বছর তিন আগের ঘটনা, সেপ্টেম্বরের কোন এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে চারজন বন্ধু বাসায় বসে আছি। ব্যাচেলর বাসা, আনন্দ-ফূর্তির উপাদান সীমাবদ্ধ। পিসির সামনে ঘাপটি মেরে থাকা, গল্প করা, নয়ত তাস পেটানো। খুব সম্ভবত সবাই আড্ডাই দিচ্ছিলাম। সকাল থেকেই বাইরে গুড়ি-গুড়ি বষ্টি হচ্ছিল, তাই আবহাওয়া খানিকটা ম্যাজম্যাজে।
এখানকার বৃষ্টির এই একটা সমস্যা। যেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হবে, সেদিন ঘন্টা দুয়েক বা তিনেক ফাটাফাটি রকমের বৃষ্টির পর গনগনে রোদের দেখা পাওয়া যায়। আর যেদিন টিপ-টিপ বৃষ্টি সেদিনকার দিনটাই মাটি। স্যাতস্যাতে হয়ে থাকে আবহাওয়া। ব্যাচেলর কবিরা কেন যে টিপ-টিপ বৃষ্টি পছন্দ করতেন সেটা ভেবে অবাক হই।
আড্ডার এক পর্যায়ে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। দরজার কাছাকাছি যেছিলো নিতান্ত অনিচ্ছায় সে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখি জনাদুয়েক ভিনদেশী। দেখে তো মনে হয় চাইনীজ বীজ, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ভাবলাম ভূল করে এসেছে, হয়ত পাশের বাসার অতিথী।
কৌতুহলী প্রশ্নের পর জানতে পারলাম তারা একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী থেকে এসেছে, তাদের উপর গুরু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে উক্ত কোম্পানীর সার্ভিসে কাস্টমাররা সন্তুষ্ট কিনা তা জানার জন্য, আর যদি সন্তুষ্ট না হয় তবে কিভাবে সার্ভিসের মান ডেভলপ করা যায় তার আইডিয়া নিতে। মেয়েটা মোটামুটি রুপসীর ক্যাটাগরীতে পড়ে। পাশের ছোরাটার সাথে ইয়ে আছে ভেবে আমরা নিরস্ত হলেও প্রেমিক বন্ধু সোহেল মেয়েটার দিকে ৪৫ ডিগ্রী এন্গেলে তাকিয়ে বাংলা হিরো টাইপ রোমান্টিক হাসি হাসার চেষ্টা করছিলো। আর সর্বদা ডাইরেক্ট একশানে বিশ্বাসী বড়ভাই স্বপনদা কামুক চোখে দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে থেকে সুবিধা করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিলো। সার্ভের প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলে তারা জানাল কোম্পানীর (টেসকো সুপারমার্কেট) পক্ষ থেকে সার্ভেতে অংশগ্রহনকারী সদস্যদের জন্য রয়েছে ছোট্ট লটারীর ব্যাবস্থা।
ব্যাগ থেকে চারপাচটা মুখবন্ধ খাম বের করে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল। বলল এবার খামগুলো খুলুন। আমার বন্ধুদের কারো ভাগ্যে ক্যান্ডি, কারো ভাগ্যে চিপস পড়ছিলো, ব্যাগ থেকে বের করে তারা সেগুলো বিতরন করছিলো। আমার খাম খুলে দেখি ভেতরে কিছু নেই, তার বদলে অরেন্জ কালারের একটা স্টিকার। চান্কুদের ওটা দেখিয়ে বললাম এটা কি? তাদের দুজনের চোখ কপালে।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তারা জানাল এই চিহ্ণটা হল মিস্ট্রি গিফট। বিভিন্ন কালারের খালি স্টিকার মানেই স্পেশাল গিফট। ওরা ব্যাগ থেকে লিস্ট বের করে দেখল অরেন্জ কালারের স্টিকার মানে স্পেশাল ২য় পুরষ্কার টয়োটা আলটিস গাড়ী। দুজনেই ইয়াহূহূ বলে লাফিয়ে উঠল, আমি যেন তখনো কিছু বুজে উঠতে পারছিনা। সবকিছু কেমন যেন অপরিচিত লাগছিলো।
