আমাদের দেশ আমাদের সম্পদ আমাদের চারপাশে এখন কেবলই অসহিষ্ণুতা, উত্তেজনা, সহিংসতা। সহিষ্ণুতা ও অহিংসা প্রতিষ্ঠায় মহাত্মা গান্ধীর সত্য ও অহিংসার মতবাদ বর্তমান বিশ্বে এখন অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন অহিংসার বাণী--দেশে দেশে : জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবখানে। সেই অহিংস আন্দোলনের প্রবর্তক ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা মহাত্মা গান্ধীর ১৪৪তম জন্মদিন আজ। ভারতজুড়ে এ দিনটি গান্ধী জয়ন্তী এবং বিশ্বে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
২০০৭ সালের ১৫ জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস বা International Day of Non-Violence হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বিশ্ব থেকে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, সহিষ্ণুতা ও রক্তপাত বন্ধে বিশ্ববাসীর চেতনাকে জাগিয়ে তোলাই আন্তর্জাতিক অহিংস দিবসের মূল বাণী। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এ উপলক্ষে বিশেষ শান্তির বাণী দিয়েছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সম্প্রীতি মিছিল, শান্তি সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আজ আন্তর্জাতিক শান্তি ও অহিংস দিবস পালিত হচ্ছে। মহাত্মা গান্ধী হিউম্যান সেন্টারের উদ্যোগে সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের হবে শান্তি শোভাযাত্রা ও সম্প্রীতি মিছিল।
গান্ধী সবসময়ই অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর এ নীতি তৎকালীন বিশ্বনেতাদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। বিশ্বে এখন যে যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা চলছে তা মূলত সহিংস ও কর্তৃত্বমূলক মনোভাবের জন্য হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে সবাইকে শান্তি প্রতিষ্ঠার শপথ নিতে হবে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে অহিংস নীতিতে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।
মহাত্মা গান্ধী একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। অহিংসা মানুষকে পশুর স্তর থেকে সভ্যতা আর শালীনতার স্তরে এনেছে। কেবল অহিংস গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই মানবসমাজকে সাম্য, স্থিতি ও শোষণহীন পরিবেশ উপহার দিতে পারে।
মহাত্মা গান্ধী বিশ্ব মানবতার কাছে এক অবিস্মরণীয় নাম এবং প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘মহাত্মা’ আর ভারতবাসী ‘বাপু’ (বাবা) নামে ডাকতেন। তিনি ছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। এ আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অহিংস মতবাদ বা দর্শনের ওপর এবং এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি, সারাবিশ্বে মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার পাওয়ার আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা।
আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলন’র অন্যতম নেতা মার্টিন লুথার কিং, জেসম লওস্, দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেলসন মেন্ডেলা, ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকারী খান আবদুল গাফফার খান, তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামা, মায়ানমারের আপসহীন নেত্রী অং সান সু চি ও ব্রিটিশ গায়ক জন লেনন তার অহিংসবাদকে অনুসরণ করেছেন তাঁদের কর্মে ও জীবনে। তাঁর অহিংসা, সত্যাগ্রহ এবং স্বরাজ দর্শনের জন্য গোটা বিশ্বের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছেন এই মহান পুরুষ।
ভারতের জাতির জনক মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীর জন্ম ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর, ভারতের গুজরাট রাজ্যের পরবনদার শহরে। ১৮৮৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবা মায়ের পছন্দে কস্তুরবা মাখাঞ্জীকে (কাস্তুবাই নামেও পরিচিত ছিলেন) বিয়ে করেন। তাঁদের চার পুত্র সন্তান : হরিলাল গান্ধী (জন্ম ১৮৮৮); মনিলাল গান্ধী (জন্ম ১৮৯২); রামদাস গান্ধী (জন্ম ১৮৯৭) এবং দেবদাস গান্ধী (জন্ম ১৯০০)। মহাত্মা গান্ধী তাঁর ছোটবেলায় পরবনদার ও রাজকোটের ছাত্রজীবনে মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। কোনো রকমে গুজরাটের ভবনগরের সামালদাস কলেজ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তিনি কলেজেও সুখী ছিলেন না, কারণ তাঁর পরিবারের ইচ্ছা ছিল তিনি ব্যারিস্টার হন।
