আকাশটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে
‘হে পথিক শোন’
আজ ৪ জুন, রাজনগর গণহত্যা দিবস। ১৯৮৬ সালের এই তারিখে ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে গ্রামটিতে ঘুমন্ত অসহায় নিরীহ মানুষের ওপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সশস্ত্র শান্তিবাহিনী। তাদের হিংসার আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায় ৫০টি বাড়ি। বৃষ্টির মত গুলি চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় একই পরিবারের সকল সদস্যসহ এগারটি তাজা প্রাণ। যাদের মাঝে অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু।
রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার একটি গ্রামের নাম রাজনগর। কেউ যদি যান, তাহলে গ্রামটির প্রবেশ পথেই দেখতে পাবেন ছোট্ট একটি বাজার। রাজনগর বাজার নামেই এটি পরিচিত। বাজার পার হলেই রাস্তার ডান পাশে মসজিদ আর বাম দিকে কবরস্থান। কবরস্থানের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে একটি স্মৃতি ফলক।
শুরুতেই লেখা আছে, ‘হে পথিক শোন’। কিন্তু কি শুনবেন আপনি? হ্যাঁ, সেই মর্মান্তিক ঘটনার কথাই আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে এই ফলক।
১৯৮৬ সালের ৩ জুন, প্রতিদিনকার মতই রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গিয়েছিল এই গ্রামের খেটে খাওয়া শান্তিপ্রিয় মানুষেরা। কিন্তু অন্যান্য দিনের মত অনাবিল শান্তির ঘুম শেষে তাদের জীবনে ফোটেনি ভোরের আলো। শান্তিবাহিনীর হিংস্রতায় মাত্র কয়েক ঘন্টায় সব শেষ হয়ে যায়; নিহতদের ছিন্নভিন্ন দেহ আর আহতদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস।
বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো সর্বস্ব হারিয়ে নির্বাক। কিন্তু শোক প্রকাশের অবকাশও নেই। কারণ আগে তো জীবনটা বাঁচাতে হবে। কোথায় পাওয়া যাবে নিরাপদ আশ্রয়? জানা নেই কারো। যে যার মত ছুটছে আর ছুটছে।
আর প্রশাসন? হ্যাঁ, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। লংগদু উপজেলার তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান, থানার ওসি এবং মাইনী আর্মি জোনের কমান্ডার এসেছিলেন সকাল ৮টার দিকে। হামলার আগেই কেন গ্রামবাসী তাদের সহায় সম্পদ সব ফেলে অন্যত্র চলে গেল না, তার জন্য তারা হম্বিতম্বি করলেন। তারপর ফিরে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে দিয়ে গেলেন কিছু কাফনের কাপড়।
গণহত্যার শিকার মানুষগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কাফনের কাপড় পেল। এটাই-বা ক’জনের ভাগ্যে জোটে! সত্যিই কি সৌভাগ্য তাদের!!
রমজান মাস, সেহেরি খাওয়ার জন্য কেউ উঠেছেন, কেউ হয়তো খেয়ে শুয়েছেন। এই সময় হঠাৎ একটা গুলির শব্দ। তারপরেই এলএমজির ব্রাশ ফায়ার। এরপর চলছে তো চলছেই, বিরামহীন গুলির শব্দে কানপাতা দায়।
গভীর রাতে এমন শব্দের সাথে পরিচিত নয় কেউ। কি হচ্ছে, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না অনেকেই। কিন্তু বুঝতে বেশি সময়ও লাগেনি তাদের। ঘর থেকে বেরিয়েই যখন দেখলেন চারপাশের বাড়ি-ঘর জ্বলছে, আগুনের লেলিহান শিখায় বিদীর্ণ হয়ে গেছে রাতের অন্ধকার আকাশ। স্বজন হারানো এবং আহতদের গগনবিদারী চিৎকারে কাঁপছে ধরণী, তখন আর কারো বুঝতে বাকি ছিল না যে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র হামলায় ধ্বংস হচ্ছে তাদেরই গ্রাম।
আতঙ্কিত মানুষ যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল, লুকিয়ে জীবন রক্ষা করল। কিন্তু যারা পারল না তাদের দেহ ঝাঁঝরা হয়ে গেল হায়েনাদের বন্দুকের গুলিতে।
সেদিন যারা রাজনগরে প্রাণ দিয়েছিল, তার মধ্যে ওমর আলীর পরিবারের ঘটনা ছিল সব চেয়ে মর্মান্তিক। একই সাথে তার পরিবারের সবাই ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছিল। তাদের জন্য কান্না করারও কেউ ছিল না।
