ইকরা- এক ক্ষণিকের অতিথির নাম। ইকরা নামের অর্থ, খুঁজে পেলাম না। বার বার মাথায় ঘুরছিল ইকারাসের কথা। ডিডালাস বন্দিত্ব থেকে পালাবার জন্য মোম আর পালক দিয়ে পাখা বানিয়েছিল। ছেলে ইকারাসকে বলেছিল সূর্যের বেশি কাছে না যাবার।
তরুণ ইকারাস ভুল করে আর সূর্যের তাপে গলে যায় মোম। তাই বন্দিত্ব থেকে আর পালানো হয় নি হতভাগা ইকারাসের। ইকরা ইকারাসের মত ভুল করে নি, ও বাবার লক্ষ্মী মেয়ে। দিদিরা ওর নরম হাতে অসংখ্য ছিদ্র করে সূঁচ দিয়ে, মুখে নেবুলাইজেশন মাস্ক দেয়, ইকরা এক ফোঁটা চিৎকার করে না। ওর বাবা বলেছে চিকিৎসার জন্য তোমাকে সব সহ্য করতে হবে।
ইকরা সমকালীন সমাজের এক হতভাগ্য চরিত্রের নাম। ইকরা, তুমি এসেছিলে শিশু বিভাগে এক নিরানন্দ নিদ্রাহীন নিশিরাতের আগমনী বার্তা নিয়ে। প্রথম দেখায় বুঝেছিলাম ফিনাইলের সুবাস তোমার অপরিচিত নয়। ফাইল হাতে নিয়ে Chief complaints এর প্রথম লাইন লিখতে গিয়ে আমার কলম যেন শ্রাবণ মাসে গরুর গাড়ির চাকার মত নরম কাদায় আটকে গেল। Fever for three years. লজ্জিত আর বিস্মিত হয়েছি, ফেসবুকের ডিজিটাল দুনিয়ায় “Fever, pray for me”- এ জাতীয় স্ট্যাটাসগুলো যখন টেলিস্কোপের মত ভার্চুয়াল সান্ত্বনা খুঁজে।
ইকরা তোমার শরীরে প্লাজমা বানের পানির মত আগ্রাসন চালাচ্ছে। ধমনীর নরম প্রাচীর যেখানে বালির বাঁধ, রেহাই পায়নি তোমার চোখের পাতাও প্লাজমার দখল থেকে, চোখের নরম পেশীগুলোও আর টানতে পারছিল না ভারী পাতাগুলোর ভার, তুমি নাকি গত দশদিন পৃথিবী দেখনি। তুমি যে Glomerulonephritis এ আক্রান্ত।
তোমার ব্লাড প্রেসার মাপতে গিয়ে নিজেকে বধির মনে হচ্ছিল, কাঁটা গুলো টিক টিক শব্দ করে না, নিরুপায় হয়ে তোমায় ক্যানুলায় Dopamine ভরেছি, রক্ত নিয়ে ছুটে এসেছি শাহবাগে, টেস্ট-টিউবের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়েছি, রক্ত না পানি! ল্যাব এর মামা সে বিস্ময়কে সত্যে রূপ দিলেন। হিমোগ্লোবিন 3.59 ।
ততক্ষনে তোমার Anaemic heart failure থেকে Cadiogenic Shock ।
রাত আড়াইটা। বারডেমের গেটে এসে দাঁড়ালাম। পিছনে তাকালাম, বারডেম আর IMC, আমার জীবনের দুই কলঙ্কিত কারাগার, আমার শরীরে পাপের সূতিকাগার, মাথার উপরে ঝুলছে ভণ্ড রাজনীতিবিদদের লাল নীল মিথ্যা অঙ্গিকারে ভরা পোস্টার। দূরে তাকালাম, দেহপসারিনির লিপস্টিকের লাল হাসি, ওরা অর্থের বিনিময়ে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়, আমার চিকিৎসক হবার স্বপ্নের ব্যবসায়ীদের মত জালিয়াতি করে না।
সেগুনবাগিচা ফিরলাম, ইকরাকে নরমাল স্যালাইন দেয়া হয়েছে। BP মাপলাম, সাবিনা সাহায্য করলো, -70/40.। ওর দিকে তাকাই- নির্ঘুম রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখ। ও ওর বাসার কাজের মেয়ে,সমবয়সী, খেলার সঙ্গী। ও হয়তোবা মারামারিতে ইকরার সঙ্গে পেরে উঠে না, বড় ডিম আর রানের মাংসটা হয়তোবা ইকরাই পায়, কিন্তু আজকে সাবিনার মমত্ববোধ আমাকে শক্তি দিয়েছে, বার বার মনে হয়েছে, সাবিনা পারলে আমি পারব না কেন? বারডেম-১ থেকে দুঃসংবাদ এলো- Na-160 ।
নরমাল স্যালাইন আর দেয়া যাবে না। ব্লাড লাগবে, ইকরার বাবা দিলো।
রাত সাড়ে চারটা, ঘুমাতে যাবো, শিশু বিভাগে (৫ তলা) এখন ভুতের আড্ডাখানা। ভূতের ওঝা সিহানের গুজব আর মৌরীর ফেসবুকের স্ট্যাটাস ভূতের বংশবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ওদের উপর ভূতের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
ভূতরা না আবার MR হয়ে সিহানকে ভিজিট না শুরু করে। যাই হোক, বুঝিলাম ভয় আর গুজব ভূতের প্রধান খাদ্য।
আজকে সকালে ওঝা সিহানের কাছে শুনলাম, লাইটে ভূত আসে না। ইকরা, তোমার ভয় নেই, ৫১৩ ওয়ার্ডের সব টিউবলাইটগুলো আমি জ্বালিয়ে রেখেছি।
চোখের দুই পাতা এক করার চেষ্টা করি, পারি না।
ইকরা, তুমি আমার মতো অভিমান করো না, ছোটোবেলায় মীরপুরের অচেনা গলিতে হারিয়ে গিয়েছিলাম, আব্বু আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলোনা তাই, তুমি পার্কে গিয়ে স্লিপার কিংবা দোলনায় উঠতে চাও না, তোমার পিছনে বিরাট অংশ জুড়ে আলসার। অনুশোচনায় দুচোখে ক্লান্তি আসে, মহিলা ভূতের(!) সাথে সাক্ষাতের উত্তেজনায় ঘুমিয়ে পড়ি। ইকরার Diagonosis ছিল- PUO 3 years, Secondary Hypocortisolisom, ACTH deficiency, Thyroid failure, Hypothalamic regulatory dysfunction, Glomerulonephritis, Acute watery diarrhea, Anaemic heart failure with cardiogenic shock e Bed sore.
পরদিন সকালে তাকে Discharge করা হয়।
ইকরা তুমি কোনো ICU তে হয়তোবা অর্থের বিনিময়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছ,- ভালো থেকো। তবু জানি, ইতিহাসের সেরা প্রতারকের নাম যদি পলাশীর মীর জাফর হয়, তবে ইকরা পৃথিবীর সবচে প্রতারিতদের একজন কারন একমাত্র প্রতিষেধকের কল্যাণে ওর চোখে যে বাসা বেঁধে ফেলেছে Steroid induced cataract. ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।