আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শারদীয় দুর্গাপূজা একের অন্তরের সাথে অন্যের অন্তরের সম্পর্ক সৃষ্টি ও মিলন।

বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় পূজা ও উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সাধারণত বিত্তশালীরাই এ পূজার আয়োজন করে থাকেন। আজকাল বারোয়ারী পূজাই বেশিরভাগ হয়ে থাকে। শরতের আগমনে আনন্দময়ীর আগমন বার্তা ভক্তদের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। সেই সাথে বাঙালী সর্বসাধারণের মনে এক আনন্দের অনুভূতি জাগায়।

দেবীদুর্গা বিশ্বজনীনরূপে বাংলার ঘরে ঘরে মানব সন্তানের কল্যাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধরায় অবতীর্ণ হন। তিনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করেন। সনাতন ধর্মের মূল গ্রন্থ বেদ। বেদের মূল কথা ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। নিরাকার ও সর্বশক্তিমান।

মহর্ষিগণ তাদের সাধনালব্ধ জ্ঞানে প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ ও শক্তির পরিচয় পেয়েছিলেন। সেই সকল শক্তিই বেদের দেবতারূপে পূজিত এবং আপন অভীষ্টলাভের সোপান। মহর্ষিগণ উচ্চকোটির সাধক ও সত্যদ্রষ্টা। সাধারণ মানুষ ও মহর্ষির দর্শন ক্ষমতা সমান নয়। তাই সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈশ্বর চিন্তাকে সহজভাবে চিন্তনের চিন্তা থেকে সাকার উপাসনার সৃষ্টি হয়।

এই সাকার উপাসনাতে ভক্ত সাধকগণ নিজ ইচ্ছানুযায়ী আরাধ্য দেবতার কাছে নিজেকে পূজা অর্চনার মাধ্যমে উৎসর্গ করে সম্বন্ধ স্থাপন করেন। এটাই মূর্তি পূজা, ঈশ্বরের সাকার উপাসনা। পূজার মাধ্যমে ভক্ত অসীম ভগবানকে সসীমের মধ্যে এনে তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণ করে এক অনাবিল আনন্দ উপভোগ করেন। কবিগুরু তাই বলেছেন ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাইত এত মধুর’। এই আনন্দই ভক্তের জীবনী শক্তি, শক্তির আধার।

তাই মানুষ নিজের সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে শক্তি সাধনা করে। এই শক্তি সাধনাই দুর্গাপূজা। দুর্গোৎসবের প্রবর্তক সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। কারও কারও মতে শ্রী রামচন্দ্র, আবার কেউ কেউ বলেন রাজা সুরথ প্রবর্তক। আবার অনেকে এ দু’য়ের কোনটি সত্য নয় বলে সৃষ্টির প্রথম থেকে আদ্যশক্তি দুর্গার অর্চনা হয়ে আসছে মতামত দিয়েছেন।

তাঁরই শক্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে, তিনিই পালন ও সংহার কর্তা। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান মতে সর্ব প্রথম পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণ জগৎ সৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টির সামর্থ্য রক্ষা করার প্রয়োজনে গোলকের নিত্য বৃন্দাবনস্থ রাসম-লে দেবীর পূজা করেছিলেন। এরপর মধূকৈটভ ভয়ে ভীত ব্রহ্মা, দূর্বাশা মুনির অভিশাপে শ্রীভ্রষ্ট দেবরাজ ইন্দ্র এবং পরবর্তীকালে মুনিগণ, সিদ্ধগণ এই মহাদেবীর পূজা করেন। পুরাকালে মহিষাসুর বধের জন্য দেবগণের সম্মিলিত তেজে দেবী আবির্ভূত হয়েছিলেন। অপর চিন্তনে মেধামুনির শিষ্য রাজা সুরথ নদীতীরে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির পূজা করেছিলেন।

দেবী ভাগবত অনুযায়ী ‘এরপর রাবণ নিধনের ইচ্ছায় শ্রী রামচন্দ্র জগন্মাতার পূজা করেন। ’ শ্রী রাম চন্দ্রের সাথে রাবণের যুদ্ধ হয়েছিল শরৎকালে। আর সে সময় দেবতাদের মধ্যরাত্রি। ঘুমন্ত অবস্থায় কেউই কাজ করতে পারে না। তাই শ্রী রামচন্দ্রকে সাহায্যের জন্য জগন্মাতা শ্রী দুর্গাকে অসময়ে ঘুম থেকে জাগাতে হয় আর একেই দেবীর অকাল বোধন বলে।

