বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...
কাউবয় হ্যাট, ঠোঁটে সিগার, টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি আসছেন। কোমরের হোলস্টার থেকে অদ্ভূত ক্ষিপ্রতায় পিস্তল বের করে তারচেয়েও অদ্ভূত স্টাইলে ঘায়েল করছেন শত্রুপক্ষকে। হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির খুবই পরিচিত দৃশ্য। আর যারা ওয়েস্টার্ন ছবির ভক্ত তারা জানেন ওয়েস্টার্ন চলচ্চিত্রের কিংবদন্তীর নাম ক্লিন্ট ইস্টউড। ক্যারিয়ারের উত্থান ওয়েস্টার্ন ছবিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দিয়ে হলেও প্রযোজনা ও পরিচালনাসহ চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ কিছু শাখায় তাঁর অবদান অপিরসীম।
দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে তিনি দর্শকদের মনোরঞ্জন করে আসছেন। এখনও দোর্দন্ড প্রতাপে বিচরণ করছেন সিনেজগতে। এত লম্বা সময় ধরে চলচ্চিত্র জগতে আর কোন তারকা এভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন কিনা তা আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের দাবি রাখে।
ক্লিন্ট ইস্টউড ১৯৩০ সালের ৩১ মে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ক্লিন্টন ইস্টউড সিনিয়র, মা রুথ উড।
পিতার কাজের সূত্র ধরেই ইস্টউডের শৈশব আর কৈশোর কেটেছে ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।
হাইস্কুলের ছাত্র খাকা অবস্থায় নাটকের ক্লাসের শিক্ষকরা তার অভিনয় প্রতিভা টের পেয়েছিলেন। বহুবার স্কুলের নাটকগুলোতে তাঁকে অভিনয় করতে বলেছিলেন শিক্ষকরা। কিন্তু তখন ইস্টউডের অভিনয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলোনা। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিলো জ্যাজ সঙ্গীতের প্রতি।
তাই শিক্ষকদের ডাকে তিনি কখনই সাড়া দেননি। হাইস্কুল শেষে একজন জ্যাজ শিল্পী হবেন এমনটাই ছিলো স্বপ্ন তাঁর! মাত্র বিশ বছর বয়সে তিনি কোরিয়ান যুদ্ধে যোগদান করেন মার্কিন সেনাবাহিনীর লাইফগার্ড ও সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন একবার প্রায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন। ছুটিতে বাড়ি ফেরার পথে জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে সাগর পড়ে যায় তাঁকে বহনকারী বম্বার উড়োজাহাজটি। সাগরের বরফ শীতল পানিতে প্রায় তিন মাইল সাঁতার কেটে তীরে ফেরেন ইস্টউড আর উড়োজাহাজের চালক।
সেদিনের সেই দুর্ঘটনা ঘটে গেলে চলচ্চিত্র বিশ্বকে এমন একজন কিংবদন্তীকে আর পেতে হতোনা! এই ঘটনা ইস্টউডের জীবনে পরবর্তীতে দারুন প্রভাব ফেলে।
ইস্টউডের অভিনয় জীবনের শুরুটা খুব একটা সুখকর নয়। ক্যারিয়ারে শুরুতে তাঁকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে । প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন সিনেমায় ছোট-খাটো চরিত্রে অভিনয় করেন। এসব ছবিতে অভিনয়ের জন্য সিনেমায় তাঁর নামও আসতো না।
তখন দুর্মুখেরা বলতো ‘ক্লিন্ট তোমার কন্ঠ ও কথা বলার ভঙ্গি অভিনয়ের সঙ্গে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তোমাকে দিয়ে হবেনা’… আর এসব তিরষ্কারকারীদের মুখে ছাই দিয়েই কিনা ইস্টউডের কথা বলার স্টাইল এক সময় পরিণত হয় হলিউড আইকনে! ইস্টউড পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন মূলত টিভি সিরিজ ‘রহাইড’ দিয়ে। শুরুর দিকে ‘রহাইড’ দর্শকরা দারুনভাবে গ্রহণ করলেও আস্তে আস্তে সিরিজটির জনপ্রিয়তা কমতে থাকে । তবে ততদিনে রহাইডে কাউবয় চরিত্রে অভিনয় করে অনেকেরই সুনজরে পড়েন তিনি। টিভি সিরিজটিতে অভিনয় করার সময়ই পরিচালনাতেও হাতেখড়ি হয় ইস্টউডের।
