আমার কিন্তু স্বপ্ন দেখতে আজও ভাল লাগে ।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একদিন হঠাৎ করে শাওন ফোন করে বলে, “আপনাদের অঞ্চলে হাওরের পাশে কোনো জমিদার বাড়ির খোঁজ দিতে পারেন? আমরা যে লোকেশন ঠিক করেছিলাম সেটা ওর [হুমায়ূন আহমেদ] পছন্দ হচ্ছে না। ”
বুঝলাম, ঘেটুপুত্র কমলার জন্য লোকেশন হান্টিং ফেল করেছে। এর আগে খবর পেয়েছিলাম যে, সুনামগঞ্জের দিকে একটা লোকেশন ঠিক করা হয়েছিল, শুটিং-এর তারিখও মোটামুটি ফাইনাল। এই লোকেশন হান্টিং-এর জন্য দুই দফায় ইউনিটের লোকজন ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে শুট করে এসেছে।
এবং মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, এই শুটিং হান্টিং-এর ঘটনা নিয়ে স্যার একটা ঈদ সংখ্যার জন্য ‘ম্যাজিক মুন্সি’ নামক একটা যাদু বিষয়ক ‘উপন্যাস’ও লিখেছেন। উপন্যাসটি আমার মোটেও পছন্দ হয়নি। বলেছিলামও স্যারকে। সে প্রসঙ্গ থাক, লোকেশন খোঁজার গল্প বলি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার গুনিয়াউক গ্রামের পাশের হরিপুর গ্রামের জমিদারের পরিত্যক্ত বাড়ির কথা হঠাৎ করেই আমাদের মাথায় চলে আসে।
২০০০ সালে আমরা ১০ দিন ছিলাম এ গ্রামে। আমার লেখা টেলিফিল্ম ‘নাইওরী’ শুট করে ট্রলার দিয়ে ফেরার পথে চমৎকার এই বাড়িটি আমরা দেখেছিলাম। হাওড়ের সঙ্গে ঘাটলা বাধানো। পানিতে টইটম্বুর পুরো এলাকা। হাওড়ের পানির ওপর চমৎকার প্রতিফলন পড়েছিল।
আমরা কিছু ছবিও তুলেছিলাম এটাকে পেছনে রেখে।
আমি ফোনের এ প্রান্ত থেকে শাওনকে এই দৃশ্যেরই বর্ণনা দেই এবং লক্ষ্য করি শাওন বেশ উত্তেজিত বোধ করছে। মনে হলো যেন, এরকমই একটা লোকেশন তারা খুঁজছে। এরপর আমি অনেক অসুবিধার কথা শোনালাম। বললাম যে, ওটা সম্ভবত: একটা পোড়ো বাড়ি, যে কোনো সময় ভেঙে পড়ে যেতে পারে।
আমাদের ‘নাইওরী’র পর তৌকির [আমার বন্ধু, প্রাক্তন ব্যবসায়িক অংশীদার, বিশিষ্ট অভিনেতা-পরিচালক তৌকির আহমেদ] এ বাড়িতে পরে আরেকটি টেলিফিল্মের [উত্তর পুরুষ] শুটিংও করেছিল। দু’টো টেলিফিল্মেরই ক্যামেরাম্যান ছিলেন রফিকুল বারী চৌধুরী। হরিপুরের পাশের গ্রাম গুনিয়াউক তার নানার বাড়ি। কিন্তু এখন তিনিও বেঁচে নেই, বর্তমানে এটা কী অবস্থায় আছে বলতে পারবো না। শাওন বললো, কাল ভোরেই সে লোক পাঠাবে জায়গা দেখার জন্য।
আমি আরো কিছু তথ্য দিলাম। তথ্যগুলো হচ্ছে, এ জমিদার বাড়িটি যে ইউনিয়নে, তার চেয়ারম্যানের নাম লাল মিয়া। তার চেহারা অতি কৃষ্ণকায়, তিনি সারাক্ষণ পান চিবান। তার সঙ্গে কথা বলে যেন সব জেনে নেয়। এ বাড়ির মূল মালিক কে বা কারা আমরা জানি না।
কিন্তু কিছু রিফিউজি টাইপের বাস্তুহারা কিছু লোক এ বাড়িতে থাকে, আমরা দেখেছি ২০০০ সালে।
