প্রথমে ঘটনা রটনা ছিলো। তারপর তার ডালপালা, শেকড়, লতা-গুল্ম গজিয়ে যে কাহিনীর অবতরণিকা প্রকাশ পেলো, তা মূলত চটকদার কোনো কাহিনীর অপভ্রংশ। বাড়ন্ত সেই রসজ্ঞ কথামালা এ-কান থেকে ও-কান হয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে নিস্তরঙ্গ নিশাপুরের হাওয়া মাতম করে উঠলো। এ বড়ো অন্যায়। যতির মতো এমন প্রিয়ময় মেয়ের কোনো ক্রন্দন, ক্লান্তিকর মুখচ্ছবি, কারো কাম্য নয়।
মুহূর্তের মধ্যে প্যান্ডেলের আলো নিভে যায়। দর্শক-শ্রোতা ভগ্নমন, অশান্ত হৃদয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে বাড়ি ফিরে গেছে। যতি হলো গিয়ে স্বপ্নের রানি। অমন বাঁকানো চোখ, কিশোরী সুলভ ভ্র“-ভঙ্গি, ববকাট চুলের সুবিন্যস্ত সিল্কি ওড়াওড়ি, আর মঞ্চে নূপুর পায়ে উন্মাতাল নৃত্য, তরুণ-বৃদ্ধের হৃদয়পুর দখল করে বসে আছে। কণ্ঠস্বর যেন স্বর্গসুধা।
এ ক’দিনে কে ওর প্রেমে পড়েনি? যতিকে প্রেমী ভেবে সুখ আছে।
দক্ষিণপাড়ার তমিজ মণ্ডল ক্ষোভ করে বলল, ‘যতির কিছু হলে, আমি তারে খাইছি। আরে বান্দিরপুত, যতি হইলো গিয়া আমাগো মেয়ে মানুষ! প্রতিরাতে ওর চাঁদমুখ দেখার জন্য সন্ধ্যার পর পরাণ ক্যামন কাঙালপনা করতে থাকে। কী শান্ত মায়াময় ওর মুখ। দেখলেই বুক খলবল করে ওঠে।
’
দূর গাঁ থেকে এসেছে নাফিজউল্লা। কলেজে পড়ে। বন্ধুদের নিয়ে অমোঘ আকর্ষণে ইন্দ্রপুরী অপেরা’র মাধব-মালঞ্চ’ যাত্রাপালা যতির কণ্ঠে ‘আমি তোমার পরাণ গো নাগর, নিশি রাইতের কন্যা’ সুললিত কণ্ঠে শুনে শুনে এক বিরহভাব মনচৈতন্যে ছায়া ফেলে। নাফিজউল্লার ধারণা যতির মতো অপরূপা, মায়াময় নেশা এর আগে কখনো পান করেনি। বন্ধুরা ফাজিল।
অশ্লীল মন্তব্য করতে দ্বিধা করে না। নাফিজউল্লা মন খারাপ করে। মনের বারান্দায় যতির যে হাঁটাহাটি তার মধ্যে কোথায় যেন হৃদয়িক স্পর্শ রয়েছে। যার অধিশ্বর নাফিজউল্লা একা। এ ভার সইভার শক্তি কারো নেই।
তাই নাফিজউল্লাহ বলে, ‘যতি হলো একান্ত আমার। তোরা হলি কাঙাল। ’
যাত্রা প্যান্ডেলের অন্ধকার ঘুপচিতে দাঁড়িয়ে নাফিজউল্লার প্রচণ্ড শীত অনুভব হলো। বোধ লোপ পেতে থাকে। মস্তিষ্কের কোষে কোষে শূন্যতা বাসা বাঁধে।
নিজকে পরাজিত মনে হয়। মাঝরাতের আকাশ ফ্যাকাশে। বন্ধুদের রেখে বাড়ি ফেরার পথ হাঁটে।
‘এমনতা হইলো কেমতে?’ নসু বেপারি প্রশ্ন করে।
কেউ জবাব দেয় না।
কারো কাছে কোনো জবাব নেই। উৎসব মুখরিত নিশাপুর গ্রাম এখন কেবলি শোকার্ত মনুষ্যকুলের নীরব কথন।
সুদূর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত ‘ইন্দ্রপুরী অপেরা’ আজ তেরোদিন হলো নিশাপুর ঐতিহাসিক যাত্রা মঞ্চে ‘মাধব মালঞ্চ’ পালা পরিবেশন করছে। আয়োজক ‘নিশাপুর ইয়ং ক্লাব’। খরচ বাদে অবশিষ্ট টাকা চলে যাবে গার্লস স্কুলের ফান্ডে।
এ অঞ্চলে নারী শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তাই আবাল-বৃদ্ধ আশান্বিত। ইয়ং ক্লাবের সভাপতি ইশরাত ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বয়স পঞ্চাশের অতি কাছে। অবিবাহিত।