ওমর আলীর পরিবার সহ যারা এই গণহত্যার শিকার হয়েছে তাদের নামের তালিকা বুকে নিয়ে বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাজনগর কবরস্থানের এই স্মৃতি ফলক। বর্তমানে রাজনগরে একটি বিজিবি জোন আছে। আর তাদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত এই ফলকে অঙ্কিত তালিকায় সেদিনের শহীদেরা হলেন-
১. মো. ওমর আলী (৪৫)
২. বেগম ওমর আলী (৩০)
৩. আব্দুল মালেক (৭), পিতা ওমর আলী
৪. ফাতেমা বেগম (৪), পিতা ওমর আলী
৫. মালেকা বানু (২৮), স্বামী খৈয়র উদ্দিন
৬. নিলুফা আক্তার (১), পিতা খৈয়র উদ্দিন
৭. এরশাদ আলী মুন্সী (৬৫), পিতা নছরদ্দিন ফকির
৮. রেজিয়া খাতুন (২৫), স্বামী হাফিজ উদ্দিন
৯. আজিজুল ইসলাম (১০), পিতা হাফিজ উদ্দিন
১০. আলিমন বিবি (২৪), পিতা আব্দুর রহমান
১১. জামেলা খাতুন (২২), স্বামী সমর আলী
রাজনগর গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ছিল যুবলক্ষী পাড়া আর্মি ক্যাম্প। আর উত্তর দিকে ছোট মাহিল্যা আর্মি ক্যাম্প। কিন্তু দুটি ক্যাম্পই বেশ দূরে।
মাঝখানের গ্রামটির পাহাড়ায় ছিল মাত্র কয়েকজন ভিডিপি সদস্য। কিন্তু সংঘবদ্ধ সশস্ত্র শান্তিবাহিনীর সাথে তাদের কুলিয়ে উঠা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই শান্তিবাহিনী হামলা শুরু করার পর মাহিল্যা ক্যাম্প থেকে আর্মিরা এগিয়ে আসে। অন্যদিকে যুবলক্ষী পাড়া ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন আতিক তার সৈন্যদল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে শান্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তবে দূরত্বের কারণে আর্মিরা এসে পৌঁছার আগেই যা করার করে ফেলে শান্তিবাহিনী। ধ্বংস করে দিয়ে যায় স্বপ্নের মত সাজানো-গুছানো একটি গ্রাম। এরই মধ্যে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করে, পূর্ব আকাশে রক্তিম সূর্যউদয় হয়। রাতের আক্রমণের পর সকলে খুঁজতে থাকেন তাদের স্বজনদের। এ সময় সকলের সামনে একে একে ভেসে উঠে এগারটি মৃতদেহ।
সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাছির নিজের তত্ত্বাবধানে রাজনগর কবরস্থানেই সমাহিত করেন মৃতদেহগুলো।
জনাব নাছির মৃতদেহগুলো সমাহিত করার ব্যাপারে শুধু তত্ত্বাবধান করেছেন, এটা বলা ঠিক হলো না। বরং নিজ হাতে প্রতিটি লাশের গোসল দিতে হয়েছে তাকেই। লাশের গোসল করানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কারো হাত খুলে আসে, কারো পা। ঠিক মত ধরাও যায় না, কোন রকমে পানি ঢেলে গোসল শেষ করতে হয়েছে।
বিশেষ করে শিশুদের অবস্থা ছিল চরম ভয়ানক। এসব দৃশ্য দেখার পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোন কিছু খেতে পারিনি। ’ লাশের গোসল দেওয়া এবং কবরস্থ করতে তাকে সহায়তা করেছেন ইউপি মেম্বার আতাবউদ্দিন, মুরব্বীদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল কাদের মুন্সী, জাহের আলী, নবী হোসেন, নুরুল ইসলাম ব্যাপারী, রুহুল আমীনসহ আরও কয়েকজন।
রাজনগর গ্রামের পাহাড়ায় থাকা ভিডিপি প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আমীর হামজা। তার অভিজ্ঞতা হলো, ‘রাতের অন্ধকার তো কেটেছে গুলি আর পাল্টা গুলির মধ্যে।
কিন্তু ভোরের আলো ফোটার পর যখন শান্তিবাহিনীর ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড দেখার জন্য বের হলাম, তখন এক জায়গায় দেখলাম কয়েকটি গরু মরে আছে, পাশেই শিশু সহ কয়েকজনের ক্ষতবিক্ষত লাশ। দৃশ্যটা এতই বিভৎস যে তা কোনভাবেই সহ্য করতে পারিনি। আমি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লাম। ’
উৎস ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।