তিনি টিভি সিরিজটির বেশ কিছু ট্রেইলার বানিয়ে দেন। ১৯৬৫ সালে ‘রহাইড’ জনপ্রিয়তা হারিয়ে বন্ধ হয়ে গেলেও ইস্টউড ততদিনে পরিপক্ক হয়ে উঠেছেন। ততদিনে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুতিটা ভালোভাবেই সেরে ফেলেছেন। ঠিক সে সময়টাতেই ইতালীয় পরিচালক সার্জিও লিওনি তাঁকে নিয়ে নির্মাণ করেন ‘এ ফিস্টফুল অফ ডলার্স’ ছবিটি। আর ঠিক এখান থেকেই হলিউড সিনেমার ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ের সূচণা হয়।
ছবিটিতে ইস্টউডের চরিত্রটি ছিলো নাম না জানা এক কাউবয়ের। ইতালিতে ছবিটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই ইস্টউড জয় করে নেন দর্শক ও সমালোচকের মন। ‘এ ফিস্টফুল অফ ডলারস’-এর সাফল্যের পর ইস্টউড ও সার্জিও লিওনি আবার জুটি বেঁধে বানালেন ‘ফর এ ফিউ ডলার্স মোর’ এবং ‘দি গুড, দি ব্যাড অ্যান্ড দি আগলি’… জন্ম নেয় বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতহাসের অন্যতম ক্লাসিক ডলারস ট্রিলজির। এই ট্রিলজির সিনেমাগুলো ইউরোপে খুবই ব্যবসাসফল হয়। সেই সঙ্গে সমালোচকদের সুদৃষ্টিতে পড়েন ইস্টউড।
কিন্তু ডলারস ট্রিলজি ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পাওয়ার পর ইস্টউড রীতিমত তারকা বনে যান। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘দি গুড, দি ব্যাড অ্যান্ড দি আগলি’ অন্যতম ক্লাসিকের মর্যাদা পায় আর ইস্টউডের অভিনয় সিনেমাপাড়ায় তাঁর আসন পাকাপোক্ত করে।
এরপর ক্লিন্ট ইস্টউডকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক ওয়েস্টার্ন সিনেমা দিয়ে তিনি বাজিমাত করতে লাগলেন। বহু বাঘা বাঘা শিল্পীরা ওয়েস্টার্ন সিনেমায় অভিনয় করলেও আজ পর্যন্ত কেউই ইস্টউডকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি।
ওয়েস্টার্ন সিনেমার অবিসংবাদিত সম্রাট ক্লিন্ট উস্টউড। তিনি নিজেই এই ধাঁচের সিনেমার স্বকীয় একটি ভাষা তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাঁর কথা বলার স্টাইল, তাকানোর ভঙ্গি, পৌরষদীপ্ত উপস্থিতি সবই ছিলো এক্কেবারে আলাদা, অনন্য। তাই পরবর্তীতে একজন সফল নির্মাতা, একজন সফল প্রযোজক এবং একজন সফল বহুমাত্রিক অভিনয় শিল্পী হওয়া স্বত্ত্বেও ইস্টউডের ওয়েস্টার্ন সিনেমার ইমেজ সবার উপরে। মানুষ সবার আগে তাঁকে চিনে ওয়েস্টার্ন ছবির ‘ম্যান উইথ নো নেম’ হিসেবে।
ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক রাম গোপাল ভর্মার কাছেও ক্লিন্ট ইস্টউডের ওয়েস্টার্ন সিনেমার তারকার তকমটাই বড়।
১৯৭১ সালে ‘প্লে মিস্টি ফর মি’ ছবিরে মধ্য দিয়ে পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে পরিচালনায় আসেন তিনি। একই সালে আরেকটি বিথ্যাত চরিত্রে ‘ডার্টি হ্যারি’ তিনি অভিনয় করেন। প্রথমিদেক ডন সিজেল এই সিরিজের ছবিগুলো পরিচালনা করলেও পরবর্তীতে ইস্টউড নিজেই পরিচালনা করতে শুরু করেন। ডার্টি হ্যারি সিরিজের মোট পাঁচটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন।
এরপর থেকে আজ অবধি ইস্টউড অসাধারন কিছু ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি দুর্দান্ত কিছু ছবি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণে তিনি সবসময়ই প্রাধান্য দিয়েছেন শক্তিশালী চিত্রনাট্য আর ব্যতিক্রমধর্মী সব গল্পের। তাই ইস্টউডের প্রতিটি ছবিতেই থাকে নতুনত্বের স্বাদ, নতুন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জনের আর অনুভব করার উত্তেজনা। ইস্টউডের ছবির আরেকটি দারুন বিষয় হচ্ছে তিনি কোন দৃশ্যই এক থেকে দুইবারের বেশি ধারণ করেননা। তাই তাঁর ছবির কাজ নির্ধারিত সময় এবং বাজেটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় সবসময়।
