আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বর্ণবৈষম্যের শেকলে বাঁধা আদিবাসী জীবন

আদিবাসীরা নানাভাবে এদেশে বৈষম্যের শিকার। এর একটি হলো বর্ণবৈষম্য। আদিবাসীদেরকে অস্পৃশ্য ভাবা। তাদের সাথে এক কাপে এক প্লেটে খাবার না খাওয়া। হোটেল থেকে বের করে দেওয়াসহ নানাভাবে তারা বৈষম্যের শিকার।

গত মাসের ৪ তারিখে জয়পুরহাটে এমনই এক ঘটনা আবারো ঘটেছে। সমতেলর আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবিতে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের গণসংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতা কর্মীরা ঐ দিন জেলার দূর্গাদহ এলাকা থেকে লং মার্চ করে জয়পুরহাট শহরে আসে এবং জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। লং মার্চে অংশগ্রহণকারীদের জন্য জয়পুরহাট বার সমিতির ক্যান্টিনে আগে থেকেই দুপুরের খাবারের অর্ডার দেওয়া ছিল। সেই অনুযায়ি তারা বার সমিতিতে দুপুরের খাবার খেতে যায়। এ সময় তারা ক্যান্টিনের গ্লাস ব্যবহার করে।

আর এতেই ঘটে বিপত্তি। জয়পুরহাট বার সমিতির সম্মানিত উকিলেরা এই খবর পেয়ে সেখানে এসে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। তারা ক্যান্টিন ম্যানেজারকে গালাগালি দিতে থাকে এই বলে যে, পানি খাওয়ার জন্য কেন আদিবাসীদের গ্লাস দেওয়া হলো। এই গ্লাসগুলো এখন অস্পৃশ্য হয়ে গেছে। এই গ্লাসে আমরা আর পানি খাব না।

ক্যান্টিন ম্যানেজার তাদের চাপে পড়ে জয়পুরহাট আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বাবুল রবিদাসকে ২৬টি গ্লাস দেন এবং গ্লাসগুলোর দাম দেওয়ার জন্য বলেন। আদিবাসীরা হতভম্ব হয়ে কি করবে কি না করবে এমন পরিস্থিতে পড়ে ম্যানেজারকে গ্লাসগুলোর দাম পরিশোধ করে দেয়। এখানে বলে রাখি বাবুল রবিদাস তিনি নিজেও একজন উকিল এবং এর আগে তাকেও বার সমিতিতে খেতে গিয়ে অপমানের শিকার হতে হয়েছে। এই ঘটনা জানতে পেরে আদিবাসীরা নিশ্চই অনেক দুঃখ পেয়েছে। কেউ কেউ হয়তো মনে মনে বলেছে এ কোন দেশ।

এটা কি আমাদের দেশ। যে দেশের জন্য আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। ঘটনা শুধু এখানেই থেমে থাকেনি। ঘটনা যাতে কেউ না জানতে পারে এই জন্য বার সমিতির সম্মানিত উকিলেরা জয়পুরহাটে কর্মরত গণমাধ্যমের কর্মীদেরও ম্যানেজ করে এবং সত্যি সত্যিই দেখা যায় পরেরদিন কোন গণমাধ্যমেই এই খবর বের হয়নি।

আদিবাসীরা এতে আরো বেশী হতবাক হয়ে যায় এবং নিরুপায় হয়ে দৈনিক ডেইলি স্টারের দিনাজপুর প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ করে এবং ঘটনার বিস্তারিত জানায়। পরে গত ৬ তারিখ অর্থাৎ ঘটনার এক দিন পর ডেইলি স্টারে এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়। আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেনের সাথে কথা বলে জেনেছি জয়পুরহাটে এ ঘটনা ঘটার পর তারা সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানকার সাংবাদিকরা এই ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং তাদের বলেন আমরা দিনের বেলা আপনাদের সংবাদ সম্মেলনে যেতে পারবো না। আপনারা রাতের বেলা সংবাদ সম্মেলন করেন।