অনেকটা আবেগশুন্য হয়ে পরেছিলাম হয়ত। সম্ভিত ফিরে পেলাম তারা দুজনে যখন আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরল তখন। আমার বন্ধুরা সহ ভিনদেশী দুজনও যেন আনন্দে আত্মহারা। তারা আমাকে হাগ করছিলো দেখে স্বপনদা বন্ধু সোহেলকে ঠেলদিয়ে সোফার অপরপ্রান্ত থেকে বিদ্যুতবেগে লাফিয়ে এল হাগকার্যে অংশগ্রহন করতে, ডাইরেক্ট একশানে বিশ্বাসী স্বপনদা হয়ত এতক্ষন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। আস্তে আস্টে আনন্দপর্ব শেষ হওয়ার পর তারা জানাল আমরা যেন যেকোন সময় তাদের অফিসে গিয়ে গাড়ীর চাবী বুঝে নিয়ে আসি।
গাড়ী হেড অফিসে গেলেই পাওয়া যেবে, বেশী কষ্ট করতে হবেনা, তবে কিছু প্রসিডিয়ার আছে সেগুলে মেনে যেকোন সময় গিয়েই গাড়ী নিয়ে আসা যাবে। আমরা ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। হেড অফিসে গেলে গাড়ী পাওয়া গেলে তবে আজ নয় কেন? আজই আনব। তাদের অনুরোধ করলাম তোমরা আমাদের সাহায্য কর। তারা রাজী হল।
স্বপনদার গাড়ীতে করে তাদের নিয়ে রওয়ানা দিলাম হেড অফিসের উদ্দেশ্যে। পঠে গাড়ীতে জানতে চাইলাম প্রসিডিওর গুলো কেমন? তারা জানাল আজ গিয়ে টিকিটটা জমা দিয়ে গাড়ীর জন্য এপ্লাই করে আসতে হবে। ১ কার্যদিবস পর গাড়ীর সকল ডকুমেন্টস আমার নামে রেডী করার পর ২য় কার্যদিবসে চাবী আমার হাতে দেওয়া হবে। তবে গাড়ীর রেগিস্ট্রেশন সহ অন্যান্য খরচ আমাকেই বহন করতে হবে, এজন্য আমাকে হেড অফিসে এপ্লাই করার সময় ১০০০ ইউএস ডলার পে করতে হবে। স্বপনদা এবার বেকে বসলেন, বললেন আগে আমরা একটা টাকাও পে করতে পারবনা, গাড়ী দেয়ার পর দরকার হলে দুই হাজার ডলার পে করব।
তারা বেশ আদবের সাথে জানাল এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানী, সবার জন্য একি নিয়ম। এবং আমাদের টাকা জমার রসিদ দেয়া হবে, সুতরাং কোন চিন্তা নেই। স্বপনদাকে অনেক কষ্টে রাজী করালাম, বললাম টাকা গেলে আমার যাবে, সব জায়গায় দর কষাকষি করবেন না। দরকষাকষির কোন দরকার নেই, আর টাকা জমার রসিদতো আমরা পাচ্ছিই। এবার কথায় কথায় তারা জানাল অফিসে আমাদের ঢুকতে হবে শুধুমাত্র যে লটারী পেয়েছে তাকেই, অন্যরা ঢোকার অনুমতি নেই, আর ঢোকার সময় অবশ্যই মোবাইল ফোন যেন বন্ধ রাখি।
এই কথা বলার সাথে সাথে বিলম্ব না করে স্বপনদা ঘ্যঁষ করে ব্রেক চাপলেন। বললেন তোমরা এই মুহুর্তে গাড়ী থেকে নামো, নইলে আমি পুলিশ ডাকবো। আমি স্বপনদার এহেন আচরনে বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম। ভাবছি ব্যাটা কি আসলে আমার এই প্রাপ্তিতে জেলাস হচ্ছে নাকি? ভিনদেশীরা গাড়ী থেকে নেমে গেল। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম স্বপনদার দিকে।
স্বপনদাও খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, চিন্তা করিসনা, ওদের নামিয়ে দিয়েছি, লটারী টিকিট টা তো ফেলে দিই নি। খোজ খবর নিয়ে কাল দরকার হলে আমরাই সোজা হেড অফিসে যাব। ফিরে এলাম ভগ্নরিদয়ে। বিধাতার লীলা। সেদিন রাতেই টিভির একটা ফান অনুষ্ঠান দেখে আঁৎকে উঠলাম।
আসলে এখানে চলছে এ ধরনের ধান্দাবাজী। এদের রয়েছে সুবিশাল সিন্ডিকেট। এরা কাউকে অনেকদিন থেকে টার্গেট করে পরে সেখানে অপারেশন চালায়। টিকিটের লটারী তাদের কাছে আগে থেকেই সেট করা থাকে। দুচারটা চকলেট বিস্কুট দিয়ে বাড়ী-গাড়ীর একটা বিশাল কাৎল মাছ ধরিয়ে দিয়ে হাতিয়ে নেয় নগদ টাকা, সোনা গহনা, এমনকি বাড়ীর ফ্রীজ ওয়াশিংমেশিন পর্যন্ত।
মনে মনে অহেতুক বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পেয়ে স্বস্তি বোধ করলাম, আর ডাইরেক্ট একশানে বিশ্বাসী স্বপনদার প্রতি কৃতগ্ঘ হলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।