আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি। ঘন জঙ্গলের বুক চিড়ে চলে গেছে পাহাড়ি রাস্তা। দু’পাশে সারি সারি গাছ। তার মধ্য দিয়ে মধ্য দুপুর কিংবা সোনাঝরা সকাল অথবা বিকেলের নরম আলোয় বন দেখার যে আনন্দ সেটা উপভোগ করতে লাউয়াছড়ায় একবার যাওয়া চাই-ই।
শুধু গাছগাছালি নয় সেখানে আছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি। বিলুপ্ত প্রায় উল্লুকের সবচেয়ে বড় বিচরণক্ষেত্র লাউয়াছড়া। আছে ১৫৫ প্রজাতির পাখি। সব মিলিয়ে বিস্ময়ের ঘোর লাগা বন লাউয়াছড়া।
‘একটি কুঁড়ি দু’টি পাতা রতনপুর বাগিচায়’ : ভুপেন হাজারিকার এই গানটি রতনপুরের জন্য হলেও শ্রীমঙ্গলের সাথেও রয়েছে আশ্চর্য মিল।
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল চা চাষের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে অনেকে আগেই। ছোট ছোট পাহাড় আর টিলার গায়ে গড়ে ওঠা চায়ের বাগান। সেখান থেকে চা পাতা তুলে বাগানের ভেতরের কারখানায় প্রসেস করা হয়। চা শিল্প ঘিরে শ্রীমঙ্গলের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। শুধু তা-ই নয়, দেশ-বিদেশের দৃষ্টি এখন লাউয়াছড়ার প্রতি।
গবেষকেরা এখানে আসছেন জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করার জন্য। তারা জীব নিয়ে গবেষণার পাশপাশি লাউয়াছড়া রক্ষার বিষয়ে কথা বলছেন। একটি পাতা দু’টি কুঁড়ির দেশ হিসাবে খ্যাত শ্রীমঙ্গলের এখন দেশের অন্যতম রিজার্ভ ফরেস্ট লাউয়াছড়ার খ্যাতি বাড়ছে। পর্যটকেরা আসছেন। কিন্তু কী দেখার আছে লাউয়াছড়ায়? কেনই বা লাউয়াছড়া এত বিখ্যাত! এ বিষয়ে বিশেষ কিছু তাদের আমলে নেই।
এমনটা মনে করেন সেখানে ঘুরতে আসা অনেকেই। তবে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার আগে কিছু বিষয় জেনে নেয়াা ভালো বলেই ট্যুর অপারেটরেরা মনে করেন। নইলে হতাশ হতে হবেÑ এটাই স্বাভাাবিক।
লাউয়াছড়ার অবস্থান : মৌলভীবাজার জেলা শহরে ঢোকার আগেই শ্রীমঙ্গল শহর। চা পাতার শহর হিসেবে খ্যাত।
এর পাশেই লাউয়াছড়া। শহর থেকে আট কিলোমিটার রাস্তা। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে সেখানে যেতে সময় লাগে ১০ মিনিট। রাস্তার দু’পাশে চা বাগান, পাহাড়ি ছড়া আর কর্র্মচঞ্চল মানুষের দিনভর ব্যতিব্যস্ততা। এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে গাড়ি ঢুকে যাবে সবুজের রাজ্যে।
দু’পাশে ঠাসা ঘন সবুজের সমারোহ। ঢুকতেই ‘স্বাগতম লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক’ লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়বে যে কারো। দু’পাশে ঘন অরণ্য আর তার মধ্যে বন বিভাগের কয়েকটি ঘর। পার্কের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে রেললাইন। দু’ভাগ করে দিয়ে গেছে বনকে।
স্থানীয় লোকজন এটাকে বলে থাকে রেইন ফরেস্ট। লাউয়াছড়া বনও বলে থাকেন কেউ কেউ।
লাউয়াছড়ায় কী আছে… : জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম। এশিয়াটিক সোসাইটির ‘এনসাইকোপিডয়া অব ফোরা অ্যান্ড ফনা অব বাংলাদেশ’-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কাজ করার সুবাদে তিনি দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চল ঘুরেছেন। তার মতে, বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের সবচেয়ে বেশির বাসস্থান লাউয়াছড়ায়।
এ ছাড়া দেড় শ’রও বেশি প্রজাতির পাখি আছে সেখানে। তিনি বলেন, উল্লুক দেখার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা লাউয়াছড়া। সহজে উল্লুকের দেখা মিলবে সেখানে। বিলুপ্তপ্রায় এই উল্লুক সারা দেশে উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান। বিপন্ন বন মানুষ হিসেবে উল্লুককে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ সঙ্ঘ উল্লুককে বিপন্ন প্রাণি হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিশ্বে উল্লুকের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাওয়ায় সঙ্ঘটি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে উল্লুক এখন প্রান্তিক বিপন্ন প্রাণি। তাই লাউয়াছড়ায় উল্লুক সংরক্ষণে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের উল্লুক নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন একজন পেট্রা অস্ট্রেবার্গ।
