিল রাতে যশোরে লিঙ্কন কাকার বাড়িতে থেকে পরদিন সকালে মেলা কমিটির ভাড়া করা বাসে কেশবপুর হয়ে সাগরদাঁড়ি যাবো। লিঙ্কন কাকা অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী মানুষ, গানবাজনা ভালোবাসেন, স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সুবীরদা’র বাবা প্রবীর কাকা লিঙ্কন কাকার সহপাঠী ছিলেন। দু’জনে একসাথে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন। পাশ করার পর মাঝখানে তাঁদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় হিসেবটা পালটে যায়।
একাত্তরের মে মাসে আমাদের পুরাতন শহরে যখন আর টেকা যাচ্ছিল না তখন সুবীর কাকাদের পরিবারে সিদ্ধান্ত হয় তারা সীমান্ত পার হয়ে কৃষ্ণনগরে তাঁদের দূর সম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে চলে যাবেন। তারপর সেখান থেকে পরিবারের সমর্থ যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। সীমান্ত পার হবার আগেই প্রবীর কাকাদের সাথে লিঙ্কন কাকার দেখা হয়ে যায়। তখনই ঠিক হয়ে যায় পরিবারের বাকী সদস্যরা সীমান্ত পার হলে প্রবীর কাকা লিঙ্কন কাকার সাথে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিমের অধীনে ৮ নাম্বার সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পরও তাঁদের মধ্যকার যোগাযোগ অক্ষুণ্ন থাকে।
এত দিনে তাঁদের বন্ধুত্ব মোটামুটি আত্মীয়তার পর্যায়ে চলে গেছে। সেই সম্পর্কের সুবাদে লিঙ্কন কাকার কাছে আমাদের আশ্রয় নেয়া।
যশোরে এসে জানা গেলো সাগরদাঁড়িতে পুরুষদের জন্য এক স্কুল ঘরে আর মেয়েদের জন্য এক ধনী লোকের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারা দিন প্রায় না-খাওয়া থাকায় এমনিতেই মাথা গরম হয়ে ছিল, তার ওপর আগামী তিন দিন থাকার যা ব্যবস্থা হয়েছে সেটা শুনে আর সহ্য করতে পারলাম না। কিন্তু কার ওপর চোটপাট করবো, সুবীর দা’র ওপর? এই লোকের ওপর রাগ করা না করা সমান।
অতএব রেগেমেগে লিঙ্কন কাকার বাড়ি থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্ট খুঁজতে লাগলাম। এমনিতে এই শহরে এর আগে আসার অভিজ্ঞতা নেই, তার ওপর চারদিক কেমন অন্ধকার। শেষে একটা পান-সিগারেটের দোকানে জিজ্ঞেস করে একটা রেস্টুরেন্টের খোঁজ পেলাম। সত্যি সত্যি নাকি রাগের মাথায় খেয়েছি বলে জানি না, আমার মনে হলো জীবনে এরচেয়ে নিম্নমানের খাবার কখনো খাইনি। খাবার পর উদ্গত বমি ঠেকানোর জন্য অনভ্যস্ত হাতে একটা বাংলা ফাইভ সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে লিঙ্কন কাকার বাড়িতে ফিরে আসি।
ফিরে দেখি আমি যে এতক্ষণ ধরে নেই সেটা কেউ খেয়াল করেনি। একটু অভিমান হলো। সুবীরদা’ বললেন,
- কাকার বাড়িতে থাকলেও আমরা এতগুলো লোক এই বাড়িতে খেতে পারি না। চল সবাই একসাথে রেষ্টুরেন্ট থেকে খেয়ে আসি।
সবাই যাবার উদ্যোগ করলেও আমি মেঝেতে বসে ব্যাগ খুলে এটা সেটা বের করতে লাগলাম।
সুবীরদা বললেন,
- ব্যাগ বন্ধ করে তাড়াতাড়ি চল্।
- আমি যাবো না। খিদে নেই।
- ঠিক আছে। তুই থাক, বিশ্রাম নে, আমরা এখনই চলে আসছি।
সুবীরদা’র এমন সোজাসাপ্টা কথায় দুঃখে বোবা হয়ে গেলাম। আমি কি তার এমন ব্যবহার আশা করি! আমি শ্রুতিকথনের কে! ওদের জন্যই তো আমি টাকাপয়সা ধার করে আসলাম! রায়নন্দিনী দেখি আমার দিকে ফিরেও তাকালো না। রুমানা আর মাসুদের সাথে কথা বলতে বলতে খেতে চলে গেল। আমার অভিমানের বাষ্প জমে ঘন কালো মেঘ হয়ে গেল।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