আদিবাসীরা বুঝতে পারে সাংবাদিকদেরকেও হাত করেছে বার সমিতির লোকজন। পরে আদিবাসীরা গত ১৫ তারিখ উক্ত ঘটনার প্রতিবাদে জয়পুরহাটের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে মানববন্ধন পালন করেন। এই সংবাদও এখানকার সাংবাদিকেরা প্রচার করা থেকে বিরত থাকে। আবারো দৈনিক ডেইলি স্টারের দিনাজপুর প্রতিনিধিকে এই খবর জানালে তিনি এই সংবাদ সংগ্রহ করে প্রচারের ব্যবস্থা করেন যা পরেরদিন ছবিসহ ডেইল স্টারে ছাপা হয়। তাই জয়পুরহাটের গণমাধ্যমের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা নিশ্চয় খবর লুকানোর জন্য এই পেশায় আসেননি।

যদি লুকাতেই চান তবে এই পেশা ছেড়ে অন্য কিছু খুজুন। আদিবাসীরা ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে গত ৭ অক্টোবর জয়পুরহাট বার সমিতি ও ১৮ অক্টোবর বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বরাবর আবেদন করেছেন। আশা করি বার কাউন্সিল ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এই লেখা থেকে আমিও জয়পুরহাটের ঘটনাসহ দেশের সকল স্থানে ঘটে যাওয়া বর্ণবৈষম্যের ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী ব্যাক্তিদের অনতিবিলম্বে শাস্তি প্রদানের দাবি জানাচ্ছি। এটাতো খুবই সাম্প্রতিক ঘটনার কথা বললাম।

এরকম ঘটনা উত্তরবঙ্গে অরো আছে। দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার বারোকনা আদিবাসী গ্রাম। প্রায় ২০০টি আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারের বসবাস এই গ্রামে। প্রায় ১০ বছর হলো এই আদিবাসী গ্রামের মাঝখানে একটি হাট বসানো হয়। খুব স্বাভাবিক আদিবাসীদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারনেই এই হাটে আদিবাসীদের কোন দোকান বা হোটেল দেখা যায়না।

আদিবাসী গ্রামের মাঝে এই হাট হলেও এখানেই তারা বর্ণবৈষম্যরে শিকার। হাটের হোটেলগুলোতে আদিবাসীদের খেতে দেওয়া হয়না। গ্রামের আদিবাসীদের মাঝে এই নিয়ে অনেক দুঃখ আছে। আমার দুঃখটা হয়তো আরো অনেক বেশী। কেননা আমিওযে ঐ গ্রামেরই ছেলে।

ঐ গ্রামই যে আমার জন্মস্থান। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তাম তখন একবার গ্রামে গিয়ে হোটেলের এই খাবার খাওয়া নিয়ে মারপিট করেছিলাম। কিন্তু আমি পারিনি। পারিনি সেখান থেকে আমার গ্রামবাসীকে উদ্ধার করতে। তাদের দুঃখ দুঃখই রয়ে গেছে আজো।

মারপিটের ঘটনার পরে হাট কমিটির সাথে মীমাংসা হয়েছিল মারপিটের কিন্তু দোকানে একই কাপ-প্লেটে খাওয়ার ব্যাপারে কোন মীমাংসা হয়নি। এই ঘটনার পরে আদিবাসীরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা আর কারো হোটলে ঢুকে কোনকিছু খাবেনা। বছরখানিক হলো গ্রামের এক আদিবাসী যুবক একটি চায়ের দোকান দিয়েছে। এখন গ্রামের আদিবাসীরা ঐ চায়ের দোকেনই আড্ডা মারে চা খায়। জানি না কবে এই বৈষম্য দূর হবে।

কবে ঐ এলাকার আদিবাসী বাঙ্গালিরা এক কাপে চা খাবে। কবে আমার সেই ক্ষমতা হবে যেদিন আমি পারবো আমার গ্রামবাসীকে এই বৈষম্য থেকে মুক্ত করতে। এরকম ঘটনা আরো অনেক ঘটেছে উত্তরবঙ্গ জুড়েই। রাজশাহীর তানোর উপজেলা বাজারে ঠিক একইভাবে আদিবাসীদের খেতে দেওয়া হয়না। আদিবাসীদের জন্য এইখানকার হোটেলগুলোতে ২ নম্বর কাপ-প্লেটের ব্যবস্থা আছে।

