আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইচ্ছাপূরণের কাছাকাছি

ইচ্ছার শেষ নেই কিন্তু ইচ্ছাপূরণ সীমিত। মাঝে মাঝে মনে হয়, হঠাৎ করে একদিন কোন আলৌকিক শক্তিবলে আমি আমার সব ইচ্ছা পূরনের সুযোগ পেয়ে যায় তাহলে জীবনটা কেমন হবে? খুব সুখকর হবে বলে মনে হয়না। সীমার মাঝেই তো অসীম সুখ। অসীমের মাঝে তাই সীমিত সুখ হবারই কথা। আমার অনেক ইচ্ছার মধ্যে একটা বিচিত্র ইচ্ছা আছে- “বিভিন্ন মেয়াদী মৃত্যুবরণ”।

ঠিক স্থায়ী মৃত্যুও না। এই মৃত্যুটা হবে কয়েকমাস, কয়েকদিন অথবা কয়েক ঘণ্টার জন্য। যখন কারো উপর প্রচণ্ড রাগ হয় তখন এই “বিভিন্ন মেয়াদী মৃত্যুবরণ” ইচ্ছাটা জাগে। একদিন মা’র সাথে ভীষণ ঝগড়া হলো। মা’র মুখ ভার, আমারো তাই।

দুপুরবেলা। আমি না খেয়ে রাগ করে শুয়ে আছি। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। রাগের একটা ধর্ম হচ্ছে- যে এই রাগের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী তার দ্বারাই সে মৃত্যুবরণ করতে চাই। আমার রাগও তাই প্রশমিত হওয়ার অপেক্ষা করছে এই আশায়- মা এসে বলবে, “সীমা খেতে আয়।

আর রাগ করেনা”। বস্তুতপক্ষে আমার রাগ আগে থেকেই খানিকটা প্রশমিত হয়ে আছে। শুধুমাত্র চক্ষুলজ্জায় পেটের ছুঁচোটার আবদার পূরণ করতে পারছিলামনা সেই মুহুর্তে। মা এলোনা, কিছু বললোও না। কষ্টে আমার বুকের ভেতর থেকে কান্না বেরিয়ে এলো যেন।

মনে হচ্ছিল যদি বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্য মরে যেতে পারতাম? একটা সময় তো ঠিকই আমার ডাক পড়তো। এসে দেখতো আমি মরে পড়ে আছি। হাত-পা বরফ শীতল। একটা উচিত শিক্ষা হতোনা তখন? সাজ্জাদের জন্য আমার মৃত্যুটা হবে কয়েকদিনের জন্য। আমার খুব কাছের বন্ধু।

প্রেমের বন্ধু। প্রেম প্রেম ভাব প্রেমের অভাব। কোনদিন যদি সে একটা শক্ত কথা বলে, মাথা চক্কর দেওয়ার অবস্থা হয় আমার। একদিনের ঘটনা বলি। ভার্সিটিতে গিয়েছি কাজে।

ও বললো বাসায় ফিরলেই যাতে মিসকল দিই। ফেসবুকে আমার সাথে কি নাকি কথা আছে। বাসায় এসে প্রচণ্ড টায়ার্ড। আগের রাতেও ভালো ঘুম হয়নি। প্রেমের বন্ধু বলে কথা!! “ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু” মনে মনে এই বলে, মিসকল মারলাম।

অনলাইনে হয়ে বললো-“সীমা একটু ওয়েট করো, আমি গোসল করে আসতেছি। থাইকো প্লিজ”। ক্লান্ত আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। ও আসলে একটু কথা বলেই আমার ঘুম-ইচ্ছার কথা ওকে জানাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। ছেলে মানুষের স্নানকার্য সাধনে বেশি সময় লাগার কথা না।

বেশি সময় নেয়নি। মাত্র আধা ঘণ্টা। টুকটাক কথা হচ্ছিল। এর মধ্যে ওকে আমার তন্দ্রা ইচ্ছা জানানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করলাম। বেচাড়া এতো শখ করে কথা বলতে এসেছে!! কিন্তু টেলিপ্যাথি ক্ষমতাবলে বোধহয় আমার ইচ্ছাটা ওকে পেয়ে বসলো।