সেই থেকে এই শরৎকালে দেবী দুর্গা পূজিত হয়ে আসছে। নিদ্রা থেকে জেগে দেবী বলেছিলেন ‘আমি সপ্তমী তিথিকে শ্রী রামচন্দ্রের দিব্য ধনুর্বাণে প্রবেশ করব। অষ্টমীতে রাম-রাবণের মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমাথা মাটিতে লুটিয়ে পড়বে। দশমীতে শ্রী রামচন্দ্র বিজয় উৎসব করবেন।

ষষ্ঠাদি কল্প অনুসারে ষষ্ঠির দিন বিল্ব বৃক্ষের শাখায় দেবীর বোধন হয়, তারপর হয় আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ঐ দিনের পূজা হয় ঘটে। সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত পূজা হয় মৃন্ময়ী প্রতিমায়। সন্ধিপূজা ও বলিদান অর্থ অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে মাতৃ পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ। মহাশক্তির আবির্ভাবে এবং করুণায় শ্রী রামচন্দ্র রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধার করেছিলেন, শ্রী রামচন্দ্রের শারদীয় দুর্গাপূজার স্মরণেই আমাদের এই শারদীয় দুর্গাপূজা।

প্রাগৈতিহাসিক যুগেও ভারতে শক্তি পূজা প্রচলিত ছিল। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার নিদর্শনে অসংখ্য মৃন্ময়ী দেবী মূর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। মার্কেন্ডেয় পুরাণে শ্রী শ্রী চ-ীতে দেবী নিজ মুখেই বলেছেন ‘একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা। এ জগতে আমি একাই মাত্র বিরাজিতা, আমা ভিন্ন অতিরিক্ত আর কে আছে?’ এই অদ্বৈত তত্ত্বই বেদ, পুরাণ এবং তন্ত্র পোক্ত দেবী তত্ত্বের মূল কথা। অনন্ত জগতের মূলে আছেন এক মহাশক্তি।

যা থেকে সকল বস্তুর উদ্ভব। তাঁর মধ্যেই সকলের স্থিতি ও বিনাশ বা শেষ পরিণতি। এক হয়েও তিনি বহুরূপে ব্যক্ত হয়েছেন সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তিনি সর্বভূতে বিরাজিতা। তাই আমরা প্রণাম জানাই ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমোঃ।

’ কাম ক্রোধের বশে জীব হিতাহিত ও ভবিষ্যত দৃষ্টি হারা হয়ে যায়। আস্তে আস্তে অসুরেরা অর্থাৎ ইন্দ্রিয় বৃত্তিসমূহ সকলেই এসে মহিষাসুরের অর্থাৎ কামের পতাকাতলে সমবেত হয় নানা ছদ্মবেশে কুপ্রবৃত্তিগুলো মানুষের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে। মানুষ তা প্রথমে বুঝতে পারে না। এবং যখন বোঝে তখন নিষ্কৃতি লাভের উপায় খুঁজে পায় না। ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়ের দাসে পরিণত হয়।

এরই প্রতিফলনে শারদীয়া মায়ের প্রতিমায় রজোগুণের প্রতীক সিংহ সাত্ত্বিকরূপী মায়ের বাহন তমোরূপী অসুর পরাস্ত হলেও মায়ের চরণেই তার স্থান হয়। দুর্গা শব্দের অর্থ যিনি জীবের দুর্গতি হরণ করেন। আর একটি অর্থ দুর্জ্ঞেয়। মায়ের বাহন সিংহ। এই সিংহ শব্দটি হিংস ধাতু থেকে উৎপন্ন রজোগুণের প্রতীক দুর্দমনীয় পশুশক্তি।

আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এ শক্তি বিরাজমান। তাই জীব চায় পশুত্ব থেকে দেবত্বে উজ্জীবন। আর এ জন্যই মাতৃচরণে ঐকান্তিক শরণাগতি। আর এতেই অন্তঃর্নিহিত সুপ্তদৈবী সত্তার উন্মেষ হয়ে দেবীর করুণার আধারে বিচরণ করা যায়। জাতির রক্ষা ও কল্যাণে রজোগুণ সম্পন্ন শক্তি সাধনার প্রয়োজন।

এবং সেই শক্তিকে নিয়ম নীতির মাধ্যমে ব্যবহৃত না হলে শক্তি হবে বিপদগামী। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দুর্গা পূজা করে থাকেন। দুর্গাপূজা শুধু একটি সাধারণ পূজাই নয়। এটি সনাতনী হিন্দু ধর্মে বৃহৎ উৎসব ও বটে। উৎসবের অর্থ হলো সর্বজনীনতা।

একের অন্তরের সাথে অন্যের অন্তরের সম্পর্ক সৃষ্টি ও মিলন। দুর্গোৎসবের মাধ্যমে আমরা পরস্পরের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে আনন্দে মেতে উঠি। তাই শারদীয় দুর্গোৎসব বাংলা ও বাঙালীর প্রাণের উৎসব। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।