পরদিন সন্ধ্যায় শাওনের ফোন আবার। ‘থ্যাংক ইউ শাকুর ভাই, আমরা বাড়ি ও লোকেশনের ভিডিও দেখেছি। লোকেশন ফাইনাল। লোক চলে যাচ্ছে বাড়ি রিনোভেট করতে।
কিছু প্লাস্টার করা হবে, রং দেওয়া হবে। রং শুকালেই শুটিং। আর শোনেন, লাল মিয়া মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। নতুন চেয়ারম্যানের নাম অমুক মিয়া। তিনি নিশ্চয়তা দিয়েছেন, আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করবেন।
সুতরাং আমরা ‘ঘেটুপুত্র কমলা’টা এখানেই করছি।
‘দখিন হাওয়া`য় এক সন্ধ্যার আড্ডায় অতি উৎসাহী হয়ে মাসুদ আকন্দ কিছু স্টিল ছবি দেখাতে চাইলো। বড় কম্পিউটার স্ক্রিনে আমরা স্টিলগুলো দেখে সবাই মুগ্ধ হলাম।
-এতো সুন্দর মেয়ে পাইলেন কোথায় স্যার?
-আরে গাধা ওটাইতো কমলা। ঘেটুপুত্র।
মেয়ে হতে যাবে কেন, ওকে মেয়ে বানানো হয়েছে।
শাওন শোনালো কি করে টোকাই থিয়েটারের এ ছেলেকে পাওয়া গেলো। আমি চিনতে পারি না। বলা হলো - বাংলা লিংকের বিজ্ঞাপনে এক জেলের ছেলের চরিত্র করেছে।
এবার চিনতে পারি।
দুর্দান্ত অভিনেতা এই ছেলেটা। একটু বড় হয়ে গেছে এখন।
মাসুদ আকন্দের উৎসাহ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। কতোগুলো পোস্টারের ডিজাইন সে নিজেই করে ফেলেছে। সেগুলোও দেখা হয়।
ইন্টারনেটে ক্যাম্পেইনের জন্য একটা শো-রিল বানিয়েছে গান দিয়ে। এ ছবিটির বহুল ডিজিটাল প্রচারের জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসে মাসুদ।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি ও আমার পঞ্চপর্যটক দল ৩ সপ্তাহের জন্য পূর্ব ইউরোপ সফরে বেরিয়ে পড়ি। অনেক দিন স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ নাই। আমরা যখন দেশে ফেরত এলাম, শুনি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র শুটিং শুরু হয়ে গেছে এবং আমি যে জায়গাটির খোঁজ দিয়েছিলাম, সেখানেই হচ্ছে শুটিং।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ইউনিট যখন নাসিরনগর উপজেলার ওই লোকেশনে গিয়ে পৌঁছে, তখন ভরা বর্ষার ভাটা শুরু হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই ৬-৭ ইঞ্চি করে পানি কমতে থাকে। আমি খবর পাই প্রতিদিনের শুটিং এর।
এদিকে মাজহার মেরুদণ্ডজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের পরামর্শে আক্ষরিক অর্থেই শয্যাশায়ী। বাথরুম ছাড়া অন্য কোনো কারণে তার দাঁড়ানোর হুকুম নাই।
এ কারণে তার লোকেশনে যাওয়া হচ্ছে না। একদিন আমাকে ফোন করে বলে, ‘স্যার নাকি বলেছেন, তুমি না হয় পিঠ ভাঙা, শাকুরের তো কিছু হয় নাই, ও আসছে না কেন?’
