...............................................................................................................................................................। ১
‘ঠক!ঠক!
অবনী বাড়ি আছ?’
কৌশিকের এমন মিষ্টি স্বরে অবনীর নাম ধরে ডাকা অবনীকে খুবই আকৃষ্ট করত।
অবনীর বাবা,মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন কোন না কোন কৌশল অবলম্বন করে হঠাৎ হাজির হয়ে এভাবেই অবনীকে চমকে দিত।
কৌশিক, অবনীর বাবার খুব পছন্দের ছাত্র ছিল। পড়ার কথা ধরে ঘরের ভেতর অবনীদের যতটা বকা দিত তার সবটা ছিল এই লোকটিকে ঘিরে।
সবসময় ওর উদাহরন ডেকে অবনীদের শাসাত। কিন্তু কে শোনে কার কথা?পড়তে যার ভালো লাগেনা তাকে কি জোর করে পড়ানো যায়?অবনীর বাবা কৌশিককে রেখে দিলেন তাদের দু ভাই বোনের মাস্টার হিসেবে। প্রতিদিন বিকেলে এসে দু,ঘন্টা পড়িয়ে যায়। কথা ছিল এক ঘন্টা;কিন্তু কৌশিক একটু বোকা ধরনের আর শিক্ষক ভক্ততো তাই বেশী সময় থাকে,ফাকিবাজি একদমই দেয়না। তবে কৌশিক না দিলে কি হবে,অবনীরা ঠিকই দিত।
কোনদিন বিকেল বেলা কৌশিক আসার আগেই তারা ঘর পালাত। অন্য সবার সাথে গিয়ে খেলায় জড়ো হত। বেশীর ভাগ দিন এসে দেখা যেত কৌশিক তাদের পেত না,কিছুক্ষন বসে তারপর চলে যেত। তাদের পালানোর এমন ধারা অব্যহত দেখে এখন কৌশিক একটা পথ অবলম্বন করতে শুরু করেছে। ইদানীং দরজায় দাঁড়িয়ে অবনীর নাম ধরে একটা মিষ্টি বাক্য উচ্চারন করে অবনীকে ডাকদেয়।
কোন সাড়া না পেলে আর ভেতরে না ঢুকে সোজা ফিরে যায়। আর যেদিন ভেতর থেকে কারো স্বর শোনা যায় সেদিন থাকে। মুলত অবনী থাকলে সাড়া দেয়,বেচারাকে এত লাই দেয়া ঠিক হবে না ভেবে কষ্ট করে হলেও দু ঘন্টা বসে থাকে। প্রথম যেদিন এ বাক্যটি অবনীর কানে যায়,তার প্রচন্ড হাসি পেয়েছিল!মুখ চেপটে ধরেছিলো,যেন বাহিরে শব্দ না যায়। শুনলে হয়ত বেচারা লজ্জা পেত।
এতে অবশ্য অবনী মজা পেত,হাসি পেলেও কেমন যেন ভালো লাগা কাজ করত। কেমন সরল ভাষায় ডাক,আহা!কোনদিন ইচ্ছে করেও সাড়া না দিয়ে খানিক্খন চুপ থাকত,বেচারার কণ্ঠে আরেকবার শোনার জন্য।
বেশ কিছুদিন পর কৌশিকের সেই মিষ্টি বাক্যের রহস্য জানা গেল!ওটা ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার লাইন। কৌশিক খুব কবিতাপ্রেমী ছিল, বাসায় সজ্জিত বইগুলোর অধিকাংশই কবিতার বই।
২
অন্তিম! অবনীর পাচ বছরের ছেলে;একদম বাবার মতই হয়েছে।
সরলতায় ভরা মায়াবী চেহারা। মায়ের অবাধ্য খুব কম হয়। তবে মাঝে মাঝে মায়ের চোখের আড়ালে এমন কিছু কান্ড ঘটিয়ে ফেলে যেগুলো হয়ত অবনীকে হতবাক করে দেয়/চিন্তাপ্রসুত নয়। এটা অবশ্য শিশুদের ক্ষেত্রেই একটা কমন ব্যাপার। কারন তারা তখনো ভালো মন্দের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেনা।
চোখে যা কিছু সুন্দর লাগে তাই ধরতে ইচ্ছে করে;মনে যেমন বোল ফুটে তাই মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে চায়।
