শহীদের খুন লেগে, কিশোর তোমার দুই হাতে দুই, সূর্য উঠেছে জেগে। -------হাসান হাফিজ গত ১৫/১২/২০১২ তারিখে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ গিয়েছিলাম একটা কাজে......সেই সাথে মযনামতি জাদুঘর, শালবন বিহার দেখে এলাম...
কিংবদন্তি অনুযায়ী কুমিল্লার ময়নামতি নামের প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাটি ১৭-১৮ শতকের বাংলা লোককাহিনীর নানা পুঁথি যেমন, গোপী চন্দ্রের গান, মানিক চন্দ্রের গান, গোরক্ষা বিজয় পুঁথির নায়িকা ‘ময়নামতি'র নামে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে মেঘনা নদীর অববাহিকায় বৃহত্তর কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার অনেকটা অংশজুড়ে বিস্তৃত ছিল প্রাচীন বাংলার ‘সমতট' জনপদ। আক্ষরিকভাবে সমতট অর্থ হলো সমুদ্রের সমতলে ব্যাপ্ত ভূপৃষ্ঠ। কুমিল্লা শহর হতে উত্তর-পশ্চিমে ১৮ মাইল দূরবর্তী এক গ্রাম থেকে এই তাম্রশাসন উদ্ধার করা গেছে।
চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৭-৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে সমতট বা আজকের কুমিল্লা অঞ্চল পরিভ্রমণ করে এই এলাকার ৩০টি সঙ্ঘারামে প্রায় দুই হাজার শ্রমণ আছে বলে তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে লিখেছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিক নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে অনুমিত হয়, সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে ভদ্র রাজবংশ সমতট বা কুমিল্লা শাসন করেছেন। কুমিল্লা শহরের ২২ মাইল দূরবর্তী দেলুবাড়ী গ্রামে পাওয়া এক ‘সর্বাণী' প্রতিমা ও ঢাকার আশরাফপুরে পাওয়া দুটো তাম্রশাসন থেকে আর জানা যায়, ভদ্র রাজবংশের পর সপ্তম শতকে খড়গ রাজবংশ প্রায় ৭০ বছর এই অঞ্চল শাসন করেছে।
১৮০৩ সালে ময়নামতি পাহাড়ে রণবঙ্কল্ল হরিকেলদেবের একটি তাম্রশাসন থেকে এ অঞ্চলের পুরাতাত্ত্বিক চারিত্র্য প্রথম জানা গেলেও প্রকৃত অর্থে পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজ শুরু হয় আরও প্রায় ১৫০ বছর পর। ১৯৪৩-৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ১৪তম ডিভিশন কুমিল্লায় থাকাকালে তাদের আবাসনের জন্য লালমাই-ময়নামতি পাহাড়ের নানা জায়গায় বাড়িঘর স্থাপনার সময় প্রচুর প্রাচীন ঘর-বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়।
পুরোদস্তুর উত্খননকাজ শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৩ সাল অবধি শালবনপুর স্তূপ, কুটিলা মুরা ও চারপত্র মুরা নিয়মিত উত্খননের সময় শালবনপুরে একটি বড় বৌদ্ধসঙ্ঘ (পরে যার নাম রাখা হয় শালবন বিহার), কুটিলা মুরার ‘ত্রিরত্ন স্তূপ' এবং চারপত্র মুরায় একটি প্রার্থনা বেদির অবশেষ পাওয়া যায়। এ তিনটি এলাকায় পাওয়া ১১টি তাম্রশাসন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতকের ইতিহাস উদঘাটনে বিশেষ সাহায্য করেছে। এইচ টি কোলব্রুক, টি এন রামচন্দ্রন, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, এ এইচ ড্যানি, শামসুল আলম, নাজিমুদ্দিন আহমেদের মতো পুরাতাত্ত্বিকদের কঠোর পরিশ্রম সমতট সভ্যতার রহস্য উন্মোচনে অনস্বীকার্য।
আজকের ময়নামতিতে গেলে প্রথমেই জাদুঘরে ঢুকতে ভুল যেন না হয়।
৪২টি শো-কেসে তাম্রশাসন, ৩৫০টি মুদ্রা, তাম্র বিগ্রহ, প্রস্তর বিগ্রহ, অজস্র মৃত্ফলক আপনাকে নিয়ে যাবে কালহীনতার অন্যতর বোধে। শালবন বিহার থেকে পাওয়া ১০'' x ৮'' তাম্রশাসনটি দেখুন, যার সবার ওপরে রয়েছে একটি সুন্দর ধর্মচক্র। ধর্মচক্রের দুই পাশে আবার দুটো হরিণ, যা সারনাথের হরিণ অভয়াশ্রমে বুদ্ধের প্রথম ধর্মোপদেশ প্রদানের স্মৃতিবাহী। আছে গুপ্ত রাজবংশের দুটো স্বর্ণমুদ্রা, যার একটি সমুদ্র গুপ্তের (৩৩৫-৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ) অশ্বমেধ যজ্ঞের চিত্রসংবলিত। ১৯৫৭ সালে কুটিলা মুরায় পাওয়া সর্বশেষ মুদ্রাটি আব্বাসীয় খলিফা আবু আহমেদ আব্দুল্লাহ মুস্তাসিম বিল্লাহর (১২৪২-৫৮) সময়ের, যা আরব দেশ ও বাংলার ভেতর প্রাক-ইসলামীয় সময় থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের বিদ্যমানতার ইঙ্গিতবাহী।