মাজহারের কথার ইঙ্গিতটা এমনই যে, প্রতিদিনই নাকি শুটিং শেষে স্যার যখন আড্ডায় বসেন, আমাদের কথা বারবার বলেন। এক শুক্রবারে আমি রওনা হলাম ঢাকা থেকে। লোকেশন আমার চেনা, সমস্যা নাই। ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ধরে মাধবপুর বাজার থেকে পশ্চিম দিকে ৩-৪ কিলোমিটার পথ।
রাস্তাঘাটের বেশ উন্নতি হয়েছে। ১০ বছর আগে ঠিক এই অক্টোবর মাসেই আমরা ভরা বর্ষায় ঐ বাজার পর্যন্ত পথ ট্রলারে করে গিয়েছি। কাদামাখা পথে রিকশা চলেছে বটে, কিন্তু গাড়ি নয়। আমাদের গাড়ি রাখা থাকতো মাধবপুর থানার কম্পাউন্ডে পুলিশের হেফাজতে।
হরিপুর বাজারটিতে যখন পৌঁছালাম, তখন প্রায় শেষ বিকেল।
হাওড়ের পানি নেমে এসেছে অনেক। ৪-৫ ফুট তো হবেই। গিয়ে দেখি, লোকেশনে কতগুলো গাড়ি ছাড়া কেউ নেই। দু’টো বজরা নিয়ে সবাই গেছেন শুটিং এ। আজ টাইটেল সঙের একটা অংশের শুটিং হবে।
আমি যে ওই দলে গিয়ে যোগ দেবো, তার উপায় নাই। যে দু’একটা জেলে নৌকা পেলাম, অনেক টাকার প্রলোভনেও তাদের মন ভেজাতে পারলাম না।
সন্ধ্যার আগে আগে জমিদার বাড়ির ঘাটলায় বসে পশ্চিমের দিগন্তে ভাটা যাওয়া হাওড় থেকে জেগে ওঠা ক্ষেতের আইল এবং তার উপর দিয়ে হেঁটে চলা জেলেদের দেখা ছাড়া আমার কাজ ছিল না। শুটিং দেখতে এসে শুটিং না দেখলেও এখানে যে দেখার মতো অফুরান অনুষঙ্গ আছে, আমি তা থেকে বঞ্চিত কেন করবো নিজেকে?
বিকেলের সূর্য হেলেই পড়েছে। তার আবিরটুকু এক রক্তিম আভা মেলে ধরেছে প্রকৃতিতে।
আমি একটা জেলেনৌকায় উঠেই পড়ি এবং তাদের সঙ্গেই মাঝ হাওড় পর্যন্ত চলে যাই। আমার জেলে-মাঝিরা জানান, তাদের রাতের আয়োজন শুরু হলো মাত্র। মাঝরাতে মাছধরা শুরু করবেন। ভোররাত পর্যন্ত মাছ ধরে নিয়ে আসবেন ওই ঘাটে। মাছ বিক্রি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাই।
যিনি হাওড়ের ইজারা নিয়েছেন তিনিই বিক্রিবাটা করেন। তারা সবাই মাস শেষে বেতন পান।
আলাপের মাঝখানেই মাত্র দু’টো বেনসন সিগারেট খাওয়ানোর পর ওদের সঙ্গে আমার খাতির অনেক গুণ বেড়ে যায়। তারা রাজি হন, সারারাত তারা আমাকে তাদের নৌকায় রাখবেন, রাতে খাওয়াবেন নৌকায় [টিফিন খাবার আছে] এবং ভোর বেলা যেখানে আমি বলবো, সেখানেই পৌঁছে দেবেন। আমার হাতের স্টিল ক্যামেরা আর ওই যন্ত্র [ল্যাপটপ] নিয়ে তাদের একটু চিন্তা।
মাঝে মধ্যে ডাকাতিও হয় এখানে। তবে এখন তারা নিশ্চিত, পানি নেমে এসেছে। ডাকাতদের উপদ্রব অনেক কম এখন, সুতরাং চিন্তা নাই।
আমাদের নৌকা প্রায় সিকি মাইলের মতো পথ পাড়ি দেয়ার পর দেখি, শুটিং নৌকা ফিরে আসছে ঘাটে। এখন কী করি? ফোনে ফোনে যোগাযোগ হচ্ছে।
