সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে... ছোটবেলা থেকেই গান শুনতে ভালোবাসি। মায়ের মুখে শোনা, '৯০ এর দশকে ভীষণ জনপ্রিয় আদনান বাবু-এর "রং নাম্বার টেলিফোনে" গান টা না বাজালে আমাকে নাকি ভাত খাওয়ানো যেত না। আমার মত এমন অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। শিশুমনের চাহিদা বড় রহস্যময়।
সব রকম গান ই শুনতাম।
তবে বেশি ভালো লাগতো ব্যান্ড এর গান গুলো। সোলস, মাইলস, এল আর বি, ওয়ারফেজ, আর্ক সবার গান ই শুনতাম। অবসরে গান গুলো নিজেই গাওয়ার চেষ্টা করতাম। ভালো লাগতো।
'৯০ এর দশকের শেষের দিকে কিংবা ২০০০ এর শুরুর দিকে হঠাৎ ই যেন বাংলা গানের অনিঃশেষ সাগরে ভাটার টান লাগে।
শ্রোতারা বাংলা গান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করেন। শুরু হয় হিন্দী গানের সাম্রাজ্যবাদ। শিশু, কিশোর, তরুণ-তরুণী সবার মুখেই শোভা পেতে লাগলো দিল ডিং ডং ডিং দোলে, কাহোনা প্যায়ার হে, কাল হো নাহো, ম্যায় হু না অথবা মেরা বিচরা ইয়ার। মুখ থুবড়ে পড়লো বাংলা গানের বাজার। খ্যাতিমান শিল্পীরা গান গাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন।
ঠিক সেই সময়....২০০৪ সালের শেষের দিকে, হঠাৎ ই এক বিকালে কানে আসলো, "কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে, ফুলে পাইলা ভ্রমরা...."। গান টা শুনেই অদ্ভূত একটা ভাল লাগার অনুভূতি আসলো। এমন ও বাংলা গান হতে পারে! তুমুল জনপ্রিয় হলো এই গানটি, সারা দেশ জুড়ে। রেকর্ড সংখ্যক এ্যালবাম বিক্রি হলো। বাংলা গান আবার যেন প্রাণ ফিরে পেলো।
আমরা চিনলাম হাবীব ওয়াহিদ কে।
ঠিক সেই ক্রমধারায় এই শিল্পীর আরো অনেক গান তুমুল জনপ্রিয় হলো। সম্পূর্ণ নতুন এক সুরের জগতে আমাদের নিয়ে গেলো তাঁর গান। সেই পথ ধরে ফুয়াদ, আরফিন রুমী, হৃদয় খান রাও সৃষ্টি করতে লাগলেন নতুন নতুন সব সুর। তাঁদের এই সুর সৃষ্টি সমালোচনারও স্বীকার হয়।
তাঁদের বিরুদ্ধে মূল যে অভিযোগ ওঠে তা হচ্ছে তাঁদের গান সফটওয়্যার ভিত্তিক। এখানে মূল কন্ঠের কোন ছোঁয়া নেই। তারপরও তাঁদের এই গান গুলোর জন্যই দেশে হিন্দী গানের জোয়ার ঠেকানো সম্ভব হয়। আস্তে আস্তে আবার জনপ্রিয় হতে থাকে দেশের সঙ্গীতাঙ্গন। বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের পালেও লাগে জোর হাওয়া।
যার ফলস্রুতি তে দীর্ঘদিন পর হাতে আসে প্রিয় ব্যান্ড ওয়ারফেজ এর নতুন এ্যালবাম।
এ্যালবাম টি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ফেসবুকে, ব্লগে লেখালেখি হতে থাকে, বাংলা গান আবার নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছে। কথা টা ভালো লাগলো। কিন্তু তারপরেই কিছু লেখা দেখে অবাক লাগলো।
লেখা হয়েছে, সফটওয়্যার ভিত্তিক মেকি স্বরের গান গুলো দেশের সঙ্গীতাঙ্গন কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দেশের কয়েকজন স্বনামধন্য সঙ্গীতজ্ঞও দেখলাম তাদের সাথে গলা মিলিয়েই কথা বলছেন।
খুব অবাক লাগলো। হয়তো তাঁদের গানে যন্ত্রের কারুকাজ আছে, তাই বলে তাঁদের গান তো স্রুতিকটু নয়! এইসব গান ই তো হিন্দী গানের আগ্রাসন থেকে বাংলা গান কে রক্ষা করেছিলো, তখন কোথায় ছিল এইসব সমালোচনা?
আমি নিজে গানের ব্যাপারে সর্বভুক। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে হার্ড রক, সব ধরণের গান ই আমি শুনি।
এসব সমালোচনা দেখে আমার নিজের কাছে মনে হয়, এসবের আদৌ কি কোন প্রয়োজন আছে? গান জীবনের কথা বলে। মনের অব্যক্ত কথা গুলোকে ব্যক্ত করার এক শ্বাশ্বত মাধ্যম হচ্ছে গান। এই মাধ্যম কে নিয়ে টানাহেঁচড়া, ফেসবুক-ব্লগ এ আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলে কি লাভ? আমরা সহজভাবে চিন্তা করি। ফুচকা আর বিরিয়ানি, দুটি খাবার ই অত্যন্ত সুস্বাদু। এই দুটি খাবার পছন্দ করেন না, এমন মানুষ বিরল।
আমরা ফুচকা খাই খোলা রাস্তায়, মাঠের ধারে, আড্ডার মাঝখানে। আর বিরিয়ানী খাই কোন অভিজাত রেস্টুরেন্ট এ, বিয়েবাড়িতে, অথবা নিজের ঘরে। এখন যদি কাউকে বলা হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিরিয়ানী খাও অথবা বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফুচকা খাও, সমান ভালো লাগবে কি? সেই আমেজ কি আসবে? সবকিছুরই নিজস্ব পরিবেশ লাগে। গানের বেলাতেও এক ই কথা প্রযোজ্য। আমরা কোন স্রুতিমধুর গানকেই মেকি কন্ঠ দোষে দুষ্ট অভিযোগে বাদ দিবো না।
খোলা ময়দানে, বিপুল লোক সমাগমে, বন্ধুদের আড্ডায় যেমন আমরা শুনবো ওয়ারফেজ, এল আর বি, মাইলস....ঠিক তেমনি ভাবে কোন মন খারাপ করা বিকেলে, একাকী কোন নিঝুম রাতে শুনবো হাবীব, বালাম, হৃদয় খান এর গান। একেক গানের জন্যও একেক রকম পরিবেশ থাকা চাই। তাহলেই কেবল আমরা সঙ্গীতের আসল রস উপভোগ করতে পারবো। ভেসে বেড়াতে পারবো সুরের মহাসাগরে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।