সাগরদাঁড়িতে যাবার পথটা কোনভাবেই বাস চলার পথ নয়।
বস্তুত এটাকে রাস্তা বললে শীতে শুকিয়ে যাওয়া খালকেও রাস্তা বলতে হবে। মেলা প্রাঙ্গনে পৌঁছে আয়োজনের অবস্থা আর আমাদের থাকার জন্য ঠিক করা স্কুলের অবস্থা দেখে ভাবলাম এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়াটা সহজ ছিল না। এটা তো এমন না যে, হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে গেলাম, বাসে চড়ে বসলাম আর গন্তব্যে চলে গেলাম। এখান থেকে কেশবপুর যেতেই তো ঘাম বের হয়ে যাবে! তাছাড়া সেদিন দুপুরের পর এমন একটা ঘটনা ঘটলো যে আমি আর পালানোর কথা ভাবতে পারলাম না।
মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে বিকেলে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত। কোন কাজ না থাকায় আমরা বা আমাদের মতো আসা আরো কয়েকটা দল মেলা চত্ত্বরের বাইরে একটু দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করছিলাম। স্থানীয় লোকজন আসতে শুরু করেছে, দূরদুরান্ত থেকেও লোকজন আসছে। মেলায় বসা বারো রকমের জিনিসের অস্থায়ী দোকানগুলোতে তাদের ভীড়। খাবারের দোকানগুলোতে উজ্জ্বলরঙের জীভে জল আনা খাবার খাওয়া লোকের সংখ্যাও কম নয়।
এমন সময় মেলা দেখতে আসা কিছু বখাটে আমাদের গ্রুপটার কাছে এসে জুটলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের মেয়েদের উদ্দেশ্যে তাদের নানা অশ্লীল মন্তব্য আর কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত শুরু হয়ে গেলো। আমরা প্রথমে উপেক্ষা করার চেষ্টা করলাম। যশোর অঞ্চলের ডায়ালেক্ট চট্টগ্রাম বা সিলেটের মতো আমাদের কাছে দুর্বোধ্য নয়। ফলে একসময় তাদের আচরণ আর উপেক্ষা করা গেলো না।
সেতু উঠে গিয়ে তাদেরকে চলে যেতে অনুরোধ করলো, কিন্তু তারা কি আর সেসব শোনে! এক কথা দুই কথায় সেতুর সাথে তাদের লেগে গেলো। বখাটের দল সেতুকে নির্মম ভাবে পেটাতে লাগলো। আমরা কয়েকজন উঠে গিয়ে তাদের বাধা দিতে চাইলে তারা আরো ক্ষেপে গেলো। সেতুর শার্ট ছিঁড়ে গেছে, মুখভর্তি রক্ত। হঠাৎ কেউ একজন আমার নাক বরাবর প্রচণ্ড ঘুষি মারলো।
আমি নাক চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়লাম। আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে টপ টপ করে রক্ত পড়ে আমার শার্ট ভিজিয়ে দিল। বুঝলাম সম্ভবত কার্টিলেজ ভেঙে গেছে। মেলা প্রাঙ্গনে কয়েকজন লাঠিধারী পুলিশ আছেন বটে, তবে তারা অচিরেই যে ভিআইপি মেলা উদ্বোধন করতে আসবেন তার নিরাপত্তার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। তাছাড়া ঘটনা মেলার প্রাঙ্গনের বাইরের, তাই বোধকরি তারা কিছু লক্ষ করেননি।
মেলার আয়োজকদের ক্ষমতা খুব সীমাবদ্ধ। তারা আর্ট-কালচার লাইনের লোক, তাদের পেশীশক্তি নেই। তাছাড়া তাদেরকে অনেক দিক বজায় রেখে চলতে হয়। তাই তাদের কেউ কেউ ঘটনাস্থলে আসলেও তাদের দৌড় “আর মারিসনে, ছেড়ে দে” পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায়। লোক জমে যাচ্ছে দেখে বোধহয় বখাটের দল সরে পড়ার কথা ভাবে।
আমরা যারা মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম তাদেরকে কয়েকটা লাথি মেরে, অশ্লীল গালি দিতে দিতে তারা চলে যায়।
চাপকল চেপে আমরা নিজেদের পরিষ্কার করি, যাদের শার্ট পালটানো দরকার ছিলো তারা শার্ট পালটে আসে। মেলার আয়োজকদের কয়েকজন এসে দুঃখ প্রকাশ করেন। বস্তুত তাদের দুঃখ প্রকাশ করার কিছু ছিল না, দায়টা তাদের নয়। আমরা তাদের আশ্বস্ত করি যে, অনুষ্ঠান শেষ না করে আমরা চলে যাবো না।
