আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: মাধুররি সাথে সারারাত

গতকালের পর: শেষাংশ... মাধুরি আমার আরও কাছে সরে আসে। আমি তার শরীরের উষ্ণতা পাই, নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই, প্রসাধনের ঘ্রাণ পাই। আমার শরীরে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়, আমার কণ্ঠস্বরে জড়তা বেড়ে যায়, আমার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যায়। সে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণভাবে জানতে চায়, ‘তুষার বাবু! ঘুমাতে যাবে না? বাতিটা নিভিয়ে দেবো?’ আমি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে তাড়াতাড়ি বলি, ‘সমীরণ বলেছিল, হোমস্টেতে হোটেলের চেয়ে অনেক কম খরচে থাকা যায়। ’ আমার নিজের কণ্ঠ নিজের কাছেই অস্বাভাবিক মনে হয়।

‘সমীরণ কে?’ ‘আমার বন্ধু, স্কুলে আমরা এক সাথে পড়েছিÑ এখন মালদায় থাকে। ’ ‘আপনার বন্ধুটি ঠিকই বলেছে। স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ড থেকে টুরিস্ট পিক করে যারা বাড়িতে নিয়ে আসে মোস্ট অফ দেম আর পুয়োর, জাস্ট লাইক মি। এক রাতের জন্যে তারা জিয়াদা সে জিয়াদা পাঁচ থেকে দশটাকা পার পারসন পেলেই খুশি। বাট ইফ আই গিভ ইউ মোর হোয়াই ডোন্ট ইউ পে মি মোর মাই ডিয়ার?’ মাধুরির প্রশ্নের উত্তরে কী বলা উচিৎ আমি বুঝতে পারি না, শুধু একটু বুঝতে পারি আমি একটা জটিল জালে জড়িয়ে পড়েছি।

এই অচেনা শহরে আধো অন্ধকার রাতে কনকনে ঠা-ার মধ্যে ইচ্ছে করলেও বেরিয়ে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। এমনিতে মেয়েটি দেখতে শুনতে যথেষ্ট ভাল। শিক্ষাদীক্ষা আছে, রুচি পছন্দও খারাপ নয় আর বংশ পরিচয়, বিশেষ করে মাতৃকূলের সূত্রে তাকে আমার খুব কাছের মানুষ বলে ভাবতেই ভাল লাগছিল। কিন্তু তার পেশাÑ নিশ্চয়ই এই পেশা সে বাধ্য হয়েই বেছে নিয়েছেÑ আমাদের স্বাভাবিক কথোপকথনের মাঝেখানেও একটা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাকে নিরুত্তর দেখে সে আমার থুতনি ধরে নাড়া দিয়ে বলে, ‘কী মশাইÑ ভাবছো এমন একটা মেয়ের পাল্লায় পড়েছি, ইয়ে তো ছোড়েগি নাহি! কি বলো ঠিক বলেছি কিনা? ‘না ঠিক তা নয়...।

’ ‘ইনফ্যাক্ট তুমি কিভাবে এসকেপ করতে, আই মিন আমার কাছ থেকে পালাতে পারো সে কথাই ভাবছো। ভয় নেই তোমাকে আমি রাত দুপুরে ঠা-ার মধ্যে বাইরে বের করে দেবো না। বের যদি করতেই হয় ভোরবেলা তোমার টাকা পয়সা রেখে দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে আসবো। ’ আবার সেই খিলখিল হাসি হেসে ওঠে মাধুরি। আমি মনের মধ্যে সাহস আনার চেষ্টা করে বেশ জোর দিয়ে বলি, ‘আমি আসলে তেমন কিছুই ভাবছি না আর তাছাড়া টাকা পয়সাও আমার কাছে তেমন বেশি কিছু নেই।

’ ‘তাহলে আর ভাবনা কিসের, চলো ঘুমানো যাক। ’ আমার আধশোয়া শরীরের উপর কম্বল টেনে দিয়ে সে নিজেও কম্বলের তলায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। আমি পুরোপুরি উঠে বসে বলি, ‘তোমার কি ঘুম পাচ্ছে? আমরা বরং আর কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি। ’ ‘তুমি চাইলে কথা আমি সারারাত বলতে পারবো। সকালে আমার কোনো কাজ নেই।

