জেনারেল জিয়ার শাসনকাল অবৈধ ঘোষিত হয়েছে সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক। ক্ষতবিক্ষত সংবিধান থেকে জিয়ার ফরমান অপমৃত্যু হয়েছে। জিয়ার স্বৈশাসনের দৃশ্যপটে ভিড় জমিয়েছিল নামী দামী অনেকেই।
তাদেরই একজন প্রধান বিচারপতি সায়েম তার রাষ্ট্রপতি জীবনের (৬ নভেম্বর ১৯৭৫-২১ এপ্রিল ’৭৭) দেড় বছরের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘এট বঙ্গভবন লাস্ট ফেজ’ নামক এক সংক্ষিপ্ত পুস্তিকায়। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে ১৯৭৭ সালের শেষ ও ১৯৭৮ সালের শুরুর সময়ে গ্রন্থটি লিখিত হলেও তখন জেনারেল জিয়া জীবিত ছিলেন বিধায় সঙ্গত কারণে তিনি তা প্রকাশের সাহস পাননি যার প্রমাণ পাওয়া যায় গ্রন্থের মুখবন্ধের অতিরিক্ত সংযোজনে (১৬/২/৮৮) এতে বলা হয় (বঙ্গানুবাদ)
‘এই টিট্রাইজ মূলত আমার মৃত্যুর পরে প্রকাশ হওয়ার বাসনা ছিল।
কিন্তু অতিবিলম্বে তা প্রকাশের সম্মতি দিলাম কেননা মৃত্যু এখানো আমাকে আলিঙ্গন করেনি যদিও আমি রাষ্ট্রপতির পদ অনেক আগেই হস্তান্তর করেছি’
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বিচারপতি সায়েম এর ‘রাষ্ট্রপতি’ কাল ছিল সামরিক শাসন। সংবিধান ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে সংবিধান থাকলেই না রাষ্ট্রপতির প্রয়োজন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সংবিধান এর বাইরেই ফরমান জারি করেন। তাহলে প্রেসিডেন্ট পদটির প্রয়োজন কি ছিল? সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার (অনুচ্ছেদ ৪৯) নিরঙ্কুশ কিন্তু সামরিক আইনে মৃত্যুদ- প্রাপ্তদের বেলায় রাষ্ট্রপতির কখনও এ ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেয়া হয়নি।
উল্লেখ্য যে, কর্নেল তাহের ছিল পঙ্গু। পঙ্গু লোকের বেলায় মৃত্যুদ- দেয়া হয় না। যাবজ্জীবন দ-ই যথেষ্ট। কিন্তু বিচারপতি সায়েমকে এটি দেখার সুযোগ দেয়া হয়নি। তিনি কিভাবে এলেন, অভিনয় করলেন রাষ্ট্রপতির, সে সময়ের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং তার বিতাড়নের দৃশ্যাবলী বিধৃত রয়েছে তার গ্রন্থে :
গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৮৭) ৬ নভেম্বর ‘৭৫ জাতির’ উদ্দেশ্যে দেয়া বিচারপতি সায়েমের যে ভাষণটি পুনঃমুদ্রিত হয়েছে তাতে উল্লেখ যে তিনি খন্দকার মোশতাকের ‘অনুরোধে’ তার মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন।
এই ব্যবস্থা নেয়ার জন্য খন্দকার মোশতাক (১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে যিনি রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেছিলেন) ৫ নভেম্বর ’৭৫-এর সামরিক ফরমান জারি করেছিলেন যার মর্ম ছিল যে, ‘তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগ বা পদত্যাগ করতে চাইলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাউকে মনোনয়ন দিতে পারবেন, যিনি তার মনোনীত প্রধান বিচারপতি বা কোন সুপ্রীমকোর্ট জজের কাছে শপথ নিয়ে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন। ” স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এমনকি সংবিধান স্থগিত (৬/১১/৭৫) হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়ানোর সাংবিধানিক বিধান জাতীয় সংসদের স্পিকারের। কিন্তু খন্দকার মোশতাক স্পিকারের কাছ থেকে শপথ নেননি, নিয়েছেন প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে যার জন্য আলাদা কোন ফরমান মোশতাক পদত্যাগ করার আগে ছিল না। তাহলে দেখা যায়, খন্দকার মোশতাক প্রকৃত পক্ষে যার কাছ থেকে শপথ বাক্য পাঠ করেন তার সাংবিধানিক ভিত্তি দূরে থাক প্রক্লেমেশন জারির ক্ষমা