জাদুঘরের শো-কেসগুলোয় আরও আছে অষ্টহাতবিশষ্টি তারা ও জস্বালার মূর্তি, বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও তারার অসংখ্য মূর্তি, যা খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে অষ্টম শতকে বাংলায় প্রচলিত মহাযান বৌদ্ধধর্মের বিবর্তনের স্বাক্ষর।
জাদুঘরের বিভিন্ন মৃত্ফলক দেখতেই এ জাদুঘরে বারবার যাওয়া যায়। বিভিন্ন মুদ্রায় নর-নারী, তরবারি-বর্ম হাতে যোদ্ধা ও তীর-ধনুক কাঁধে তীরন্দাজ, উড়ন্ত মানবী, প্রেমময় দম্পতি বা খেলোয়াড় দেহ...কী নেই এই মৃত্ফলকগুলোয়? আছে পাখি, ময়ূর ও রাজহাঁস, মুক্তোর মালা ধারণরত রাজহংস ও পদ্ম ফুলের কাণ্ড ভক্ষণরত অপর এক রাজহংসের অনিন্দ্য মৃত্কর্ম। আছে ‘কিম্পুরুষ' বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মুখ। সিংহ, অশ্ব, বানর, বন্য বরাহ, কুমির ও কীর্তিমুখ বা দুটো সিংহের মূর্তিসহ অনেক কিছুই উত্কীর্ণ এই মৃত্ফলকগুলোয়।
জাদুঘরে রক্ষিত ছয়টি বৃহত্তম মূর্তির ভেতর তানি্ত্রক বৌদ্ধ দেবতা হেরুক, দেবী তারার বেলে পাথরের বিগ্রহ, লোকনাথের তাম্র মস্তক, কালো পাথরে খোদাই মঞ্জুবর, অষ্টহাতবিশষ্টিা কালো পাথরের দেবী মারিচি বা মহাযান মতে ধ্যানী বুদ্ধের নারী সঙ্গিনীর মূর্তি এবং হিন্দু দেবতা গণেশের মূর্তি উল্লেখযোগ্য।
ময়নামতি জাদুঘরের বাইরেও রয়েছে ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা, যার সব এক দিনে ভ্রমণ না করতে পারলেও এক দিনে অন্তত চার-পাঁচটি এলাকা তো ভ্রমণ করাই যায়। শালবনপুর স্তূপে পাওয়া ৫৫০ বর্গফুট আয়তনের ও ১১৫টি কক্ষবিশষ্টি সঙ্ঘর, কুটিলা মুরার উত্তর-দক্ষিণ থেকে পূর্ব-পশ্চিমে ২৮০ ফুট ও ২২৫ ফুট বিস্তৃত ত্রিরত্নের স্মারক তিনটি স্তূপ, চারপত্র মুরার পূর্ব-পশ্চিমে ১০৫ ফুট ও উত্তর-দক্ষিণে ৫৫ ফুট পরিসরে বিস্তৃত মন্দিরের ভূমি পরিকল্পনা ও চারটি তাম্রপত্র, রূপবান কন্যা মুরার ২৫০x২৫০ ফুট পরিসরে বিস্তৃত একটি সঙ্ঘ, বর্তমানের বার্ড কমপ্লেক্সের নিকটবর্তী ১৫ ফুট উঁচু আনন্দ রাজার বাড়ি বা আনন্দ বিহার, ময়নামতি পাহাড়ের উত্তর কোণে ৪০ ফুট উঁচু রানির বাংলো, রূপবান মুরার ৪০০x৪০০ ফুট উঁচু আয়তাকার সঙ্ঘ, চান্দি মুরা প্রভৃতি এলাকা ইতিহাসের নানা অজানা অধ্যায় পাঠের সংকেতবহ। চান্দি মুরায় পাওয়া ১০১৫ সালের একটি বিগ্রহের শিরোনাম ‘পট্টিকেরা চুণ্ডাবরাভবনে চুণ্ডা অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা' গবেষকদের যথষ্টে কৌতূহলী করেছে এবং বিগ্রহটি এখন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পাঠাগারে রয়েছে।
গ্রীষ্মে (১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা এবং শীতে (১ অক্টোবর থেকে ৩১ মার্চ) সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে।
প্রতিদিন আধা ঘণ্টা মধ্যাহ্নভোজের বিরতি এবং রোববার সাপ্তাহিক ছুটি। টিকিট বিক্রি থেকে মাসে দেড়-দুই লাখ টাকার মতো আয় হলেও এ আয় পর্যাপ্ত নয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ সন্তোষজনক হলেও জনবল অপর্যাপ্ত। ঢাকা থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার রাস্তা। সময় সুযোগ করে ঘুরে আসতে পারেন।
সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে -প্রাইম, তিশা, এশিয়া লাইন, কর্ডোভা ইত্যাদি বাসে ১০০-১৬০ টাকা ভাড়া।
তথ্য উৎস:
১। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন
২। শালবন বিহারের পরিচিতি ফলক
৩। ইন্টারনেট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।