'বিভিন্ন ব্যক্তিদের ফোন নম্বর এনে দিতো চাচা আবু তালেব ও আজহার। তার কাজ ছিল শুধু ওইসব ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করা। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের নিজের ফ্ল্যাটে এনে দিলেই তার কাজ শেষ। এরপর ব্লাকমেইল করে অর্থ হাতানোর কাজটা করত দলের অন্য সদস্যরা। ' কথাগুলো বলছিল রাজধানী থেকে গ্রেফতার হওয়া প্রতারক চক্রের সদস্য দোলা আক্তার।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গত মঙ্গলবার দোলা ও তার পাঁচ সহযোগীকে মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দোলার আপন খালা সালমা বেগম ও চাচা আবু তালেবও রয়েছে। তালেব-সালমা বিবাহিত দম্পতি। দীর্ঘদিন ধরে তারা প্রেম-প্রতারণার ফাঁদ পেতে পকেট কেটেছে অসংখ্য পুরুষের। বছরখানেক আগে ভাগ্নি দোলাকে এ দলে ভেড়ায় তারা।
গোয়েন্দা পুলিশ তাদের আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
দোলা বলে, ‘চাচার দেওয়া নম্বরে প্রথমে মিস কল দিতাম। একবার নয় একাধিকবার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই নম্বর থেকে কল ব্যাক করতো। আমি একটু কথা বলে বলতাম ‘রং নাম্বার’।
লাইন কেটে দিতাম। ঘণ্টাখানেক পর আবারও মিস কল দিতাম। আবার কল ব্যাক করলে কথা বলতাম। মেয়ের গলা পেয়ে অপর প্রান্তের লোক এমনিতেই কথা বলতো। একপর্যায়ে সম্পর্ক গাঢ় হতো।
তারপর একদিন উনিই (ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি) আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন। প্রথমে রাজি হতাম না। পরে রাজি হয়ে যেতাম। প্রথমে দেখা করতাম কোন একটি রেস্টুরেন্টে। পরে ফোনের কথোপকথন এডাল্ট বিষয়ে নিয়ে যেতাম আমি নিজেই।
এরপর উনিই আমাকে কোনো ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে চাইতেন। কখনও কক্সবাজার বা অন্য কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইতেন। আমি বলতাম, আমার খালার বাসা ফাঁকা। এখানে আসেন। বাসা ফাঁকা শুনে তিনি সহজেই রাজি হয়ে যেতেন।
এভাবেই আমার কাজ ছিল ফ্ল্যাট পর্যন্ত এনে দেয়া। বাকি কাজ অন্যরা করতো। ’
দোলা জানায়, তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার রাজপাট এলাকায়। পিতা আবু দাউদ শিকদার ছিলেন গার্মেন্ট কর্মকর্তা। বাবা-মায়ের সঙ্গে মিরপুরেই থাকতো সে।
কিন্তু বছর চারেক আগে তার বাবা এক মেয়েকে বিয়ে করে তাদের পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যান। এরপরই তাদের পরিবারে নেমে আসে অর্থনৈতিক দুর্যোগ। মা ছোটখাটো একটি চাকরি করে সংসার চালাতেন। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চলত না। শেষে ছোট ছেলেকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান মা।
দোলা শেওড়াপাড়ায় মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে থাকে। গত বছর মিরপুরের একটি স্কুল থেকে সে এসএসসি পাস করেছে। পরিবারের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাতে বছরখানেক আগে সে আপন চাচা ও খালার 'প্রেম-প্রতারণা' চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এক বান্ধবীর মাধ্যমে আজহার নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। আজহারের সঙ্গে তার চাচা ও খালারও পরিচয় ছিল।
আজহারই তাকে এই পথে নামতে প্রলুব্ধ করে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ জেনে সে বিপুল টাকার লোভ দেখায়। সেই লোভে পড়েই এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
দোলা বলে, মধ্য পাইকপাড়ার ৩৬/২ নম্বর বাসার পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় আজহার। দুই বেডরুম ও ড্রয়িং-ডাইনিংয়ের ওই বাসায় তার খালা, চাচাসহ সে নিজেও মাঝে মধ্যে থাকতো।
ওই বাসায়ই বিভিন্ন ব্যক্তিকে ফুসলিয়ে নিয়ে যেত দোলা। একটি লোককে পটিয়ে বাসা পর্যন্ত আনতে তার সময় লাগতো সর্বোচ্চ ১৫ দিন। সর্বশেষ এক রাজনীতিককে পটিয়ে বাসায় আনার কথা স্বীকার করে সে। এর আগে এক প্রকৌশলীকেও একই কায়দায় পটিয়ে বাসায় আনে। এই দুই ব্যক্তির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করলেও তাকে দুই লাখ ও আড়াই লাখ টাকার কথা বলেছে।
তার কাজের জন্য দিয়েছিল মাত্র ৪০ হাজার। টাকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল বলে জানায় দোলা। দোলা জানায়, পরিবারের ভাঙন তার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। এই সুযোগ নিয়েছে তার আপন খালা ও চাচা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এই চক্রটি এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
চক্রের পুরুষ ব্যক্তিরা প্রথমে বিত্তশালী লোকজনের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করতো। পরে ওই নাম্বারটি দেয়া হতো দোলকে। দোলা প্রেমের অভিনয় করে লোক পটিয়ে ওই ব্যক্তিকে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতো। ফ্ল্যাটে ঢোকার পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মাথায় আবু তালেব, আজহার, মোস্তফা ও শামিম শিকদার ওই ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়তো। তাদের হাতে থাকতো খেলনা পিস্তল, হ্যান্ডকাফ ও ওয়্যারলেস সেট।
শামীম শিকদার নিজেকে ফটোসাংবাদিক ও অন্যরা ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেইল ও ভয়ভীতি দেখাতো। অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি পরিবারকে জানিয়ে দেওয়া ও গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে বিপুল অর্থ আদায় করতো তারা। গত বছরের ২৬ই আগস্ট এই চক্র লন্ডন প্রবাসী এক ব্যবসায়ীকে এভাবে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে ২৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে। চলতি বছরের ২০শে ফেব্রুয়ারি সরকারি এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা আদায় করে। সর্বশেষ রংপুরের এক রাজনীতিক এই চক্রের প্রেম-প্রতারণার ফাঁদে পড়েন।
তার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলে তিনি পুলিশকে বিষয়টি জানান। পরে পুলিশ চক্রটি শনাক্ত করে তাদের গ্রেফতার করে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।