শুটিংয়ের সময় অ্যাকশন আর কাট বলেননা। শুধু এক ‘ওকে’ দিয়েই কাজ চালিয়ে দেন। সিনেমার অভিনয় শিল্পীদের তিনি খুব একটা নির্দেশনা না দিয়ে স্বাভাবিক অভিব্যক্তিকেই প্রাধান্য দেন বেশি। নিজেই বলেছেন এমন সব অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন যাদের নিজেকে প্রমাণ করার কিছু নেই।
গত পাঁচ দশকে তিনি উপহার দিয়েছেন দি আউটল জোসি ওয়ালেস, কেলি’স হিরোজ, এ পারফেক্ট ওয়ার্ল্ড, হোয়্যার ঈগল ডেয়ারস, এস্কেপ ফ্রম আলকাট্রাজ, ইন দি লাইন অফ ফায়ার, আন ফরগিভেন, মিস্টিক রিভার, মিলিয়ন ডলার বেবি, লেটারস ফ্রম আইয়োজিমা, ফ্ল্যাগস অফ আওয়ার ফাদারস, ইনভিক্টাস’-এর মতো অসাধারন সব ছবি।
১৯৯২ সালে ‘আনফরগিভেন’ ছবিটির জন্য অস্কারে একসাথে তিনটি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে শ্রেষ্ঠ পরিচালক আর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এ দু’টি বিভাগে পুরষ্কার জিতে নেন তিনি। একইভাবে ২০০৫ সালে ‘মিলিয়ন ডলার বেবি’ ছবিটির জন্য অস্কারে একসাথে তিনটি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে শ্রেষ্ঠ পরিচালক আর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র এ দু’টি বিভাগে পুরষ্কার জিতে নেন ইস্টউড। ২০০০ সালে ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মাননা হিসেবে পান ক্যারিয়ার গোল্ডেন লায়ন পুরষ্কার। আর ২০০৩ সালে ‘মিস্টিক রিভার’ ছবির জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘গোল্ডেন কোচ’ পুরষ্কার জিতে নেন। এছাড়া একাধিকবার জিতেছেন ‘ডিরেক্টরস গিল্ড অফ আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, পিপলস চয়েজ অ্যাওয়ার্ড সহ আরো নানা পুরষ্কার।
অবাক করা বিষয় দু দু’বার শ্রেষ্ঠ নির্মাতার অস্কার ঝুলিতে পুরলেও এবং বেশ কয়েকবার মনোনীত হওয়া স্বত্ত্বেও অস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারটি এখন পর্যন্ত অধরাই রয়ে গেছে ইস্টউডের। ইস্টউডের আরেকটি অজানা দিক হলো তিনি নিজের গুটি কয়েক ছবিতে মিউজিক কম্পোজিশনের কাজও করেছেন। ছেলেবেলায় জ্যাজ সঙ্গীতের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগের কারনেই মিস্টিক রিভার, মিলিয়ন ডলার বেবির মতো বেশ কয়েকটি ছবিতে গানের সুর সৃষ্টির কাজ করেছেন নিজেই।
বিশ্বচলচ্চিত্রের এই দিকপাল রাজনীতিতেও আগ্রহ রাখেন। ভালোবাসেন গলফ খেলতে।
সিনেমাতে চুরুট ফুঁকতে দেখা গেলেও বাস্তব জীবনে অধূমপায়ী। প্রতিভাবান এবং দাপুটে এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো নিজেকে পর্দায় দেখতে কেমন লাগে তাঁর। তিনি জবাব দিলেন ‘পর্দায় প্রতিবার নিজেকে দেখে আমি কেঁদে ফেলি’। ক্লিন্ট ইস্টউড এমন একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের নাম বছরের পর বছর যিনি মানুষকে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, সত্য উন্মোচন আর ন্যায় প্রতিষ্ঠায় দর্শকরাও ছবি দেখতে দেখতে অজান্তেই তাঁর ছবির একটা অংশ বনে গেছেন। দর্শকদের এমনই মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন তিনি।
৮৩ বছর বয়েসেও চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ আর অনুরাগের কমতি নেই। ঘোষণা দিয়েছেন যদি একশ বছরের বেশি সময় বাঁচেন তখনও তিনি ছবি নির্মাণ অব্যাহত রাখবেন। এই বয়সেও এতটাই সজীব এবং কাজ পাগল তিনি! সেই লক্ষ্যে নতুন ছবির কাজ শুরু করে দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী তাঁর ভক্তকূল এখন ক্লিন্ট ইস্টউডের নতুন ম্যাজিক দেখায় অপেক্ষায়।
___________________________________________________
দেশের প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক অনলাইন ম্যাগাজিন 'মুখ ও মুখোশ' এ প্রকাশিত
ফেসবুকে 'মুখ ও মুখোশ' এর সঙ্গেই থাকুন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।