শুনতে পাচ্ছি, সন্ধ্যার পর এখানে আর কোনো কাজ নাই। মাধবপুর থেকে সামান্য দূরে ‘হাইওয়ে ইন’ এ সবাই চলে যাবেন, আমাকে সেখানেই চলে যেতে বলা হলো।
হাওড়ে রাত্রিবাসের প্রোগ্রাম বাতিল, আমি আমার মাঝি ভাইদেরকে নৌকার ইউটার্ন দিতে অনুরোধ করি। একটা বাজারের ঘাটে নৌকা ভেড়ে। দুই মাঝিসহ আমরা তিনজন মিলে বাজারের চা স্টলে গিয়ে চা-সিঙ্গাড়া-লুচি-পিঁয়াজু-মিষ্টি খাই এবং ওদের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে আমি বিদায় নিয়ে নিই।
জেলে-মাঝিরা কি কারণে জানি না, তারা নৌকায় না উঠে আমার ক্যামেরা-ল্যাপটপ বয়ে নিয়ে এলো গাড়ি পর্যন্ত। আমার ড্রাইভার সেখানে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
ইউনিটের ক্রুরা সবাই আমার পরিচিত। ওরা এখানেই কোনো এক বাড়িতে থাকে। আমার ড্রাইভারের থাকার ব্যবস্থা ওদের সঙ্গে করে আমি স্টিয়ারিং ধরি।
মিনিট বিশেকের মাথায় গিয়ে পৌঁছি ‘হাইওয়ে ইন’-এ।
ঢাকা-সিলেট পথে বাসযাত্রীরা এর নিচ ও দোতলার অর্ধেকটুকুর রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া সারেন। তার অপর পাশটিতে দু’পাশে ৬টি মাত্র গেস্টরুম। প্রতি রুমে দু’টো করে সিঙ্গেল বিছানা বসানোর পর খুব জায়গা ফাঁকা থাকে না, এমন ব্যবস্থার এই হোটেলটিই এখানকার সবচেয়ে সেরা হোটেল। তার দু’টো কামরা হুমায়ূন আহমেদ দম্পতি ও তার শিশুপুত্রদ্বয় ও তাদের সহকারীর জন্য।
বাদবাকি ৪টা কামরায় ৮ জনের থাকার বন্দোবস্ত।
শুটিং-এর ক্লান্তি ঝরানোর জন্য হুমায়ূন আহমেদ বসেছেন আড্ডায়। এ আড্ডায় আমার কাছে দু’জন মাত্র নতুন মুখ। তারিক আনাম খান আর আগুন। তারিক আনাম খান এর আগে হুমায়ূন আহমেদের কোনো ছবিতে অভিনয় করেননি।
নাটকে করেছেন বলেও মনে পড়ছে না। হুমায়ূন আহমেদ জলসুখা গ্রামের যে জামিদারের কাহিনী এ ফিল্মে লিখেছেন তার জন্য হয়তো আসাদুজ্জামান নূরকে তিনি চিন্তা করেছিলেন [আমার ধারণা, ভুলও হতে পারে]। রাজনীতি আর টেলিভিশন কোম্পানি চালানো, এ দু’টোর ব্যস্ততার জন্য হয়তো তাঁকে তার শেষ ছবিটিতে তিনি নিতে পারেননি। আড্ডার এক পর্যায়ে ক্ষেপে যান মাসুদ আকন্দ, অভিনেতা ও সঙ্গীতশিল্পী আগুনের ওপর। আগুন আজ প্রথম এসেছেন শুটিং-এ।
তিনি তার চিফ অ্যাসিসট্যান্টের কাছে একটা সিঙ্গেল রুমের জন্য হালকা আবদার জানিয়েছিলেন। ক্ষিপ্ত হলেন এ কারণে। অল্প কিছুক্ষণ পর সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেলো যখন খাবার ঘরে যাওয়া হলো। সিলেট থেকে আরজু ভাই সস্ত্রীক এসেছেন গাড়িভর্তি খাবার নিয়ে। খাবারের মধ্যে অন্যসব কিছু ছাড়াও আসে সিলেটের সাতকরা দিয়ে রান্না গরুর মাংস।