তবে আমাদের মেয়েদের জন্য তো বটেই, আমাদের পুরুষদের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগের কথা জানাই। জানা যায় বখাটের দল সাগরদাঁড়ির লোক নয়। স্থানীয় কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ আসেন। তারা অভয় দেন বটে তবে তাতে আমাদের ভয় হ্রাস পায় না। আমাদের মতো বাইরে থেকে আসা আরো কয়েকটা দল আমাদের সাথে জোটে।
ভয় তারাও পেয়েছে। ঠিক হয় রাতে আমরা পালা করে পাহারা দেবো। আর মেয়েরা যে বাড়িতে থাকবে তার বারান্দায় সব দলের টিমলিডার পাহারায় থাকবে। আমার অভিমান, অসহ্য লাগা, পালানোর ইচ্ছে সব কখন যেন মিলিয়ে গেছে। কিন্তু একটা ভোঁতা অনুভূতি আমাকে গ্রাস করে।
আমি চুপচাপ প্রাঙ্গনের পেছনে বয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদের দিকে এগিয়ে যাই। একটা হাত আলতো করে আমার হাত ধরে। পাশে না তাকিয়েও বুঝতে পারি হাতটা কার। আমরা নদীর পাড়ে বসি, কিন্তু কোন কথা বলি না। একটা সময় আমিই নিরবতা ভাঙি,
- এই খালের মতো সরু জিনিসটাকে নদ বলার কারণটাই কী আর এটাকে নিয়ে এতো উচ্ছ্বসিত হয়ে কবিতা লেখার মানেটাই বা কী! মাঝখান থেকে আমাদেরকে পরীক্ষা পাশের জন্য এমন শক্ত শক্ত শব্দওয়ালা কবিতা পড়তে হলো!
রায়নন্দিনী কোন উত্তর দেয়া না, শুধু অনুচ্চ শব্দে হাসে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শব্দ শোনা যায়, কিন্তু তবু আমরা উঠি না। রায়ন্দিনী তার হাত আমার নাকের ওপর আস্তে করে বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
- ব্যথা লাগছে?
আমার অভিমানের মেঘ ঘন কালো হয়ে নেমে আসে। আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়। এবং এতো মার খেয়েও যা হয়নি সেটা ঘটে যায়। মরা কপোতাক্ষ নদের মতো দুটো সরু ধারা আমার গাল বেয়ে নেমে আসে।
এরপরের দুটো রাত আর আরো একটা দিন কেমন গেছে তার বিস্তারিত আর বলতে পারবো না। যেমন বলতে পারবো না মঞ্চে আমাদের লোকজন কেমন পারফর্ম করেছে। এই সময়টাতে আমরা সবাই গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থেকেছি, আশেপাশে কোথাও বেড়াতে যাবার চেষ্টা করিনি। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে দুর্ঘটনাটা ভোলার চেষ্টা করেছি। রিহার্সাল চলেছে দায়সারা ভাবে।
সবচে’ বেশি মার খাওয়া সেতু একের পর এক গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখতে চাইছিল, কিন্তু যে সুর কেটে গিয়েছিল সেটা আর জোড়া লাগলো না। সিদ্ধান্ত হলো আমরা তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানে আর অংশ নেবো না। ঐদিন সকালেই যশোর ফিরে যাবো।
সাগরদাঁড়িতে আমাদের থাকার জায়গার ঠিক পাশেই মহাকবির এক দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ার সন্ধান পেয়েছিলাম। তার অবস্থাকে হতদরিদ্র বললেও কম বলা হয়।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে তার মুখের ভাষা। এমন পরিশীলিত ভাষায় বাস্তবের দুনিয়ায় এদেশের গ্রামের এক নারীকে কথা বলতে দেখা ছিল আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে। যেমন টাকার হিসেবে নয়, পয়সার হিসেবে ডাব আর কলা কিনে খাওয়াটাও আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