তিনি ফিনল্যান্ডে জীববৈচিত্র্য নিয়ে পড়াশোনা করছেন। এর অংশ হিসেবে তিনি বাংলাদেশের উল্লুকের ওপর কাজ করেছেন। এর আগে তিনি থাইল্যান্ডেও এ নিয়ে কাজ করেন। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম লাউয়াছড়ায় এ মুহূর্তে কত উল্লুক আছে? তার দেয়া তথ্য মতে, লাউয়াছড়ায় ১৬টি উল্লুক পরিবার আছে। এসব পরিবারের সদস্য হিসেবে ৫৯টি উল্লুক আছে।
বনের আকার অনুযায়ী সেখানে এর চেয়ে বেশি উল্লুক বাস করতে পারে না বলেই অভিমত করেন পেট্রা।
উল্লুক সম্পর্কে জীববৈচিত্র্যবিষয়ক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, এরা মূলত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র বনমানুষ। এরা বানরের চেয়ে আলাদা । তাদের লেজ নেই। মাথায় মগজের পরিমাণ বেশি।
শৈশব বেশি দিনের। মেয়ে উল্লুকেরা প্রতি দুই থেকে তিন বছর পর একটি করে বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চাকে দু’বছর বহন করে। জীবনে পাঁচ থেকে ছয়টি বাচ্চা জন্ম দেয় উল্লুক। বাঁচে ৩০ বছর পর্যন্ত।
উল্লুক বহুগামী নয়। তারা ছেলে বা মেয়ে উল্লুক স্থায়ী সঙ্গী নির্বাচনের আগে সন্তান জন্ম দেয় না। জীবন যাপন করে পরিবারকেন্দ্রিক। এদের খাদ্য ফলমূল। ডুমুর তাদের সবচেয়ে প্রিয়।
উল্লুকদের বাস করা বনে প্রচুর ফল থাকাটা জরুরি। প্রতিটি উল্লুক পরিবারের জন্য একটা নির্দিষ্ট এলাকা আছে। কোরাস গানের মধ্য দিয়ে আধিপত্য ঘোষণা করে তারা। এই ঘোষণার পর সেখানে অন্য উল্লুক আবাস গড়ে না। নিরাপত্তার জন্য তারা উঁচু ডাল থেকে নেমে আসে না।
গাছ কাটা মানেই এদের বিপর্যয় ডেকে আনা।
এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মিলে লাউয়াছড়ায়। প্রাণিবিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন এ নিয়ে। তাই এখনই এর প্রজাতির সংখ্যা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়Ñ জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এ ছাড়া ফরেস্ট বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, সেখানে এ মুহূর্তে আছে ১৫৫ প্রজাতির পাখি।
পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে লাউয়াছড়া। কোরোফন বা অজ্ঞান গাছ হিসেবে যেটাকে এতদিন কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল সেটা চলতি বছরে ঝড়ের তোপে পড়ে গেছে। ‘অজ্ঞান’ গাছ নামকরণ স্থানীয়দের। এটি বাংলাদেশের একমাত্র গাছ বলেই ধরে নেয়া হয়ে থাকে। ঝড়ে পড়ে যাওয়ার পর সেটা কেটে সরিয়ে ফেলতে হয়েছে।
এখন নতুন করে একই প্রজাতির আরেকটি গাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। আছে বাঘ, কাঠবিড়ালি, গুঁই সাপ। গাছে উল্লুকের খেলা দেখে কিংবা পাখির ডাক না শুনে লাউয়াছড়া থেকে ফেরার উপায় নেই বলে বন বিভাগ থেকে বলা হয়েছে।
লাউয়াছড়ার ইতিকথা : লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক মূলত পশ্চিম ভানুগাছ বনাঞ্চলের অংশ। ১৯৪৭ সালের জীববৈচিত্র্য আইনের অধীনে ১৯৯৬ সালে এটিকে একটি স্বতন্ত্র পার্ক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
এর পর এখন এটি সরকারের পাঁচটি পাইলট প্রকল্পের অধীনে আছে। ‘নিসর্গ’ শিরোনামের এই প্রকল্প সরকার ও ইউএসএইড যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে। এক হাজার ২৫০ হেক্টর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই পার্ক।
যাবেন কিভাবে : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার আধার লাউয়াছড়া পর্যটকদের ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে। বছরের যেকোনো সময় যাওয়া যায় সেখানে।
ঢাকা থেকে সিলেটগামী বাসে যাওয়া যাবে লাউয়াছড়ায়। এ জন্য শ্যামলী, কল্যাণপুর, ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ থেকে যাওয়া যাবে সেখানে। এসি, নন-এসি দু’ধরনের পরিবহন আছে। নিজস্ব বাহনেও যাওয়া যাবে। ট্রেনেও যাওয়া যাবে শ্রীমঙ্গল।
তবে গণপরিবহনে নামতে হবে শ্রীমঙ্গল শহরে। সেখান থেকে থেকে বাসে ১০ টাকা অথবা ২০ টাকায় জিপে যাওয়া যাবে লাউয়াছড়া।
থাকবেন কোথায় : লাউয়াছড়া বেড়াতে গেলে থাকার জন্য খুব ভালো হোটেল নেই শ্রীমঙ্গলে। তবে শহরে বেশ কিছু হোটেল আছে। আগে থেকে বুকিং না দিয়ে সেখানে গিয়েই পছন্দ মতো হোটেলে থাকতে পারেন।
ভাড়া ১০০০ টাকার মধ্যে। এর বাইরে টি গার্ডেন রেস্ট হাউজ এবং টি গার্ডেনের বাংলো আছে। তবে সেটা ঢাকা থেকে আগে বুকিং করে যেতে হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।