গত বছর এই সময় সারা বাংলাদেশ কাঁপছে আবেগ, আনন্দ ও বিস্ময়ে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ঘুমকাতুরে বাঙালিকে ঘাড় ঝাঁকিয়ে, চুলের মুঠো উঁচিয়ে রাস্তার মাঝখানে টেনে নামিয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ, তাদের মধ্যে যেমন রয়েছে সদ্য স্কুলে যাওয়া কিশোর, তেমনই অশীতিপর বৃদ্ধ, ভিড় জমিয়েছিল শাহবাগ চত্বরে। দেশের প্রতিটি পত্রিকার শিরোনামে শাহবাগ, টিভি চ্যানেলগুলোর চৌপ্রহরের তাজা ধারাভাষ্যে শাহবাগ। বিদেশের তথ্যমাধ্যমেও সেই ঘটনা সমান গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার পায়।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রথম পাতায় সচিত্র প্রতিবেদনে একদিকে বিস্ময়, অন্যদিকে উদ্বেগ। কেউ কেউ শাহবাগের টগবগে তরুণদের সঙ্গে আমেরিকার ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনকারীদের মিলও খুঁজে পায়। তাহরির স্কয়ারের তরুণ মিসরীয়দের আন্দোলনের সঙ্গে তাদের তুলনাও স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে।
মাত্র এক বছরের মাথায় সেই শাহবাগ এখন পুলিশি রোষের শিকার। গত সপ্তাহে এই আন্দোলনের নেতারা আভিযোগ করেছেন, পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের আক্রমণে আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা আহত হয়েছেন।
সামাজিক তথ্যমাধ্যমে ঘটনাটির প্রতিক্রিয়া পড়ে এই ধারণা জাগে যে অধিকাংশেরই চোখে শাহবাগের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ফেসবুক ও বিভিন্ন সামাজিক ব্লগে পরিহাস করে বলা হয়েছে, সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে এর চেয়ে বেশি অর্জন অসম্ভব। এই টীকাভাষ্যকারেরা ধরেই নিয়েছেন, ক্ষমতাসীন দলের অনুচরেরা, গোপনে অথবা প্রকাশ্যে, এই আন্দোলনের ওপর ভর করার ফলেই আন্দোলন তার নির্দলীয় চরিত্র হারিয়ে ফেলে। ক্ষমতাসীন দল তার প্রয়োজনমাফিক এই আন্দোলনকে ব্যবহার করেছে। এখন সে প্রয়োজন ফুরিয়েছে, অতএব এই আন্দোলন জিইয়ে রেখে তাদের জন্য লাভের চেয়েই লোকসানই বেশি।
একসময় পুলিশ তাদের রক্ষা করেছে, এখন পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে।
শুধু সামাজিক মাধ্যমের আশাহত তরুণ-তরুণীরাই নয়, বিচক্ষণ বলে সম্মানিত কেউ কেউ প্রায় একই ভাষায় মন্তব্য করেছেন। যেমন, একজন জানালেন, তাদের যা করার, যা দেওয়ার, তা অর্জিত হয়েছে। এখন সময় এসেছে পাততাড়ি গোটানোর।
শাহবাগ আন্দোলনের বাহ্যিক লক্ষ্য ছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সুবিচার নিশ্চিত করা।
সেই বিচার-প্রক্রিয়া এগিয়েছে, কিন্তু এখনো সমাপ্ত হয়নি। এখনই যদি এই আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া হয়, তাতে শুধু তাদেরই লাভ হয়, যারা সে বিচার-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হোক, তা চান না বা তা বিলম্বিত হলে অধিক রাজনৈতিক মুনাফা আছে বলে বিশ্বাস করেন। শাহবাগ আন্দোলনের যুদ্ধাপরাধী-বিরোধী এই বাহ্যিক প্রকাশ ছাড়াও একটি অন্তর্গত চেহারা আছে, তা হলো একাত্তরের চেতনার নবায়ন। শাহবাগ আমাদের বুঝিয়েছিল, শুধু একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারকার্য সম্পন্ন করে আমাদের স্বপ্নের সেই বাংলাদেশের নির্মাণ সম্পূর্ণ হবে না। একাত্তর মানে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নয়; একাত্তর মানে এক নতুন বাংলাদেশ, এক গণতান্ত্রিক, বহুপক্ষীয়, গণকল্যাণমুখী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