পর্যন্ত ছিল না। বলা বাহুল্য, ১৫ আগস্ট সংবিধান (সংসদ বাতিল করা হয়েছিল ৬ নভেম্বর, ’৭৫) যা প্রমাণ করে যে ১৫ আগস্ট থেকে ৬ নবেম্বর পর্যন্ত সংবিধান বলবৎ ছিলÑ মতে রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করা কথা ছিল কিন্তু তা লঙ্ঘনের ফলে বস্তুত ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের অবৈধ ক্ষমতা দখল, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করা যাবে না ইত্যাদি ১৫ আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর ’৭৫ পর্যন্ত কার্যাবলীসহ জেনারেল জিয়া নিজের অবৈধ ক্ষমতা দখল এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত অবৈধ কার্যাবলীকে বৈধ করে নিয়েছিলেন ৬ এপ্রিল ’৭৯ তারিখে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ‘রিটিফিকেশন এ্যান্ড কনফারমেশন’ ইত্যাদি আইন বলে।
এ ধরনের আইন পাস করিয়ে নিয়েছিলেন আইয়ুব খান তার ৭ অক্টোবর ’৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সালের সামরিক আইনকালের কার্যাবলীকে সিদ্ধ করার জন্য। যে কাজ করার সময় নিজের ক্ষমতা থাকে না সে কাজ পরে বৈধ করিয়ে নেয়ার মধ্যে অভিধানিক বৈধতার লেবাস থাকলেও তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় আইনসম্মত বলে বিবেচিত হবে না।
আলোচ্য গ্রন্থে বিচারপতি সায়েম শাসনভার গ্রহণ থেকে শেষ পর্যন্ত সময়কে আলোচনায় নিয়েছেন, বিধৃত করার চেষ্টা করেছেন একজন বেসামরিক ব্যক্তিত্ব সামরিক আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত থেকেও প্রকৃত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কথা।
বিচারপতি সায়েম লিখেছেন যে তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পুরোপুরি বাতিল করার চিন্তা করেছিলেন এবং এজন্য তাঁর বিশেষ সহকারী বিচারপতি সাত্তারকে ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে একাধিকবার খসড়া প্রণয়নের নির্দেশ নিয়েছিলেন। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানে থাকা বা না থাকার প্রশ্নে নীরব রয়েছেন এবং সংশোধনীর কোন উদ্যোগ নেননি।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি লিখেছেন যে, তাঁর বিশেষ সহকারী, সুপ্রীমকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির মতো পদের দায়িত্ব পালন করছিলেন অথচ তিনি একজন বেসামরিক রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যা আলাপ হতো সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে তা সবিস্তারে জানিয়ে আসতেন সমর নায়কদের। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সায়েম চতুর্থ সংশোধনী বাতিল না করলেও একটি জাতীয় দলের পরিবর্তে বহুদল গঠনের ফরমানটি জারি করেছিলেন। বিচারপতি সায়েমকে দিয়ে অন্য যে কাজ করানো হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে : (ক) ৮ নভেম্বর ’৭৫ জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান হিসাবে পুনঃনিয়োগ এবং ৬ নবেম্বর থেকে সংসদ বাতিল (খ) ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর কলাবরেটর আইন বাতিল যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা (৩০/১১/৭৩) বহির্ভূত অপরাধী খুন, ধর্ষণ, লুটের মতো জঘন্য অপরাধীর বিচার করা যেত এর ফলে কলাবরেটর আইনে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিরা (৭৫২ জন) মুক্তি পেল এবং ধর্ম ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করার সুযোগ পেল। (গ) ২২ জানুয়ারি ’৭৬ তারিখের সামরিক ফরমান দিয়ে নাগরিক পরিচয়ে ‘বাঙালীকে’ বাংলাদেশী বানালেন।
