আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সতীর্থদের কণ্ঠে হাহাকার

কদিন আগের কথা। কথা প্রসঙ্গে তামিম ইকবাল প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আশরাফুল ভাইকে আমি বলি বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম প্রেম। ’ কদিন পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন তামিম। মহা ধুমধামে বিয়ে হবে, চলছে জোগাড়-যন্তর, চরম ব্যস্ততায় কাটছে সময়। কিন্তু হঠাৎই মুষড়ে পড়েছেন ‘প্রথম প্রেম’ ভঙ্গের বেদনায়।

না পারছেন মেনে নিতে, না পারছেন ভুলতে।
নানা সময়ে মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে খেলেছেন, এমন অনেকেরই প্রতিক্রিয়া কমবেশি তামিমের মতো। বিস্মিত, হতভম্ব সবাই। আশরাফুলের স্বীকারোক্তির পরও যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে অনেকের। সতীর্থ-বন্ধু আশরাফুল আর ফিক্সিংয়ে জড়িত আশরাফুল—আশরাফুলের এই দুই সত্তার দোলাচলে সবাই।

ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা বন্ধু-সতীর্থ হিসেবে আশরাফুলের প্রতি সহানুভূতি আছে। আশরাফুলের কান্না দেখে চোখে পানি চলে এসেছে অনেকের। কিন্তু সবাই মানছেন, বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে, দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে শাস্তিটাও জরুরি।
সুযোগ পেলেই তামিম মনে করিয়ে দেন, আশরাফুলের ব্যাটিংয়ের কত বড় ভক্ত তিনি। দেশজুড়ে আশরাফুলের কোটি ভক্তের মনোবেদনাও তাই ভালোই বুঝতে পারছেন বাঁহাতি ওপেনার।

আঘাতটা সইতে তাই কষ্ট হচ্ছে তামিমের, ‘প্রথমত, আমি আশরাফুলের ভাইয়ের খেলার বড় ফ্যান ছিলাম। এ জন্যই আরও বলতে হচ্ছে, কাজটা উনি ভালো করেননি। এমন কিছু করার আগে ভাবা উচিত ছিল কত কত তরুণের আইকন ও আইডল তিনি। কোন পরিস্থিতিতে তাঁকে এসব করতে হয়েছে, সেটা অবশ্য একটা ব্যাপার। তবে এটাও বলতে হবে, কোনটা ভুল, কোনটা ঠিক, সেই বোধটাও থাকা উচিত।


জীবনের নতুন ইনিংস শুরু করতে যাচ্ছেন, তবে সেই রোমাঞ্চের চেয়ে আপাতত আশরাফুল-বেদনাই ছেয়ে আছে তামিমকে। মন খুবই খারাপ। যদিও সবার জন্য এটাকে একটা শিক্ষাও মানছেন, ১০-২০ বছর পর হলেও কৃতকর্মের ফল একদিন ভোগ করতে হয়। তবে এই কঠিন বাস্তবতাবোধের মাঝেও ঠিকই বেরিয়ে এসেছে তামিমের ‘ভক্ত’ পরিচয়টা, ‘আর কখনো ক্রিকেটে ফিরতে না পারলে ব্যক্তিগতভাবে আমি ওনার ব্যাটিং অনেক মিস করব। ’
ব্যাটসম্যান আশরাফুল তো বটেই, সতীর্থ আশরাফুলেরও বড় ভক্ত ছিলেন নাসির হোসেন।

পূর্বসূরির ঘটনায় দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হতভম্ব, ‘আমি পুরোপুরি শকড...। নিজের সেরা চেহারায় থাকলে আশরাফুল ভাইয়ের ব্যাটিং ছিল ছবির মতো। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সত্যিকারের প্রথম তারকা উনিই। গত কয়েকটা সিরিজে ড্রেসিংরুমে সব সময় আমার বাঁ পাশে বসতেন, কত কথা হয়েছে! এত ভালো মানুষ, কত মজা করতেন, অথচ...আমি আর কিছু বলতে চাই না, বলতে পারছি না। ’
সম্প্রতি গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে বর্ষসেরা উদীয়মানের পুরস্কার পাওয়া জাতীয় দলের নবীন ব্যাটসম্যান এনামুল হক কিছু বলতেই পারলেন না, ‘উনি যখন সুপারস্টার, আমার তখন সবে খেলা শুরু।

ওনাকে দেখেই আমি, আমার মতো অনেকে ক্রিকেটে এসেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে উনি একজন কিংবদন্তি...কী বলব ওনাকে নিয়ে!
টিভিতে আশরাফুলের কান্না দেখে চোখ ভিজেছে মোহাম্মদ শরীফেরও। কাল দুপুরে বাসায় কয়েকজন বন্ধু এসে জিজ্ঞেস করল আশরাফুলের কথা। শরীফের আবার কান্না চেপে গেল। ওয়াহিদুল গনির অঙ্কুর ক্রিকেট একাডেমিতে একসঙ্গে ছিলেন দুজন।