শাহবাগের তরুণেরা বুঝেছিল, ক্ষমতার বৈঠা যাঁদের হাতে, অথবা যাঁরা ঘাপটি মেরে বসে আছেন কখন ক্ষমতার কুরসিতে বসবেন, তাঁদের দ্বারা সে লক্ষ্য অর্জিত হবে না, কারণ তাঁদের অনেকেই সে চেতনায় আদৌ বিশ্বাসী নন।
ঠিক এই কারণে শাহবাগকে বাক্সবন্দী করলে লাভ হয় শুধু তাদের, যারা নগদ পাওনায় বিশ্বাসী। অনুমান করি, আজ যারা শাহবাগের পেছনে পেটোয়া বাহিনী পাঠিয়েছে, তারা সেই নগদ পাওনার দল। এ কথা ভাবা সম্ভবত অযৌক্তিক নয় যে সরকারি দলের সমর্থকদের কাছে এই আন্দোলনের একটি অকথিত রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল। তাঁরা হয়তো এই বিশ্বাস থেকে চালিত হয়েছিলেন, এই মুহূর্তে যেকোনো মূল্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমর্থক এমন রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতার কেন্দ্রে ধরে রাখা দরকার।
ধরে রাখার পদ্ধতিটি যদি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক নাও হয়, তাতেও ক্ষতি নেই। শাহবাগ তাদের সে লক্ষ্য অর্জনে সাহায্যে সক্ষম, অতএব তাদের আগলে রাখা দরকার। তো, ইতিমধ্যে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, কাজেই তোমরা ছেলে-ছোকরারা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। আর এ কথাও তো সত্যি, সরকারের ক্ষমতার বলয়ের বাইরে স্বাধীনভাবে যদি এই আন্দোলনকে জিইয়ে রাখা হয়, তাহলে একসময় তারা সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। কাজ কী সে ঝামেলায় গিয়ে!
এই শেষের বিচারে শাহবাগ আন্দোলনকে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’-এর বদলে বরং মিসরের ‘তাহরির স্কয়ার’ আন্দোলনের অধিক নিকটবর্তী বলে মনে হয়।
মিসরেও মুখ্যত যুবা শ্রেণীর নেতৃত্বে আন্দোলন, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল একনায়কতন্ত্রের উচ্ছেদ ও বহুপক্ষীয় গণতন্ত্রের বিকাশ। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে মিসরের সামরিক বাহিনী তাহরির আন্দোলনকে তাদের জন্য হুমকি ভেবেছিল। ফলে, মিটিং-মিছিলে নির্দ্বিধায় হামলা হয়েছিল। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর যখন ইসলামপন্থী ব্রাদারহুড নতুন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়, সেনাবাহিনী তখন তাহরিরকে নিজের পক্ষে টেনে আনে। সেই তাহরিরকে ব্যবহার করে যেই ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে নামানো হলো, অমনি সেনাবাহিনী জানিয়ে দিল, আপাতত তাহরিরের আর প্রয়োজন নেই।
অতএব, বাপুরা, তোমরা পাততাড়ি গোটাও, না হলে পুলিশের গুঁতা। এখানে শাহবাগ ও তাহরিরের অভিজ্ঞতা অভিন্ন।
‘অকুপাই’ আন্দোলনের সঙ্গেও যে শাহবাগের কোনো মিল নেই, তা নয়। বস্তুত, গঠনগতভাবে এই দুই আন্দোলনের মধ্যে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। আন্দোলনের শুরুতে, চেনা পুরুতদের হাতে সেই আন্দোলন হাইজ্যাক হওয়ার আগে, শাহবাগ ছিল নতুন প্রজন্মের ক্রোধ, হতাশা ও বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে ওঠা এক নিষ্কলুষ নির্ঘোষ বার্তা।