রাতে ঘুমাতে গিয়ে পরিচয় হলো আরেক বিলেত ফেরত অভিনেতার। তার নাম রানা। তিনি এই নাটকের একজন অভিনেতা আপাতত। ইতিপূর্বে স্যারের লেখা একটা নাটক তিনি পরিচালনা করেছেন এবং ভবিষ্যতে আরো দু’টো নাটক পরিচালনা করার কথা প্রায় ফাইনাল হয়ে আছে বলেই জানালেন। আরো বললেন, স্যারের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলে একেবারেই বিলেত থেকে চলে আসবেন।
তিনি স্যারকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি বানানোর কাজ অলরেডি শুরু করে দিয়েছেন। অনেক অনেক পরিকল্পনা স্যারকে নিয়ে। আমার মনে পড়ে, এই রানার পরিচয় দিতে গিয়ে কমল আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘ও হচ্ছে স্বাধীন খসরু-৩’। এরপর আমার আর কিছু জানতে বাকি থাকে না।
পরদিন সকাল বেলা আমি বেরিয়ে যাই হোটেল থেকে।
আমার গন্তব্য শুটিং স্পট। গিয়ে দেখি, একটা দৃশ্য শুট করার সব আয়োজন তৈরি। একটা চেয়ারের ওপর বসে আছেন জমিদারবেশী তারিক আনাম খান। এই গরমের মধ্যেও তার গায়ে শেরওয়ানির মতো একটা পোশাক পরা। মাথার ওপর ছাতা ধরে রাখা আছে।
একজন বাতাস করছে।
পাশে দুটো চেয়ারে স্যার আর শাওন বসা। স্যারের সঙ্গে স্ক্রিপ্ট। কয়েকজন বেদেনি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে চারজন আসল বেদেনি।
তাদের সংগ্রহ করা হয়েছে পাশের থানা থেকে। একজন মাত্র অভিনেত্রী, তার নাম জিনাত হোসেন যুথী। এক সময় লাক্সের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় তিনি পঞ্চম হয়েছিলেন। হুমায়ূন আহমেদর অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন। আমি তাকে আগে থেকেই চিনি।
চ্যানেল ওয়ানে একবার সকাল বেলার কোনো একটা অনুষ্ঠানে আমাকে তার সঙ্গে আধা ঘণ্টা আড্ডা দেবার জন্য ডাকা হয়েছিল। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান এখন। তিনিও বেদেনিদের মতো পোশাক আশাক পরেছেন। এখানে অন্য চারজন বেদেনির সাথে তিনিও দাঁড়িয়ে থাকেন। একই রকমের পোশাক।
অন্য মেয়েগুলো কিছুক্ষণ পরপরই ফিকফিক করে হাসছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তাদের নিয়ে মহাবিপদে আছেন ক্যামেরাম্যান মাফফুজুর রহমান। স্যার এলেন স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে। ক্যামেরা রোল করার আগে রিহার্সেল করলেন অন্তত তিনবার।
বেদেদের শট নেওয়ার আগে খুব ছোট একটা দৃশ্য একবারেই ওকে হয়ে গেলো।
তারিক আনাম একজনকে বলছেন - হাওড়ের পানি মনে হয় কমতে শুরু করেছে।
নায়েব গোছের একজনের জবাব - জ্বে। বেজায় টান দিছে। এ বছর অল্প দিনেই পানি নাইমা যাবে।
এ সময় বেদে বহরের দিকে চোখ পড়লো জমিদারের। তিনি বলছেন - ‘বেদের নৌকা আসছে নাকি?’