রাজনৈতিক সুবিধাবাদের ধারা কিভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে তার প্রামাণ্য তথ্য রয়েছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির গ্রন্থে।
নিজের বেসামরিক উপদেষ্টাদের সম্বন্ধে লিখেছেন যে, সভায় তাদের মতামত জানতে চাওয়া হলে তারা প্রথম দিকে চুপ থেকে জেনারেল জিয়ার দিকে তাকাতো। জেনারেল জিয়া যখন বলতেন, ‘দিস ইজ এ ভ্যালিড পয়েন্ট স্যার’ তখন অন্যরা সুর মেলেতো। বিচারপতি সায়েম ৬ নবেম্বর ’৭৫ প্রদত্ত বেতার/টিভি ভাষণে (গ্রন্থে সংযোজন পৃ. ৮৭) বলেছিলেন যে স্বল্পতম সময়ে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন। (অবশ্য খন্দকার মোশতাক ৬ অক্টোবর ’৭৫ ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৫/৮/৭৬ থেকে রাজনৈতিক বিধি নিষেধ প্রত্যাহার ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিন ধার্য করেছিলেন ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি)। কিন্তু তিনি তা করে যেতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
অবশ্য ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, তিনি ‘শেখ মুজিবের মতো টাওয়ারিং এবং ক্যারিসমেটিক ব্যক্তিত্ব এবং যার নামে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বিজয় অর্জিত হয়েছে’ তার এবং জেল হত্যা পরবর্তীতে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিচারপতি সায়েম বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে দাবি করলেও বস্তুত তা ছিল সামরিক ব্যাপার। কেননা, সে সময় থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গন ‘ডিফিকাল্ট’ হতে শুরু করে যা এখানও অব্যাহত রয়েছে। তিনি কেন নির্বাচন করে যেতে পারেননি সে প্রসঙ্গে লিখেছেন যে এ বিষয়টি যদিও তাঁর বিশেষ সহকারী বিচারপতি সাত্তারের প্রধান দায়িত্ব ছিল তবুও সে জন্য বিচারপতি সাত্তারের কোন আগ্রহ ছিল না (পৃ. ৪৩)। এছাড়া তার অন্যান্য উপদেষ্টাদের অনেকেই চাকরি হারানো বা তারা যা করেছেন তা নির্বাচিত সরকার বাতিল করে দিতে পারেন এই ভয়ে নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন না।
রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনের চাইতে ক্যান্টনমেন্টের সমর্থন আদায় (পৃ. ৩৭) বেশি মনোযোগী ছিল। তবে সে প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ছিল না বলে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি স্বীকার করেছেন (পৃ. ১১)। একজন বেসামরিক রাষ্ট্রপতি থাকা সত্ত্বেও রাজনীতিবিদরা ক্যান্টনমেন্টের সমর্থন লাভের চেষ্টাকে তিনি উত্তরাধিকারী সূত্রে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের সামরিক শাসনের সুবাদে প্রাপ্ত হীনমন্যতাকে দায়ী করেছেন (পৃ. ৩৬)। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার (ফসল অক্টোবর ’৮৭) সঙ্গে সাক্ষাতকারে তিনি সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের মূল্যায়ন করেছেন এই ভাষায়, ‘যাদের রাজা হবার কথা তারা চাকর হতে চায়। ’
নিজের পদত্যাগ মুহূর্তের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন বিচারপতি সায়েম।
তিনি লিখেছেন যে, শেষ দিকে নিজে উপলব্ধি করেছেন যে সরকারের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। উল্লেখ্য, ২১ এপ্রিল ’৭৭ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকলেও ২৯ নভেম্বর ’৭৬ এক সামরিক ফরমান বলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি জিয়া দখল করায় রাষ্ট্রপতির বস্তুত ভূমিকা থাকে না। তিনি নাকি নিজে পদত্যাগ করার কথা চিন্তা করেছিলেন কিন্তু ইতোমধ্যেই তাঁর বিশেষ সহকারী বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে কতিপয় বেসামরিক উপদেষ্টা ২১ এপ্রিল ’৭৭ রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে দেয়ার জন্য প্রস্তাব দেন এবং তারা তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে চাকরি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তিনি রাজি হন এবং নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানদের মতামত নিয়ে বিশেষ সহকারীকে (বিচারপতি সাত্তার) পাঠিয়ে জেনারেল জিয়াকে বঙ্গভবনে আনা হয়। রাষ্ট্রপতি সায়েম কাকে সম্বোধন করে পদত্যাগ পত্র পেশ করবেন এবং কিভাবে করবেন তা নিয়ে সমস্যার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন যে এ বিষয়ে সামরিক আইনে কোন বিধান ছিল না আর খন্দকার মোশতাকের মতো প্রতিনিধি মনোনয়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্লামেশন দেয়ার ক্ষমতাও তার ছিল না।
কেননা সিএমএলএ পদটি অনেক পূর্বেই জিয়া দখল করে নিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে ফরমান জারির ক্ষমতা ছিল জেনারেল জিয়ার। ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকলে তাকে সম্বোধন করে পদত্যাগ পেশ করা যেত; কিন্তু তখন সে পদে কেউ ছিলেন না। সঙ্কট উত্তরণের জন্য বিচারপতি সাত্তার আইন সচিবের শরণাপন্ন হন। কিন্তু জেনারেল জিয়া এই জটিলতার অবসান করেন এই বলে যে, যেহেতু তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সেহেতু সামরিক আইনের বলে জটিলতা নিরসন করে নেবেন।
এমতাবস্থায় বিচারপতি সায়েম যখন নিশ্চিত হলেন যে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি হতে চান তখন ‘স্বাস্থ্যগত’ কারণে এবং জাতীয় স্বার্থে জেনারেল জিয়ার অনুকূলে পদত্যাগ করেন। বিচারপতি সায়েম পদত্যাগ করার আগে জেনারেল জিয়াকে বলেছিলেন যে, তিনি অবাধ একটি নির্বাচন করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেছিলেন তা যেন তিনি করেন। বিচারপতি সায়েম ভাবতে পারেননি যে জেনারেল জিয়া নিজে নির্বাচন করবেন এবং তা নিজে সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি ও সিএমএল এ পদে অবস্থান করে।
বিচারপতি সায়েম অনেক কথাই লিখতে পারেননি বলে স্বীকার করেছেন (পৃ. ৪৫)। তিনি ৪র্থ সংশোধনী বাতিল বা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে না পারায় ব্যর্থতাই নিয়েই মূলত আলোচনা করেছেন।
তবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেল হত্যার বিচার প্রসঙ্গে কোন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কিনা তা আলোচিত হয়নি। এই হত্যাকা-ের বিচার না হওয়ার প্রক্লামেশন মোশতাক দিলেও তা বাতিল করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি সায়েমের ছিল। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- বিচার করা যাবে না বলে যে আইন পাস করা হয়েছিল তাই-ই আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় হিসেবে ২০ বছর ধরে বিবেচিত হতো। স্মরণ করা যেতে পারে সে বিচারপতি সায়েম পদত্যাগের ২ দিন পর ২৩ এপ্রিল ’৭৭ জেনারেল জিয়া সংবিধানের প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রীয় নীতিমালা পরিবর্তনসহ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী জারি করেন সামরিক ফরমান দিয়ে। পদত্যাগের মাত্র ২ দিন পরে সুদীর্ঘ এই ফরমানটি জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি পদ দখলের পরে ঘোষিত হলেও প্রণয়ন ২ দিন সম্ভব নয়।
