টং করে কী যেন একটা শব্দ হলো। পায়ে লেগে ছিটকে গেল সামনে। দেবব্রত প্রথমে ভাবল, হয়তো তার মাথা থেকে কোনো স্ক্রু খুলে পড়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বুঝল, তাহলে তো এত জোরে শব্দ হওয়ার কথা নয়। ইন্দিরা রোডটা এমনিতেই সুনসান, অন্ধকার থাকে সন্ধ্যার পর থেকেই।
এখন রাত ১২টায় আরও নির্জন, আরও নিঝুম। রাতকানা রোগে পাওয়া ল্যাম্পপোস্ট একটাও জ্বলছে না।
খানিকটা হেঁটে সামনে এগোতেই চাঁদের আলোয় কী যেন একটাকে চকচক করতে দেখল। বুঝল, এটাই সেই বস্তু, যেটাকে না-দেখে খানিকক্ষণ আগে লাথি কষেছে সে। নেব কি নেব না করতে করতে বস্তুটা হাতে তুলে নিল দেবব্রত।
কাছে এনে ভালো করে দেখেও ঠিক বুঝল না। অনেকটা চায়ের পেয়ালার মতো দেখতে। তবে যে নল দিয়ে চা বেরোনোর কথা, সেদিক দিয়ে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। বোমাটোমা নাকি! জিনিসটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলতে যাবে, অমনি কোত্থেকে তার সামনে হাজির হলো এক ভদ্রলোক!
ভদ্রলোক বলতে যতটা বয়স বোঝায়, লোকটার বয়স আসলে ততটা মনে হচ্ছে না। পরনে কেতাদুরস্ত স্যুট-টাই।
এই কুত্তা-পাগল গরমে এভাবে স্যুট-টাই পরে থাকতে পারে কেবল ইনস্যুরেন্সের লোকেরা, নয়তো এমএলএম এজেন্ট। এই দুই প্রজাতিকেই সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে দেবব্রত। ‘হ্যালো স্যার, ভালো আছেন,’ লোকটা দাঁত বের করে আন্তরিক হাসি হাসল। এমন বিগলিত ‘স্যার’ শুনে দেবব্রতের আর কোনো সন্দেহই থাকল না, এই লোকটা এমএলএম-এরই কেউ হবে।
নাকি ছিনতাইকারী!
ঢাকা শহরের ছিনতাইকারীরা ইদানীং নানা রকম বেশ ধরতে শুরু করেছে।
সেদিন তাঁর এক বন্ধুকে রাস্তায় একা পেয়ে পিছু তাড়া করছিল কিছু সন্দেহভাজন ছেলেছোকরা। সামনে কয়েকজন পুলিশকে দেখতে পেয়ে সেই বন্ধু দৌড়ে গিয়ে তাদের আশ্রয় নেয়। ওমা, কোথায় কী! পরে আবিষ্কৃত হলো, সেই পুলিশগুলো আসলে পুলিশ নয়, পুলিশের ছদ্মবেশে থাকা ছিনতাইকারী। আর যে ছেলেগুলোকে সেই বন্ধু ছিনতাইকারী ভেবেছিল, তারাই শেষ পর্যন্ত সাহসী যুবক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে উদ্ধার করেছিল বন্ধুটিকে; না হলে কী যে হতো!
সাবধানী দেবব্রত তাই লোকটির কান অবধি ঠোঁট ঠেলানো হাসির জবাবে ক্লিষ্ট-কৃপণ হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেল। কিন্তু লাভ হলো না।
লোকটা আবার ভুস করে হাজির, ‘স্যার, কোনো কমান্ড দেবেন না?’
এই দ্যাখো, কী সব কমান্ডটমান্ড বলছে! জঙ্গি-টঙ্গী-জয়দেবপুর টাইপ নয়তো! দেবব্রত দরদর করে ঘামতে শুরু করল। আমতা-আমতা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ক-ক-কমান্ড মানে!’ লোকটা টাইয়ের গিঁটে একটা নাড়া দিয়ে বলল, ‘উইশ স্যার, উইশ, মানে ইচ্ছা। ইয়োর উইশ ইজ মাই কমান্ড। ’
: মাম্ম-মানে কী এসবের?