নারীর প্রতি উদাসীন। সামাজিকভাবেও দায়বদ্ধ মানুষ। ইন্দ্রপুরী অপেরার অধিকারী বাবু চণ্ডীচরণ পুরকায়স্থ। সংস্কৃতিবান, ধোপাদুরস্ত, ধীরস্থির। দীর্ঘ দশ বছরের সাধনায় এই যাত্রাদল গড়ে তুলেছে।
রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে। যতি হলো এ দলের প্রাণ-ভোমরা। তাতেই অধিকারী বাবুর পোয়াবারো। দর্শক-শ্রোতার উপচে পড়া ভিড়। মালঞ্চ কন্যা যতির চাঁদ মুখ দেখা এবং গান শোনার জন্য আজ তেরোদিন পর এমন ঘটনার জন্য কেউ প্রস্তুত নয়।
যতির বয়স আঠারো-উনিশ। আজ তিন বছর যাবৎ চণ্ডীচরণ বাবুর সঙ্গে আছে। প্রথমে ঢুকেছিলো নায়িকার সখি হিসেবে। তিন বছরেই নায়িকা। ইন্দ্রপুরীর অপেরা’র প্রধান আকর্ষণ।
ইশরাত ভাইয়ের প্রশ্ন, ‘কী ভাবে ঘটনা ঘটলো। ক্লাবের ভলান্টিয়াররা কোথায় ছিলো? অধিকারী বাবু, পুলিশে খবর দিতে হবে। ’
বিমর্ষ চণ্ডীচরণ বাবু মুঠোফোনে কথা চালাচালিতে ব্যস্ত। উইংসের পিছনে অন্যান্য কুশীলবগণ নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। কেউ কেউ ঘষে ঘষে মুখের রঙ তুলছে।
বাজানদাররা যার যার মতো যন্ত্র গুটিয়ে নিথর বসে আছে। শুধু মঞ্চের এক কোণায় অধিকারী, আর ইশরাত ভাই খুব নিচু কণ্ঠে কথা বলছে।
চারদিকে মেটে জোছনা। মধ্য রাতের শেষ প্রহর। ঘন কুয়াশা আচ্ছন্ন।
টুপটাপ শিশির ফোঁটা পড়ছে। জানুয়ারি মাসের শীত। ঝাঁকিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে হন্তদন্ত হয়ে থানার ওসি সাহেব, দু’জন পুলিশ এলো মোটর সাইকেলে করে।
পুলিশ দেখে, ইশরাত ভাই এবং অধিকারী চণ্ডীচরণ পুরকায়স্থ এগিয়ে আসে।
মঞ্চের এক পাশে চেয়ারে বসে সবাই।
ওসি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে বলে, ‘বাবারে শীত একেবারে জমে গেছি। আপনার কল পেয়ে ছুটে এলাম। কী ব্যাপার বলুন তো ইশরাত ভাই?’
ইশরাত ভাই বিষণœ কণ্ঠে বলে, ‘অধিকারী বাবুর নায়িকা হঠাৎ করে লাপাত্তা। উদ্বোধনী সংগীত শেষ হয়ে দলবেধে ওরা উইংসের পিছনে ঢোকার পর পর নায়িকা যতিকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সে কি অপহৃত! না কোনো ছোকড়ার সঙ্গে ভেগে গেছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। ’
ওসি সাহেব চিন্তিত কণ্ঠে বলেন, ‘তদন্তের দরকার। অপেরার অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সংবাদ পত্রে নিউজ আসার আগেই যতিকে খুঁজে বের করতে হবে। ’
অধিকারী বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
হাতশ কণ্ঠে বলে, ‘যতি না থাকলে আমার মূল্য কী? যতির কারণে এই মন্দার বাজারে ভাতের দেখা পাচ্ছি। ইন্দ্রপুরী অপেরা পথে বসে যাবে। ’ অধিকারী বাবু ওসি সাহেবকে নিয়ে গ্রিন রুমের দিকে পা বাড়ায়।
‘ঘাবড়াবেন না বাবু, কেসটা খুব সিরিয়াস। যতি কী অপহৃত না ধর্ষণের শিকার? কেউ কিছু জানি না।
আর এতো নিরাপত্তার মধ্যে যতির মতো মেয়ে উধাও হয়ে গেলো কি
করে?’
