আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট !

বড়ো ছেলে হামিম আজ সকা‍লে ফোন করেছিল , মাএ দুই মিনিট কথা হয়েচিল। অথচ এই দুই মিনিট কথা বলার রেশ আজ সারাদিন বয়ে বেড়াচেছ আমিনা আক্তার কবিতা। অনেকে বলে আমিনা আক্তার নাম এর সাথে কবিতা নামটি কেমন যেন বেমানান বেমানান লাগে। কবিতা’ র বাবা ছিল গ্রামে স্কুলের শিক্ষক। খুবই সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন তিনি।

তাই তিনি চেয়েছিলেন মেয়ের নাম গতানুগতিক না হয়ে একটু অন্য রকম হবে। কিন্তু এতে বাধ সাধেন কবিতা’ র দাদি। শেষে মা ছেলে মিলে সন্ধি হয়। আমিনা আক্তার অংশটি দাদির দেয়া আর কবিতা অংশটি তার বাপের দেয়া। বিয়ের পর পরই কবিতার নাম পাল্টে যায়।

কবিতা সরোয়ার। কবিতা’ র স্বামীর নাম সরোয়ার খান। এ বংশের সবার নাম এর সাথে খান পদবী জুড়ে দেওয়া হয়। মেয়েদের নাম এর শেষে ও। কবিতা’ র নামতো এরা কবিতা খান রাখতে পারত, তা না রেখে কবিতা সরোয়ার রাখলো কেন? প্রথম প্রথম এ নিয়ে অনেক ভেবেছে কবিতা।

একবার ভেবেছিল স্বামীকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করবে। কিন্তু কিছু দিন পর কবিতা বুঝতে পারে তার চাওয়া বা ইচ্ছার কোন মূল্য নেই এই পরিবারে। সরোয়ার খানরা কবিতাদের গ্রাম এর বনদী ধনী পরিবার । কবিতা’ র বাবাকে কেন জানি সরোয়ার খানের বাবা খুব পছন্দ করতেন। সরোয়ার খানদের গ্রামের সবকিছু দেখাশুনা করতেন কবিতার বাবা।

খান পরিবার নিয়ে গ্রামে কত রকম কাহিনী লোকে বলে বেড়ায়। পাচঁ বছর বয়েসে মা মারা যাওয়ার পর দাদীর কাছেই মানুষ হয় কবিতা। মা হীন কবিতার সার্বক্ষনীক সঙ্গী দাদী। বাবা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন স্কুল আর সামাজিকতা নিয়ে। মাঝে মাঝে দাদী ও সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ।

তখন কবিতার খুব খারাপ লাগত। বাবার বুক সেলফে সাজানো সারি সারি বাংলা সাহিত্যে্র বই গুলো নিঃসগঙ কবিতার নিঃসগঙতার সতিন হয়ে গেল। স্কুল এর পাঁচিল পেরিয়ে কলেজ এ উঠার আগেই সাহিত্যর প্রচুর বই পড়ে শেষ করে পেলে কবিতা। সাহিত্যর প্রেমে এতো মশগুল হয়ে যায় যে কলেজে পড়ার সময় সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, বাংলা সাহিত্যে অনার্স করে কলেজ শিক্ষিকা হবে। কিশোরীর মনে তখন কত রঙিন স্বপ্নের নিত্য আনাগোনা।

শরৎ চন্দ্রের ‘অপরাজিতা’ উপন্যাস পড়্তে পড়্তে সে এর নায়ক শেখরের প্রেমে পড়ে । মনে মনে ভাবতো তার ভালোবাসার মানুষ হবে গম্ভীর প্রকৃ্তির। যার দুই চোখে ভালোবাসার যাদু খেলা করবে সব সময় কিন্ত মুখ এ কিছু বলবে না। রবিন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ পড়ে অমিত- লাবণ্য র প্রেমের বিয়োগান্তক পরিনিতি দেখে বেশ কয়েক দিন কবিতার মন খারাপ ছিল। কিশো্রীর মনে যখন এই সব সপ্ন খেলার জোয়ার-ভাটার খেলা চলছিল, তখন হঠাৎ করে কবিতার বিয়ের প্রস্তাব আসে।