: স্যার মনে হয় বুঝতে পারেননি। আপনার হাতে যে প্রদীপটা ধরা আছে, আমি স্যার সেই প্রদীপের দৈত্য।
ভিরমি খাওয়া কথাটা এত দিন বইয়ে পড়েছে। আজ দেবব্রত বুঝল জিনিসটা কী। লোকটাকে আগাগোড়া পরখ করল। পায়ের জুতাটা পর্যন্ত চকচক করছে। দেখে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকের মতোই মনে হয়।
সুদর্শন। ফরসা। দেবব্রত এবার বুঝতে পারল, লোকটার মাথাতেই বোধ হয় সমস্যা আছে। কিছু একটা বলতে যাবে, অমনি তাকে থামিয়ে দিয়ে লোকটাই বলে উঠল, ‘বুঝতে পারছি স্যার, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। না, আমার মাথায় ছিট নেই।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও নই। আমি আসলেই দৈত্য। ’
দেবব্রতের বুকটা ধড়াস করে উঠল। কীভাবে বুঝল ব্যাটা মনের কথা! এবারও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উত্তর মিলল, ‘স্যার, আমি আপনার মনের সব কথাই শুনতে পাচ্ছি। এ-ও বুঝতে পারছি, প্রদীপের দৈত্য বলতে যেমনটা লোকে ভাবে পা-বিহীন, টিকিধারী, ইয়া বড় ভ্রু, শূন্যে ভাসমান আর হুহু হিহি হাহা হুকুম করুন মালিক—এসব স্যার ওল্ড ফ্যাশনড।
সেকেলে। আধুুনিক যুগের সঙ্গে দৈত্যরাও যদি তাল না মিলিয়ে চলে, হেহ হেহ হেহ। ’
লোকটা একটা চুটকি বাজাল। ওমনি তার হাতে চলে এল একটা ফুলের তোড়া। দেবব্রতের দিকে বাগিয়ে ধরে বলল, ‘নেন, স্যার।
এটা আপনি না চাওয়ার আগেই দিলাম। এমনিই দিলাম। এখন বলেন আপনার ইচ্ছা কী। তিনটা ইচ্ছা পূরণ করব আমি। যা চাবেন, তা-ই পাবেন।
’
ইচ্ছা আর কী! এমনিতেই ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে দেবব্রতের গলা শুকিয়ে কাঠ। আগে গলাটা একটু ভিজিয়ে নেওয়া দরকার। কোনোমতে ফিসফিসে গলায় বলল, ‘পাহ-পানি হবে একটু?’ লোকটা আরেকটা তুড়ি মেরে বলল, ‘অবশ্যই, স্যার। ’ নিমেষে সদ্যই ফ্রিজ থেকে বের করা এক বোতল ঠান্ডা পানি হাজির।
গলায় পানি ঢালতে ঢালতে দেবব্রত ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগল। দৈত্য যে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কী চাওয়া যায় এর কাছে? নাহ্, মাথাটা খুলছে না। এই সময় যদি একটা সিগারেটে টান দেওয়া যেত!
: স্যার মনে হয় সিগারেটের কথা ভাবছেন।
: হুম্, হবে নাকি আপনার কাছে? আছে?
আবারও চুটকি মেরে সিগারেট হাজির।
সেই সিগারেট ধরাতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। পকেট হাতড়ে দেবব্রত দেখে লাইটার নেই। এই জীবনে যে কতটা ম্যাচ হারাল! তবে সমস্যা কী। সামনে তো ওই ব্যাটা আছেই। ‘ইয়ে, একটা লাইটার বা ম্যাচ হবে?’ শূন্য থেকে একটা ম্যাচ নিয়ে এসে লোকটাই ধরিয়ে দিল সিগারেট।
বেশ কিছুক্ষণ ভাবল দেবব্রত। মাত্র তিনটাই ইচ্ছা যেহেতু, হিসেবি হতে হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিল, একটা বড় ফ্ল্যাট চাইবে, আরেকটা গাড়ি। শম্পার খুব শখ। আর ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট লাখ পঞ্চাশেক টাকা।
ব্যস্। এরপর ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে দিয়ে...
‘তাহলে বলছ, তুমিই প্রদীপের দৈত্য?’ দেবব্রত একেবারে হুট করে তুমিতে নেমে এল। এখন আর আপনি করে বলার মানেই হয় না। লোকটা আবার বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘জি স্যার। আমার জন্য দোয়া করবেন।
তাহলে আজ আসি। ’
দৈত্য দেখে যতটা চমকেছিল, তার দ্বিগুণ চমকাল দেবব্রত, ‘আসি মানে? আমার তিনটা ইচ্ছা?’ লোকটাকে এবার একটু অসন্তুষ্টই দেখাল, ‘স্যার, পানি চেয়েছেন, দিয়েছি। সিগারেট চাইলেন, সেইটাও দিলাম, এরপর চাইলেন ম্যাচ। এক-দুই-তিন, খেল খতম। আসি স্যার, গুডবাই।
’
ভুস করে ধোঁয়া হয়ে গেল লোকটা। সুড়ুত করে ঢুকে পড়ল প্রদীপে!।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।