নায়েব - জ্বে
জমিদার - বেদে সর্দাররে ডাক দিয়া আনো।
নায়েব চলে গেল। জমিদার ঘাটে বসে আছেন। একজন এসে তাকে হুক্কা দিল, একজন বড় একটা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে শুরু করলো।
শুরু হলো সংলাপ
জমিদার - মিঠা দক্ষিণা বাতাস ছাড়ছে, তুমি আবার পাংখা নাড়ানাড়ি করছো কেন? অকারণে বিরক্ত করবে না।
এ সময় বেদে সর্দার এসে উপস্থিত হয়। তারা কিভাবে জমিদারের পা ধরে সালাম করবে, নিজে দেখিয়ে দেন হুমায়ূন আহমেদ।
এরপর আরো কিছু দৃশ্য ও সংলাপ।
কেন যেন মনে হলো, এ দৃশ্য নেওয়াটা তার খুব পছন্দ হয় নাই।
অরিজিনাল বেদেনিরা বারবার ক্যামেরার দিকে ফলস লুক দিচ্ছে। বিরক্ত ক্যামেরাম্যান, বিরক্ত পরিচালক।
আমি একটু দূরে গিয়ে একটা গাছের তলায় বসে থাকি। ওখানে মামুন আছে। মামুন এ ছবির নায়ক বা নায়িকা দু’টোই।
কাহিনীটা আমার জানা। এরকম একটা কিশোর চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ভদ্রঘরের ছেলে পাওয়া কঠিন। কে কার ছেলেকে দেবে, ভাটি এলাকার এক জমিদারের যৌনপীড়নের শিকার হওয়া কিশোরের চরিত্রে অভিনয় করতে?
মামুনকে দেখি, বাড়ির কোণায় শুটিং জোনের বাইরে একটা হাফপ্যান্ট পরে বসে আছে। তার কাছে গিয়ে কথা বলি। জানি যে, টোকাই থিয়েটারে সে নাটক করতো।
একটা সিনেমায় অভিনয় করবে এমন কথা শুনে তারা একই বয়সের চার বন্ধু একদিন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে দেখা করে। হুমায়ূন আহমেদকে সে চেনে না, নামও শোনেনি। ছবিতে অভিনয় করতে পারবে এটা শুনেই সে খুশি। তারপর স্যারের সাথে কথা হয় চারজনেরই এবং এক সময় নির্বাচন করা হয় মামুনকে।
মামুনকে বলি - তোমার চরিত্রটা নিয়ে কি তুমি খুশী?
মামুন জবাব দেয় না।
নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। আরো কিছু কথা বলতে গিয়েছিলাম, সুযোগ হলো না। মামুন চলে গেল।
আমরা সাবাই মিলে লোকেশনে দুপুরের খাওয়া খেলাম। শুটিং-এর খাবার অনেক মজার।
অনেকগুলো আইটেম থাকে। ৩/৪ রকমের ভাজি ভর্তা, ছোটমাছ, মুরগির মাংস, গরুর মাংস।
বিকেল বেলা ইউনিট যখন হোটেলে ফিরবে, আমি ফেরত আসি ঢাকায়।
ইউনিট ২/৩ দিন পরই সব কাজ শেষ করে চলে আসে ঢাকায়। দিন পনেরো পরে আবার একবেলার কাজ করতে ছোট একটা ইউনিট আসবে।
পানি যখন একেবারেই নেমে যাবে, তখন।
ইউনিট ঢাকা ফেরত আসে না, সরাসরি স্যার চলে যান নুহাশপল্লীতে। সেখানে এই সিনেমার শুটিং করার জন্য এফডিসির স্টুডিওর মতো একটা বড় গুদামঘর বানানো হয়েছে। তার ভেতরে জলসুখা গ্রামের জমিদারবাড়ির অন্দরমহল এবং কয়েকটি ঘর। দু’দিন গিয়েছিলাম শুটিং-এর সময়।
লক্ষ্য করলাম যে, নাটকগুলো বানানোর সময় তিনি নিজে যেভাবে ফাঁকি দেন, তার সব আলসেমির খেসারত উসুল করে ছাড়েন এই ফিল্মের শুটিং-এ। এখানে একটি শটও তার অবর্তমানে নেবার সুযোগ নাই।