বিছানার উপর মায়ের আচলতলে মাথা রেখে শুয়ে আছে অন্তিম। মা ছেলের মাথার উপর হাতবুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছেন রাজকুমারীর গল্প শুনিয়ে।
বেশ সময় ধরে ছেলেকে ঘুম পাড়ানোর এই চেষ্টা চলে আসছে;অথচ অন্তিমের চোখে ঘুম নেই। একটুর জন্য চোখ বন্ধ করে,মনে হয় এই বুঝি ঘুমিয়ে পড়ল;অবনী গল্প বলা থামিয়ে দেয়।
ছেলে আবার জেগে উঠে। মা,তারপর কি হল?ছেলের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অবনী যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। নিজের ক্রোধ ধরে রাখতে না পেরে অন্তিমকে বকা দেয়। মায়ের প্রকৃত রুপ দেখাতে ব্যর্থ হয়। শিশুদের সাথে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলা উচিত নয়।
তাদের এই সরল সময়টাকে তাদের মত করে কাটতে দেয়া উচিত। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামাবার চেষ্টা করে।
অন্তিমের চোখে ঘুম আসতে খুব বেশী সময় লাগেনি। কান্নার পর তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসে। বাচ্চার ঘুম না আসলে কেউ আবার এই পদ্ধতি অবলম্বন করে ঘুম পাড়াবেন না যেন!ছেলেকে পর্যবেক্ষন করতে গিয়ে অবনীর চোখ পড়ে যায় অন্তিমের হাতে ধরে রাখা ছবির আলবামটির উপর।
বিছানায় বালিশের নিচে ছিল। কখন যে অন্তিম তার হাতে নিয়েছে মনে নেই। কিছুটা হাফ ছেড়ে উঠার মত করে আলবামটা সরিয়ে ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
আলবামে অবনী আর কৌশিকের বেশ কয়েকটি ছবি রয়েছে। ছেলে কৌশিককে দেখলে হয়ত তার বাবার কথা মনে পড়বে আর তখন তাকে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে যা সে এই মুহুর্তে চাইছেনা।
ছেলেকে সে তার মত করে গড়ে তুলতে চায়। এখনি সে পিতৃশুন্যতার কথা ভেবে ভেঙ্গে পড়ুক এ অবনী কোনমতেই চায়না।
……… ৩
মাত্র ছয়মাসের সংসার জীবন। অন্তিম সবে মাত্র গর্ভে এসেছে তখন। যেদিন এ সংবাদটা কৌশিককে প্রথম অবনী জানায়,কৌশিক খুব খুশি হয়েছিল।
এত খুশি হয়েছিল যে অবনী জড়িয়ে ধরে ফুপরে কেদে উঠেছিল।
বেশ জোরে শোরেই গুঞ্জন শোনা গেল অফিসের এক সহকর্মীর সাথে কৌশিকের অন্তরালে কিছু ঘটে চলেছে। ইদানীং বাসায় তার অস্বাভাবিক চলাফেরা গুঞ্জনের সত্যতাকে যেন ভারি করে তুলেছে। কিছু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে,উল্টো অবনীকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। অবনী কিছু বলেনা,চুপ করে তার সামনে থেকে সরে আসে।
তখনো অবনী গুঞ্জনে কান না দিয়ে কৌশিকের উপর দৃঢ়ভাবে নিজের বিশ্বাস রাখল। একদিন দুইদিন তিনদিন কিছুতেই কৌশিকের আচরনে কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। অবনী এবার দৃঢ়ভাবে কৌশিককে চেপে ধরে,-
‘আমি যদি অজান্তে কোন ভুল করে থাকি আমাকে ক্ষমা করে দাও,কিছু বলার থাকলে বলতে পারো,প্লিজ,এভাবে থাকার তো কোন মানে হয় না। ’
কৌশিক কোন কথা বলে না।
অবনী আবার জিজ্ঞেস করে।
এবার কৌশিকের বোল ফুটে-
‘আমাকে ক্ষমা করো!’