‘জানি না! মেয়েটির জন্য কষ্ট হচ্ছে। নিজ হাতে গড়ে তুলেছি। খুব মেধাবী। ’
‘মাল তো সরশ। যতির জন্য এলাকার মানুষ খুন হয়ে আছে।
’
ওসি সাহেবের এ ভাষা অধিকারী বাবুর এবং ইশরাত ভাইয়ের পছন্দ হলো না। চণ্ডাল বলে গাল দিতে ইচ্ছে হলো। মনে ক্ষোভ ফুঁসে ওঠে। ওসি সাহেবের পিছনে দু’জন কনস্ট্রেবল হাঁটছে। এদের দেখে গ্রিনরুমের বাসিন্দাদের মাঝে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
কী হবে! ইতোমধ্যে ওসি একজন একজন করে জবানবন্দি নিচ্ছে। নাচ শেষ হবার পর উইংসের দিকে যাওয়ার সময় শেফালি যতির পিছনে ছিলো।
স্টেজ থেকে বেরিয়ে যাবার সময় এদিকটা অন্ধকার ছিলো। তাছাড়া গান শেষ হবার পর কুশীলববৃন্দ যার যার রোল অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে থাকে। তাই যতির কী হলো কেউ বুঝে ওঠার আগেই মহাকালে হারিয়ে যায়।
না কেউ যতিকে দেখেনি!
প্রমটার বসির উদ্দিন বলে, ‘পালা শুরু না হলে তো আমার কোনো কাজ থাকে না। ’
ঢোলকওয়ালা ক্ষিতিশ কর বলে, ‘মঞ্চে বাতি নিভে গেলে বাজনা তখনো চলতে থাকে। তবে যতিকে আমার পাশ দিয়ে ভেতরে চলে যেতে দেখেছি। ’
এ পালার নায়ক সমীরণ দত্ত বলে, ‘সাজ নেবার সময় দেখা হয়েছে। যতির জন্য আমার কান্না আসছে।
ও জাতশিল্পী। ’
বিবেকের চরিত্র যিনি রূপায়ণ করে, সেই পল্লাৎ সেন বলে, ‘পালা শুরু হবার ঘণ্টাখানেক আগে হঠাৎ করে যতি বলে, পল্লাৎদা, আমার খুব মরে যেতে ইচ্ছে করছে। জগৎ-সংসার বড়ো কঠিন জায়গা। ’
‘ক্যানে?’
‘পিরিতের মায়া!’
ওসি সাহেব পিরিত, মায়া এ দুটো শব্দ তার ডায়েরির খাতায় আন্ডার লাইন করে লিখে রাখে। না হারিয়ে যাবার আগে কেউ যতিকে দেখেনি।
জবানবন্দি নিতে নিতে রাত মাঝপ্রহর পেরিয়ে যায়।
ওসি সাহেব ডায়েরির খাতা গুটিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
অধিকারী বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘রাত তো শেষ হতে যাচ্ছে। ভোর হোক। দেখা যাবে।
তবে ওর কোনো প্রেমিক আছে কী না? খোঁজ নিন। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। ’
গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে আসে। কুয়াশা সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। চাঁদ নেই।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিঃস্তব্ধ। উৎসব মুখরিত যাত্রা প্যান্ডেল সুনসান নীরবতা! মোটরসাইকেলে কর্কশ শব্দ তুলে ওসি সাহেব তার দু’জন কনস্ট্রেবল নিয়ে চলে যায়।
অধিকারী বাবু এবং ইশরাত ভাইকে খুব অসহায় মনে হয়।
ইশরাত ভাই বলে, ‘বাবু বিছানায় গা এলিয়ে দেন।
আমি বাড়ি ফিরবো! দরকার হলে ডাকবেন। ’
ভোর না হতেই যাত্রা প্যান্ডেলের আশপাশ লোকজন ঘুর ঘুর করতে থাকে। যতির সর্বশেষ সংবাদ জানতে চায় তারা। আশপাশের চা দোকানগুলোতে ইতোমধ্যে যতি নিখোঁজ হবার ঘটনা নিয়ে অমমধুর গল্প তৈরি হতে থাকে।
কমল দত্ত বলে, ‘এটা কোনো কাম হলো মিয়া ভাই।
যতির মতো একজন জ্যান্ত মানুষ হাওয়া হয়ে গেলো কেউ দেখলো না। এ কেমন কথা!’