এই সিনেমার শুটিং-এ আমাদের বাড়তি কোনো আড্ডা থাকে না। শুটিং ফ্লোরে স্যারের পাশে বসে মনিটর দেখা আর কিছুক্ষণ পর পর রং চা খাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। তার ইউনিটের কেউ কেউ এমনও বলেছেন যে, এ সিনেমার [ঘেটুপুত্র কমলা] মতো এতো সিনসিয়ার তিনি এর আগের সিনেমাগুলোতে ছিলেন না।
যেহেতু এ ছবিটার কাহিনী দেড়শ’ বছরের পুরনো জমিদারদের নিয়ে, সুতরাং প্রপস নির্বাচনে নাকি তিনি অনেক সময় নিয়েছেন। নিজেও যখন যেখানে যা কিছু পেয়েছেন যা এ সিনেমার জন্য দরকারি হবে, তা সংগ্রহ করে রেখেছেন।
দখিন হাওয়ায় আড্ডায় ছবির প্রসেসিং, এডিটিং, ডাবিং, মিউজিক নিয়ে প্রায়ই কথা শুনি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিকিৎসার জন্য তাকে যেতে হয় আমেরিকায়। ততোক্ষণে ছবির মূলকাজ শেষ।
অল্প কিছু মিউজিক বসানো আর গ্রেডিং এর কাজ বাকি থাকে। কিন্তু এক সময় তা-ও শেষ হয়ে যায়।
২০১২ সালের ১১ মে তারিখে হুমায়ূন আহমেদ দেশে আসেন ৩ সপ্তাহের চিকিৎসা বিরতিতে। এ সময় তার প্রযোজক, ইমপ্রেস টেলিফিল্ম থেকে জানানো হলো যে, ছবিটি সম্পূর্ণভাবে প্রদর্শনের জন্য তৈরি। কিন্তু যেহেতু ছবিটি তারা এখনই মুক্তি দেবে না, তাই এ মুহূর্তে ছবিটির প্রিমিয়ার করতে চায় না।
তবে হুমায়ূন আহমেদ এবং তার ইউনিট সদস্য ও একান্ত বন্ধুবান্ধব নিয়ে যাতে এ ছবিটা একসঙ্গে হলে বসে দেখা যায়, তার একটা আয়োজন হলো ২০১২ সালের ২৮ মে, হুমায়ূন আহমেদ আমেরিকা ফেরত যাবার ২ দিন আগে।
বসুন্ধরা সিটির সিনেপ্লেক্সের একটা হল ভাড়া করা হয় সেদিন। প্রচার মাধ্যমকে জানানো না হলেও অনেক সংবাদকর্মীর ভিড় হয়। সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনের প্রায় সবাই এবং কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ছবিটা তিনি দেখেন।
এর আগে হুমায়ূন আহমেদ ঠিক এই হলে বসেই দেখেছিলেন, গৌতম ঘোষের ছবি ‘মনের মানুষ’-এর প্রেস শো’টি।
ছবি ভালো লাগেনি কিংবা ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে এর যে কোনো একটার কারণে তিনি ইন্টারভ্যালের সময় শাওনকে নিয়ে চলে যান। যাবার পথে সাগর ভাইয়ের সঙ্গে গেটে দেখা। সাগর ভাই খুব অপ্রস্তুত, কেন হুমায়ূন আহমেদ চলে যাচ্ছেন? শাওন বলে, ছোট বাচ্চাটাকে বাসায় রেখে এসেছে, ওর শরীর খারাপ, এ জন্যে চলে যাবেন।
হুমায়ূন আহমেদ হলে গিয়ে ছবি দেখেন না, ঘরে বসে দেখেন। তিনি দেখেন, বেশিরভাগই বিদেশি ছবি।
আমাকে বেশ ক’বার তার প্রিয় বেশ ক’টি ছবির ডিভিডি দিয়েছেন দেখার জন্য। দু’টো ছবির নাম মনে আছে, ‘দি আদার বলেইন গার্ল’, আর টলস্টয়ের উপর ‘দি লাস্ট স্টেশন’।
তার দখিন হাওয়ার বাসাতে একসঙ্গে দেখেছি তার পছন্দের ছবি ‘দি জাপানিজ ওয়াইফ’। আমি কখনো কখনো আমার প্রিয় কোনো ছবিও তাকে দেখতে দিয়েছি। একবার পোলিশ ট্রিলজি ‘থ্রি কালার্স’ এর ‘রেড’, ‘হোয়াইট’ আর ‘ব্লু’ তিনটা ছবিই দিলাম দেখার জন্য।