ধুম করে বলে বসলো-“যাইগা ঘুমাবো”। শুনে এতো কষ্ট লাগছিলো। মনে হচ্ছিল কয়েকদিনের জন্য যদি নির্বিঘ্ন ঘুম দিতে পারতাম? আমাকে খুঁজে খুঁজে মরতে তুমি, ঘুম কি তখন এতো সহজে তোমার চোখে ধরা দিত ? কয়েকমাসের মৃত্যুটা হবে আমার যাবতীয় স্কুল-কলেজ বন্ধু-বান্ধবদের জন্য। মিস করি ওদের ভীষণ। কেন যে করি, নিজেও জানিনা।

মাসের পর মাস যায়, একটা ফোন দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনা। আমি যদি ফোন করি, আপনি সম্বোধণ শুনতে হয়। “কি আপনি তো খোঁজ-খবর নেননা”। কার কথা কে বলে? রাগে আমার দাঁত কিড়মিড় করে তখন। বেঁচে থাকলেই ওদের ফোন দিতে ইচ্ছা করবেই।

তাই এই কয়েকমাসব্যাপী মৃত্যুইচ্ছা। নাহ্, কয়েকমাস মনে হয় যথেষ্ট না। বছরের পর বছর গেলেই হয়তো ওদের খেয়াল হবে অনেকদিন কাওকে ব্যঙ্গ করে “আপণি” ডাকা হয়না। বেশ কয়েকদিন ধরেই জ্বর জ্বর। ভার্সিটি থেকে ফিরলেই সমস্ত ক্লান্তি যেন আমাকে পেয়ে বসে।

ডাক্তার দেখাবো দেখাবো করে দেখানো হয়না। জ্বর আসে আর যায়। যেদিন ভাবছি ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত সেদিন শরীর ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা শরীর নিয়ে কি আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায়? এমন করতে করতে ১৫ দিনের মতো কেটে গেলো। এতোদিনে জ্বরের “আসি-যায়” স্বভাবের পরিবর্তন হলো।

স্থায়ীভাবে চেপে বসলো আমার উপর। ডাক্তার দেখানো হলো। যথারীতি অনেকরকম টেস্ট পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হলো। টেস্টের ফলাফল টাইফয়েড। মনে মনে খুশিই হলাম।

আমার খাতির বাড়বে- মা’র কাছে, সাজ্জাদের কাছে, যাবতীয় বন্ধু-বান্ধবের কাছে এবং আরো অনেকেরই কাছে। ডাক্তার মহাশয় প্রেশক্রিপশনে ওষুধের নাম লিখে দিলেন এবং পূর্ণাঙ্গ বিশ্রামের আদেশ দিলেন। সকাল আদেশ মাথা পেতে নিয়ে আমি শয্যা বিশ্রামে দিনকাল পার করতে লাগলাম। ওষুধে অসুখ কমার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিলনা। মুখের রুচির যাচ্ছেতাই অবস্থা।

শয্যাবিশ্রাম আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিলো। একদিন শরীরটায় কি জানি হলো। জ্বর হু হু করে বেড়ে যেতে লাগলো। চোখ-মুখ রক্ত লাল। আমি কি মরে যাচ্ছি? মা কেমন পাগলের মতো শুরু করলেন।

যেন মা আমার মৃত্যুটা সামনেই দেখতে পাচ্ছেন। কেন জানি মা’র জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনে পড়ে গেলো, মাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমি কয়েকঘণ্টার মৃত্যু চেয়েছিলাম। চোখের সামনেই যেন মা’য়ের উচিত শিক্ষা পাওয়ার দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছিলাম। সহ্য হচ্ছিলনা একটুও।

মনে মনে প্রার্থণা- “সৃষ্টিকর্তা এই যাত্রায় আমায় বাঁচিয়ে দাও”। শেষপর্যন্ত বেঁচেই আছি। রোগমুক্তির জন্য হাসপাতালের দ্বারস্ত হতে হয়েছিল সেবার। যমের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলনা। কিন্তু বেচাড়াকে বিফল মনোরথ নিয়ে ফিরতে হয়েছে।

মৃত্যু এবং জীবন উভয়েরই মর্ম কিছুটা হলেও বুঝতে পারি এখন। আমার অসীম ইচ্ছাগুলো থেকে “বিভিন্ন মেয়াদী মৃত্যুবরণ” এর এন্ট্রি তাই বাদ পড়েছে। সৃষ্টিকর্তা অসীম দয়াময়। বিচিত্র ইচ্ছাটি যদি কোনদিন পূরন করে দেন সেইজন্যই তো এই সাবধানতা...... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.