‘এ কথাই ঠিক কমল বাবু, কোন লাংগের সাথে ভেগে গেছে। দেখেন নাই, নাচতে নাচতে কেমনে বলে ওঠতো, জ্বালা। আরে মাগী তোর এতো জ্বালা তো আগে কভি!’
‘কী আজে বাজে কথা বলছেন মনির ভাই! এ কথা কী বলার সময়! জ্বালা শোনার জন্য তো ঠিকঠাক প্রথম কাতারে বসে থাকতেন। ’
‘আপনে থাকেন না?’
‘আমি যতিকে পছন্দ করতাম।
’
‘চিতার কাঠ কিনুন। বয়স তো সত্তরের মতো। ’
‘না পঞ্চান্ন। ’
‘এ বয়সে যতির কথা না ভেবে কাকিমা’র কথা ভাবুন। ’
কমল দত্ত বিরক্ত হয়।
পোলাপান মানুষ। এখনো মাথার ঘিলু পোক্ত হয় নাই। কী কথার ছিরি। অর্ধেক চা খেয়ে কমল বাবু উঠে দাঁড়ায়। কুয়াশা কেটে সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে।
অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ নিশাপুর বাজার মুখর। প্রতিরাত যতির অভিনয় দেখে আর গান শুনে অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙে। যতি লাপাত্তা হবার পর কেমন মনমরা ভাব সবার মাঝে প্রতীয়মান হচ্ছে।
ঠিক এ সময় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে শ্যামাচরণ পোদ্দার। বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে।
কেতা দুরস্ত ধুতি আর পাঞ্জাবি পরিহিত। হাতে বেতের লাঠি। ইতোমধ্যে একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। পড়ে যাবার ভয়ে ইদানীং বেতের লাঠিকে অবলম্বন করেছে।
মুলি বাঁশের বেড়ার সঙ্গে লাঠি রেখে বলল, ‘ও হেলাল আব্বা, যতি নাকি হারিয়ে গেছে।
আহা আমি সারাজীবন মনে রাখবো। ’
চা বয় শমসের বলে, ‘পোদ্দার কাকা কী বদলোক। ’
‘কেন?’
‘যতি দিয়ে আপনার কাম কি?’
‘ও কথা বলিসনি আব্বা, যতির মুখকায়া আমার স্বর্গীয় কন্যা মল্লিকার সঙ্গে মিল আছে। সাক্ষাৎ দেবী! আমি যতিকে সারাজীবন মনে রাখবো। ’
‘তা তো রাখবেনই! নইলে...’
‘খবর আছে, খবর আছে’ বলে চিৎকার করতে করতে শহর আলী হেঁটে যাচ্ছে।
হেলালের দোকানের বয় জিকির তুলে বলে, ‘কোনসে খবর?’