এমনি এক সমাজ-বাস্তবতা ও সংসার জীবনে ১৮৮৮ সালে গান্ধী আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য (ব্যারিস্টারি পড়তে) লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। বার-অ্যাট-ল’ পাস করার পর তিনি ১৮৯১ সালে ভারতে ফিরে যান। ১৮৯৩ সালে তিনি একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শকের চাকরি নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে চলে যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি ভারতীয় শ্রমিক ও নাগরিকদের ওপর ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ শাসকদের নিপীড়ন তাঁকে আন্দোলিত করে।
মানবতাবাদী গান্ধী সে কারণে সেখানেই তাঁর অহিংস আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। তাদের সামাজিক ও মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ শুরু করেন। এ আন্দোলনের মুখে ১৯১৪ সালে তৎকালীন আফ্রিকা সরকার তাঁর অনেক দাবিই মেনে নিয়েছিল।
১৯১৪ সালেই তিনি ভারতে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন শুরু করেন। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নিউক্লিয়াসে পরিণত হন।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কেতাদুরস্ত গান্ধী যখন তাঁর ওকালত পাঠ শেষ করে ভারত ফেরেন তখনো ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব ছিল না যে, ক্ষীণকায় এই মানুষটিই অসহযোগিতার এমন এক আন্দোলন গড়ে তুলবেনÑ যা তাদের ভারত ছাড়া করবে। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন গান্ধী। উপমহাদেশের দুই হাজার বছরের ইতিহাসে তাঁর এই আন্দোলনের তুলনা পাওয়া যায় না। ১৯২১ সালে তাঁকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের (আইএনসি) নেতৃত্বে আনা হয়। নেতৃত্বের এক অনুচ্চারিত দক্ষতায় তিনি যখন ভারতীয় কংগ্রেসের শীর্ষপদে, তখন টনক নড়লো ব্রিটিশ সরকারের।
ততদিনে গান্ধিজী, মহাত্মার আসনেও আসীন। দারিদ্র নিরসন, নারী অধিকার, জাতিগত বিভেদ মোচন আর অচ্ছুত নামের শব্দটিকে ভারতের সমাজ থেকে দূর করে দিতে তাঁর প্রচারও তখন অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। আর স্বরাজ ও স্বদেশির যে ধারণা নিয়ে তিনি আন্দোলন গড়ে তুললেন, তার মর্মার্থ ইংরেজ বুঝতে বুঝতে ভারত স্বাধীনতার পথে এগিয়ে গেল অনেক ধাপ। আন্দোলনের নাম অসহযোগ, যেখানে আরও কাবু হয়ে পড়ল ইংরেজ সরকার। অসহযোগ আন্দোলনের পরে তাঁর নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের ‘লবণ সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন হয়।
লবণের ওপর করারোপের বিরোধিতায় আড়াইশ মাইল টানা হেঁটেছেন তিনি। দাবি আদায়ে না খেয়ে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। বিলেতি পণ্য বর্জন করতে পরেছেন ধুতি চটি। আর কথা বলে গেছেন মানবতার পক্ষে একটি স্বাধীন ভারতের পক্ষে। ১৯৪২-এ ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন।
এসব গণ-আন্দোলন ব্রিটিশ রাজত্বের ভিত নাড়িয়ে দেয়। ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভারত ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
মহাত্মা গান্ধীর জীবনের শেষ বড় কর্মযজ্ঞ নোয়াখালী শান্তি মিশন। নোয়াখালীর দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় তিনি ১৯৪৬ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৭-এর মার্চ পর্যন্ত চার মাসের বেশি একনাগাড়ে অবস্থান করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনে ভূমিকা রাখেন।
দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসে নামের এক ব্যক্তি অহিংস আন্দোলনের এ প্রাণপুরুষকে গুলি করে হত্যা করে।
গান্ধীর ইচ্ছানুযায়ী, তার দেহভস্ম পৃথিবীর প্রধান কয়েকটি নদী, যেমন--গঙ্গা, যমুনা, নীলনদ, ভোলগা, টেমস ইত্যাদিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।
গান্ধীর অহিংসা ও সত্যাগ্রহ অন্যায়, অবিচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিদ্রোহ। রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় যে কোনো সংঘাত অহিংস উপায়ে সমাধানের শিক্ষা দিয়ে গেছেন তিনি। তাঁর উদ্ভাবিত সত্যাগ্রহ নীতি যুদ্ধের বিকল্প হিসেবে সর্বত্র সমাদৃত। শান্তিপূর্ণ বিশ্বের জন্য গান্ধীর আদর্শ আজও অনুসরণীয়।
মোদ্দাকথা, গান্ধী তাঁর কর্মের মধ্য দিয়েই বিশ্ববাসীর কাছে বেঁচে আছেন। মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে পেরেছিলেন গান্ধী। হিংসা দূর করতে গান্ধীর নীতি অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। একদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটছে, অন্যদিকে সহিংসতা বাড়ছে। এ কারণেই গান্ধী অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সহিংসতার বিরোধিতা করেছিলেন।
মানবতা বিবর্জিত জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। নীতি ছাড়া রাজনীতি কিছুই দিতে পারে না। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গান্ধীর অহিংস নীতিই সবচেয়ে যুগোপযোগী। তাঁর এ নীতি বাস্তবায়ন করতে পারলেই বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।