‘কেন কি করেছ তুমি?’
কৌশিক কোন কথা বলে না।
‘বিয়ে করেছ?’
কৌশিক চুপ থাকে!মৌনতা সম্মতিকে প্রশ্রয় দেয়,অবনীর বুঝতে দেরি রইল না।
‘অফিসের ঐ মেয়েটিকে?’
কৌশিক মাথা তুলে অবনীর দিকে তাকায়। আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত খবর শুনেও অবনী যেন পুর্বের মত অটল;ভেঙ্গেও মচকায়নি;কৌশিকের সরলতা বলছে তার ভুলের জন্য সে অনুতপ্ত। সে অবনীকেও ছেড়ে যেতে রাজি নই আবার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকেও ছাড়তে পারছেনা; বিগত সাতদিনের চলাফেরায় তার এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বহুবার।
‘তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি অনেক বড় ভুল করেছ?’
কৌশিক কোন কথা বলে না।
‘একটি বার আমার কথা চিন্তা করোনি?কিভাবে পারলে তুমি?ছি!তুমি কিভাবে বুঝবে আমার মনের অবস্থা?আমি যদি এমন কান্ড ঘটাতে পারতাম তাহলে অনুধাবন করতে পারতে নিজের মনের জ্বালা। আমার সকল চাওয়া পুরনের পেছনে তোমার এই কাহিনী লুকিয়ে আছে জানতাম না। পৃথিবীর কোন স্ত্রী-ই তার স্বামীর কাছে এই একটি প্রত্যাশা করেনা। আভিজাত্যের মোহ থেকে আমাকে দূরে রাখবার জন্য কই একবারও তো তোমাকে কঠিন হতে দেখেনি?অগাধ ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে স্ত্রীর সব কথায় কখনো সমর্থন দিতে হয়না।
তোমার কঠিন অবস্থা দেখার জন্যই রোজ নতুন বায়না ধরতাম,অথচ তুমি মিষ্টি হাসি দিয়ে আমার কথায় সায় দিয়ে চলে যেতে আর অচিরেই তা পুরন করে দিতে। তুমি কি জান,তখন তোমার ঐ মিষ্টি হাসিটি আমার কাছে অনেক কুৎসিত লাগতো!চাওয়া মাত্রই তোমার পুরন করে দেবার স্বভাব আমার স্বভাবকেও বদলে দিয়েছে,তাই আমিও সময়ে অসময়ে নতুন বায়না নিয়ে তোমার সামনে হাজির হতাম। আজ সবটুকু প্রতিদান তুমি একসাথে দিলে।
আমি আর কিছুই চাইবোনা,শুধু তুমি হলেই চলবে;প্রমোশনের দরকার নেই। কালই তুমি সব কিছু মিমাংসা করে দাও!এমন ঘটনার পর পৃথিবীর কোন স্ত্রী তোমাকে ক্ষমা করবে কি না জানিনা,তবে যেহেতু এর মুলে আমারও কিছু না কিছু অপরাধ আছে তাই আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।
কোন বিহিত করতে পারলে তবেই বাসায় ফিরে এসো না হয় আমি-ই বেরিয়ে যাবো। তোমার অনাগত সন্তানের ভারটা তোমার উপরই থাকলো। ’
না,আর ফিরে আসেনি কৌশিক!