যশোরে ফিরে আসার পর হঠাৎ করেই সবার মুড বদলে গেলো। সাগরদাঁড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসায় সবাই স্বাভাবিক আচরণ শুরু করলো।
সাদিয়া তার ব্যাগের ভেতর থেকে ভাঁজ করা বিশাল লম্বা এক কাপড়ের ব্যাগ বের করে ঘোষণা দিলো সে তুলোতলা মার্কেটে যাবে। সেখানে নাকি সস্তায় ভারতীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়। একথা শুনে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই তুলোতলা যেতে চাইলো। আসলে সবাই কিছু একটা করতে চাইছিল। আপাতত শপিং-এর সুযোগ পাওয়া যাওয়ায় তাতেই সই।
আমরা এক এক রিকশায় তিনজন তিনজন করে তুলোতলায় রওয়ানা হলাম। আমরা ঠিক মার্কেটে পৌঁছেছিলাম কিনা জানি না। কারণ যে জায়গাটায় আমরা পৌঁছেছিলাম সেটা দেখতে মোটেও আমাদের জানা কোন মার্কেটের মতো নয়। সেখানে ছোট ছোট কুঁড়েঘরের মতো ঘরে টেবিলে পণ্য সাজিয়ে বিক্রি করা হচ্ছিল। আমার পকেটের অবস্থা এমনিতেই খারাপ তাই ইচ্ছে থাকলেও বিশেষ কিছু কিনতে পারলাম না।
আমি কিনলাম তোয়ালের মতো দেখতে কয়েকটা রঙিন রুমাল, আর দীপা কিনলো চন্দন কাঠের কলম। ফেরার পথে বাসের টিকিট কিনতে গেলে সাদিয়া দাবি করলো তার জন্য দুটো টিকিট কাটতে হবে। কারণ, সে তার এই ব্যাপক শপিং করা জিনিসপত্র মাথার ওপরের বাঙ্কে রাখবে না, তার পাশে রেখে তাতে হেলান দিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে যাবে। অন্য সময় হলে সুবীরদা’ সাদিয়াকে দিতেন এক রামধমক। কিন্তু এখন কিছুই বললেন না।
তাহলে যাবার বেলায় বাসে দীপার পাশে কে বসবে? নিশ্চয়ই সুবীরদা’! আর আমাকে নিশ্চয়ই আসার সময়ের মতো ওয়াজেদ ভাইয়ের পাশে বসতে হবে! আমার সব ঋণাত্মক ভাবনাকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে দীপা আমার কাছে এসে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো,
- বাসে তুমি আমার পাশে বসবে।
আমার কাছে মনে হলো কেউ এসে বলছে, “এবছরে নোবেল প্রাইজের জন্য তোকে নির্বাচিত করা হয়েছে”!
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
এই যশোর ভ্রমণের পর এই জীবনে বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে-প্লেনে-গাড়িতে বহু ভ্রমণ করেছি। দেশের ভেতরে বহু জেলায় তো বটেই দেশের বাইরেও অনেক জায়গায় ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। সেসব ভ্রমণের মধ্যে আরামদায়ক, বিলাসবহুল, ব্যতিক্রমী, উত্তেজনাকর, দ্রুতগামী নানা রকম ভ্রমণ আছে; কিন্তু ঐ যশোর-ঢাকা বাস ভ্রমণটার সাথে আর কোন ভ্রমণের তুলনা হয় না। কারণ, গোটা একটা রাত ধরে রায়নন্দিনীর পাশে বসে ভ্রমণের সুযোগ আর কখনো পাইনি।
রাতে বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে যখন ঘুমের সুবিধার্থে সব আলো নিভিয়ে দেয়া হলো, তখন সবার গল্পগুজব, হাসিঠাট্টার পরিমাণ আস্তে আস্তে কমে এলো। এক সময় বাসের কর্মীরা ছাড়া সবাই একটু একটু করে ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকলো। আমারও ঘুম পাবার কথা। কারণ, সকাল বেলা সাগরদাঁড়ি থেকে যশোরে এসেছি, দিনের বাকি সময়টা এখানে সেখানে ঘুরে কেটেছে। বিশ্রামের কোন সুযোগ হয়নি।
রায়নন্দিনী বাসের সিটের উপর দু’পা তুলে একটা শালমুড়ি দিয়ে জানালাতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তার পা আমার গায়ের সাথে ঠেকে আছে, তাতে আমার নড়াচড়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেলো। আমি নির্ঘুম চোখে পিঠ সোজা করে ঠায় বসে থাকলাম। কতোটা পথ বা কতোক্ষণ পরে জানি না রায়নন্দিনী পাশ ফিরে জানালার দিকে পা ফিরিয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো।