কাজ হলো না। একদিন বললেন, তোমার ছবিগুলো দেখতে চেষ্টা করলাম - এতো বোরিং যে দেখা গেল না।
মনের মানুষের পুরোটা দেখে অবশ্য আমরা যোগ দেই দখিন হাওয়ার আড্ডায়। এমনিতে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সম-সাময়িক কোনো চলচ্চিত্রের প্রশংসা করেন না। তার নিজের ছবি সম্পর্কে কেউ খারাপ কিছু বললে সেটাও খুব সহজে নেন না।
মুখ কালো করে থাকেন। তবে এ ছবির (মনের মানুষ) ফটোগ্রাফির খুব প্রশংসা করেন। মনের মানুষ প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের দেশের হাওড়ের পানি দেখলাম কি স্বচ্ছ, কি নীল! অথচ আমাদের ক্যামেরাম্যানরা এই হাওড়ের ছবি তুললে এ রং আনতে পারে না কেন?
( শাকুর মজিদ : স্থপতি, লেখক, নাট্যকার, পরিচালক )
কঠিন অসুখ শরীরের মধ্যে নিয়েও ডাক্তারের বারণ অনেকটা অমান্য করে ২-৩ শ’ লোকের সামনে তিনি হাজির হয়েছিলেন। এটাই যে এতো দর্শকের সামনে তার শেষ উপস্থিতি তা কি জানতেন?
সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিতে গিয়ে রসিকতা করলেন অনেক। শাওন যে একদিন ভোরবেলা ছোট বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে শুটিং স্পটে হাজির হয়ে তাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল, তার বর্ণনাও দেন।
তবে এ ছবির মালিক ইমপ্রেস টেলিফিল্মের কাছে তিনি অনুরোধও করেন যে, ছবিটি যাতে টেলিভিশনে দেখানো না হয়। আর বড়রা কেউ যাতে শিশুদের নিয়ে ছবি দেখতে না আসেন। কারণ, জমিদারের ঘর থেকে কিশোরের [কমলা] চিৎকার শোনার পর শিশুরা যদি বাবা মাকে প্রশ্ন করে বসে যে, বাবা ছেলেটা চিৎকার করলো কেন? এর জবাব কি দেবেন?
ছবি দেখা শেষে দখিন হাওয়ার বাড়িতে খুব ফুরফুরে মেজাজের আড্ডা হচ্ছে আমাদের। সে আড্ডায় অনেকটাই জুড়ে ছিল ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র প্রশংসা। তার সব বন্ধুবান্ধব স্বজনরা প্রশংসায় প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন তাকে।
আমার কাছে এসে আস্তে করে বলেন, ‘ছবিটা কেমন লাগলো?’
আমি বললাম, স্যার, আমার বিবেচনায় এটা আপনার বানানো সবচেয়ে ভালো ছবি। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, ছবিটা খুব বেশি বদনাম কুড়াবে দেশে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে একটা বড় স্বীকৃতি পাবে। ওয়েস্টার্নরা এসব সাবজেক্ট খায় ভালো। শেষের অশ শুনে, স্বভাবসুলভ উল্লাসের ভঙ্গিতে বললেন, চিয়ার্স।
কথাটি বলে ফেলার পর মনে মনে অনুশোচনা হয়। মনে মনে বলি, আমার মন্তব্যের প্রথম অংশটি যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
(লেখাটি শাকুর মজিদ ভাই'র অনুমতিক্রমে সামহোয়্যার ইন ব্লগে প্রকাশ করা হয়েছে । )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।