------ (এক)
আমাদের ভার্সিটিতে তখন বিভিন্ন হলের নামকরণ নিয়ে জটিলতা চলছে। ক্লাশ নেই-পরীক্ষা নেই-অখন্ড অবসর। হলে-মেসে কোথাও ভাল্লাগেনা। তাই চলে আসি ঢাকায় বড়পা'র বাসায়। ভালোই কাটে, মাঝে মাঝে ঢাকা ভার্সিটির ডজন খানেক বন্ধুর সাথে টিএসসি, ছবির হাট, চারুকলায় বসে আড্ডা।
আপারা থাকেন চারতলার ফ্ল্যাটে। বড্ড নি:সঙ্গ আপা, শ্বাশুড়ি ও তার ননদী। দুলাভাই অফিস থেকে ফেরেন রাত আটটায়।
আমাকে পেয়েতো আপা আনন্দে টগবগ। তাছাড়া আমিও ঢাকা আসিনা অনেকদিন।
আপা বলে-"তোদের ভার্সিটিটা একটা কিন্ডার গার্টেন। "
সত্যিই কিন্তু তাই। সেমিস্টারের চাপে ছোট বাচ্চাদের মতো টানা ক্লাস করতে হয়।
কোনদিন বিকেলটা কাটতো ছয়তলার ছাদে। ঢাকার পড়ন্ত বিকেলটা কেমন যেন ভাল লাগে।
আর যখন গ্রামে যাই, শান্ত স্নিগ্ধ ভোর আমাকে অভিভূত করে। পাশের হলুদ বিল্ডিংয়ের ছাদে মাঝে মাঝে বিকেলে পুরো পরিবারের আড্ডা জমে। তবে প্রতিদিনই দেখি টি-শার্ট পড়া একটি মেয়ে। চোখ দুটি অদ্ভুত সুন্দর! হালকা লিকলিকে গড়ন, আবার চুলগুলো ছোট মেয়েদের মতো বিনুনি করা। কোনদিন একা একা পায়চারি করে।
কানে তার আইফোনের হেডফোনটা টুয়েন্ট ফোর আওয়ারই লাগানো থাকে। সে যেন বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন আলাদা একটা প্রাণী। মাঝে মাঝে দূরের পানে নির্বাক দৃষ্টি- কখনও আড়চোখে আমাদের ছাদে।
ছাদে উঠা প্রতিদিন হতোনা। এখন প্রতিদিন....।
কোন কথা হতোনা। অথচ দূর থেকে দুষ্টামি করতো মেয়েটি। সে দুষ্টামির ভাষা গুলো অদ্ভুত। সে ভাষা অনায়াসে আমার দ্বারা আয়ত্ব করা বড় কঠিন কাজ ছিল। আমি কিছু বলতে গেলে গলা ফাটানো ছাড়া কোন উপায় ছিলনা।
কারন কানে তার হেড ফোন। আমার তখন হুমায়ূন আহমেদের রুপা'র কথা মনে পড়তো। সেতো এতো অশান্ত না...। তার এই প্রানচঞ্চলতা আমাকে মুগ্ধ করতো আবার বিরক্তিতে ভরে যেত মন।
সেই দুষ্টুমির দুর্বোধ্য ভাষা আবিষ্কার করতে না করতেই একদিন একটা চিরকুট পেলাম ছাদে।
তাতে লিখা-
"প্রতিদিন ছাদে আসেন কেন...?"
আর কিছুই লেখা নেই, আশ্চর্য্য! তবু বুঝতে অসুবিধে হয়নি- এটি মঙ্গল গ্রহের অধিবাসী এই মেয়েটিরই কান্ড! পরদিন ছাদে যাইনি। কি লিখতে পারি এই চিরকুটের উত্তর। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল এই ব্যাপারটি। শেষে ছোট্র কাগজে লিখলাম-
"আমারওতো সেই প্রশ্ন!"