অন্ধকারে মানুষ ভয় পায় বটে তবে কখনো কখনো তা মানুষকে সাহসীও করে তোলে। সাহসী আমি আমার বাঁ হাতটা দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে তার ঘুমন্ত মুখের দিকে আমার মুখ নামিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। অন্ধকারে আমি আমার লক্ষ দেখতে পাই না। তাছাড়া দুজনের মুখের আপেক্ষিক অবস্থান এমন যে আমার লক্ষ্য সহজে পূরণ হবার নয়। বাসের ক্রমাগত ঝাঁকুনিতে আমি কেবলই লক্ষ্যচ্যূত হতে থাকি, আমার ঠোঁটজোড়া আর রায়নন্দিনীর অধরোষ্ঠের ঠিকানা খুঁজে পায় না।
এমন সময় একটা বড় ঝাঁকুনিতে আমার ভাঙা নাক তার কপালে জোরে ধাক্কা খায়। আমি উফ্ করে উঠি। রায়নন্দিনী একটু মোচড় দিয়ে উঠে আমার বাঁ হাত সরিয়ে দিতে দিতে বলে, “অ্যাই, না”! তারপর সে জানালার দিকে হেলান দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। বাস দৌলতদিয়া ফেরিঘাট আসা পর্যন্ত আমি ঠায় বসে থাকি। ফেরিতে উঠে কেউ কেউ যখন চা খেতে চললো আমি আর তাদের সাথে গেলাম না।
আমার একটু একা থাকা দরকার। আমি ফেরির এক কোনায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে পদ্মার কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বাস যখন জাহাঙ্গীরনগর পার হচ্ছে তখন চারদিক একটু একটু করে ফর্সা হতে শুরু করলো। আমিনবাজার আসতে রায়নন্দিনীর ঘুম ভাঙে। পা নামিয়ে বসে বললো,
- তুমি ঘুমাও নি?
সীমাহীন লজ্জায় আমার তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।
ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে কোনরকমে বললাম,
- না, ঘুম পায়নি।
- একটু ঘুমিয়ে নিলে পারতে। কাল সারা দিন যা ধকল গেছে!
আমি আর কিছু বলি না। গাবতলীতে বাস থামলে আমি সুবীরদা’র সাথে একটা মিনিবাস ভাড়া করতে ছুটি যা আমাদেরকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। গন্তব্যে পৌঁছে আমি কাউকে বিদায় না জানিয়ে তাড়াহুড়া করে একটা রিক্শা নিয়ে বাসায় চলে যাই।
এই ঘটনার পর বহুদিন পর্যন্ত রায়নন্দিনীর মুখোমুখি হলে মনে হতো এই বুঝি সে আমাকে ঐ রাতের ঘটনার জন্য চেপে ধরবে। কিন্তু আর কোনদিনই সে আমাকে এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। ধীরে ধীরে একটা সময় আমি তার সামনে অনেক স্বাভাবিক হয়ে আসি। ঐ রাতের মতো সাহস দেখানোর মতো আর কোন সুযোগ তৈরি হবার আগেই কর্তব্য, নিয়তি ইত্যাদি নানা অনিবার্য বা অমোঘ বিষয় আমাদেরকে পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কিন্তু আজো কখনো রাতের বেলা কোথাও যাবার প্রয়োজন হলে, তা সে যে যানবাহনই হোক, তাতে আমার আর ঘুম আসে না।
আলো নিভলেই যশোর-ঢাকা নাইটকোচের স্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে, আমি নির্ঘুম বসে থাকি। এর জন্য হয়তো ঐ ঘটনা দায়ী নয়। হয়তো অন্য কোন কারণে আমার ঘুম পায় না। তবু রাতের আঁধারে ছুটে চলা যানে আমার নির্ঘুম চোখে কেবল ঐ রাতটাই বার বার ফিরে আসে।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
রায়নন্দিনী দু’হাতে কফির মগ নিয়ে ঢোকে।
কফিতে চুমুক দিতে তার স্বাদ আর সুবাস আমাকে চাঙা করে তোলে। এমন সময় রায়নন্দিনীর মোবাইল বেজে ওঠে।
- হ্যাঁ সুনি বলো।
.........
- ঠিক আছে। ধীরেসুস্থেই আসো।
বাসায় অতিথি এসেছে।
.........