এখানেও অনেক প্রতিবাদ হয়েছে কিন্তু এই বৈষম্য রয়েই গেছে। পবা উপজেলার রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে বায়া মোড় বাজারের হোটেলেও আদিবাসীদের না খেতে দেওয়ার নজির আছে। উত্তরবঙ্গ ছাড়াও দেশের অনেক স্থানেই এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে। গত ২২ মার্চ দৈনিক সমকালে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদ সূচনাতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের একজন সুইপারের বক্তব্য উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল ‘হোটেলে ঢুকতে দেওয়া হয়না।

আর দিলেও নি¤œমানের কিংবা অব্যবহৃত প্লেট দেওয়া হয়। ভালো সেলুনে আমাদের প্রবেশ নিষেধ। এমনকি ছোট-খাটো দোকানে চা খাইতে চাইলে বাড়ি থেকে কাপ আনতে বলা হয়’। এইসব উদাহরণগুলো কোনভাবেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের যে চেতনা কাজ করেছিল তার সাথে মেলেনা। ভাবতে অবাক লাগে যখন একজন মানুষকে নয় পুরো একটি জাতিকে এইভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) ধারায় খুবই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। কিন্তু এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা যে বাংলাদেশের সংবিধান শুধু লোক দেখানোর একটি বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এখানে শুধু ভালোভালো কথা লেখা থাকবে কিন্তু সেগুলোর কোন বাস্তবায়ন হবেনা। গত ২১ মার্চ আন্তর্জাতিক বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী এক বাণীতে বলেছিলেন, 'আমি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে এই বিশ্ব থেকে সব ধরনের বর্ণবাদ, বর্ণ-বৈষম্য, জাতিগত বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা সম্পূর্ণভাবে নির্মূলে সব ধরনের বর্ণ-বৈষম্য নির্মূল সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের স্বাক্ষরকারী এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ একটি শান্তিময় ও সহিষ্ণু বিশ্ব গড়তে সব জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব প্রচেষ্টার প্রতি আমাদের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছি।

' প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, আপিন শুধু সুন্দর সুন্দর বক্তব্য দানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না। একটু চোখ কান খোলা রাখুন এবং দেশের সকল প্রশাসনকে নির্দেশ দিন কোথাও যেন কোন বর্ণবৈষম্যের ঘটনা না ঘটে আর যদি এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটে তাহলে যেন বর্ণবৈষম্য প্রদর্শনকারী ব্যাক্তিকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় । গত ৪ আগস্ট রাজশাধনাীর ব্রাক ইন সেন্টারে এক কর্মশালায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের ড. মিজানুর রহমান বলেছিলেন, ‘একটি বৈষম্যবিরোধী আইন করতে পারলে এদেশের আদিবাসীসহ দলিত, হরিজনরা সুরক্ষিত হবে’। আমিও তাঁর সাথে একমত বৈষম্যের শেকল থেকে মুক্তির জন্য একটি আইন খুবই জরুরী। আজ এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই এখনো বর্ণবৈষম্য টিকে আছে।

কিন্তু সত্যিকারের মানবতাবাদিদের প্রতিরোধের মুখে বর্ণবৈষম্য আস্তে আস্তে নির্মূল হওয়ার পথে। অনেক হতাশার মধ্যে এটি হচ্ছে আশার কথা। বর্ণবাদ বিরোধী নেতা ন্যালসন ম্যান্ডেলার কথা এখানে স্মরণ করতেই হয়। বর্ণবাদের শিকার মানুষদের পাশে তিনি দাড়িয়েছিলেন বলে তাকে ২৭ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছিল। আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও এখনো বর্ণবৈষম্য টিকে রয়েছে।

সেখানে যখন আমাদের দেশের মানুষরা বিভিন্ন কাজে যায় তারাও নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হোন। তখন নিশ্চয় একজন বাংলাদেশী হিসেবে সেটা আমাদের সকলকে দুঃখ দেয়। তাহলে কেন আমরা নিজ দেশের আদিবাসী, দলিত, হরিজন জাতিগোষ্ঠীদের সাথে বর্ণবাদ আচরণ জারি রাখবো আর তা দেখেও কোন ব্যবস্থা নিবনা। কবি বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্। নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি’।

সকলকে আহ্বান জানাই আসুন, কবির কন্ঠে, কন্ঠ মিলিয়ে এ কথা উচ্চারণ করি আর চিরতরে সোনার বাংলাদেশ থেকে বর্ণবাদ মুছে ফেলতে সকলের হাতে হাত রাখি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।