কিন্তু আমার প্রথম কথা হলোÑ অন্য কোথাও না গিয়ে তুমি দার্জিলিং এলে কেন?’ ‘একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি। তার সাপোর্ট পেলে হয়তো একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ওই যে প্রথমেই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম রুংটুং রোড...’ আমি পুলওভারের ভেতর দিয়ে সার্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঠিকানাটা বের করে আনি। চিরকূট হাতে নিয়ে এক পলক দেখেই মাধুরি জানতে চায়, ‘ডাক্তার জে পি নন্দী কি তোমার আত্মীয়?’ ‘ঠিক আত্মীয় না, বড়ভাই মানে আমার দাদার খুব ক্লোজ বন্ধু। তুমি চেনো?’ ‘দাদার কাছে নাম শুনেছি, এক সময় ওরা সব এক সাথে পলিটিক্স করতো।

’ ‘তারপর?’ ‘তারপর আর কি! পলিটিক্সে যা হয়... দল ভাঙাভাঙি হয়ে দাদা নকশালদের সাথে ভিড়ে গেল। বিএ পাশ করে অনেকদিন স্রেফ বসে ছিল, ঠিকঠাক কোনো কাজ নেই, রুজি নেই। সিআরপি জানো তোÑ সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ। তো... সিক্স মান্থস আগে সিআরপি দাদাকে তুলে নিয়ে গেছে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। ’ আমার মন খারাপ হয়ে যায়।

মাধুরি তার দাদা এবং বাবা মার সাথে কখনও দেখা হয়নি... এদের কাউকে চিনি না... এই পরিবার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না তারপরেও আমার খারাপ লাগে। ‘তুমি পড়াশোনা করোনি?’ ‘পড়েছিলাম। দার্জিলিং-এর ভার্জিন মেরি ইংলিশ স্কুলে পড়েছি, ম্যাট্রিকও পাশ করেছিলাম। তারপর বাবাটা বিনা নোটিশে মরে গেল, লেখাপড়াও খতম!’ ‘এই বাড়িটা কি তোমাদেরÑ আই মিন নিজেদের নাকি ভাড়া?’ ‘থাকার মধ্যে এই বাড়িটাই আছে, তা না হলে তো পথে বসতে হতো। বাবা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং-এ এসে সেটল করার পরে এই শেলটারটুকু করে গেছেন।

’ কিছুক্ষণ আমরা কেউই কোনো কথা বলি না। নিরবতা ভেঙে মাধুরিই আবার বলে, ‘আচ্ছা... এসব কথা আমি তোমাকে বলছি কেন! ইনফ্যাক্ট আমি আমার গেস্টদের সাথে কোনো কথাই বলি না। ’ ‘যে কোনো কারণেই হোক, অনেক কথাই তো তুমি বলেছো। আর একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’ কম্বলের ভেতরে পা দুটো রেখেই মাধুরি উঠে আমার মুখোমুখি বসে। আমি কি অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা বলে অকারণে তার সময় নষ্ট করছি বলে সে ক্রমশ বিরক্ত হচ্ছেÑ না কি সে জিজ্ঞাসার ধরনটা বুঝতে চেষ্টা করছে! ‘প্রশ্ন করতে পারো।

বাট... প্লিজ ডোন্ট আস্ক মি হোয়াই ডিডন্ট আই গেট ম্যারিড, কেন বিয়ে করিনি অথবা আমি বিয়ে করছি না কেন!’ ‘নাÑ সে প্রশ্ন তোমাকে আমি করবো না, কিন্তু একটা প্রশ্ন তো করতেই পারিÑ এই হোমস্টের অতিথি আপ্যায়ন করে দার্জিলিং এর মতো শহরে একটা পরিবার কি চলতে পারে?’ ‘অনেকেই তো চলছে। টুরিস্ট সিজনে ওয়েদার ভাল থাকলে গেস্টের কোনো অভাব হয় না। আর আমি সব সময় তোমার মতো গেস্ট খুঁজে বের করতে চেষ্টা করি। ’ মাধুরি তার একহাত দিয়ে আমার এলোমেলো চুল আরও এলোমেলো করে দেয়। আমার মেরুদ- বেয়ে আরও একবার একটা হিমবাহ নিচের দিকে নেমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

আমার মতো অতিথি বলতে আসলে সে কি বোঝাতে চেয়েছে আমি বুঝতে পারি না। তাই চুপ করে থাকি। আমার চেহারা অথবা জামা কাপড় থেকে সে কি ধরে নিয়েছে আমার টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই! অবশ্য তার কথা থেকে আমি অনুমান করতে পারি, এক রাতের জন্যে এই মেয়ের চাহিদা পূরণ করার মতো যথেষ্ট টাকা এখনও আমার কাছে আছে। আমাকে নিশ্চুপ এবং একই সঙ্গে শীতল দেখে মাধুরি নিজেই বলে, ‘আমি তো অনেক কথা বলেছি আমার সম্পর্কে। হোয়াই ডোন্ট ইউ ওপেন আপ ইয়ার?’ ‘আমার আসলে বলার মতো তেমন কিছু নেই।

ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষা দিয়ে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দেয়ার জন্যে রাজশাহীতে থেকে গিয়েছিলাম। দেশে যুদ্ধ শুরু হবার পর রাস্তাঘাট সব বন্ধ হয়ে হয়ে গেল। বাড়ি ফেরাটা যখন অসম্ভব মনে হলো, তখন বর্ডার পার হয়ে প্রথমে মুর্শিদাবাদ তারপরে রানাঘাটের শরণার্থী শিবির এবং শেষপর্যন্ত মালদা হয়ে এখন এখানে। ’ ‘তার মানে তুমি পালিয়ে এসেছো। দেশে তোমার আপন লোকেরা পাকিস্তানিদের গুলি খেয়ে মরছে, বাবা মা ভাই বোন হয়তো এ্যাংশাসলি লুকিং ফর ইউ।

এখানে বন্ধুরা অস্ত্র নিয়ে লড়াই করতে নেমে গেছে। আর তুমি এখানে একজন পলিটিক্যাল দাদার খোঁজে এসেছো। সে তোমাকে একটা কাজ জুটিয়ে দেবে... যুদ্ধ যতোদিন চলে তুমি দিব্যি আরামে কাটিয়ে দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরে যাবে। ’ মেয়েটি কথাগুলো হালকাভাবে বললেও আমার কোথায় যেনো বড় রকমের আঘাত লাগে। আমার মনে হয় সে অনধিকার চর্চা করছে।

আমি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠি এবং সেই ক্ষোভের একটি অসংলগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ‘আমার প্রকৃত পরিচয় জানলে তুমি হয়তো আমার সাথে রাত কাটাতে চাইতে না। আমার নাম তুষার তালুকদার ঠিকই, বাট আই এ্যাম এ মুসলিম। ’ অশ্লীল অথবা সবার সামনে উচ্চারণযোগ্য নয় এমন অনেক শব্দ যেমন আমরা ইংরেজিতে উচ্চারণ করি তেমনি মুসলমান হিসাবে নিজের পরিচয় দেবার সময় আমি ভাষা বদলে ফেলি। দেশে যা চলছে তাতে মুসলমান হিসাবে পরিচয় দেয়ার মধ্যে গৌরবের কিছু নেই।

আমার কথা শুনে আবারও খানিকটা সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে মাধুরি। সে কি আমার চেহারা থেকে আমার নৃতাত্ত্বিক পরিচয় উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছিল! দীর্ঘ নিরবতা ভেঙে এক সময় বলে, ‘তুমি কি মনে করো আমি হিন্দু মুসলিম, জাতি ধর্ম, রং চেহারা বিচার করে গেস্টদের বিছানায় যাই? লিসনÑ আই এ্যাম ওয়ান অফ দ্য চিপেস্ট রান্ডি অব দ্য টাউন। ইউ পে মানি এ্যান্ড এনজয়। আই এ্যাম ফাইটিং ফর লিভিং এ লাইফÑ টু সারভাইভ, জিনে কে লিয়ে, শুধু বাঁচার জন্য লড়াই করছি। ’ আমি চিরকালই বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই।

দেশে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়েছি এখানে একজন সামান্যা নারীর কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বেঁচে যাই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার পালাবার কোনো উপায় নেই। ঘরের ভেতরের উত্তাপ এবং বাইরের শৈত্যপ্রবাহÑ কোনোটাই আমার এখান থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার অনুকূলে নয়। সে জন্য অন্তত আগামীকাল ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমি ক্রমেই ভাবনার অতলে তলিয়ে যাচ্ছিলাম।

আমার চেহারায় ফুটে ওঠা অসহায় আক্ষেপ অভদ্রজনোচিত বিরক্তিতে রূপান্তরিত হলে এক সময় মাধুরি অসহণীয় নিরবতা ভেঙে বলে ওঠে, ‘আজকের রাতটা তোমার এখানেই থেকে যেতে হবে। যা ডিসিশান নেবার, ইউ উইল হ্যাভ টু টেক দ্যাট টুমরো মর্নিং। ’ আমি এবারে ভবিতব্যের হাতে এবং আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায় মাধুরি নামের একজন অজ্ঞাতকূলশীল নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে ফেলি। কম্বলটা আর একবার আমার শরীরের উপর টেনে নিয়ে শোবার চেষ্টা করতেই মাধুরি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। ‘তুমি নিশ্চয়ই ড্রিংক করো না? আই মিন কখনও করেছ বলে মনে হয় না।