পরদিন থেকে আবার নিয়মিত ছাদে। পরিচয়, কথাবার্তা, জমকানো আড্ডা।
অবশ্য দু'জন ছাদের এপাড়ে ওপাড়ে দাঁড়িয়ে। মাঝখানে বিশাল মরন ফাঁদ।
(দুই)
কিছু বই কিনতে গিয়েছিলাম নিউ মার্কেটে। সিলেটে বই কমদামে পাওয়া কঠিন। সব বই পাওয়াও যায়না।
মূলত আমি ঢাকায় আসলে বই কেনার ভূতটা বেশি চেপে ধরে। ইচ্ছে করে ট্রাক ভাড়া করে সব বই কিনে নেই। কেনটা রেখে কোনটা কিনি। কোন সময় বাবার পাঠানো সব টাকা শেষ হয়ে যায়, তখন টিউশনি থেকে পাওয়া টাকাই হয়ে উঠে শেষ অবলম্বন । এই ভয়ন্কর নেশাটা ছাড়তে পারছিনা।
তিরিশটা বইয়ে বাঁধানো কার্টুন আর আপার জন্য ফুচকা নিয়ে অবশেষে গলদগর্ম হয়ে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে দেখি সেই মেয়ে।
"কি ব্যাপার, আপনি এইখানে?" - সে বলল।
"তুমিও যে এখানে?"- আমার প্রশ্ন।
আমি রীতিমত একটু অবাকই হলাম।
যে আরাধ্য মানুষ ছাদে ভার্চুয়াল হয়ে কথা বলে এক অদৃশ্য মানবীর মতো সে আজ আমার সামনে মুখোমুখি বসে আছে। বইয়ের কার্টুন সোফার কাছে রাখতে না রাখতেই বলে উঠল-
এতো ঘামছেন কেন? কি কি বই কিনলেন? আপার বানানো চা' টা না দারুন। আপাকে বলব এক কাপ দিতে আপনাকে?
আমি আরো হতচকিয়ে গেলাম। নিজেকে সম্ভিত ফিয়েয়ে এনে জিজ্ঞেস করলাম-
"আচ্ছা বলেনতো ব্যাপারটা কি, আমি বুঝতে পারছিনা। "
"বুঝে কি লাভ, আমার বই চাই, তিনটা বই, এক সপ্তাহের জন্য।
"
"হ্যা, বই দেব নিশ্চয়ই। আমার কেনা বই আপনার একটাও পছন্দ হবেনা। সস্তা কবিতা আর উপন্যাসের বই আমি কিনিনা, পড়িওনা"
"আমিও আপনার সেই রুচিবোধের বাইরের কেউনা, সো..."
"ঠিক আছে, তাহলে বই পাবেন, তবে শর্ত প্রযোজ্য। "
"শর্ত ? বই ফেরত যোগ্য, এইতো? "
"হ্যা। আচ্ছা বলেনতো আপনি আমাদের বাসায় কি করে?"
"কেন, আপার বাসায় কি আমি আসতে পারিনা?"
"পারেন, তো ব্যাপারটা খুলে বলেন প্লিজ?
"কোন ব্যাপার ট্যাপার না, আপার সাথে আড্ডা দিতে আর আপার বানানো ডেলিসিয়াস চা খেতেই এখানে"।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। বই গুলো ভেতরের রুমে নিয়ে যেতে পা বাড়াতেই আবার প্রশ্ন-
"আচ্ছা, যে বইগুলো আমি নেব, সেগুলো কি ফেরত দিতেই হবে?"
আমি সে রকম মানুষ না। আমি বই ছাড় দিতে রাজি না। কষ্ঠের টাকায় কেনা বই। ছোট বেলায় বইয়ে পড়েছিলাম- "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়না"।
আমি সে কথার ঘোর বিরোধী একজন মানুষ। বইয়ের যে দাম, এখন একজন মানুষকে তার পছন্দের বই কিনলে দেউলিয়া হওয়া ছাড়া উপায় থাকেনা। আর ক'জনের সময় আছে পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ার।
আমি বললাম- হ্যা ফেরত্ দিতে হবে। "
"আপনি এতো কাটখোট্টা কেন? সামান্য কয়েকটা বই..."
"বই আমার কাছে সামান্য নয়, ভালো বই দেবতার মতো।
আমার বন্ধুরা ধার করা টাকা নিয়ে ফেরত না দিলেও মন খারাপ হয়না, কিন্তু আমার পছন্দের বই পড়তে নিয়ে ফেরত না দিলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। "
"আপনি আসলে একটা পাগল, বুঝলেন!"