‘যতি, যতি। ’
ইতোমধ্যে স্থানীয় পত্রিকার দু’একজন সংবাদকর্মীকে ব্যস্ত চলাফেরা করতে দেখা যায়। প্রেসক্লাবের সভাপতি কামাল হোসেন উৎকিণ্ঠত অধিকারী চণ্ডীচরণ বাবুর সঙ্গে কথা বলছে। না অধিকারী বাবু যতির সর্বশেষ কোনো সংবাদ দিতে পারে না।
র্যাব-পুলিশে সয়লাব নিশাপুর বাজার।
শত বেদনার মধ্যে বিগত তেরো দিনের রোমাঞ্চকর রাতে নিশাপুর ঐতিহাসিক যাত্রা মঞ্চে যতির উপস্থিতি নেই! এ যেন কেউ মেনে নিতে পারছে না। কেউ কেউ যতির চেহারা, গাত্রবর্ণ, বক্ষ, কটিদেশ, জঙঘা, হাঁটাচলা, হাসি-কান্না নিয়ে রসজ্ঞ আলোচনা মেতে ওঠেছে।
তরুণ মাদল হাসান টিটো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়ছে।
‘ফোক এমনিতে আমার প্রিয়। তার মধ্যে যতির মতো অডিয়েন্স শিল্পী বিরলপ্রজ, যাত্রা শিল্পের গর্ব।
ওর অর্ন্তধানে আমি ব্যথিত। ওর ‘সীতার বনবাস’ দেখার জন্য ঢাকা যাচ্ছি না। ’
উত্তরপাড়ার ফালু মুন্সী। বয়স চব্বিশ। যাত্রা প্যান্ডেলের আশপাশে জিলেপি বিক্রি করে।
অত্যন্ত বেদনার্ত চিত্তে বলে, ‘আমার বউ প্রতিরাত যতির পালা দেখতে আসতো। সে কান্নাকাটি করছে। ’
অশীতিপর বৃদ্ধা সুরতি বেওয়া বলে, ‘মেয়াডা সোন্দর। পরান পোড়ে। ’
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশাপুর বাজার লোকারণ্য হচ্ছে।
এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান এসেছেন। তাদের সঙ্গে দলীয় কর্মী, কৌতূহলী মানুষের ভিড় বাড়ছে। ইয়াং ক্লাবের সদস্যরা হোন্ডা স্কোয়ার্ড নিয়ে সম্ভাব্য জায়গায় তল্লাশি চালাচ্ছে।
পুলিশের বড় দারোগাকে সাথে নিয়ে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছেন, যে করেই হোক যতিকে খুঁজে বের করা হবে। এ অন্যায়ের বিচার স্পেশাল ট্রাইবুনালে নেয়া হবে।
নিশাপুর বাজারের ফাজিল ছোকড়া চেরাগ আলী বলে, ‘যতিকে নিয়ে দু’বার হস্তমৈথুন করেছি। সে মেয়েটি নাই হোয়ে গেলো, তা কী করে হয় মিয়া ভাই!’
এ সময় কিছু গল্প তৈরি হয়। হবার কথা।
সংবাদ আসে, যতির লাশ ভেসে যেতে দেখেছে চর গাবসারার নালায়। ’
‘না না ওটা কাদের ডাকাতের লাশ।
’
‘যতি এখন ঢাকায়, সিনেমার নায়িকা হবে। ’
‘দেখো, ওকে ধর্ষণের পর লাশ পুঁতে ফেলেছে। ’
নিশাপুর জুড়ে যতির শূন্যতায় সহস্র মন্তব্য তৈরি হলেও যতির কোনো সহি খবর নেই। মরে গেছে না বেঁচে আছে তাও কেউ বলতে পারে না।
দু’দিন অতিবাহিত হবার পর নিশাপুরের যাত্রা প্যান্ডেল ভাঙার কাজ শুরু হয়।
যতি বিহীন এ পালার সমাপ্তি। কে পাঠ করবে যতির ভূমিকায়। হতাশায় নুয়ে আছে অধিকারী বাবু। সদাহাস্য মুখমণ্ডলে এখন কালো ছায়া। ইশরাত ভাইয়ের মাঝে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে।
যে স্কুলের স্বপ্ন নিয়ে এগোতে চেয়েছিলো এখন তার আদম সুরত দিকভ্রষ্ট। গহিন সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া কাতর ডলফিন।
অতি উৎসাহী হোন্ডা স্কোয়াডের তরুণ দল হেলাল চাচার চা’র দোকানের সামনে সার সার গাড়ি রেখে নিজেদের ব্যর্থতার হিসেব-নিকেশ করে।
না, কেউ যতির হদিস করতে পারে না। সহস্র মানুষের চোখের মণি, অন্ধকারে হারিয়ে যায়নি।
ধবল জোছনায় যতি নামক যে তরুণী লাপাত্তা হলো, তার স্ফূরিত যৌবন বসন্তের মাদকতায় পূর্ণ, কামনায় থর থর। তারপরও তাকে কী কোনো দুঃখ স্পর্শ করতে পেরেছিলো। কারতে পারে। মানুষের কতো ধরনের কষ্ট! ভাতের কষ্ট, যৌবনের কষ্ট, পিরিতের হাহাকার। যতির কিসের কষ্ট?