’ ‘একেবারে কখনও করিনি তা নয়, ওয়ান্স আই ট্রাইড হুইস্কি আরেকবার বিয়ার। বাট আই ডিডন্ট লাইক, কোনোটাই আমার ভাল লাগেনি। ’ ‘গুড। আমার এখানে ড্রিংকসের কোনো ব্যবস্থা নাই। কিন্তু চা খেতে পারো, দার্জিলিংএর চায়ের খুব নাম আছে জানো তো?’ ‘এই এতো রাতে আবার চাÑ সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বানাতে হবে? ‘তুমি যদি সারারাত শুধু কথা বলে কাটাতে চাও, তাহলে একটু চায়ের খুব দরকার আছে।

ইট উইল টেক ফাইভ মিনিটস ওনলি। ’ আমাকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে মাধুরি ভেতরে চলে যায়। আমার অবশ্য বলার কিছু ছিল না, তাছাড়া আমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে আছিÑ যা হবার হয়ে যাক! পাঁচ মিনিটে না হলেও অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দু হাতে দুই মগ ধোঁয়াওড়া চা নিয়ে সে ফিরে আসে। একটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এবারে বিছানায় না বসে মগটা টেবিলে রেখে সে চেয়ারে বসে। এক হাতে মগের হাতল এবং অন্য হাতে মগটা চেপে ধরে আমি উষ্ণতা অনুভবের চেষ্টা করি।

মগের সেই উষ্ণতায় নাকি চায়ের ঘ্রাণে, একটি দীর্ঘ চুমুক দেবার সাথে সাথেই আমার মন ভাল হয়ে যায়। আমি বলেই ফেলি, ‘তোমার চা’টা খুব ভাল হয়েছে। ’ ’ক্রেডিট মেইনলি গোজ টু দার্জিলিং টি। ’ বলেই সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানতে চায়, ‘আচ্ছা তোমাদের দেশে তো পাহাড় নেই... তোমরা নিশ্চয়ই টি প্রোডিউস করো না?’ ’কথাটা ঠিক নয়। আমাদের দেশে পাহাড় পর্বতের উচ্চতা খুব বেশি না হলেও পাহাড় আছে এবং চা বাগানেরও অভাব নেই।

ঠিক দার্জিলিংএর মতো না হলেও আমাদের সিলেটের চায়ের সুনাম আছে। ’ চা সম্পর্কিত আলোচনা এবং মগের চা ফুরিয়ে যাবার পরেও আমরা কথা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করি। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক কথা বেশি দূর এগোতে চায় না। আমি প্রতি মুহূর্তে আশা করতে থাকি মাধুরি আবার বিছানায় আমার পাশে এসে বসবে। সে কথা বলে, আমার ট্রাভেল ব্যাগটা মেঝে থেকে টেবিলে তুলে রাখে এবং শূন্য কাপ দুটো নিয়ে ভেতরে রেখে এসে আবার চেয়ারে বসে কিন্তু কাছাকাছি আসার কোনো কোনো আভাস তার মধ্যে দেখতে পাই না।

আমি জানি, একটু হাত বাড়িয়ে দিলেই সে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার ভেতরের আজন্ম লালিত সংস্কার নিজের থেকে সেই উদ্যোগটা নিতে আমাকে বাধা দিচ্ছে। আমাকে অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকতে দেখে মাধুরি নিজেই জিজ্ঞেস করে, ‘কি তুষার বাবুÑ ঘুম পাচ্ছে?’ ‘ঠিক ঘুম পাচ্ছে না, তবে রাত যতো বাড়ছে ঠা-াটাও মনে হয় বেড়ে যাচ্ছে। ’ ’মিড নাইটের পরে গ্রাজুয়ালি ইট বিকামস কোল্ডার। দাঁড়াওÑ তোমাকে আরও একটা ব্লাংকেট এনে দিচ্ছি।