কবিতা তখন মাত্র অনার্স ফাস্ট ইয়ারের ছাএী। কবিতা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। এদিকে কবিতার দাদীতো মহাখুশী। নাতনীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, নাতনি আমার চাঁদ কপাল নিয়ে জন্মেছিল , নইলে কি আর খান বংশ থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। বিয়ের প্রস্তাব আসার পর থেকে কবিতার বাবা দূর থেকে মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে শুধু চোখ মুছেন।

কবিতার বাবার এ চোখ মোছা আজ ও বন্ধ হয়নি। হুটহাট করে মহা্ধুমদামের সাথে কবিতার বিয়ে হয়ে যায়। বাসর রাতের সময় থেকেই কবিতার সপ্ন নায়করা বেগোরে প্রান হারাতে থাকে সরোয়ার খানের হাতে। বিয়ের কয়েক মাসের মাথায় কবিতা তার স্বামীর প্রথম বিয়ের কথা শুনতে পায়। ততোদিন এ কবিতার গর্ভে বাসা বেঁধেছে খান পরিবারের বংশধর।

এ পরিবারে কবিতা যেন এক অবাঞ্ছিত অতিথি। ওদের কোন কিছুর সাথেই সে তাল মিলাতে পারে না। কাজের লোকদের সাথে এ পরিবারের লো্কজন খুব একটা ভালো ব্যবহার করে না। কবিতার সহজ সরল আচরণের কারনে কাজের লো্কেরা তাকে খুব পছন্দ করতো। ওদের কাছেই সরোয়ার খানের প্রথম বিয়ের কথা শুনে কবিতা।

খানের প্রথম বউ বড় বিয়ের পাচঁ-ছয় মাসের মাথায় কবিতা কে আলাদা বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হ্য়। আজ দশ বছর যাবত কবিতা এই বাসায় একাই থাকে। সরোয়ার খান যখন ইচ্ছে তখন আসেন। মাঝে মাঝে অনেক দিন আসেন না। প্রথম সন্তান হওয়ার পর শ্বশুর-শাশুড়ি আর ননদ মিলে তাকে প্রথম দেখতে আসে।

ছেলেটার বছর খানেক হওয়ার পর প্রায় নাতিকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতেন শাশুড়ি। এক সময় নাতিকে পড়াশুনা করানো আর নিজেদের কালচার শিখানোর কথা বলে নিজের কাছে রেখে দেন শাশুড়ি। কবিতা অনেক কান্নাকাটি করেছিল কোন লাভ হইনি। ছেলেটাও দাদী আর ফুফু ছাড়া কিছু বুঝে না। বড়ো ছেলে হামিম এখন সিঙগাপুরে একটা বোডিং স্কুলে পড়ে।

ছোট ছেলেটা যদিও দেশে আছে, দাদীর কাছেই থাকে। মাঝে মাঝে এ জীবনের কোন মানে খুঁজে পায় না কবিতা। এ যেন এক মুক্তবন্দী জীবন। এরকম জীবন সে যাপন করতে চায়নি তবুও সে যাপন করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, সে কি স্বেচ্ছাবন্দী? নিজের দুই ছেলে মায়া , পিতার দায় আর অনিশ্চিত জীবনের ভয় তাকে এ বন্দীত্ব গ্রহনে বাধ্য করেছে।