টিনএজ বয়সেই দুজনের জাতীয় দলে অভিষেক কাছাকাছি সময়ে। শরীফ পরে জাতীয় দল থেকে ছিটকে গেছেন, কিন্তু দুজনের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। বন্ধুর জীবনের অজানা অধ্যায় চমকে দিয়েছে এই পেসারকে, ‘ছোট থেকে দুজন একসঙ্গে খেলেছি। আমার শুধু বারবার মনে পড়ছে, সেই আশরাফুল আর এই আশরাফুল কি এক! এমন কোনো ব্যাপার নাই যে আশরাফুল আমার সঙ্গে শেয়ার করেনি। কিন্তু এসব কখনো বলেনি, আমিও বিন্দুমাত্র টের পাইনি।


মানসিক সমর্থন দিতে বন্ধুকে অনেকবার ফোন করেছেন, কিন্তু ফোনে পাচ্ছেন না। শরীফের চাওয়া, যেন পুরো ঘটনার পেছনের দিকটাও বেরিয়ে আসে, ‘বন্ধু ও সতীর্থ হলেও আশরাফুল ছিল আমার আইডল। ভক্ত ছিলাম ওর। দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে, শাস্তিটা পারলে যেন কম দেওয়া হয়। হানসি ক্রনিয়ের বইয়ে আমি পড়েছিলাম যে একবার এই জগতে ঢুকলে বের হওয়া যায় না।

আশরাফুলকে অন্ধকার জগতে কে বা কারা ঠেলে দিল, সেটাও বের করা দরকার। ’
ওয়াহিদুল গনির অঙ্কুরে আশরাফুল-শরীফের সঙ্গে ছিলেন শাহরিয়ার নাফীসও। আশরাফুলের দুটি ভিন্ন সত্তার দ্বিধাদ্বন্দ্বে এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানও, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এটা দুঃখজনক এক ঘটনা। ও যে সাহস করে সত্যটা স্বীকার করেছে, সেটার প্রশংসা করতেই হবে। সতীর্থ হিসেবে ওর জন্য খারাপ লাগছে।

তবে অপরাধ করলে প্রাপ্য শাস্তিই হওয়া উচিত। তবে আবারও বলছি, দুঃখজনক একটা ঘটনা। ’
২০০০ সালে শ্রীলঙ্কায় অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আশরাফুলের অধিনায়ক ছিলেন হান্নান সরকার। পরে একসঙ্গে খেলেছেন জাতীয় দলে। মাঠের বাইরেও ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

একই এলাকার দুজন, হান্নানকে দেখেই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় নেমেছেন আশরাফুল। সাবেক এই ওপেনারের চাওয়া, আশরাফুলের শাস্তিটা যথাসম্ভব কম হোক, ‘মাঠের বাইরেও ও আমার অনেক ক্লোজ ছিল। কখনো ভাবতে পারিনি ও এমন করতে পারে, কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। ওর কান্না দেখেও আবার আমার চোখে পানি চলে এসেছে। ক্ষমা যখন চেয়েছে, শাস্তিটা কি কম দেওয়া যায় না! কোনোভাবে ওকে আমাদের পাশে রাখা যায় না!’
বার্মিংহাম ক্রিকেট লিগে উলভারহ্যাম্পটনের হয়ে খেলছেন এনামুল জুনিয়র।

ইংল্যান্ড থেকে জানালেন কষ্টের কথা, ‘পত্রিকায় জানার পর পুরো দিন শকড ছিলাম। ওর স্বীকারোক্তি দেখে মনে হয়েছে আপন কেউ যেন আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। ’ অলক কাপালির ভাবনা আবার একটু অন্য রকম, ‘ওর জন্য খারাপ লাগছে। তবে আমার মনে হয় না জীবনে আমাদের এত টাকার দরকার যে ফিক্সিং করতে হবে। সাকিবকে দেখুন, বিশ্বজুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে।

ভালো খেললে টাকা এমনিতেই আসবে। ’
মুশফিকুর রহিমকে পাওয়া যায়নি ফোনে। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন তাঁর বাবা। নিরাশার ঘোরেও আশা হাতড়াচ্ছেন মাহবুব হামিদ, ‘আশরাফুল নিজেই স্বীকার করেছে। তার পরও মনে মনে কেবলই দোয়া করছি আকসুর রিপোর্টে যদি তেমন কিছু না থাকত! আশরাফুল বেঁচে যেত, বাংলাদেশ ক্রিকেটও কলঙ্কিত হতো না।


মুশফিকের বাবা মনে করিয়ে দিলেন ‘হোপ অ্যাগেনস্ট দ্য হোপ’ কথাটি। আশরাফুলের কোটি ভক্তও নিশ্চয়ই এমন আশার খড়কুটো আঁকড়ে ধরছেন। কিন্তু বাস্তবতা যে বড্ড কঠিন!।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।