যদিও ২৯/১১/৭৬ এরপর ফরমান জারি করতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছিল না কেননা তা সিএমএলএ জিয়াই করতেন। এই ফরমানটি জারিতে রাষ্ট্রপতি সায়েম কি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে কোন বক্তব্য নেই। থাকলে পুস্তকটি আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। সে যাই হোক, বিচারপতি সায়েম প্রথম সংবিধান লঙ্ঘনকারী হিসেবেই চিহ্নিত থাকবেন।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়া চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করেননি।
একদলের বদলে বহুদল করার সুযোগ দিয়েছিলেন বিচারপতি সায়েম। বঙ্গবন্ধুকে ৪র্থ সংশোধনীর সুবাদে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন এর ত্বরিত সিদ্ধান্তের প্রয়োজনে যে ক্ষমতা জাতীয় সংসদ দিয়েছিল সে সুবাদে পরবর্তীকালে তাকে গণতন্ত্র হত্যার একনায়ক আখ্যা দিয়ে হত্যার অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয় কিন্তু এই ক্ষমতা নিয়ে দেশ শাসন করে জেনারেল জিয়া হলেন ‘গণতন্ত্র উপহারকারী’ (উপহাস আর কাকে বলে)। জেনারেল জিয়ার গণতন্ত্র যা তিনি নিজেই ডিফিকাল্ট করে দিয়েছেন। জিয়া-এরশাদ যুগে গণতন্ত্রের নামে ভোট ডাকাতি, রাজনীতি ক্রয় পণ্য-জনগণ তার নিজের ভোট প্রয়োগ থেকে ছিল বঞ্চিত। ক্ষমতার শীর্ষে বসে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের যে রাজনীতি বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে শুরু হয় তার প্রামাণ্যচিত্র রয়েছে গ্রন্থে।
তবে বাংলাদেশে সামরিক শাসন পাকাপোক্তর জন্য সমর নায়কদের সঙ্গে মদদ যোগাতে বেসামরিক সুবিধাবাদী রাজনীতিক ও আমলাতন্ত্র যে অতি বেশি উৎসাহী সে কথা স্পষ্টভাবেই একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি স্বীকার করেছেন। বলাবাহুল্য, সামরিক শাসন তথা রাষ্ট্র পরিচালনায় যে মেরুকরণ জেনারেল জিয়া করেছিলেন তার জন্য তার সামরিক সহকর্মীদের চাইতে (জিয়ার বিরুদ্ধে কমবেশি ১৮টি সেনা বিদ্রোহ ছাড়াও জিয়া তার সেনাবাহিনীর হাতে নিহত)। মূলত দায়ী ছিল সেই সব মেরুদ-হীন রাজনীতিক যাদের এমন কোন রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না যা নিয়ে তারা এককভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারেন। কেননা তাদের মন্ত্রী হতে হলে কোন না কোন সমর নায়কদের পদলেহনই করতে হবে এবং তারা তখন জেনারেল জিয়াকে এমনি ধারায় নিয়ে গেলেন যা শুধু জেনারেল জিয়াকেই মিনি পাকিস্তান বানাতে সাহায্য করেছে। শুধু তাই নয়, সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে চার মূলনীতি বাতিল এমনকি ১৯৪৭ সাল থেকে ঐতিহাসিক সংগ্রামকে অস্বীকার করে সামরিক ফরমান বলে সংবিধান সংশোধন করে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ বলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গ-ি শুধুমাত্র ২৬ মার্চ ’৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়।
তাই দেখা গেছে যারা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচীর জন্য প্রেস সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরি রাখার চেষ্টা করা হয়। তাই দেখা গেছে, যারা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচীর জন্য প্রেস সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরি করেছেন। (এনায়েত উল্লাহ খান) এবং দলে দলে বাকশালে যোগদান করেছিল, শ্রেণী সংগ্রামের নামে গলাকাটার রাজনীতি করেছেন তারাও আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে জিয়ার উপদেষ্টা সেজেছেন। এরাই মদদ যুগিয়েছিল জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক সুবাদে স্থপতি বানানোর ষড়যন্ত্রে। যে কলম দিয়ে জিয়া সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন করেছিলেন সে কলম দিয়েই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাতিলকৃত মদের লাইসেন্স নবায়ন করে দিয়েছিলেন।