অবনী নিজেকে শক্ত করে আজো বেচে আছে। পণ করেছে আর কোন পুরুষের ছোয়া সে নিবেনা। অন্তিমকে নিয়েই জীবনের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত পাড়ি দিবে।
৪
……আলবামটি দেখে যেন কৌশিককে অবনীর খুব মনে পড়ে গেল। যত ক্ষোভ,অভিমান, যাই থাকুক না কেন স্মৃতির পাতা জুড়ে এত বিশাল জায়গা করে আছে কেমনে ভোলা যায় তারে। মনের ব্যাকুলতা সইতে না পেরে ক্ষোভ,অভিমান আর ঘৃনাকে দূরে ঠেলে আলবামটি নিয়ে বারান্দায় দুলতে থাকা শুন্য হেলানো চেয়ারে গা মিলিয়ে দেয়। ছবির প্রতিটি পাতা দেখে অবনী মুহুর্তের জন্য নিজেকে সে ছবির সাথে মিলিয়ে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। কোন ছবি মনে করিয়ে দেয় বিয়ের আগের ঘুরে বেড়ানোর কতশত লুকানো দিনের স্মৃতি।
কোন ছবি মনে করিয়ে দেয় মধুর অভিজ্ঞতায় ভরা বিয়ের সেই প্রথম রাতের কথা।
নিজেদের মধুর সময়কার স্মৃতি রোমন্থনের ফাকে জলে অবনীর চোখ ভারি হয়ে আসে। একটি একটি করে আলবামের ছবির পাতা উলটে যাচ্ছে আর একটি করে অবনীর চোখের জল আলবাম ভিজিয়ে যাচ্ছে। আজ বহুদিন পর অবনীর কৌশিককে খুব মনে পড়ছে। দেখতে ইচ্ছে করছে।
এখনো কি সে বাবড়ী দোলানো চুল নিয়েই আছে?নাকি কেটে ছোট ছোট করেছে?আচ্ছ!ছোট চুলে কৌশিককে দেখতে কেমন লাগে?পাঞ্জাবী পরলে কৌশিককে খুব মানাত!এখনো কি বোকাটা পাঞ্জাবীর হাতা উপরে টেনে ছোট করে রাখে?অবনীর তা পছন্দ না,স্বাভাবিক ভাবে পাঞ্জাবী পরাই অবনীর ভালো লাগতো তাই অবনী কখনো কৌশিককে হাতা উপরে টানতে দিতনা। অবনী আর কৌশিক কোথাও ঘুরতে গেলে তাদের পোশাক হত শাড়ি আর পাঞ্জাবী।
কাল অন্তিমের তিন বছর হবে। ছেলেটাকে কখনো বাবা ডাক শিখায়নি অবনী। আচ্ছা!অন্তিমের মুখে বাবা ডাকটা কেমন শোনাবে?কৌশিকের অনুভুতিটা তখন কেমন হবে?
কৌশিক এর আগেও কয়েকবার এসেছে।
চিরচেনা ডাকে অবনীকে বহুবার ডেকেছে,অবনী সাড়া দেয়নি। বাহির থেকে কথোপকথোনেই কৌশিককে বিদায় নিতে হয়েছে। আজ খুব মনে পড়ছে কৌশিককে। অবনী ভাবে কৌশিক যদি সব কিছু ছেড়ে আবার ফিরে আসে!কত না উচ্ছ্বাস ফিরে পাবে এই সংসার!আলবামে আরো কত ছবি যোগ হবে। প্রতিটি ছবি হবে নতুন সাজে,দুজনের মাঝে অন্তিমের হাসিমাখা চেহারায় প্রতিটা ছবি হয়ে উঠবে অন্তিমময়।
শব্দ শোনা যাচ্ছে,কোথাও থেকে সেই চিরচেনা মিষ্টি স্বরের ধ্বনি ভেসে আসছে, অবনী চমকে উঠে।
‘ঠক!ঠক!...!
অবনী বাড়ি আছ?’
অবনী দৌড়ে গিয়ে দরজার পানে দাড়ায়। তখনো শব্দ হচ্ছে-
ঠক!ঠক!
অবনী,বাড়ি আছ?
মন কি চাইছে অবনী জানেনা। এতক্ষন ধরে অবনী কৌশিককে মনে প্রানে চেয়েছিল। কিন্তু এখন যেন অবনী কি করবে বুঝতে পারছেনা।
অবনীর শব্দহীন বোবা উক্তি কি বলছে- অবনী বাড়ি নেই!
শব্দ থেমে যায়। ওপাশ থেকে আর কোন আওয়াজ আসছেনা। সাড়া না পেয়ে কৌশিক ফিরে গেছে।
অবনী ঠুকরে কেদে উঠে।
অবনীর কান্নার ভাষা হয়ত চিৎকার করে বলছে-
অবনী বাড়ি আছে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।