স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি যতদূর এগিয়েছে তার চেয়ে বেশি অগ্রসর হবে সামনের দিনগুলোতে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার কিছু সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে এবং দেশটি এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশে পরিণত হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য বাংলাদেশ একটি আকর্ষণীয় বাজার হয়ে উঠছে। একই মত দিলেন দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, গবেষক ও ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, সামনের দিনগুলো বাংলাদেশের জন্য যতটা চ্যালেঞ্জের ততটাই সম্ভাবনাময়।
আর এটি বাস্তবায়ন হবে ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বাংলাদেশের জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রই হবে রফতানির প্রধান বাজার। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের সহায়তায় সম্প্রতি এইচএসবিসি গ্লোবাল কানেকশন রিপোর্টে ১৮০ দেশের আমদানি-রফতানির তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বাংলাদেশের শীর্ষ পাঁচ রফতানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা। ২০৩০ সালে গিয়ে শীর্ষ তিনটি দেশের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকবে। তবে ফ্রান্স ও কানাডাকে পেছনে ফেলে চতুর্থ অবস্থানে উঠে আসবে ভারত, যে সময় ফ্রান্স হবে বাংলাদেশের পঞ্চম শীর্ষ রফতানি বাজার।
২০১৩-১৫ সালের দিকে ভারতে বাংলাদেশের রফতানির গড় প্রবৃদ্ধি হবে ১৯ শতাংশ। ২০১৫-২০ সালে তা কিছুটা কমে হবে ১৪ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত ভারতে দুই অঙ্কের রফতানি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবে বাংলাদেশ।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১০ ও ’১১ সালে বাংলাদেশের রফতানি ১৫ শতাংশ বেশি হারে বেড়েছে। যদিও চলতি বছর বৈশ্বিক মন্দায় রফতানি প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে।
তবে বিশ্বমন্দা কাটতে শুরু করেছে। তাই ২০১২ সালের শেষ কয়েক মাসে বাংলাদেশের রফতানি বাড়বে। ২০১৩ সালে এসে এ প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে, যার মাধ্যমে আগের বছরের মন্দার প্রভাব পুষিয়ে নিতে পারবে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ যদি রফতানির জন্য ভারতকে নতুন বাজার হিসেবে পায়, তবে তা ইতিবাচক। স্বাভাবিকভাবে আমরা ভারতে মূল পণ্যের চেয়ে আনুষঙ্গিক পণ্য বেশি রফতানি করি।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবেদনে যেহেতু ২০৩০ সাল ও দেশের রফতানি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ উদীয়মান অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে সক্ষমতা রাখবে।
এইচএসবিসির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাপান বাদে এশিয়ার অন্যান্য দেশে ২০২১-৩০ সালে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি হবে ১২ শতাংশ। এ সময় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া হবে বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার। লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায়ও বাংলাদেশের রফতানি দ্রুত বাড়বে। ২০২০ সালের দিকে মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ।
রাশিয়া বাদে ইউরোপের অন্যান্য দেশে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ। এ অঞ্চলে তুরস্ক হবে বাংলাদেশের জন্য রফতানির সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশ।
এদিকে বাংলাদেশের বর্তমান রফতানি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের চার মাসে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৬৫ কোটি ডলার। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ রফতানি করেছে মোট ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক রফতানিও চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
যদিও নিটওয়্যারের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। রফতানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত খবরটি হলো পাটের ব্যাগ ও বস্তার রফতানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ গার্মেন্টস মালিক সমিতি বিজিএমইএ সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। বিশেষ করে ওভেন গার্মেন্টস রফতানি সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের বড় দুটি আমদানিকারক।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির যথাক্রমে ৫১ ও ২২ শতাংশ যায় ওই দুটি দেশে। এ দুটি দেশ ছাড়া তৈরি পোশাক রফতানির নতুন বাজার খোঁজা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চিলি, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া ও তুরস্কে তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে। তিনি দাবি করেন আগামী দিনগুলোতে তৈরি পোশাক খাত বহুদূর এগিয়ে যাবে। অন্তত শীর্ষস্থানীয় পঞ্চাশ দেশে এ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি হবে।
জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ‘আইএফও ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চ’ সম্প্রতি বিশ্বের ১২০টি দেশের সহস্রাধিক অর্থনীতিবিদের অনুসন্ধানী তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা এক জরিপে বলা হয়েছে, এশিয়ার প্রধান উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এতে বলা হয়, হংকং, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার পথে এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্র তীরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতি। ওই জরিপে দেখানো হয়, আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী যদি ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পরিমাপ করা হয় তবে দেখা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতি। ২০১১ সালে আমেরিকার একটি রেটিং এজেন্সি স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড পুওরসের (এসএ্যান্ডপি) ক্রেডিট রেটিংয়ে দেখা যায়, অর্থনৈতিক দিক থেকে ইতিবাচক ও স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর ২০১০ সালের এপ্রিলে এসএ্যান্ডপি ক্রেডিট রেটিংয়ে দেখানো হয়, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের পরে, কিন্তু পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ওপরে।
দেশটির ডয়েশ ব্যাংকের এক জরিপে বলা হয়েছে, বিগত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৬ শতাংশ, যা মোটামুটি স্থিতিশীল।
দ্বিতীয়বারের মতো অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে ইউরোপসহ বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন এবং ভারতের অর্থনীতি নিম্নমুখী। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে এবং দেশটি এশিয়ার উদীয়মান বাজার। উদীয়মান বাজার হিসেবে উঠে আসার পেছনে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, জ্বালানি সমৃদ্ধি, শ্রমমূল্যের নিম্নহার এবং বাণিজ্য সুবিধার বিষয়টিকে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুটি সমস্যা হলো স্বল্প জ্বালানি সরবরাহ এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি। তবে গত পাঁচ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাঠানো বাংলাদেশীদের রেমিটেন্স অর্থনীতিকে শক্তিশালী অবস্থানে ধরে রেখেছে বলে জরিপে উঠে আসে।
তবে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র ইতিবাচক ধারাতেই রয়েছে।
এ ব্যাপারে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জনকণ্ঠকে বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেক। ৪০ বছরে কৃষিতে, শিল্প ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। তবে তিনি বলেন, জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। তিনি আরও বলেন, তৈরি পোশাক রফতানি আয়ে চীনের পরেই আমরা অর্থাৎ দ্বিতীয় বৃহত্তম।
এই অর্জন আমাদের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। তিনি আরও বলেন, বিগত সময়ে দেশে বিপুল পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছে। এটাও অর্থনীতির জন্য সুসংবাদ।
চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে ইউনাইটেড নেশনস্ কনফারেন্স অন ট্রেড এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) এক প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০১১ সালে সারাবিশ্বে গড় বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪.৪২ শতাংশ।
ওই বছর বাংলাদেশে ১১৩ কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। এতে বলা হয়, বিনিয়োগ পরিস্থিতির এই উন্নতি নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা কম। বাংলাদেশে কর্মরত পুরনো কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা সম্প্র্রসারণের জন্য বিনিয়োগ করেছে বলে মোট বিদেশী বিনিয়োগ বেশি দেখা যাচ্ছে, যদিও নতুন বিনিয়োগ (গ্রীনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট) পরিস্থিতি ভাল করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে সরকার। সরকার এই মুহূর্তে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিয়ে কিছুটা হতাশ। তারপরও সম্প্রতি পৃথিবী বিখ্যাত ব্রান্ডের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার।
এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, এটা নিঃসন্দেহে ভাল। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থেই দেশে বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। তবে তারচেয়েও জরুরী দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ধরে রাখা। বিশেষ করে দেশের অবকাঠামোগত কিছু সমস্যার সমাধান করলে দেশী উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে ফিরে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির বর্তমান হালে সন্তুষ্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
সম্প্রতি তিনি তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্বমন্দার পর থেকে এ পর্যন্ত ভাল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের মধ্যে শীর্ষ কাতারে রয়েছে বাংলাদেশ। তাঁর মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি খুবই ভাল। দেশের মধ্যে অনেকেই এটা স্বীকার করেন না, অথচ বাইরে থেকে প্রশংসা পেয়েছি। মূল: রহিম শেখের লেখা, জনকণ্ঠ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।