’ ভেতর থেকে একটা কম্বল হাতে ফিরে এসে আমার গায়ে টেনে দিয়ে বলে, ‘এবারে তুমি ঘুমাও, আমি বাতিটা বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছি। ’ আমার মনে হয় এটাই শেষ সুযোগ। এখনও তাকে ফেরানো না গেলে সে সত্যি সত্যিই আলো নিভিয়ে ভেতরে কোনো অদৃশ্য ঘরের অদেখা বিছানায় ঘুমিয়ে পড়বে, সকালের আগে আর তার সাক্ষাত পাওয়া যাবে না। মাধুরিকে কাছে পাবার অদম্য আকাক্সক্ষা স্বত্ত্বেও আমি শুধু বলি, ‘তুমি ঘুমাবে না?’ আমার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই কাছেই অচেনা লাগে। আমার ভেতরের অস্থিরতা মাধুরি তার অভিজ্ঞতা দিয়ে সহজেই ধরে ফেলে।

‘ঘুমাবো নিশ্চয়ই, বাট আই ডোন্ট ফিল লাইক স্লিপিংÑ আভিতক নেহি। তোমার কাছে তো ঘুমাতে নেবে না, কি করা যাবেÑ মা’র সাথে ঘুমিয়ে যাব। ’ ‘আমার সাথে ঘুমাতে পারবে নাÑ তা কিন্তু আমি বলিনি। তবে...’ কথাটা আমি শেষ করতে পারি না তার আগেই সে ধরে ফেলে, ‘...তবে এটা হবে ভেরি ইনোসেন্ট কাইন্ড অফ স্লিপিং। লাইক এ চাইল্ড... স্লিপিং ইন হিজ মাদারস ল্যাপ।

... জাস্ট এ মোমেন্ট, আই এ্যাম কামিং। ’ আকস্মিকভাবে মাধুরি ভেতরে চলে যাবার পরে সময় যেনো আর ফুরাতে চায় না। আমার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হতে থাকে এবং এক সময় মনে হয় সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। না ঘুমিয়ে পড়ে সে কী কী করতে পারে তাও আমি ভাবতে চেষ্টা করি। হয়তো ঘুমাতে যাবার আগে রাতের হালকা প্রসাধন সেরে নিচ্ছে।

আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে বসেছে অথবা বাইরের পোশাক বদলে ঘরের জামা কাপড় পরছে। হতে পারে আগামীকাল সকালের জন্য ঘরকন্নার কিছু কাজ এখনই সেরে রাখছে। আরও পাঁচ-সাত রকমের ভাবনা ভেবে আমি যখন ভাবনার খেই হারিয়ে ফেরেছি তখন ঘরে ঢুকেই একমাত্র আলোটা সে নিভিয়ে দেয়। নিñিদ্র অন্ধকারে বিছানায় আমার পাশে এসে বসার পরেও মাধুরির চেহারা আমি দেখতে পাই না। কিন্তু তার উষ্ণ কোমল উপস্থিতি আমাকে দ্রুত আচ্ছন্ন করে ফেলে।

জীবনে প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পারি, একাকী একটি হিমেল রাতে দুটি কম্বল যতোটা উত্তাপ ছড়াতে পারে তারচেয়ে দুজন মানুষ কম্বল ছুঁড়ে ফেলে শুধু পরস্পরকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। মাধুরি তার খোলা বুকের মধ্যে আমার মাথাটা টেনে নিলে আমি বুনো গন্ধ আর নরম উষ্ণতার মধ্যে এক অপার্থিব আনন্দের গহীনের তলিয়ে যেতে থাকি। সারারাত ধরে আমি সেই উষ্ণতা মাধুরির সাথে ভাগাভাগি করে নিই। সকালে আমার ঘুম ভাঙে বেশ দেরিতে। পূর্ব দিকের জানালার শার্সি দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে মুখে পড়ার পরেই কেবল বুঝতে পারি কোথায় রাত কাটিয়েছি! আমি বিছানায় উঠে বসার প্রায় সাথে সাথেই ঘরে ঢোকে মাধুরি।

আধো আলোছায়ায় ঘেরা ঘরটাতে ঢুকে জানালা খুলে দিতেই একরাশ আলোর সাথে ঘরে ঢুকে পড়ে খানিকটা শীতল হাওয়া। সকালের নরম আলোয় শাড়ির উপরে শাল জড়ানো মাধুরিকে দেখে আমি চোখ ফেরাতে পারি না। ‘কিÑ বাবুর ঘুম ভাঙলো?’ আমি মাধুরির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি শাড়ি পরতে পারো?’ ‘বাঙালি মেয়ে শাড়ি পরতে পারবো না কেন! বাট আই ডোন্ট ফিল কম্ফোর্টেবল ইয়ার। আজ শুধু তোমার জন্যে শাড়ি পরেছি। মে বি ইউ উইল লাইক ইট।