কবিতা স্বপ্ন দেখে তাঁর দুইছেলে বড় হলে অকৃএিম ভালোবাসা দিয়ে তাকে এ বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করবে। সরোয়ার খান অনেক কঠিন হৃদয়য়ের মানুষ হলেও কবিতার বাবার চিকিৎসার ব্যাপারে উদারভাবে অনেক টাকা ব্যয় করছে। এখন ও প্রতি মাসে মাসে টাকা পাঠান শ্বশুরের জন্য । কবিতার বাবা এখন শয্যাশায়ী, এক দূরসম্পর্কের আত্নীয়ের বাড়ীতে থাকেন। সরোয়ার খান পাঠানো টাকার বিনিময়ে ওরা কবিতার বাবার দেখাশুনা করে।

দাদী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর হল। সব কিছুকে চাপিয়ে অনিশ্চিত জীবনের ভয় এখন কবিতাকে পেয়ে বসেছে বেশী। এখান থেকে পালিয়ে সে কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? এখানে সবই আছে, গাড়ী-বাড়ি, চাকরবাকর, নিরাপত্তা, সবই আছে। নেই শুধু মনের সুখ। অতৃপ্ত আত্মার যাতনা মাঝে মাঝে কবিতার কাছে অসহ্য ঠেকে।

কিছু দিন থেকে হামিমের কথা খুব মনে পড়ছিল কবিতার। সরোয়ার খানের যে পিএ মেয়েটা কবিতার দেখাশুনা করে তার নাম শায়লা। শায়লাকে একটাবলেছিল হামিমের সাথে কথা বলা যায় কি না একটু চেষ্টা করে দেখতে। শায়লা , সরোয়ার খানের সাথে আলাপ করে হামিমের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করেছিল। কবিতার বাসার কাছাকাছি সরোয়ার খানদের একটা ইন্ডাস্ট্রি আছে।

ওখানে খানের পিএ হিসেবে কাজ করে শায়লা, বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে কবিতার দেখাশুনা করে। সরোয়ার খানের অনেক পিএ আছে। যাদের বেশীর ভাগই মেয়ে। প্রত্যেকটা ইন্ডাস্ট্রির জন্য আলাদা আলাদা পিএ আছে খানের। অনেক পিএ মেয়েকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে।

কিছু কিছু কথা কবিতার কানে ও এসেছে। শায়লা মেয়েটাকে ও কবিতার প্রথম প্রথম ওই রকম মনে হতো কবিতার, পরে কেন জানি মেয়েটাকে ভালো লেগে যায় কবিতার। শায়লার ভিতর সরলতার একটা সূক্ষ্ম আভা টের পায় কবিতা। যদিও শায়লা সারাক্ষন কৃএিম স্মার্টনেস দেখিয়ে নিজের সরলতা ঢেকে রাখতে চায় শায়লা। এিশ পেরিয়ে গেলেও এখনো বিয়ে করেনি মেয়েটা।

মেয়েটার চোখের দিকে তাকালেই বুঝা যায় শায়লার ও অনেক গল্প আছে। আজ সকালে খুব হাসতে হাসতে বাসায় ঢুকে শায়লা, ম্যাডাম আপনার জন্য একটা সুসংবাদ আছে বলেই, একটা কাগজ মেলে ধরে সে। কবিতা দেখতে পায়, এটা সরোয়ার খানের সাপ্তাহিক রুটিন। সপ্তাহে প্রতিটা ইন্ডাস্ট্রি নিয়মিত ভিজিট করেন সরোয়ার খান। রুটিনে নয়টা একে একে নয়টা ইন্ডাস্ট্রিতে সরোয়ার খানের ভিজিটের সময়সূচি দেওয়া আছে।

দশ নাম্বারে কবিতার নাম লেখা। সরোয়ার খান কোন কোন দিন কবিতার সাথে সময় কাটাবে সে সময়সূচি। সাথে সাথে কবিতা তার জীবনের মানে খুঁজে পায়। কবিতা আসলে সরোয়ার খানদের বাকী নয়টা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটের মতো একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট। যে ইন্ডাস্ট্রিতে সরোয়ার খানদের বংশধারা রক্ষার জন্য সন্তান উৎপাদন করা হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।