- কে সেটা আসলেই দেখতে পাবে।
.........
- রাতে থাকবে কিনা জানি না। কর্ণফুলী ব্রীজের অবস্থা নাকি ভালো না। ইয়াকুব ভাইকে বলো গাড়ি সাবধানে চালাতে।
বীচ চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে পা লম্বা করে পাশাপাশি বসে আমরা আস্তে আস্তে কফির মগে চুমুক দেই। আমি দ্বিধা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করি,
- আচ্ছা, তোমার সাগরদাঁড়িতে মধুমেলায় যাবার কথা মনে আছে?
- থাকবে না আবার! কতো কাণ্ড হলো। তোমার নাক ভাঙলো।
- নাক আমার এর পরেও ভেঙছে — দরোজায় ধাক্কা খেয়ে। আমি সেসবের কথা বলছি না।
- তাহলে?
- ফেরার পথে নাইটকোচের কথা বলছি।
তার মুখে একটু হাসির ঝিলিক খেলে যায়।
- মনে নেই আবার! এক বীরপুরুষ তো আগানোর সাহসটাই করতে পারলো না।
- তাকে ‘না’ করেছিল কে শুনি?
- বারে আমি তো ‘না’ করবোই। তাই বলে তুমি সাহস দেখাবে না!
- ঐ বয়সে ‘না’ শুনলে কারই বা সাহস থাকে বলো! আমি তো সেদিন থেকে কী লজ্জা আর দ্বিধার মধ্যে ছিলাম — তুমি কী ভাবলে সে’কথা ভেবে।
- সেটা আমি তোমার আচরণে ঠিকই বুঝেছিলাম। কিন্তু তোমার ভুল জানাটা ভাঙাতে ইচ্ছে করেনি। তোমাকে অমন অবস্থায় দেখতে মজাই লাগতো।
- তারপর থেকে কী হয়েছে জানো, যখনই কোন রাতে ভ্রমণের ব্যাপার থাকে আমার চোখে আর ঘুম আসে না। বাস হোক, ট্রেন হোক আর প্লেনই হোক, আলো নিভিয়ে দিলেই আমার মাথায় ঐ রাতের স্মৃতি চলে আসে।
আমি আর ঘুমাতে পারি না।
- সত্যি? এখনো কি এমন হয়?
- হ্যাঁ এই দুই যুগেও তার শেষ হয়নি।
- মিথ্যুক কোথাকার!
- বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে ছুঁয়ে এ’কথা বলতে পারবো। মনে হয় তোমার অভিশাপে আমার সব রাতের ভ্রমণ নির্ঘুম হয়ে গেছে।
রায়নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর আস্তে আস্তে বলে,
- আমি তোমাকে কোন অভিশাপ দেইনি। যেহেতু আমার জন্য তোমার এই দশা, তাই আমি তোমাকে রাতের নির্ঘুম ভ্রমণের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার একটা চেষ্টা করতে পারি।
- কী করে?
- রাজকুমারী যেভাবে ব্যাঙ রাজকুমারকে তার অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছিল সেভাবে।
- তাই নাকি!
রায়নন্দিনী আর কোন কথা না বলে আমার দিকে ফিরে হাঁটুমুড়ে সোজা হয়ে বসে দুহাতে আমার মাথাটা ধরে তার মুখটা আমার মুখের দিকে নামিয়ে আনে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার মুখে কোন কথা সরে না।
ব্যাঙ রাজকুমারের শাপমোচনের কালে চারদিক আলোয় অথবা কোন ধ্বনিতে ভরে গিয়েছিল কিনা জানি না। তবে আমার মনে হয় চারপাশ তীব্র নীল আলোয় ভরে গেছে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। লতার মতো তার দুই বাহু আমার ঘাড় আবেষ্টন করে রাখে। আমার বুকের কাছে তার কবোষ্ণ পেলবতা।
ডার্ক রোস্ট করা কফির সুবাসের সাথে পারফিউমের হালকা গন্ধ আমাকে যতোটা না আচ্ছন্ন করে আমার ঠোঁটে অমৃত কুম্ভের স্পর্শ আমাকে তারচে’ বেশি আচ্ছন্ন করে। আমার চারপাশ সৃষ্টির আদিলগ্নের নাদব্রহ্মে ভরে ওঠে। আমি আস্তে আস্তে তার অতলে তলিয়ে যেতে থাকি।
ওঁ হ হ হ হ হ হ হ হ হ হ ম্!।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।