সন্দেহ নেই, শাহবাগের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ যুবক-যুবতী জামায়াত ও বিএনপিবিরোধী ছিল এবং সেই কারণে ‘অনিবার্য’ভাবে আওয়ামীপন্থী বলে বিবেচিত হয়েছিল। অকুপাই আন্দোলনের সমর্থকেরাও রিপাবলিকান নেতৃত্বের ধনিক-তোষণনীতিতে ক্রুদ্ধ, ফলে সেই একই ‘অনিবার্যতায়’ তাদেরও ধরে নেওয়া হয় ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক হিসেবে। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় বসুক, এই লক্ষ্য তাদের ছিল না। তারা চেয়েছিল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন। ক্ষমতায় যে দলই আসুক, শুধু ১ শতাংশের অনুকূলে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো টিকিয়ে রাখা হোক, সেই গড্ডলিকাপ্রবাহের বিরুদ্ধে ছিল তাদের উচ্চারণ।
নির্বাচনী ফলাফলের বিচারে শাহবাগের আন্দোলন আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে, যেমন অকুপাই আন্দোলন ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। এই দুই দল, ভিন্ন ভিন্ন দুই আন্দোলনের ফলে তারা যে যার মতো মসনদ দখল নিয়েছে।
ফায়দা হাসিল, অতএব শাহবাগ ও অকুপাই, দুজনেই তফাত যাও! বাস্তবে হয়েছেও তা-ই।
কিন্তু ব্যাপারটা যদি এমন এক সহজ সমীকরণ হবে, তবে তা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন পড়ত না। আমেরিকার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, অকুপাই আন্দোলনের প্রভাব প্রথাগত নির্বাচনের বাইরেও বিস্তৃত, মানুষের চেতনায় তা গভীর দাগ ফেলে গেছে।
অকুপাই আন্দোলনের ফলেই ‘১ শতাংশ বনাম ৯৯ শতাংশ’-এর হিসাব এ দেশের প্রতিটি রাজনীতিককে মাথায় রাখতে হচ্ছে। নতুন বাজেট প্রস্তাবের সময় বা ব্যয় বরাদ্দ দাবির সময় স্বাভাবিকভাবেই কথা উঠছে, এর ফলে ১ শতাংশের কী লাভ, আর ৯৯ শতাংশেরই বা কী সুবিধা। অকুপাইয়ের প্রভাবেই ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নতুন কড়াকড়ি আরোপ হয়েছে, ভোক্তা-অধিকার রক্ষায় নতুন দপ্তর খোলা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিমায় নতুন আইন হয়েছে, ঘণ্টাপ্রতি বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন বেগবান হয়েছে, বেআইনি অভিবাসীদের আইনসম্মত করতে সব দলের সচেতনতা বেড়েছে। পাঁড় দক্ষিণপন্থীও মানবেন, অকুপাই আন্দোলন এ দেশে নাগরিক অধিকার সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এ কথা ঠিক, অকুপাই আন্দোলনের অধিকাংশ দাবিই এখন পর্যন্ত অপূর্ণ রয়ে গেছে।
কিন্তু সেসব বাস্তবায়নের দায়িত্ব অকুপাই আন্দোলনের নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর, তারা ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান, যা-ই হোক।
একই কথা শাহবাগ আন্দোলনকে নিয়ে। মানুষের মনে নতুন চেতনার আলোকবর্তিকা হয়ে এসেছে শাহবাগ। পরিবর্তনের পক্ষে জমিন তারা তৈরি করে দিয়েছে, এখন সেই জমিনের ওপর ঘর তোলার দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের। তাদের ব্যর্থতার দায়ভার আর যারই হোক, শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের নয়।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।