মাল-ছামানা বাঁধার কাজ চলছে।
সার সার মোষের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ইশরাত ভাইয়ের সঙ্গে শেষ কথা বলছে অধিকারী চণ্ডীচরণ বাবু। ইন্দ্রপুরী অপেরা’র শিল্পীবৃন্দ বিমর্ষ বদনে যার যার গাড়ির সামনে জটলা করছে। লোকজনের হৈ-হোল্লোড়।
বাস রোড এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার।
এ অঞ্চলের সবাই জানে আজ যতি বিহীন ‘ইন্দ্রপুরী অপেরা’ ফিরে যাচ্ছে। মালামাল গাড়িতে তোলার পর মহিলা শিল্পীবৃন্দ মোষের গাড়িতে আশ্রয় নিলেও পুরুষ শিল্পী হেঁটে যাত্রা করে। বিমর্ষ নিশাপুরের সব কিছুই যেন উদাসীন হাওয়ায় আক্রান্ত। শোকার্ত প্রকৃতি এবং জনপদ।
বিদায় নেবার সময় ইশরাত ভাই মান কণ্ঠে বলে, ‘অধিকারী বাবু, দুনিয়া ভয়ানক রহস্যময়।
তার চেয়ে রহস্যময় মানুষ নামক প্রজাতি। ক্ষমা করবেন, প্রকৃতির সন্তান হিসেবে আমার অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। যা ছিলো আমার ন্যায্য অধিকার। তাও আমি গ্রহণ করিনি। আপনি এবং ইন্দ্রপুরী অপেরা আমাকে হাহাকার থেকে রক্ষা করেছেন।
’
অধিকারী বাবু ইশরাত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে চোখে জল এলো। ইশরাত ভাই খালপার পর্যন্ত হেঁটে আসে। উৎসুক জনগণ ইন্দ্রপুরী অপেরা’র এ দুঃখময় বিদায় ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। মমতার চোখে তাকিয়ে দেখে, ইশরাত ভাই, আর অধিকারী বাবু হেঁটে আসছে।
পাদটীকা : একদা ইন্দ্রপুরী অপেরা’র অধিকারী চণ্ডীচরণ বাবু ইশরাত ভাই কর্তৃক একটি পত্র পায়।
ইশরাত ভাই লিখেছে, ‘চণ্ডীচরণ বাবু, এ সময়ের ভিতরে যতির কোনো খোঁজ পেয়েছেন কী? না পাবার কথা। একদিন উইংসের পিছনে যতিকে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখি। ওর ভেজা আঁখির দৃষ্টি একটি অসম বয়সের মানুষকে পাল্টে দেয়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে মনে হয়েছিলো, ওইটা চূড়ান্ত। সমর্থ থাকা সত্ত্বে নারীকে ঘরে তুলিনি।
অর্থনৈতিক যা কিছু অর্জন তা মানুষের কিছু কর্মে সাহায্য করতে পারে বলে বিশ্বাস করি। তাই এত বছরের সঞ্চিত নিজস্ব যা কিছু তা যতিকে দিয়ে দিলাম। অবশিষ্ট যা ছিলো তার একটি অংশের চেক পাঠালাম। ব্যাংক থেকে তুলে নেবেন। ভাববেন না, যতির বিনিময়ে আমি আপনাকে দিচ্ছি।
আপনার মাধ্যমে যতির মতোন নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। আপনার কাছে ঋণী। যতি কথা দিয়েছে, বাকি জনম সে আমাকে বয়ে বেড়াবে। আপনি নিশ্চয়ই খুশি হবেন, খুব শিগগির আমি জনক হবো। প্রতিরাতে যতি তার অধিকারী দাদার জন্য কান্নাকাটি করে।
বাবু আপনি কী এই সত্যটুকু স্বীকার করবেন, যতির মতো নারীদের কোনো দুঃখ থাকতে নেই। মুক্ত বলাকার মতোন আকাশে কিছুক্ষণ ওড়াওড়ি। তারপর একদা গানের সুরে বলবে, ‘হায়রে পিরিতি। ’।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।