(তিন)
আমি সত্যিই বুঝতে পারলাম না, ব্যাপারটি কি? পরে আপার কাছে শুনলাম, মেয়েটি নাকি গল্প করেছে- প্রতিদিন বিকেলে ছাদে সে একটা ছেলের সাথে দুষ্টুমি করে। চিরকুট আদান প্রদান হয়।
বলে রাখা ভালো, আপার সাথে ওর সখ্যতা অনেক আগ থেকেই। এক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আপার সাথে প্রথম পরিচয় হয়।
একই এলাকায় থাকা হয় বলে তারপর থেকে গল্প করতে মাঝে মাঝে আপাদের ফ্ল্যাটে আসে। তাই আমাকে দেখে প্রথম লজ্জায় মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল আপার সামনে। আমাকে দেখে এক দৌড়ে ভেতরের রুমে। সে জানতো না যে, "সে আপারাই ভাই আমি। "
(চার)
সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ডেভলপমেন্ট স্টাডিজে ফোর্থ ইয়ার।
আমি সোস্যিওলজিতে ফোর্থ ইয়ার। তাই কনসেপ্টচুয়াল বিষয় গুলোতে দারুন মিল ছিল বলে আমাদের আড্ডার পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। আমরা একদিন কথা বলতে বলতে ডোমিস্টক ভায়োলেন্স অন উইমেন বিষয়ে একটা দারুন কনসেপ্ট নোট তৈরি করে খুব এক্সাইটিং ছিলাম। পরে সেটা একটা জার্নালে এসেছিল। সে কথা থাক।
আমাদের বিতর্কের জায়গাটি সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। সোস্যিওলজিতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিসার্চের সময় যে যুক্তি-তর্ক-গল্প দানা বেধে উঠত, তার চিরকুট অনেক দূর হাটার পথ। এতো পরিচ্ছন্ন ভালো মনের বন্ধু কম মানুষেরই জুটে। দিনে দিনে সে হয়ে উঠেছে আমার ভালো বন্ধুর তালিকার একজন।
(পাঁচ)
ওর নামই বলা হয়নি।
তবে নামটা জানাতে আমার একটু আপত্তি। তা না হলে আমার ডিপার্টমেন্টের বান্ধবীদের হাত থেকে রেহায় পাওয়া একটু মুস্কিল। নাম জানলে....ক্যান্টিনে অথবা ক্যাফেটেরিয়ায় পেলে আমার পকেটের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। ওদের চাঁদাবাজি হয়ে যাবে নিত্যদিনের ঘটনা। তাছাড়া আমাদের এই নিখাদ এই বন্ধুত্ব দেখে ওদের মধ্যে একটা ঈর্ষা সারাক্ষন কাজ করতো।
বন্ধুত্ব দেখে যে ঈর্ষা হয় সেটাও আমি প্রথম দেখলাম। তাই নামটা আপাতত নাইবা জানা হলো।
(ছয়)
গতকাল হলের ঠিকানায় ওর চিঠি পেলাম। খামে প্রেরকের ঠিকানা নেই। প্রাপকের ঠিকানায় গোটা হাতের অক্ষরে লেখা-
প্রাপক-
অনিরুদ্ধ
২৩০/সি, শাহ পারান হল
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,
সিলেট-৩১১৪
খাম খুলে দেখি সেটা চিঠি নয়, একটা খয়েরি রংয়ের উইডিং কার্ড।
কার্ডের ভেতর ছোট একটা চিরকুট, তাতে পরিচিত হাতের লেখা-
"বন্ধু,
আমার কাজিনের সাথে আব্বু-আম্মু আমার বিয়ে চূড়ান্ত করেছেন। আগামি শুক্রবার ফেলকন হলে প্রোগ্রাম। আসবে কিন্তু। তোমার বইগুলো পরে সময় করে ফেরত দেব। ভালো থেকো, শুভ কামনা।
- বন্ধু"
দুলাভাইয়ের জব ট্রান্সফারের কারনে আপারা চলে আসে ময়মনসিংহে। আমি চলে আসি ক্যাম্পাসে সেমিস্টার ফাইনালের কারনে। প্রিয় বন্ধুর বিয়েতে যাওয়া হয়নি।
(সাত)
আজ সেই বন্ধুর কথা খুব মনে পড়ছে। ওর ইয়াহু ই-মেইল আইডিতে মেইল পাঠিয়েছি।
ইয়াহু থেকে রিপ্লাই এসেছে-
Sub: Failure notice
Sorry, we were unable to deliver your message to the following address.
:
No MX or A records for yahoo.com
--- Below this line is a copy of the message.
Received: from [xx.xxx.xxx.xxx] by nm30.bullet.mail.bf1.yahoo.com with NNFMP; 31 Dec 2004 04:40:00 -0000
To:Subject:To:MIME-Version:Content-Type;
(পুনশ্চ: এই গল্পটি লিখেছিলাম আমি যখন অনার্স ৪র্থ সেমিস্টারে পড়ি। সেই সময়কার প্রেক্ষিতে গল্পটি মানানসই ছিল। সময়ের ব্যবধানে এখন সেটার কোন কিছুই মিল নেই। গল্পের পরিপ্রেক্ষিতটুকু যদি পাঠকেদের কাছে বেমানান লাগে, সেজন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ধন্যবাদ।
)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।