আর মুসলিম বিশ্বের সাহায্য পাওয়ার আশায় যদি তা করে থাকেন তবে তা বঙ্গবন্ধুর আমলেই মুসলিম বিশ্বের প্রায় সব দেশেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। সৌদি-চীন স্বীকৃতি আগস্ট ’৭৫ শেষ সপ্তাহেই। একদিকে অতি প্রগতিবাদীরা জিয়ার আনুকূল্য লাভের আশায় জিয়াকে অতি উচ্চাভিলাষী করে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান দখল করার ষড়যন্ত্রে মদদ যুগিয়েছে অন্যদিকে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিজেদের পুনর্বাসনের জন্য রাজনীতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে, রাজাকার হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য, জিয়ার যেসব অনুসারীরা তাঁর মৃত্যুর পরে নতুন স্বৈরশাসক এরশাদের দরবার মশগুল করেছেন। আবার ফিরেছেন তার স্ত্রীর দলে।
অথচ জিয়াকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে মাত্র সাড়ে তিন বছরে (’৭৪-এর পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিকরণসহ) দেশকে একটি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে বঙ্গবন্ধু যখন সক্ষম হয়েছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শাহাদাৎবরণের পরে জিয়া ক্ষমতা দখল করেছিলেন। জিয়া পেয়েছিলেন, মুক্তি স্বাধীন সঙ্কটমুক্ত দেশ এবং চার নেতার অবর্তমানে (অন্যরা জেলে) অবস্থান ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির প্রায় শীর্ষে। জিয়া যেভাবে এগুলে জাতীয় ঐক্য বিপন্ন হতো না তা হচ্ছে :
(ক) তিনি যে জয় বাংলা বলে ২৬ মার্চ, ’৭১ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ২৭ মার্চ যার পক্ষ থেকে কালুরঘাট বেতার ভাষণ (অবশ্য এমএ হান্নানের ৩০ ঘণ্টা করে) সেই বঙ্গবন্ধুর একজন সৈনিক তাঁর হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়ে মাত্র একটি ঘোষণা দিতেন ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আততায়ীর হাতে শহীদ হয়েছেন। আমরা তাঁর সৈনিক।
তাঁর অসমাপ্ত কাজ আমাদের করতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যেদিন এদেশের মানুষ খেতে পরতে পারবে সেদিনই তাঁর আত্মা শান্তি পাবে। (জেনারেল জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনীদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করে বরং দায়-দায়িত্ব নিজেই গ্রহণ করলেন। তার উত্তরসূরি বিএনপি সে বলয় থেকে বেরুতে পারছেন না। )
(খ) সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনী বাতিল করে ২৫ জানুয়ারি ’৭৫ পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাওয়া।
বস্তুত জিয়া তা না করে নিজে রাজনীতিক ডিফিকাল্ট এবং জাতিকে একাত্তরের চেতনা ও কথিত ৭ নবেম্বর চেতনায় বিভক্ত করে দিয়ে, ধর্মব্যবসায়ীদের রাজনীতির অধিকার দিয়ে (২৩/৭/১৯৭৭) পরাজিত শত্রুর পাকিস্তানী ধারায় অবস্থান নিয়ে, পাকিস্তানের নাগরিক গোলাম আযমকে দেশে এনে (১১/৭/৭৮) নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করবেন এই আশায়। এখন সেই গোলাম আযমরা জিয়ার উত্তরসূরিদের কাঁধে ভর করে জাতিকে জিম্মি করে ফেলেছে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। যে বঙ্গবন্ধুর জন্ম এবং দেশ স্বাধীন না হলে মেজর জিয়া বড়জোর পাকিস্তানের কর্নেল হতেন হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট বাংলাদেশে। অথচ বঙ্গবন্ধুর প্রতি জেনারেল জিয়া যে আচরণ করেছিলেন তার শাস্তি ইতিহাসে নির্ধারিত।
এটা তার উত্তরাধিকারীদের বহন করতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।