’ ভোর বেলাতেই গোসল করে কাপড় বদল শুধু নয়, সম্ভবত সে ইতিমধ্যে নাস্তাও তৈরি করে ফেলেছে। আমাকে ‘জলদি করো ইয়ার’ বলে তৈরি হবার জন্যে তাড়া দিয়ে ভেতরে চলে যায় মাধুরি। শেষপর্যন্ত ভীষণ আপত্তি সত্ত্বেও তার বানানো নাস্তা এবং গতরাতের মতোই বড় এক কাপ চা শেষ করে বিদায় নেবার আগে আমার মনে হয় একটা জরুরি কাজ বাকি থেকে গেছে। ‘মাসি মাÑ অর্থাৎ তোমার মা’র সাথে একবার দেখা করতে পারি না?’ এক মুহূর্তে কি যেনো ভাবে মাধুরি। ‘আগে হলে আমি নিজেই তোমাকে বলতাম।

দেশের মানুষের সাথে দেখা হলে মা খুশিই হতেন, অনেক ডিসকাশন করতেন। এখন শি ইজ... অনেকটা আউট অফ হার মাইন্ড। তুমি কিছু মনে করো না। ’ এরপর আর কোনো কথা চলে না। আমি আমার সার্টের ভেতরের পকেট থেকে আমার একমাত্র একশ টাকার নোটটি বের করে মাধুরির দিকে বাড়িয়ে দিই।

‘আই ক্যান গিভ ইউ দিস মাচ। ’ ‘প্লিজ কিপ ইট ইয়োরসেলফ। তোমার কাজে লাগবে। ’ এই অল্প সময়ে যতটা বুঝেছি, ওকে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার বলে কোনো লাভ নেই। টাকাটা আমি মাধুরিকে দিতে পারবো না।

তবুও শেষ চেষ্টা হিসাবে বললাম, ‘তুমি এটা রাখলেই আমি খুশি হবো। ফিরে যাবার মতো যথেষ্ট টাকা আমার কাছে আছে। ’ ‘কোথায় ফিরবে তুমি? তোমাদের এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে আর কবে বাড়ি ফিরতে পারবে তার কোনো ঠিক আছে!’ সুযোগ পেয়ে মাধুরি একটু রসিকতাও করে। ‘আমি এমনিতেই অনেক খুশি, পসিবল হলে তোমাকে আমি রেখেই দিতাম। ’ এরপর আমার খুলে রাখা পুলওভারটা হাতে দিয়ে প্রায় নির্দেশের সুরে বলে, ‘বাইরে অনেক ঠা-া, এটা পরে ফেলো।

দাদা কখনও ফিরে এলে একটা পুলওভার সে কিনেও নিতে পারবে। ’ বিনাবাক্যে শীতবস্ত্রটা গায়ে চড়িয়ে আমার মনে হয় এ সময় এইটুকু উষ্ণতার খুব প্রয়োজন ছিল। মাধুরির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হয়তো হঠাৎ করেই তার ডাক্তার জে পি নন্দীর কথা মনে পড়ে যায়। বিছানায় পড়ে থাকা দোমড়ানো মোচড়ানো চিরকূটটা তুলে নিয়ে আমাকে রুংটুং রোডের দিক নির্দেশনা দেবার জন্যে মাধুরি আমার খুব কাছে সরে আসে। আরও একবার তাকে জড়িয়ে ধরার প্রবল আকাক্সক্ষা উপেক্ষা করে আমি বলি, ‘জ্যোতিদার সাথে আর দেখা করবো না ঠিক করেছি।

’ ‘তাহলে কোথায় যাবে তুমি?’ ‘আপাতত শিলিগুড়ি। ’ মাধুরি আর কোনো প্রশ্ন করে না, আমাকে বাধাও দেয় না। আমার একটা হাত অল্প কিছুক্ষণ ধরে রাখে, তারপর দরজাটা পুরোপুরি খুলে দেয়। বাইরে রোদ ঝলমলে দিন। দার্জিলিংএর এক অখ্যাত সড়কে একটি ছোট্ট কাঠের বাংলো পেছনে ফেলে পাহাড়ি পথের চড়াই উৎরাই ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি আমার আগামী দিনের করণীয় সম্পর্কে একটা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই।

বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যে রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প খোলা হয়েছে, তার যে কোনো একটা খুঁজে বের করা মোটেও কঠিন হবে না। শেষ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.